আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযোদ্ধা জনাব গাজী আমিন উল্যা -এর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত

মুক্তিযোদ্ধা জনাব গাজী আমিন উল্যা -এর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত

মরহুম জনাব গাজী আমিন উল্যা নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত বেগমগঞ্জ থানাধীন চৌমুহনী পৌরসভাস্থ উত্তর হাজিপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতা নূর মিয়া পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তৎকালীন সময়ে চৌমুহনী বাজারে নূর মিয়া আড়তদার নামে সুপরিচিত ছিলেন। শৈশব - কৈশর পেরিয়ে যৌবনের প্রারম্ভেই গাজী আমিন উল্যা রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি বেগমগঞ্জ হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।

মহাত্মা গান্ধীজির তৎকালীন অহিংস স্বদেশী আন্দোলন তাঁকে প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি তৎকালীন মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার হিসাবে সিলেট রেফারেন্ডামেও অংশ গ্রহন করেছিলেন। তৎকালীন হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য গান্ধীজি নোয়াখালী সফরে এলে তিনি তাঁর (গান্ধীজির) সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিলেন। এসব কারণে একজন পরীক্ষার্থী হয়েও তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহন করা হয়নি।

তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাও তাঁকে কখনো বিন্দুমাত্র আকর্ষন করতে পারেনি। উলে¬খ্য, এ সময়ে তিনি খদ্দর কাপড়ের পাঞ্জাবী পরতে শুরু করেন এবং সারাজীবন খদ্দর কাপড় পরে কাটিয়ে দেন, আমৃত্যু আর কোন বিদেশী কাপড় ব্যবহার করেননি।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গনঅভ্যূথান, ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনসহ বাঙালির প্রতিটি গন আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পুরো ৯ মাস রনাঙ্গনে একজন সাহসী যোদ্ধা হিসাবে পাকিস্থানী হানাদার এবং তাদের এদেশী দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামসের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে লড়াই করেছিলেন। তিনি মহান মুক্তি যুদ্ধের পুরো ৯ মাসই সুবেদার লৎফর রহমান, সুবেদার শামসুল হক ও সুবেদার অলি উল্যা ( তাঁরা তিন জনই পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন) নায়েক শাহজাহান এর সহযোদ্ধা ছিলেন এবং বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।

এর মধ্যে উলে¬খযোগ্য ছিল , কোম্পানীগঞ্জ স্কুলে হানাদার বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমন (যেখানে চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের ছাত্র ছালেহ আহমেদ শহীদ হয়েছিলেন), চৌমুহনী, আপানিয়া, সোনাইমুড়ি, গজারিয়া পুল অপারেশন, বেগমগঞ্জ থানা ও চৌমুহনী পুলিশ ফাঁড়িতে গেরিলা আক্রমন, লক্ষীপুর ব্রীজ ও দালাল বাজারে অপারেশন, ফেনীর সিলোনিয়াতে গেরিলা অপারেশন।
মূলত নোয়াখালী লক্ষীপুর তথা বৃহত্তর নোয়াখালীর মুত্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ । অনেক আগে থেকে রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ফলে তিনি সহজেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, খাবারও রসদ-সরঞ্জাম যোগাড় করে দিতেন। অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে তিনি ৯ বার ভারতে গিয়েছিলেন এবং নিজের মাথায় করে অস্ত্র ও গোলাবারুদের বাক্স বহন করে সহকর্মী যোদ্ধাদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন।


দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের আতœত্যাগ ও দ’ুলক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির মহান স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সনে জেলা আওয়ামী লীগের সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ত্াঁকে গাজী উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেই থেকে তিনি গাজী আমিন উল্যা হিসাবে সুপরিচিত। তিনি আওয়ামী লীগের একজন সার্বক্ষনিক কর্মী হিসাবে নিজের সারা জীবন উৎসর্গ করে দেন। কখনো কোন পদ- পদবীর পিছনে ছোটেননি। কখনো কোন আর্থিক সুবিধা লাভের চেষ্টা করেননি।

তিনি সব সময় বলতেন, “সহজ কথায়, মানুষ দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি করে, একটি হলো দেশ ও মানুষের কল্যান এবং অপরটি হলো নিজের নানা রকম স্বার্থ সিদ্ধি। আমাদের দেশের অধিকাংশ নেতাই শেষোক্ত উদ্দেশ্য নিয়েই রাজনীতি করেন”।

তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ভাতা কখনো গ্রহন করেননি। মুুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটও তোলার প্রয়োজন মনে করেননি। তিনি বলতেন, “সার্টিফিকেট কিংবা কোন সুবিধা লাভের জন্য তো যুদ্ধ করিনি, যুদ্ধ করেছি নিঃস্বার্থভাবে, দেশকে ভালবেসে, দেশের মানুষকে ভালবেসে, নিজে কোন কিছু পাওয়ার জন্য নয়”।


তিনি সত্যিকার অর্থে একজন ধর্মপ্রান মুসলমান ছিলেন। তাঁকে কখনো নামাজ কাজা করতে দেখা যায়নি। তিনি সব সময় বলতেন, ”পাশের বাড়ির লোককে অভুক্ত রেখে বিরিয়ানি - পোলাও খেলে মহান আল¬াহর কাছে দায়ী থাকতে হবে। ” তিনি আরও বলতেন, ”এমনভাবে খাও, যাতে তোমার ভাল খাবারের ঘ্্রাণ অন্্য গরীব মানুষের নাকে না লাগে। এমন পোশাক পর, যাতে অন্্য গরীব মানুষ দেখে তার মনে হাহাকার সৃষ্টি না হয়।

” । তিনি এরকম সাদা মনের মানুষ ছিলেন যে, রাস্তায় কখনো থুতু— ফেলতে দেখলেও রাগ হতেন; বলতেন, ”মানুষের পায়ে যদি থুতুগুলো লেগে যায়?” তিনি অত্যন্ত দীন - হীনভাবে সারা জীবন অতিবাহিত করেছেন। কোন ধরনের জাগতিক লোভ -মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ন্যায় - নীতির প্রশ্নে সর্বদায় অবিচল ছিলেন। কখনো কোন অন্যায়ের সংগে আপোস করেননি।

শত দুঃখ - কষ্টেও তিনি সবসময় হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল। সুদীর্ঘ জীবনে আতœীয় - অনাতœীয়, বন্ধু -বান্ধব, রাজনৈতিক কর্মী, হাজার হাজার মানুষের সংগে তাঁর জানা - শোনা ও যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কেউ কোন দিন তাঁর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কিংবা মনে কষ্ট পেয়েছেন, - এরকম কথা, কখনো শোনা যায়নি। নিজের ব্যক্তিগত সুখ - শান্তি, ছেলেমেয়ে বা পরিবার পরিজনের ভবিষ্যতের কথা কখনো চিন্তা করেননি।


মরহুম গাজী আমিন উল্যা ২০০৯ ইং সনের ২১ শে নভেম্বর তারিখে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে প্রায় একশত বছরেরও বেশি বয়সে পরলোক গমন করেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.