আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বালুর অবাধ ব্যবসা, ধসে পড়ছে সেতু কালভার্ট

অবাধে বালু তোলার কারণে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের
করা দুটি সেতু ও একটি কালভার্ট ধসে পড়েছে। হেলে পড়েছে, দেবে গেছে বা ঝুঁকির মধ্যে আছে ৪৫টি কালভার্ট। পাঁচটি বিদ্যুতের খুঁটি হেলে পড়েছে এবং ১৫টি হুমকির মুখে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক ও ফসলি জমি।
দুটি খালের সাতটি মহাল থেকে প্রায় ১০ বছর ধরে বালু তোলার কারণে দুটি ইউনিয়নের প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এই এলাকায় অন্তত ৫০টি শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু তোলা হয়। মানুষের চলাচল, জীবনযাত্রা, কৃষি, পরিবেশ—সবকিছুতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ডলু বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলও ভাঙনের কবলে পড়েছে। বন বিট কার্যালয়ও ভাঙনের মুখে।
ধসে পড়া সেতু দুটি হলো পুটিবিলা সরইয়া সেতু ও চান্দা সেতু।

ধসে পড়া কালভার্টটি কালা জোড়া সেতু নামে পরিচিত। চান্দা সেতুর পুরো কাঠামো এখন পানির নিচে। স্থানীয় সরকার বিভাগের হিসাবে, সব মিলিয়ে এই এলাকায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার সরকারি সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই বালু তোলার কারণে।
বালু ব্যবসায়ী, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সূত্র এবং ভুক্তভোগীরা জানান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী ও দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সদস্য মোরশেদুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট এই বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। মোরশেদ আলমের ভাই নওশাদ আলম চৌধুরী ও ভাগিনা মো. ইলিয়াছ এবং নূরুল আবছারের প্রতিনিধি হিসেবে মো. ইদ্রিচ মাঠপর্যায়ে এই ব্যবসা পরিচালনা করেন।

এঁদের সবাই লোহাগাড়ার বাসিন্দা।
এর মধ্যে পুটিবিলা-২ ও ৩ নম্বর বালুমহাল ইজারা নিয়েছেন যথাক্রমে মোরশেদ আলম ও নওশাদ আলম। পানত্রিশা-১ ইজারা নিয়েছেন মো. ইদ্রিচ। গত বছর ৬৩ লাখ টাকায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এই মহাল তিনটি ইজারা দেয়। বাকি চারটি মহালের মধ্যে দুটি ইজারা দেওয়া হয়নি।

দুটিতে বালু তোলার বিষয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে।
বালু ব্যবসায়ী ও টোল আদায়কারীরা জানান, বালুর ট্রাকপ্রতি সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩০০ টাকা নেয় ইজারাদারেরা। সাত বছর ধরে এঁরা বালু-বাণিজ্য করছেন। এর আগে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ও এখানে বালু-বাণিজ্য হয়েছিল।

উপজেলার পুটিবিলা ও চুনতি ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ডলু ও সরই খাল।

সরই খালের ওপর স্থানীয় সরকার বিভাগের করা দুটি সেতু ছিল। এর মধ্যে পুটিবিলা সরইয়াতে নির্মিত সেতুটি দুই বছর আগে ধসে পড়েছে। গোরস্থান সেতু নামে পরিচিত অপর সেতুটিও আছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।
সরই খালের সঙ্গে সংযুক্ত আছে অনেকগুলো ছড়া (ছোট খাল)। এই ছড়াগুলোর ১০ থেকে ১২টি বক্স কালভার্টও ঝুঁকির মধ্যে আছে।

বালু সরে যাওয়ায় পাড় ধসে বা মাটি দেবে গিয়ে কয়েকটি কালভার্ট ইতিমধ্যে হেলে পড়েছে।
ডলু খালের ওপর নির্মিত একমাত্র ডলু বেইলি সেতুটিও হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। এটি বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার সঙ্গে লোহাগড়ার সংযোগস্থাপনকারী সেতু।
ডলু খালের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন ছড়ার প্রায় ৩০টি বক্স কালভার্টের দুই পাশের মাটি সরে গেছে। ধসে পড়েছে ডলু খালের সঙ্গে সংযুক্ত চান্দা খালের চান্দা সেতু ও কালা জোড়া খালের পানত্রিশা কালা জোড়া সেতু।


এলজিইডির লোহাগাড়া উপজেলা প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বালু তোলার কারণে পুরো এলাকায় ভূমিধস হচ্ছে। বালু তুলে নেওয়ায় খালের গভীরতা বেড়ে গেছে। ভাঙছে দুই পাড়। ফলে ডলু ও সরই খালে নির্মিত সেতুগুলো ভেঙে পড়ছে। তিনি বলেন, এ দুই খালের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন ছড়ায়ও ধস শুরু হয়েছে।

এ কারণে বক্স কালভার্টগুলোও ধসে যাওয়ার পথে। ইতিমধ্যে প্রায় শতকোটি টাকার সরকারি সম্পদ ক্ষতি হয়েছে এই এলাকায়।
শুধু সেতু নয়, সরেজমিনে দেখা গেছে, ডলু খালের পাশে পল্লী বিদ্যুতের পাঁচটি বৈদ্যুতিক খুঁটিও হেলে পড়েছে। খাল ও ছড়ার পাড়ের আরও ১৫টি খুঁটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

পুরো বৈদ্যুতিক লাইনই এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে।
এলাকার আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, কালা জোড়া সেতুটি ধসে যাওয়ায় কয়েক শ পরিবার ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুর্ভোগে পড়েছে।
সরইয়া এলাকার বাসিন্দা ফরিদুল আলম জানান, সরই খালের একমাত্র সেতুটি ভেঙে যাওয়ায় লোহাগাড়ার অন্যান্য ইউনিয়নের সঙ্গে এলাকার স্বাভাবিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বছরের পর বছর বালুবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে সড়কগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী বলেন, যে রাস্তায় আট টনের বেশি ভার নিয়ে গাড়ি চলাচলের নিয়ম নেই, সেখানে প্রতিদিন ৩০-৪০ টন ওজনের দু-তিন শ বালুর ট্রাক চলাচল করছে।

এতে সব কটি রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন দাবি করেছে, খাল ও ছড়ার ভাঙন ও ধসের কারণে এলাকার কয়েক শ একর ফসলি জমি ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় পুটিবিলা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবর রহমান জানান, ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে পুটিবিলা এমচরহাট বাজারও।
চুনতি পানত্রিশা এলাকার বাসিন্দা কৃষক আহমদ হোসেন বলেন, নিজের ১০ শতক জমিতে চাষাবাদ করে তাঁর সংসার চলত। কিন্তু বালু ব্যবসায়ীদের কারণে সব ডলুর পেটে গেছে।


উপজেলার চুনতি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০টি শ্যালো মেশিন দিয়ে ডলু ও সরই খাল থেকে বালু তোলা হচ্ছে। অপরিকল্পিত বালু তোলার কারণে আশপাশের প্রায় দুই হাজার পরিবার কৃষিজমি হারানোসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মহিবুল্লাহ বলেন, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বালু তুললে নদী বা খালের গভীরতা যেমন বাড়ছে, তেমনি প্রশস্ততা বেড়ে যায়। এতে কৃষিজমি ধ্বংস হয়, নষ্ট হয় জীববৈচিত্র্য।
সিন্ডিকেটে কারা: মহালগুলো থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু তুলছেন স্থানীয় বদি আলম, মো. মঞ্জুর, মো. কাশেম, মো. নাজিম, জানে আলম, মো. হারুন, নূর আলম, শাহ আলম, মো. ইউনুচ, মো. মানিক, মো. ওসমান, মো. আজিজ, আহমদ ছফা, আমানে আলম, নেছার মিয়া, আবদুল আলম, জিল্লুর রহমান, মো. আকতার, নুরুল হুদা, সাইফুল ইসলাম, আবুল কাশেম প্রমুখ।


পুটিবিলা ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম বলেন, বালু উত্তোলনের কারণে ডলু সেতুসহ প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাকা সড়ক, চাম্বী সেতুসহ প্রায় ৩০টি বক্স কালভার্ট ভেঙে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে ১৪টি মিথ্যা মামলা দিয়েছেন বালু ব্যবসায়ীরা। উপজেলা সমন্বয় সভায় এ ব্যাপারে কার্যবিবরণী তৈরি করে জেলা প্রশাসককে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ’
তবে লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিজনূর রহমান বলেন, ইতিমধ্যে সেতুর আশপাশ থেকে বেশ কিছু শ্যালো মেশিন জব্দ করা হয়েছে।

আবারও অভিযান চালানো হবে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বালু উত্তোলনকারীরা ট্রাকের ওজন অনুযায়ী বালু সিন্ডিকেটকে টোল দেন। টোল আদায়ের জন্য পুটিবিলা ইউনিয়নের জোট পুকুরিয়া এলাকায় একটি কার্যালয়ও স্থাপন করা হয়েছে।
টোল আদায়কারী মো. জাফর, সাইফুল ইসলাম ও মো. নাসির প্রথম আলোকে বলেন, নুরুল আবছার চৌধুরী ও মোরশেদ আলম চৌধুরীর পক্ষে তাঁরা বালু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টোল আদায় করছেন। তাঁরা জানান, ট্রাকপ্রতি সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩০০ টাকা টোল আদায় করা হয়।


পুটিবিলার বালু ব্যবসায়ী মো. বদি আলম, মো. শাহ আলম, মো. আজিজ ও মো. হারুন বলেন, পুটিবিলা ও চুনতি এলাকা থেকে বালু নিতে হলে এখানে টোল দিয়ে ট্রাক পার করতে হয়।
জানতে চাইলে নুরুল আবছার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ’
আর মোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যেটুকু ইজারা নিয়েছি, তা থেকে টোল আদায় করছি। ’
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. জাফর আলম বলেন, বালুমহাল ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে এলাকার পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে কি না, সে ব্যাপারে প্রথমেই জরিপ করা উচিত। তা না হলে সরকারের লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.