আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ সঙ্গিনী

পৌষ মাসের ভোর। দূরে কুয়াশার চাদর ফুড়ে কেবল ভোরের প্রথম সূর্যরশ্মি এসে পড়ছে ঝোপঝাড়ে,গাছের পাতায়। গাছগুলো যেখানে ঘন হয়ে জন্মেছে সেখানে এখনো অন্ধকারের ছায়া রয়ে গিয়েছে। হায়দার আলী জানেন একটু পড়ে পুকুরধারের ছায়াছায়া অন্ধকার শেষকোনটিও আলোকিত হয়ে উঠবে মিষ্টি রোদের আলোয়। অনেকদিনের অভ্যাস ভোরে ঘুম থেকে ওঠার তাই ভোর হলেই আর চোখের পাতা এক করে রাখতে পারেন না তিনি।

এই শীতের সকালেও তার জানালা খোলা। বিছানায় আধশোয়া হয়ে তিনি জানালা দিয়ে বাইরের প্রান্তরে তাকিয়ে তাকিয়ে এভাবেই ভোর হওয়া দেখেন প্রতিদিন। বয়স হয়েছে,শরীরে সেই আগের জোর নেই তাই পৌষের এই জাঁকালো শীত তাকে প্রায় কাবু করে ফেলে। তবুও তার ভাললাগে এভাবে ভোর হওয়া দেখতে। আলেয়া অবশ্য আপত্তি তুলেছিল কিন্ত তিনি স্পষ্টভাষায় নিজের ইচ্ছা জানিয়ে দিয়েছেন তাই সে মেনে নিয়েছে।

প্রতিদিন হায়দার আলীর ঘুম ভাংলে আলেয়া নিজেই সব জানালা খুলে দিয়ে যায়।


হায়দার আলী অবাক চোখে দেখেন রোদ উঠলেই কেমন যাদুর মত কুয়াশার চাদর মিলিয়ে গিয়ে চারিদিক ঝকঝকে হয়ে যায়। তিনি মনে মনে ভাবেন চিরদিন এই গ্রামেই তিনি বাস করেছেন তবুও এই অপূর্ব দৃশ্য দেখা হয়নি আগে এমন মন দিয়ে। আর দেখবেনই বা কি করে?চিরকালই তো তিনি ভীষন ব্যস্ত মানুষ,এমন অবসর ছেলেবেলার পর আর কখনো পাননি তিনি। এই শীতের সকালেই চাদর মুড়ি দিয়ে ঝুড়িকোদাল হাতে দুটো লোককে মাঠের দিকে হেঁটে যেতে দেখা গেল।

নিশ্চয় রইস মোল্লার দুই ছেলে। আহা! সোনার টুকরা দুই ছেলে পেয়েছে রইস। বাপের জমিতে জান দিয়ে খাটে। ওদের মাঝে নিজের যুবক কালের চিত্র যেন দেখতে পান তিনি। তিনি যানেন ওরা অনেক উন্নতি করবে যেমনটা করেছেন তিনি নিজে।

এই শীতের সকালে নরম বিছানার ওম,বউয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনের ওম ছেড়ে হিম ঠান্ডায় মাঠে কাজ করতে যাওয়া কোনো সহজ কাজ নয়। বুকে বল লাগে,নিয়তের জোর লাগে তবেই না এমন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করা যায়। আর এমন পরিশ্রম করলেই না ঘোরে ভাগ্যের চাকা।


হায়দার আলীর নিজেরই বা কি ছিল?পৈত্রিক ভিটা আর কয়েক বিঘা জমি রেখে সেই যে বাপ তার ঘাড়ে সংসার রেখে মরল,তারপর থেকে তো সমস্ত দায়ভার তিনিই নিয়ে আসছেন। বাড়িতে অবিবাহিত দুই বোন,দুইটি ছোট ভাই আর অসহায় মা,এতগুলো মুখের খাবার যোগানোর কাজ তো তিনি নিজেই করেছেন দুহাত দিয়ে।

শুধু কি খাবার?আরো কত কি লাগে একটা সংসারে কয়বিঘা দোফসলী জমি দিয়ে কি আর সারা বছরের খরচ মেটে?অভাবের যাতনায় অতিষ্ট হয়ে যেদিন তিনি ব্যবসা করবে বলে ঠিক করলেন তখন তাকে কতজনই তো কত কথা বলল। ধারের কিছু টাকা সম্বল করে বাড়ির মাত্র দুমাসের খোরাকি ধান রেখে বাকি ধান নিয়ে তিনি যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলেন তখন তার ভাইরা তাকে কত নিষেধ করল,বোনেরা কাঁদল আর তার মা তো তার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিল। তবুও কি সে থেমে গিয়েছে?নিজের নীতিতে অটল থেকে সামনে চলার পথ করে নিয়েছে। পশুর মত খেটেছে। গ্রাম থেকে কমদামে ধান কিনে নিজের খরচে চাল করে শহরের বাজারে পৌঁছে দেয়া,এ কি কম খাটুনির কাজ?তখন তো তার ব্যবসা কেবল শুরু।

দুজন মাত্র মজুরের সাথে নিজে রাত দিন খেটে ধান থেকে চাল করতে হত। অনেকসময় তিনি মজুরদের সাথে নুন মরিচ দিয়ে দুটো ভাত খেয়ে দোকানেই রাত কাটাতেন। প্রথমে তো গ্রামের সবাই ধরে নিল এ হচ্ছে বোকা গোঁয়ার যুবকের পাগলামী ,সর্বশান্ত হওয়ার আগে এই পাগলামী ঘুঁচবে না কিন্ত চার পাঁচ মাসের মধ্যেই যখন তিনি লাভের মুখ দেখতে লাগলেন তখন সকলে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার ব্যাবসা বেশ ফুলে ফেঁপে উঠল। তিনি ব্যবসার টাকা দিয়েই সে বাপের ভিটাতে এতবড় পাকা দালান তুলেছেন,জমি কিনেছে্ন।

ভাইদের ভবিষ্যত গড়ে দিয়েছে,বোনদের ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। তার নিয়তের জোর না থাকলে কি তিনি এতকিছু পারতেন?তবে হ্যাঁ তার আর একটা জিনিস ছিল বটে আর তা হচ্ছে সততা। কোনোদিন তিনি গ্রামের কোন কৃষকের কাছে অন্যায্য মূল্যে ধান কেনেননি,তাইতো সবাই নিজের জমির অতিরিক্ত ধান তার কাছেই নিয়ে আসত। আহা!কি কর্মব্যস্ত দিনই না ছিল তখন!সেসময়ের কথা ভাবতে হায়দার আলীর এখনো বড় ভাল লাগে।


বাইরের উঠোনে মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে।

একটু পরেই আলেয়া উঠোনের রোদে তার জন্য চেয়ার পেতে দেবে। সকালের এই সময়টা হায়দার আলীর সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে। শীতের সকালের রোদে এমন মিষ্টি একটা ওম থাকে যার সাথে তুলনা করার মত জিনিস কমই আছে পৃথিবীতে। ছোটকালে সে ঘুমালে তার ঘুমন্ত শরীরে মা যখন আলতো করে হাত বুলিয়ে দিত তখন যে আরাম লাগত রোদটা যেন অনেকটা সেরকম। আজ উঠোনে বসে হায়দার আলী আলেয়ার দিয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক দিয়ে আরামে চোখ বন্ধ করে ফেলে আর ভাবে এই রদের সাথে আর একটা জিনিসের তুলনা দেয়া যায়।

নিজের নবজাতক শিশু সন্তানকে কোলে নিলে শিশুর শরীরের ওম যেমন মিষ্টি লাগে সকালের রোদটা মনেহয় তেমনি মিষ্টি। হায়দার আলীর নিজের সন্তানদের কথা মনে পড়ে। তার সন্তান ভাগ্য ভাল। তিন ছেলে এক মেয়ের জনক সে। ছেলে মেয়েদের সে যে যত্ন দিয়ে মানুষ করেছে তা এই গ্রাম অঞ্চলে বিরল।

এখনো গ্রামের লোকে সেকথা বলাবলি করে। শৌখিন ছেলেকে কৃষক বাবা এই বলে ধমক দেয় যে,তুই কি হায়দার আলীর পোলা যে এত নবাবী করিস?


হায়দার আলী বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। হঠাত একগাদা হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে উঠানময় ছড়িয়ে পড়ে। আলেয়া নিশ্চয় হাঁস মুরগীর ঘর খুলে দিয়েছে। একটু পড়েই আলেয়াকে দেখা যায় এক গামলা খাবার নিয়ে হাঁস মুরগীগুলোকে ডাকতে।

ডাকা মাত্রই সেগুলো আলেয়াকে ঘিরে ধরে লাফালাফি করে খাবার খাওয়া শুরু করে। হায়দার আলী মনে মনে ভাবেন বড় লক্ষী বউ পেয়েছে তিনি। এবাড়িতে আসামাত্রই বাড়ির সকলের জন্য জানপ্রান দিয়ে খাটছে। তার ব্যবসা শুরুর প্রথম বছরেই মা নিজে পছন্দ করে তাকে বাড়িতে এনেছে। সেই থেকে সে হাঁস মুরগী গরু এসব পালছে।

সংসারের অগনিত কাজের সাথে তার এই অতিরিক্ত শ্রমটুকুর কারনেই তার সন্তানেরা বাড়ির দুধ ডিম খেয়ে মানুষ হয়েছে। এই একটা মানুষ যে এতদিন বাড়ির কত খরচ বাঁচিয়ে আসছে তা হায়দার আলী আজ হঠাত বুঝতে পারেন। তার অবাক লাগে আগে কেন এমন বোধদয় হয়নি?তখন কি দেখার চোখ ছিলনা নাকি উপলব্ধি করার মত মন ছিলনা?


বাবা মা মরা মেয়ে। হায়দার আলীর মা তাকে ঘরে এনেছিল হয়ত তার রূপ আর গুন দেখেই। হায়দার আলীকে অবশ্য সে রূপ কখনো স্পর্শ করেনি।

তিনি তখন তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত,তিনি তখন অন্য জগতের মানুষ। জোয়ান কালে সকল পুরুষে একটা বউ লাগে,তারও একটা হয়েছিল তাতেই তিনি খুশি। বউ নিয়ে বেশি আহ্লাদিত হতে কখনোই দেখা যায় নি তাকে। এতবড় সংসারের পেছনে গরুর মত খেটে আর উচ্ছিষ্ট খেয়েই টিকে ছিল আলেয়া। হায়দার আলী যেন কেমন,যতই ছোট করে দেখুক সোহাগের সময় পুরুষ মানুষ বউকে রানী বানাতেও দ্বিধা করেনা।

হায়দার আলী তাও করেনি কোনোদিন। তার কাছে তার মা আর ভাইবোনই ছিল সব। গুরুত্বের দিক থেকে আলেয়ার অবস্থান সবসময়ই তার কাছে ছিল সবার নিচে। আলেয়া অবশ্য কোনোদিন কোনোকিছুতে প্রতিবাদ করেনি। এত অবহেলা সত্ত্বেও চিরকাল তার সেবা করেছে মন দিয়ে।

ঠিক যেন বাকহীন ছায়ার মত পেছনে থেকেছে চিরকাল। হায়দার আলী আলেয়ার গায়ে হাতও কম তুলেনি। কেন তুলেছে?পুরুষের আবার বউয়ের গায়ে হাত তুলতে কারন লাগে নাকি?গ্রামের প্রায় সকলেই বউ পেটায়,সেও পেটাত। হয়ত কারো উপরে রাগ উঠল,হয়ত কোনোদিন ভাত দিতে একটু দেরী হলো,হয়ত ব্যবসায় লস হয়েছে বলে মেজাজ খারাপ কিংবা হয়ত মা বা বোন এসে নালিশ করল এমন কতই না কারন খুঁজে নেয়া যায়। আলেয়া বেশ শক্ত মেয়ে,মার খেয়ে তেমন কাঁদত না বরং একটু পরেই উঠে ঘরের কাজে চলে যেত।

ঘরের কাজও করত বেশ স্বাভাবিক ভাবে। রাগ,দুঃখ বা অভিমানের কোনো ছাপই পড়ত না তার চেহারায় বা কাজে তাই তার মনের খবর পাওয়ার কোনো উপায় ছিলনা। একবার অবশ্য সে মার খেয়ে বেশ কেঁদেছিল। যখন প্রথমেই কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার দোষে হায়দার আলী তাকে বেদম পিটুনি দিয়েছিল। হায়দার আলীর অবশ্য কন্যা সন্তান হওয়ায় তেমন কিছু মনে হয়নি কিন্ত তার মা তাকে এটা নিয়ে অনেক কিছু বলল তখন তার মনে হলো আসলে আলেয়াই তাদের সকলের সাথে শত্রুতা করে মেয়ে জন্ম দিয়েছে।

সেদিন হায়দার আলীর মনে যে রাগ দানা বেধে উঠেছিল তা আলেয়ার শরীরে বাঁশের কঞ্চির আঘাতে রক্তলাল রূপ পেয়েছিল। তার কন্যা সন্তানটি হয়ত পৃথিবীর উপর অভিমান করেই দশ দিনের মাথায় বিদায় নিল। তবে সে যাই হোক আলেয়া আর এমন ভুল দ্বিতীয়বার করেনি। সে পরপর তিনটা পুত্র সন্তান জন্ম দেয়ার পর একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। সেই কন্যা অবশ্য হায়দার আলীর চোখের মনি।

হায়দার আলী মেয়েকে কলেজ পর্যন্ত পড়িয়েছেন তারপর শহরে একটা ভালঘরে বিয়ে দিয়েছেন। হায়দার আলীকে যখন তাদের ফুটফুটে দু সন্তান নানা বলে ডাকে তখন তার কাছে জীবনটা বড় সুন্দর বলে মনে হয়।


কাঁধে আলেয়ার হাতের স্পর্শে হায়দার আলী একটু চমকে উঠে। আলেয়া তার হাতে এক প্লেট পাটিসাপটা পিঠা ধরিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়। হায়দার আলী পিঠা বড় পছন্দ করে তাই আলেয়া শীতকালে প্রতি সকালেই কোনো না কোন পিঠা বানিয়ে রাখে তার জন্য।

একটা পিঠা তুলে কামড় দিতেই বাড়িতে তৈরী ঘন দুধের ক্ষীরের অপূর্ব স্বাদে হায়দার আলীর মুখ ভরে উঠে। তিনি আয়েশ করে সেটা খেতে খেতে ভাবেন আহা! এই শীতের মাঝে কত ভোরেই না উঠে আলেয়া এসব করেছে। বয়স তো তারও হয়েছে। এবয়সে এমন খাটুনি করতে নিশ্চয় তার খুব কষ্ট হয়। হায়দার আলীর মন হঠাত করেই তার স্ত্রীর জন্য আর্দ্র হয়ে ওঠে।

অথচ আগে কখনো হায়দার আলীর এমনটা হয়নি। না,হয়েছিল বোধ হয় একবার। সেই যে যেবার আলেয়াকে অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি বেদম মেরেছিলেন আর তার ফলে আলেয়া অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আসলে হায়দার আলী বুঝতেই পারে্ননি যে আলেয়ার গায়ে এতটা জ্বর ছিল। সেদিন খুব অপরাধি মনে হয়েছিল তার নিজেকে।

কিন্ত সে তো পুরুষ তাই লজ্জা প্রকাশ করতে পারেনি কিংবা ক্ষমা চাইতে পারেননি। আর অপরাধবোধও থাকেনি একদিনের বেশি। আসলে এমনি তো তাদের জীবন। সকালবেলা বউ পিটিয়ে রাতে ঘরে ফিরে সেই বউকেই জড়িয়ে ধরে তারা সোহাগ করে। না,এ সোহাগ রাগ ভাঙ্গানোর সোহাগ নয় বরং প্রয়োজনের সোহাগ।

রাগ অভিমান নিয়ে বাড়াবাড়ি করা শহুরে বড়লোকদের মানায়,হায়দার আলীর মত যারা জীবিকার সন্ধানে সবসময় ব্যস্ত থাকে এসব তাদের জন্য নয়। তাদের মত লোকদের রাগ উঠতে যেমন সময় লাগেনা আবার রাগ পড়ে গেলে সব ভুলে যেতেও তেমন সময় লাগেনা। তবুও তার মত সকলের মাঝেও্ তিনি যেন আরো একটু রসকষহীন। বন্ধুরা এ নিয়ে ঠাট্টাও কম করেনি কিন্ত হায়দার আলী কবে অন্য লোকের কথায় কান দিয়েছে?তবুও আজকাল কেন যেন মনে হয় তাদের কথায় একটু কান দিলে বোধহয় মন্দ হতোনা।


রোদ বেড়ে গেছে।

এখন আর হায়দার আলীর উঠানে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। তবুও তিনি চুপচাপ বসে আছেন। কারন তিনি জানেন আলেয়া কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে তাকে বারান্দার ছায়াতে বসিয়ে দেবে। হায়দার আলী খুবই অবাক হয় কিন্ত কিভাবে যেন আলেয়া ঠিক বুঝে যায় তার কখন কি লাগবে । তার নিজে থেকে কিছু বলতেও হয় না।

ছয়মাস আগে শহরে একটা চালান নিয়ে যাওয়ার সময় মালবাহী ট্রাকটি এক্সিডেন্ট করে একটা খাদে পড়ে যায়। সেই সময় তার দুই পা ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে ভেঙ্গে গিয়ে তিনি গুরুতর আহত হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন চিকিতসা চলেছে,আরো অনেকদিন চলবে তারপরেও তার পা আর আগের মত হবেনা। ডাক্তার বলে দিয়েছেন বাকিজীবন তাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে। এখন তিনি নিজে নিজে দাঁড়াতেও পারেন না।

তাকে সবকিছুই করতে হয় আলেয়ার সাহায্য নিয়ে। কিছুদিন আগেও তিনি ছিলেন একজন কর্মব্যস্ত লোক আর এখন তিনি আলস জীবন কাটাচ্ছেন। ব্যবসা রয়েছে বড় ছেলের হাতে। আল্লাহ জানে সে কি না কি করছে। সত্যি বলতে তিনি তার বড় ছেলের উপর ভরসা রাখতে পারেন না।

এই ছেলেটার তেমন বুদ্ধিও নেই,সততাও নেই ,ধৈর্যও নেই। তার মনে হয় এই ছেলেটি তার এত কষ্টের ব্যবসাটা নষ্ট করে ছাড়বে। জমানো টাকা আর জমি দিয়ে তাদের দুজনের জীবন নিশ্চিন্তে কেটে যাবে কিন্ত তার চিন্তা তার সন্তানদের নিয়ে। ব্যবসার সুবিধার জন্য তার বড় ছেলে বউ সন্তান নিয়ে শহরে বাসা নিয়ে থাকছে। হায়দার আলীও মনে মনে একটা গালি উচ্চারন করলেন।

কেন তিনি কি গ্রামে থেকে ব্যবসা চালান নি?তাহলে এতবড় বাড়ি ফেলে রেখে তাকে কেন শহরে থাকতে হবে?হায়দার আলী সবই বোঝেন কিন্ত কাওকে কিছুই বলেন না।


আলেয়া রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এসে হায়দার আলীকে সযত্নে উঠিয়ে বারান্দার ছায়ায় বসিয়ে দেয়। সেখানে বসে তিনি এই বিশাল আঙ্গিনার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। উঠানের শেষ্ প্রান্তে চারটি ঘরের পাকা দালান,তার দুপাশে দুটি করে আধাপাকা ঘর দিয়ে মোট আটটি ঘর। একসময় এই ঘরগুলি সব ভরা ছিল।

বাড়িতে মানুষজন গমগম করত আর আজ সবকিছুই খা খা করছে। একসময় মা আর ভাইবোনরা ছিল। বোনদের বিয়ে হয়ে গেল,ভাইরা তার সাহায্য নিয়ে ব্যবসাপাতি করে অন্যত্র সংসার পাতল,বয়স হয়ে মা মরে গেল। সবকিছু মিলিয়ে বাড়ি কেমন শূন্য হয়ে গেল। তবুও বাড়িতে ছেলে মেয়েরা ছিল।

বড় ছেলের বাচ্চা তিনটি হওয়ার পর বাড়ি আবার যেন ভরে উঠল। হায়দার আলী ভেবেছিলেন তার তিন ছেলের বিয়ে হয়ে গেলেই তিনি অবসর নিবেন। বাড়িভরা থাকবে ছেলে বউ নাতি নাতনিতে আর তিনি শুধু বসে বসে দেখবেন। কিন্ত নিয়তির বিধান!কিছুই যেন তার ইচ্ছামত হলোনা। মেজছেলেকে ভাল জায়গায় পড়তে দিয়েছিলেন কারন মনে মনে তার ইচ্ছা ছিল ছেলে পাশ করলে গ্রামে একটা স্কুল খুলে দেবেন যেখানে সে পড়াবে।

কিন্ত মেজছেলে পড়া শেষ করার আগেই কোন এক ধনীর একমাত্র দুলালীকে বিয়ে করে তার শশুড়বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে উঠে গেছে। এখন নাকি সে শশুড়ের ব্যবসা দেখাশোনা করবে। ছোট ছেলেটা বিদেশ যাওয়ার বায়না ধরল। অনেকদিন ধরে আপত্তি করেও শেষ পর্যন্ত হায়দার আলী তাকে টাকা দিতে বাধ্য হলেন। মেয়ের তো আগেই বিয়ে হয়েছে,তিনমাস আগে শহরে বড়ছেলে বাসা নেয়ার পর এই বাড়ি একদম ফাঁকা হয়ে গেল।




হায়দার আলী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবেন তিনি যাদের চিরদিন আদর করেছেন, কদর করেছেন তারা কেউ আজ তার পাশে নেই। আছে শুধু চিরকালের অনাদরের শিকার আলেয়া। যাদের তিনি বৃদ্ধ বয়েসের সম্বল বলে মনে করতেন তারা আজ একাকী রেখে গেছে কিন্ত সেই নিরব ছায়ার মত আলেয়া আজ তার একমাত্র সাথি। তিনি আজকাল আলেয়াকে খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেন। তার চলাফেরা,কাজকর্ম,মুখের ভঙ্গিমা সবকিছুই তিনি দেখেন খুঁটিয়ে খুটিয়ে।

তারমতই আলেয়াও আজ বৃদ্ধ হয়েছে তাও হায়দার আলীর বেশ ভাল লাগে তাকে। তার মাঝে কেমন যেন একটা নির্ভরতা খুঁজে পান আজকাল। প্রথম প্রথম ছেলেরা চলে গেলে নিজেকে তার ভীষন অসুখি মনে হতো তাই আরো বেশি কাজে ডুবে থাকতেন। কিন্ত এক্সিডেন্টের পর বাড়িতে আলেয়ার সংস্পর্শে তার দিনগুলি কেমন যেন শান্তিময় হয়ে গেছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই ভাবছেন এটাই বা খারাপ কি?ছেলে মেয়েদের বড় করেছেন, তারা নিজ নিজ জীবনে ভালই আছে তাহলে আর দুঃখ কিসের।

এখন তার খুব ইচ্ছা করে আলেয়াকে একটু স্নেহ করতে,একটু নরম স্বরে জিগাসা করতে তার বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে কিনা। কিন্ত নিজের সারাজীবনের কঠিন মূর্তি ভেঙ্গে ফেলতে তার ভীষন দ্বিধা হয়। যে দুরত্ব প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বিরাজমান তা কি এক নিমেষে ভেঙ্গে ফেলা যায়?

পাশের ঘরে মোবাইল ফোনটা বাজছে। আলেয়া রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ঘরে ঢুকে যায়। আলেয়া পাশের ঘর থেকে ফোনটা এনে হায়দার আলীর কানে ধরিয়ে দেয়।

তার মেয়ে ফোন করেছে। খুব খুশি নিয়ে তিনি ফোনে কথা বলা শুরু করেন কিন্ত কথা শেষে তার মন ভীষন খারাপ হয়। মেয়ের দুই দিন পর আসার কথা ছিল,সে বলছে তার বড় ছেলের সামনের মাসে পরীক্ষা তাই সে এখন আসতে পারবে না। অভিমানে হায়দার আলীর চোখে পানি এসে পড়ে। ক্লাস ওয়ানে পড়া দুধের বাচ্চার এত কিসের পড়ার চাপ যার জন্য অসুস্থ বাপকে দেখতে দুইদিনের জন্য আসা যায় না?এই মেয়েকেই কিনা তিনি এত আদর দিয়ে মানুষ করেছেন!!হঠাত একটা নরম শান্তনার হাত এসে পড়ে হায়দার আলীর কাঁধে,একটা ছাপা শাড়ির আঁচল তার গাল বেয়ে পড়া অশ্রু শুষে নেয়।

হায়দার আলীর শূন্য পৃথিবী হঠাত করে পূর্ন হয়ে যায়। তিনি অবাক হয়ে দেখেন তার অশ্রু অন্য কারো চোখেও অশ্রু এনেছে। তার খুব ইচ্ছা করে সেটা মুছিয়ে দিতে। আজন্মকালের দ্বিধা কাটিয়ে তিনি প্রথমবারের মত হাত বাড়িয়ে দেন সেই স্নেহময়ীর দিকে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।