আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোটা রাজধানীই যেন বৃহৎ ভাগাড়

সচেতনতার অভাব, দায়িত্ববানদের অবহেলা ও কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনায় গোটা রাজধানীই যেন ময়লা-আবর্জনার বৃহৎ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাট, অলিগলি, আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকা- সর্বত্রই ধুলা, ধোঁয়া, ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। ড্রেন-নর্দমার নোংরা তরল ময়লা-পানি ঢুকে পড়ছে বাড়িঘরেও। চারদিকের উত্কট গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকছে। প্রতিটি বাড়ির ফাঁকে, খোলা জায়গায়, গলিপথে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।

সৌভাগ্যবশত ময়লা-আবর্জনা চোখে না দেখলেও গন্ধ ঠিকই পাওয়া যাবে। রাজধানীতে চলাচলকারী ও বাসিন্দাদের চরম দুর্গন্ধ সয়ে বাস করতে হচ্ছে।

ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার টন ময়লা-আবর্জনা জমে। এর মধ্যে ডিসিসির পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সর্বোচ্চ তিন হাজার টন পর্যন্ত ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন। বাকি চার হাজার টন ময়লা-আবর্জনার ধকলে বেসামাল থাকেন নগরবাসী।

হোটেল-রেস্তোরা, শিল্প কারখানা, ব্যবসা কেন্দ্র, কাঁচাবাজার, নির্মাণকাজ ও বাসাবাড়ির বর্জয পুরো রাজধানীর জন্যই মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এসব ময়লা-আবর্জনার মধ্যে আবার ২০০ টন বর্জয থাকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের। ব্যবহূত সুচ, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, ওষুধের শিশি; স্যালাইন, রক্তের ব্যাগ ও রাসায়নিকসহ সব ধরনের চিকিত্সাজাত দ্রব্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, ক্লিনিক্যাল বর্জ্যে প্রায় ২০ শতাংশ প্রাণঘাতী রোগের জীবাণু বহন করে থাকে, এগুলো খুবই বিপজ্জনক। দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, দুই সিটি করপোরেশন যথারীতি বর্জ্য অপসারণ না করায় ঢাকা এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

কোথাও ডাস্টবিন উপচে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে ময়লা। যেখানে ডাস্টবিন বা কনটেইনার নেই সেখানে ময়লা-আবর্জনা সরাসরি রাস্তায় ফেলা হচ্ছে। অনেক স্থানে আবর্জনার স্তূপ জমে রিকশা-গাড়ির চলাচল পর্যন্ত বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এর পরও উপায়ান্তরহীন মানুষ মলমূত্র, কাদা-পানিতে পা ডুবিয়েই পথ চলতে বাধ্য হচ্ছে। কোতোয়ালি, বংশাল, যাত্রাবাড়ী, চকবাজার ও মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ডাস্টবিন উপচে ময়লা পড়ছে চারপাশে।

আবার জনবহুল রাস্তায় ব্যস্ততম সময়ে ময়লাবোঝাই গাড়িগুলো এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। চলন্ত গাড়ি থেকে ময়লা পড়ে রাস্তায়, যাত্রী-পথচারীর শরীরেও লাগে নোংরা দাগ।

এদিকে, ডিসিসি নির্মিত প্রায় ৭০টি পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী। মানুষ বিপজ্জনক এ টয়লেটগুলো ব্যবহারের পরিবর্তে ফুটপাতকেই টয়লেট বানিয়ে ফেলেছে। ফলে ফুটপাত দিয়ে চলাই দুরূহ হয়ে উঠেছে।

রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো যেন আবর্জনার পাহাড়। কাপ্তানবাজারের নোংরা ময়লার অব্যবস্থাপনা গুলিস্তান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। রাস্তাজুড়েই ফেলে রাখা হয়েছে মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ি, পালক, গরু-ছাগলের মলমূত্র। বেশির ভাগ ব্যবসা কেন্দ্রে শত শত মুরগি জবাই করে নাড়ি-ভূঁরিসহ সব ময়লা সরাসরি রাস্তায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে।

রাজধানীর গ্রিন রোডবাসী প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়েই গলির মুখে আবর্জনার পাহাড় দেখতে পায়।

এতে চলতে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি দুর্গন্ধে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে। মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকের বাসিন্দা আনোয়ারুল হক জানান, বর্ষাকাল কী শীতকাল, সবসময় পানি জমে থাকে। বৃষ্টি হলে কথাই নেই, জলাশয়ে পরিণত হয়ে যায় এলাকা।

মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা লুত্ফর রহমান, শামসুজ্জামান, আলহাজ শহিদুল ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, রাজধানীর আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই তা ভাবতেও অবাক লাগে। মহল্লায় মহল্লায় বড় বড় যে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হয়েছে, কোনো ভবনের সঙ্গেই ডাস্টবিন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি।

বহুতল একেকটি অ্যাপার্টমেন্টের ২০০-৩০০ পরিবার নিত্যদিনের আবর্জনা গৃহপরিচারিকাদের দিয়ে পাশের পার্কে বা ডোবায় ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে! এদিকে, দখলবাজদের থাবায় বিলীন হতে থাকা বুড়িগঙ্গার বুকজুড়ে এখন ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, পুরান ঢাকার পুরোটাই যেন একটি ভাগাড়। অপরিচ্ছন্নতা, নোংরা আবর্জনা এবং কারখানার বিষাক্ত বর্জয পুরান ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা। প্রায় প্রতিটি সরু পথের পাশে ময়লার স্তূপ, মোড়ে মোড়ে বিপজ্জনক রাসায়নিকের কারখানা, বিষাক্ত বর্জয, আরমানিটোলা, লালবাগ, সূত্রাপুর কিংবা হাজারীবাগ যে কোনো স্থানে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে এতটুকু নিঃশ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে যায়। ট্যানারির অশোধিত বর্জয হাজারীবাগ, লালবাগ, রায়েরবাজার, জিগাতলা, ধানমন্ডিসহ আশপাশের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে তুলছে।

বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। বাতাস আর পানিতে ঘুরছে বর্জযের বিষ। নানাভাবে এ বিষেই আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর মানুষ। এক সমীক্ষায় বলা হয়- বর্জযের কারণে ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ৩০ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু হাজারীবাগের ১৯৪টি ট্যানারি কারখানা থেকে প্রতিদিন ১৫ হাজার কিউবিক মিটার তরল বর্জয নিষ্কাশন হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে আরও ১০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জয।

লালবাগ এলাকার ট্যানারিগুলো থেকে ৭ হাজার কিউবিক মিটার তরল ও ৫ হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জয মিলে পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করে চলছে।

জানা গেছে, নগরীর সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে শিল্প কারখানার আবর্জনা। ঢাকার চারপাশে চার নদীর তীরেই রয়েছে ৭ হাজারের বেশি শিল্প ইউনিট। শিল্পবর্জযের ৯০ শতাংশই কেমিক্যাল। বাদামতলী থেকে নবাবগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতে শিল্পবর্জয ফেলায় সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে সতর্ক করেছে পরিবেশ অধিদফতর।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-বাপার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, নগরীর ডাস্টবিনগুলো থেকে সিটি করপোরেশন অর্ধেক বর্জ্যও পরিষ্কার করতে পারছে না। পড়ে থাকা বর্জয প্রাণঘাতী বিভিন্ন ধরনের রোগ বিস্তারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে, বর্জ্য পরিবহনে প্রতি মাসে গড়ে পৌনে ৩ কোটি টাকার জ্বালানি খরচ দেখানো হয় বলে জানা গেছে। এর মধ্যে 'বোগাস' বিলের পরিমাণই কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিসিসি সূত্রে জানা যায়, মাতুয়াইলে ১০০ একর ও আমিনবাজারে ৫০ একর জায়গাজুড়ে ডাম্পিং স্টেশন করা হয়েছে।

এ দুটি ভাগাড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন ময়লা জমা হচ্ছে। ময়লা জমিয়ে সেখানে পাহাড়ে পরিণত করা হয়েছে। ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তারা জানান, কিছু এলাকায় ময়লা এমন জায়গায় ফেলা হয় যেখান থেকে গাড়িতে তোলা যায় না। জনবল প্রয়োজন ২০ হাজার, আছে মাত্র সাড়ে ৮ হাজার, গাড়ি দরকার ৭৫০টি, আছে ২৫০টি। এত কম লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে শতভাগ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।