আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিরুপমা

কখনো সুরের ছন্দ মেলেনা,তো কখনো তাল তবু গেয়ে যেতে হয় মিলিয়ে সাথে সময়ের সুর-তাল!

:নিরু,এই নিরু...চা এর ট্রে টা নিয়ে এদিকে আয় তো।
খানিকটা নড়েচড়ে নিরু আবারো চেয়ারে বসে থাকে। এই মুহুর্তে উঠে কোথাও যাবার ইচ্ছে নেই,এমনকি পাশের ঘরেও না। হাতের বইটার দিকে রাখা মনোযোগটা আরেকটু মজবুত করার চেষ্টা করে,কিন্ত পাশের ঘর থেকে আবারো মা ডাক দিলেন,
:নিরু,তাড়াতাড়ি আয়,তোর খালা চলে যাবে।
বাধ্য হয়ে বইটা রেখে উঠে দাঁড়ায় নিরু,বের হওয়ার আগে আয়নার সামনে এসে একবার দাঁড়ায়!ভেজা চুল গুলো কেমন অগোছালো হয়ে আছে,কিন্তু তার মাঝেও চেহারায় এক ধরনের স্নিগ্ধ আভা ফুঁটে আছে ওতেই কি চলবে না?নাহ,চলবে না!চিরুনী দিয়ে মাথা আঁচড়ালও,তারপর রান্না ঘরে চেয়ে ট্রে তে চায়ের কাপ রাখল।

আজ বেবি খালা চা বানিয়েছে,নিরু আন্দাজ করতে পারে,এই চা মুখে দেয়ার অযোগ্য!কিন্তু তবুও ট্রে সাজায়।
-সেকি!নিরু দেখি আগের চেয়েও কালো হয়ে গেছে!কিরে?গত মাসে যে চন্দন গুড়োর প্যাকেট দিয়ে গেলাম,নিয়ম করে মুখে মাখিস না?
মতি খালার কথা শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় নিরুর!এই মহিলার সমস্যা কি?নিজের চেহারা কি আয়নায় দেখে না কখনো? সারাক্ষন খালি মানুষের চেহারা নিয়ে তার চিন্তা!নিরু কিছু বলার আগেই মা বলে উঠলেন,
-মাখে তো,অবশ্য রোজ পারে না,ক্লাস থাকে যে সারাদিন!
-না না,রোজ দিবি,না হলে চেহারা হাল দেখেছিস?এমন হলে চলবে?এই যে দেখ,যত বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছি,সবার খালি একটাই কথা,'একটু ফর্সা'!বুঝলি,রুপের দাম যুগে যুগে,বিদ্যার দাম কে দেখে!
নিরু কোন কথা না বলে চলে আসে নিজের ঘরে। এসব কথা শুনতে শুনতে এখন আর গায়ে লাগে না। শুধু মাঝে মাঝে মায়ের উপর খুব রাগ লাগে!

-নিরু শুনেছিস?মুক্তার বিয়ে হয়েছে নাকি গত সপ্তাহে!
-কোন মুক্তা?
-আরে ঐ যে তোর আফজাল চাচার মেয়ে।
-ও না মাত্র এসএসসি দিলো?
-হুম,খুব ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে,দেখলি?সবাই কিভাবে বিয়ে শাদি করে সংসারি হচ্ছে,আর তুই?
নিরু রাগে-অপমানে মুখ লাল করে নিজের রুমে চলে আসে! 'সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে!কিন্তু সবাই কতো সুখে আছে শুনি?' মাঝে মাঝে নিরুর খুব রাগ লাগে নিজের প্রতি!সে এমন কেন?চারপাশে সবাই খালি মত্ত'বিয়ে' নিয়ে আর সে?এসব নিয়ে ভাবতেই ইচ্ছে করে না!আর করবেই বা কেন?এই পর্যন্ত যা যা দেখেছে তার পর আর কি করেই বা ভাবা যায়!কিন্তু সবাই কি আর তা বুঝে?আছে শুধু গরুর হাটের গরু বেচা-কেনার মতো,রুপের বিনিময়ে অন্যের কাছে গোছাবার চিন্তায়!

:নিরুপমা...বাহ,খুব সুন্দর নাম!কে রেখেছে নামটা?
নিরু নিরস কন্ঠে জবাব দেয়,
-আমার ছোট মামা।


-উনি বুঝি সাহিত্যিক মানুষ ছিলেন?
-হুম।
-আপনিও কি সাহিত্যচর্চা করেন
-করি টুকটাক।
-নিরুপমা,আপনার কি আমার সাথে কথা বলতে বিরক্ত লাগছে?
নিরু কিছু না বলে না। কি বলবে সে?একটু আগে সে শুনে এসেছে,ছেলের মা,মতি খালাকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলছে,
-এই মেয়ে তো মোটেও ফর্সা না,শ্যামলাও বলা যায় না!তুমি তো বলেছিলে উজ্জ্বল শ্যামলা,কই?দেখো আগেই তোমাকে বলেছি,আমার ছেলের জন্য ফর্সা মেয়ে চাই,আর তুমি কি দেখাতে নিয়ে আসলে?
-আরে বিয়ের পর আরো ফর্সা হয়ে যাবে,আরে ভাবি আপনিও তো বিয়ের আগে এমন ছিলেন দেখতে,এখন আপনাকে দেখে কি কেউ বলবে?আপনার বড় মেয়ে শিমু কি দেখতে একদম ফর্সা?তো কি হয়েছে,এই মেয়েও দেখবেন আপনার ছেলের জন্য ভালো হবে।
মহিলা মহা বিরক্ত হয়ে যায়!
-আমার মেয়ের হিসেব আলাদা! মেয়ের বিয়ে আর ছেলের বিয়ে কি এক?কিসের সাথে কি মিলাও তুমি?শোন,এই মেয়ে আমার পছন্দ হয়নি,আর এরকম মেয়ে দেখাবে না,ফর্সা হলে বলবে,না হলে না,শুধু শুধু সময় নষ্ট!
নিরু মাকে ইশারায় বুঝাতে চাইছিলো,যে তার ছেলের সাথে দেখা করার ইচ্ছে নেই কোন,কিন্তু মা এর তো ছেলে এমন পছন্দ হয়েছে যে কমনসেন্স হারিয়ে বসে আছেন!কে কি বুঝাচ্ছে বুঝতেই পারছেন না! তাই বাধ্য হয়ে নিরু এখন শাকিলের সামনে বসে আছে,আর শাকিলও আলাপ জমানোর অযথা চেষ্টা করেই যাচ্ছে,যা নিরুর রাগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে! করবে না বিয়ে,অযথাই আসলো,আবার এখন খাতির করার ঢং দেখাচ্ছে!
-নিরুপমা,আপনার কি আমার সম্পর্কে কিছু জানার আছে?থাকলে প্রশ্ন করুন।


নিরু খুব দ্রুত মাথা নাড়ল। ভেতরে ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসছে!নাহ,আর ভদ্রতার নাটক চালানো সম্ভব না।
-আচ্ছা,শুনুন আমি বরং যাই,শুধু শুধু এখানে বসে থাকতে আমার অনেক বিরক্ত লাগছে!
শাকিল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো মনে হয়!সাথে সাথে কিছু বলতে পারল না,তা দেখে নিরু ই বলল,
-না না,ঘাবড়াবেন না,আমি বুঝেছি,আপনাদের কারোর ই আমাকে পছন্দ হয়নি,বাট ভদ্রতার খাতিরে আপনারা এখনো আমাদের বাসায় আছেন!আমি আবার অতো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না,তাই সোজা ভাবেই বললাম। আমি এরকম পরিস্থিতির সাথে পরিচিত!
শাকিল চুপ করে থাকলো,কিছু বলল না। নিরু কিছুটা অবাক হলো!
-আপনি কি আমার কথায় রাগ করলেন?
শাকিল খানিকটা হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
-নাহ,নিরুপমা,আপনি যদি বিরক্ত না হোন আপনাকে একটা ছোট্ট গল্প শোনাই?
নিরু কিছুটা অবাক হয়েই মাথা নেড়ে সায় দিলো।


-আমার দেখা পৃথিবীর অসম্ভব ভালো মেয়েদের মধ্যে একজন হচ্ছে আমার বোন শিমু। বেশ গুণি,মায়াবতী একটা মেয়ে,কিন্তু জানেন?আমার এই বোনটাকে শুধু মাত্র কারো বউ হবার জন্য গায়ের রঙ কালো বলে কি পরিমাণ অপমান হতে হয়েছে!আমি দেখেছি,আমার বোনকে নিরবে চোখের পানি ফেলতে,ওর ভালো একটা বিয়ের চিন্তায় আবার আব্বা-আম্মাকে হতাশ আর পেরেশান হতে!আল্লাহর রহমতে শিমুর বিয়ে হয়েছে,ভালোই আছে আর তাই এখন আমার মা ও ঐ সময়ের দুঃখ গুলো বেমালুম ভুলে গেছেন হয়তো!এটাই হয়,মানুষের সুসময় আসলে দুঃসময়ের কথা ভুলে যায়। কিন্তু ওই দুঃসময় গুলোই অনেক কিছু নতুন করে শিখিয়ে দিয়ে যায়,যেমন আমি শিখেছি। ''
নিরুর একবার মনে হলো,'লোকটা শুধুই বক বক করছে,এসব কথা এখন তার সামনে বলছে,একটু পর তার মা সামনে আসলে সব ভুলে যাবে!' আবার মনে হলো,'লোকটার ভালো একটা মন আছে,না হলে মায়ের মতো সেও পারতো সব ভুলে যেতে!' নিরুকে চুপ থাকতে দেখে শাকিল আবার বলতে শুরু করলো,
-নিরুপমা,আমি আজকেই প্রথম মেয়ে দেখতে আসলাম,এর আগে আম্মাই গিয়েছেন,আপনার সিভি টা দেখে আমার পছন্দ হয়েছিলো,তারপর যখন আপনার পরিবার সম্পর্কে শুনলাম,তখন আমি আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,আমি...
-শুনুন
কথা শেষ না করেই শাকিল থেমে যায়। তাকে চুপ করিয়ে নিরু বলল,
-আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি,বাট আপনি বরং কথা গুলো আপনার পরিবার কে আগে বুঝান,যদি সবাই বুঝতে পারে আমার কোন আপত্তি নেই,আমি তো গত দু'বছর ধরে এই সামনে আসা-যাওয়া করতে করতে ক্লান্ত!বাট বাস্তবতা ক্লান্তি বা আবেগ বুঝে না! যাইহোক,আমি এখন আসি,ভালো থাকবেন।

'
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিরু দ্রুত নিজের রুমে চলে আসল। শাড়ি পাল্টে বারান্দায় যেয়ে বসল,ততোক্ষনে শাকিল সাহেব আর তার মা চলে গেছেন। কোন সিদ্ধান্ত তারা জানিয়ে জাননি,পরে জানাবেন বলেছেন।
নিরুর কেন যেনো খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে!আবার খুব কাঁদতেও ইচ্ছে করছে!কাউকে বুঝাতে পারছে না বুকের ভেতর তার কেমন করছে!একটা সময় ব্যালকনির গ্রিলটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে,যেনো ভেতরের কান্নার বেগটা নিজেকে ভেঙ্গে না দেয়।

ওয়ার্কিং ডে বলে আজ বাণিজ্য মেলায় ভীড় অনেক কম,নিরু স্টল ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো।

একটা সময় আইসক্রিম কিনে নিয়ে নামাজ রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো,যোহরের সময় হয়ে আসছে,কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে,নামাজ পড়ে আবারো বের হবে ভাবলো। তাঁতের স্টলটা অতিক্রম করার সময় এক দম্পতির দিকে চোখ আটকে গেলো!নিরু যদিও মানুষের চেহারা খুব একটা মনে রাখতে পারে না,বিশেষ করে ছেলে মানুষের চেহারা আরো না,কিন্তু এই দম্পতির মধ্যে ভদ্রলোকের মুখটা খুব পরিচিত মনে হলো! একটা সময় নিরুর ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠলো!
সেদিন শাকিল সাহেব সেই যে গেলেন,আর কখনোই তার খবর পাওয়া যায়নি!নিরুর মা খুব আশা করেছিলেন,কিন্তু বেচারির আশা বরাবরের মতো সেবারও ভেঙ্গে ছিলো। নিরুর খুব একটা খারাপ বোধ হয়নি,শুধু ক'দিন অকারণেই কেমন কান্না পেতো,এক ধরনের ক্ষোভ কাজ করতো বুকের ভেতর!
প্রায় দু'বছর পর আজ দেখলো ভদ্রলোক কে,বেশ সুন্দরী একটা বউ পেয়েছেন,খুব মানিয়েছে দু'জনকে একসাথে। সম্ভবত নতুন সংসারের জন্য কেনাকাটা করছেন। নিরুর মনে হলো তার মন খারাপ করা উচিত,কিন্তু তেমন কিছু মনে হচ্ছে না!বরং ভেতর কেমন যেনো স্বস্তি বোধ কাজ করছে,
যাক,অবশেষে ভদ্রলোক তার পরিবারের মনের মতো একটা বউ পেয়েছে,হয়তো সে নিজেও এমনটাই চেয়েছে,মন্দ কি? সবাইকেই যে 'কালো মেয়ে'বিয়ে করার মতো 'মহান' কাজের অংশীদার হতে হবে এমন তো কথা নেই!তার জন্য হয়তো আল্লাহ এটাই ঠিক করে রেখেছিলেন।


মুখে মৃদু হাসি নিয়ে নিরু আবার হাঁটা শুরু করে।

রাত গভীর হয়,ঠান্ডা কফির মগটা হাত থেকে রেখে গায়ের শালটা আরো ভালো ভাবে জড়ায়। তারপর আবারো কলম চালায়,
''কতো সময় চলে যায়,আমরা ভুলে যাই,আর কতো সময় ভুলেও ভুলতে পারি না!মাঝে মাঝে ইচ্ছে করি,কোন শিল্পীর আঁকা ছবি হয়ে বেঁচে থাকতে!তাহলে হয়তো জীবন্ত অনুভূতি গুলোকে কাগজে মুড়ে ছুঁড়ে ফেলা যেতো!
নিরুপমা...যার কোন উপমা হয় না। নামটার মতোই জীবনটা!নিরুপমাদের অনুভূতি গুলো অদ্ভুদ হয়!মরেও না আবার সতেজ ও থাকে না! মাঝে মাঝে সেগুলো জীবন্ত হয় তখন,পুরনো ডায়েরির পাতা গুলো খুলে চোখের পানিতে লেখা গুলোকে ঝাপসা করে দেয় শুধু! অস্পষ্ট করে দেয় সব জমানো আবেগ গুলো,অনুভূতি গুলো!''
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।