আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবন্ত উপহার!

ঢাকা শহরের জমি সোনার চেয়েও দামী। কেউ এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে চায়না। এমনভাবে বাড়ি বানায় যেন একছাদ থেকে অন্যছাদে লাফ দিয়েই যাওয়া যাবে। গায়ে ঘেষা এই সব বাড়ি লোকজনও গায়ে ঘেষা ঘেষি করে থাকে। ছাদে উঠলে অন্য ছাদে কি হচ্ছে তা না চাইলেও চোখে পড়ে।

রান্নাঘরে তেলেভাজার শব্দ ও ঘ্রাণ পাশের বাড়ি থেকেও পাওয়া যায়। অনেকসময় পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে কার বাসায় কি রান্না হচ্ছে। ঘরের আলো জ্বালালে পাশের বাড়িতেও সেই আলো অনেকখানি চলে যায়। জানালার কপাট খুললে অন্যবাড়ির জানালা চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখে অনেক চোখাচোখি হয়।

এই চোখাচোখি থেকে ঘটে যায় পারস্পরিক সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ কখনো ভালোবাসার স্ফুলিঙ্গ ঘটায় আবার কখনো বিকর্ষণ ঘটিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি করে। আমাদের আজকের গল্প ঢাকা শহরের এমন গায়ে ঘেষাঘেষি দুটি বাড়ি নিয়ে।

জামাল সাহেব সামরিকবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন। জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীতে গিয়ে এবং অবসরকালীন প্রভিডেন্ট ফান্ড একত্র করে ঢাকা শহরে কোনমত দোতালা একটা বাড়ি করেছেন।

তিনকাঠার উপর বাড়ি। একটু জায়গা ছেড়ে দিলে মনমত বাড়ি করা যায় না। তাই সীমানা ঘেষেই বাড়ি করেছেন। ওনার প্রতিবেশী আওয়াল সাহেবের একই অবস্থা। সীমানা ঘেষে দোতালা বাড়ি করেছেন।

দুইজনের বাড়ি গা ঘেষাঘেষি করে থাকলেও জামাল সাহেব আওয়াল সাহেবকে এড়িয়ে চলেন। প্রতিবেশী হিসেবে আওয়াল সাহেবকে জামাল সাহেবের পছন্দ না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আওয়াল সাহেবের দ্বৈত বিবাহ। তিনি দুই ফ্লাটে দুই স্ত্রী রেখে বসবাস করছেন। একটি পুত্র সন্তানের আশায় আওয়াল সাহেব তার দুই স্ত্রীর উপর প্রতি বছর অত্যাচার করছেন।

তার দুই স্ত্রী মিলে মোট ছয়টি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েও আওয়াল সাহেবের মুখে হাসি ফুটাতে পারে নাই। তার এই পুত্র সন্তান প্রীতির জন্য দ্বৈত বিবাহ জামাল সাহেবের পছন্দ না। তাই তিনি আওয়াল সাহেবকে এড়িয়ে চলেন। তার দুই সন্তান মামুন ও কামাল দুইজনকেই তিনি বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন পাশের বাড়ির কারো সাথে মিশতে না। তাদেরকে এড়িয়ে চলতে।

এখন গায়ে ঘেষাঘেষি বাড়ি চাইলেও এড়িয়ে চলা সম্ভব না।

জামাল সাহেবের দুই পুত্র মামুন ও কামাল। কামাল কলেজে ২য় বর্ষে পড়ে আর মামুন ক্লাস সেভেনে পড়ে। কামাল বাড়ির দোতালায় একা থাকে। আর তার বাবা-মা এবং ছোট ভাই মামুন নিচতলায় থাকে।

তার জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির জানালা অনেকখানি দেখা যায়। গায়ে ঘেষাঘেষি বাড়ি হবার কারণে জানালা খুললে আলো বিশেষ আসে না তাই জানালা খোলা হয় না। কামালের তখন টেস্ট পরীক্ষা চলছে। রাত পোহালে পরীক্ষা। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়ছে।

পড়া শেষে যখন ঘুমাতে যাবে তখন সে কেমন যেন মিহি গলায় কেমন যেন শব্দ শুনতে পেল। একা ঘরে এই অস্পষ্ট শব্দ গুনুর গুনুর করে তার কানে বাজতে লাগলো।

তারা এই নতুন বাসায় এক মাস হল উঠেছে। এতদিনে কোন শব্দ সে শুনতে পাইনি আজ হঠাৎ করে কেমন যেন মিহি গলায় অস্পষ্ট শব্দ তার কানে বেজে উঠছে। একটা শীতল বায়ু তার সারা শরীরে প্রবাহিত হয়ে গেল।

একটা ভয় তার মনে উঁকি দিল। একটু খেয়াল করে সেই অস্পষ্ট শব্দ শোনার যখন চেষ্টা করলো তখন তার মধ্যে আরও ভয় ঢুকে গেল। একটু আগে সে হৈমন্তীর চরিত্র বিশ্লেষণ কর প্রশ্নটি পড়েছে। সেই একই প্রশ্ন মেয়েলি গলায় কে যেন পড়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড ভয় পেলে মানুষের প্রস্রাবের বেগ পায়।

কামালের একইভাবে প্রস্রাবের বেগ পেয়েছে। এতই বেগ যে যেকোন সময় বের হয়ে আসবে। এই বেগ নিয়ে বিছানায় ঘুমানো যাবে না। সমস্যা হল নতুন বাসার দোতালায় এখনো বাথরুমের সংযোগ দেয়া হয়নি তখনো। বাথরুম করতে হলে নিচতলায় যেতে হবে।

এই মধ্যরাতে এমন ভুতুরে আওয়াজের মধ্যে তার সাহস হল না দরজা খুলে নিচতলায় গিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। এইদিকে প্রস্রাবের বেগ বাড়ছে। সে চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে এই প্রস্রাবের বেগকে মুক্ত করা যায়। তখনই তার নজর জানালার দিকে চলে গেল। জানালা সামান্য একটু খুলে সেখান দিয়ে প্রস্রাব করা যায়।

এতে দরজা খুলে আর বাইরে যাওয়া লাগবে না। সে ধীরে ধীরে জানলার দিকে গেল। জানালা একটু খুলে সে পাশের বাসার জানালার দিকে তাকালো। পাশের বাসায় আলো নিভানো এবং জানালা বন্ধ করা। সে পরম নিশ্চিন্তে প্যান্টের চেইন খুলে তার হাত চেইনের ভেতর ঢুকিয়েছে আর ঠিক তখনই পাশের বাসার জানালা খুলে গেল এবং আলো জ্বলে উঠলো।

কামালের বুক কিছুক্ষণের জন্য পিলে চমকানোর মত আটকে গেল। সে ভুলে গেল চেইন থেকে তার হাত বের করতে। সেই অবস্থায় সে কিছুক্ষণ ঘটনার আকস্মিকতায় বিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার হুঁশ হল যখন পাশের বাসার জানালা একটি ঢেউ খেলানো হাসি দিয়ে সজোরে বন্ধ হয়ে গেল। সে সাথে সাথে তার হাতের অবস্থান দেখে জিহবায় কামড় দিয়ে ফেললো।

একটু হলেই সে বড় কেলেঙ্কারিতে পড়ে যেত। প্রস্রাবের বেগের কথা ভুলে সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো জানালা দিয়ে উঁকি মারার খেলায়। জানালা একটুখানি ফাঁক করে পাশের বাড়িতে খেয়াল করা। সে যখন জানালা খুলে উঁকি মারে তখন পাশের বাসার জানালা বন্ধ হয়ে যায় আবার সে যখন জানালা বন্ধ করে তখন পাশের বাসার জানালা খুলে যায়। এভাবে জানালা খোলাবন্ধ করে উঁকি মারার খেলা কিছুক্ষণ চলল।

কিছুক্ষণ আগে যে ভয়ের পরিবেশ তার মধ্যে দোল খেয়েছিল তার উৎস এই পাশের বাড়ির জানালা এটা জানার পর থেকে তার ভয় উধাও হয়ে গেছে। এক অন্যরকম আবিষ্কার জয়ের আনন্দে সে আত্মহারা হয়ে গেল।

চুম্বকের বিপরীত দুটি মেরু কাছাকাছি আসলে পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এক জানালা হতে অন্য জানালার ব্যবধান মাত্র একহাত। এই এক হাত ব্যবধানে দুটি ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ বসবাস করে।

তাদের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের এই আকর্ষণে একটা লুকোচুরি ছিল। কামালের পাশের বাসায় তারই বয়সী এক সুদর্শনা নারী থাকে অথচ সে একমাসেও আবিষ্কার করতে পারেনি এরজন্য সে নিজেকে বারবার ধিক্কার দিচ্ছিল। এখন যেহেতু জেনেই ফেলেছে তার জানালার ঠিক একহাত সামনেই এক বিপরীত লিঙ্গ বসবাস করে তাই চুম্বকের ধর্ম অনুযায়ী তার মধ্যে প্রবল আকর্ষণ অনুভূত হল। কিন্তু সমস্যা হল দুইজন একটু কাছে যেতে চাইলে দুইজনেই লজ্জায় পরস্পরের আড়ালে চলে যায়।

এরপর আড়াল থেকে চলে লুকোচুরি। এই লুকোচুরি খেলা বন্ধ করতে চাইলেও কামাল বন্ধ করতে পারছে না। সে এখন পর্যন্ত মেয়েটির নাম পর্যন্ত জানতে পারলো না। দুইজন দুইজনের সামনে গেলেই প্রথম সাক্ষাতের সেই অস্বস্তিকর দৃশ্যর কথা মনে পড়ে আর দুইজনেই হাসি দিয়ে আড়াল হয়ে যায়।

মুখের ভাষা যেখানে লজ্জা পায় সেখানে চিঠি সেই লজ্জা দূর করে।

কামাল ছোট একটা চিরকুটে তার নাম এবং সেদিনের ঘটনার জন্য সরি লিখে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলো। এরপর কামালের শুরু হল অন্তিম অপেক্ষা। জানালার পাশে বসে সে অপেক্ষা করতে থাকলো কোন কিছু ছুড়ে আসে কিনা। এই অপেক্ষার মুহুর্ত তার মধ্যে এক ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করলো। অপেক্ষার প্রহর যতই দীর্ঘ হচ্ছে তার মনের অস্থিরতা ততই বাড়ছে।

তবে একসময় এই অপেক্ষার প্রহর শেষ হল। জানালার ঐপাশ থেকে আরেকটি চিরকুট ছুড়ে মারা হল। চিরকুটে কি লেখা আছে এটা পড়ার ভাবী আনন্দে কামালের চোখে আনন্দে ছলমল করে উঠলো। সময়ক্ষেপণ না করে সে বেশ দ্রুততার সাথে চিরকুটের ভাজ খুললো। সেখানে একটি হাসির ইমোটিকোন সহ তিন অক্ষরের যে শব্দটি ছিল এই শব্দটি যে একসময় তার হৃদয় মাজারে আসন গেড়ে বসবে তা তখনো কামাল বুঝতে পারেনি।


সেই তিন অক্ষরের নামটি ছিল মিথিলা। নিজের মনেই কয়েকবার মিথিলা বলে উচ্চারণ করে সে আবার চিরকুট লিখে ছুড়ে মারলো। সেখানে লিখে দিল তুমি কোন কলেজে পড়াশোনা কর? এরপর আবারও শুরু হল অপেক্ষা। কখন চিরকুটের উত্তর আসে। কিছুক্ষণ পর আবারও উত্তর আসলো।

সেই চিরকুটে লেখা ছিল তিনটি বর্ণ। ভিএনসি। এভাবেই মুখের ভাষা চিরকুটে স্থান পেয়ে তাদের যোগাযোগ চলছিল। কামালের কাছে চিরকুট আদান প্রদানের এই খেলা ছিল জগতের সবচেয়ে আনন্দের খেলা। এই খেলায় আছে টানটান উত্তেজনা এবং কি ঘটবে তা জানার আগ্রহ।

এই জিনিস সব খেলায় পাওয়া যায় না।

প্রতিবেশীর প্রতি জামাল সাহেবের অনেক বিরাগ ছিল। পাশের বাড়িতে ছয়টি যুবতী মেয়ে। যেকোন সময় যেকোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। বিকালে পাশের বাসার সেই যুবতী মেয়েরা ছাদে আড্ডা দিতে আসে তাই জামাল সাহেব তার পুত্রদ্বয়কে ছাদে উঠতে নিষেধ করেন।

সেই উঠতী ছয় যুবতী কন্যা থেকে যথা সম্ভব নিরাপদে রাখার চেষ্টা করেন তার ছেলেদেরকে। একদিন পাশের বাড়ির আওয়াল সাহেবের দুই মেয়ে ভাপা পিঠা নিয়ে তাদের বাসায় আসলো। জামাল সাহেব তার পুত্রদ্বয়কে তাদের ঘর থেকে বের হতে দিলেন না। ঘরেই বন্দী করে রেখে ঐ দুই মেয়েকে বিদায় করলেন। এছাড়াও ছেলেদের মোবাইলে বেশি টাকা ভরে দিতেন না।

মোবাইলে কার সাথে কথা বলছে তাই প্রায়ই খতিয়ে দেখতেন। এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও শেষ রক্ষা হল না। জানালার মাধ্যমে যে চিরকুটের আদান প্রদান ঘটছে তা জামাল সাহেবের চোখের অগোচরেই ঘটে গেল।

চিরকুটের নিষ্প্রাণ ভাষা একদিন প্রাণ পেল। চিরকুটের মাধ্যমে কামাল একদিন জানালো সে ভিকারুননিসা নূন কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।

সে যেন তার সাথে দেখা করে। কামালের ঐ প্রস্তাবে অপর পক্ষের মৌন সম্মতি ছিল। এই সম্মতি দেখে কামালের মধ্যে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠলো। প্রথম যেদিন তাদের দেখা হয় সেদিন তারা অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলো না। এতদিন চিরকুটে ভাবের আদানপ্রদান ঘটেছে হঠাৎ করে আজ প্রথম তার সাথে কথা বলতে যাবে।

এখন কি দিয়ে শুরু করবে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। পাশাপাশি কিছুক্ষণ হেঁটে তারা বেইলী রোডে বসলো। নিরবতার মাধ্যমেই তারা মনে মনে কিছুক্ষণ কথা বলল। কামাল মনে মনে বলল
- আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে

মিথিলা এই কথা বুঝতে পেরে একটা হাসি দিল। এরপর কামালের দিকে তাকিয়ে তার শার্টের বোতামের দিকে তাকালো।

এরপর সে মনে মনে বলল- শার্টের বোতাম সব লাগিয়ে রেখেছো কেন? একটা খুলো।
কামাল গরম লাগছে এই ভঙ্গী করে তার শার্টের একটা বোতাম খুলে ফেললো। এরপর কামাল মনে মনে বলল, তুমি এত সুন্দর কেন?
- তুমি সুন্দর করে তাকিয়ে থাকো তাই
- তোমাকে প্রতিদিন দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু আব্বু সমস্যা করে
- কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই তো পারো
- তুমি কিছু মনে করবে নাতো?
- আমি কিছুই মনে করবো না
- আচ্ছা, আমি কখনো এভাবে কোন মেয়ের সাথে দেখা করিনি। আজকেই প্রথম
- আমারও আজকে প্রথম
- আমাদের এখন কি করা উচিত
- কোথাও খেতে গেলে মন্দ হয় না। এখানে সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে
- মন্দ বলোনি।

কি খাওয়া যায়?
- আইসক্রীম
এতক্ষণের নিরব কথোপকথন কামালের সশব্দে ভেঙ্গে গেল। আর এতে মিথিলা চূড়ান্ত পর্যায়ে অবাক হল কারণ কামাল বলে উঠলো- চলো আইসক্রীম খেতে যাই। তাদের মনের এই অপরূপ যোগাযোগে মিথিলা অবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগলো সেই কি তার মনের পুরুষ যার জন্য মেয়েরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।

লেখকরা স্পেডকে যদি স্পেড বলতে না পারে তবে সমাজের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধিত হয় না। মিথিলা ও কামালের ভালোবাসার পূর্ণতা যখন পাচ্ছিল তখন একটি ঘটনা গল্পের ঘটনাপ্রবাহকে পরিবর্তণ করে ফেলে আর তা পাঠকদের অস্বস্তিতে ফেলে দিবে।

এখন স্পেডকে স্পেড বলার খাতিরে তা প্রকাশ করতেই হচ্ছে। কারণ আমাদের সমাজের চিত্রটাই এমন। আওয়াল সাহেব বিষয় সম্পত্তি ভালোই করেছেন। যে বিষয় সম্পত্তি তিনি করেছেন তা দিয়ে তার মনের সকল সাধ পূরণ করতে পারবেন কিন্তু একটি ছেলে সন্তানের আশা তার পূরণ হল না। দুইটি বিয়ে করেছেন।

১ম স্ত্রীর ঘরে চারটি মেয়ে হয়েছে। এরপর এই ঘর থেকে পঞ্চম সন্তান নেয়ার সাহস না করে ২য় বিবাহ করে ফেলেন। দ্বিতীয় ঘরে এখন পর্যন্ত দুটি কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে। মিথিলা প্রথম ঘরের সন্তান।

আওয়াল সাহেবের ২য় স্ত্রীর নাম সাবিতা।

যেমন রূপ তেমন তার চলন। সবার কাছে সাবিতা ভাবী নামেই পরিচিত ছিল। তার রূপ ও সৌন্দর্যের প্রশংসা আশেপাশের সব পুরুষ মানুষের মুখেই শুধু ছিল না অনেক উঠতি যুবকের মুখেও ছিল। সবার একটা বাসনা ছিল সাবিতা ভাবীর মত একটা বৌ পেলে জীবনে আর কি চাই? তবে সবার একটা আক্ষেপ ছিল শুধু মাত্র একটা পুত্র সন্তানের আশায় আওয়াল সাহেব এত সুন্দরী একটা হুর পরীকে বিয়ে করে ঘরে এনেছেন। পুত্র সন্তানই যখন মুখ্য তখন এত সুন্দরী বউ কেন আনার দরকার ছিল? তাও আবার দুইটা বউ।

টাকা থাকলে মানুষ কত কিছুই না করতে পারে। এলাকার মানুষ আওয়াল সাহেবের উদাহরণ দিয়ে বলে- আল্লাহ যারে ধন দেয় তারে জন দেয় না। কত কবিরাজ আর হেকিমের শরণাপন্ন হয়েও একটা পুত্র সন্তানের মুখ দেখতে পারলো না।

সাবিতা একদিন কেনাকাটা করে বাসায় ফেরার জন্য সিএনজি খুঁজছিল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও একটা সিএনজি পাচ্ছিল না।

ঠিক তখন জামাল সাহেব ঐ রাস্তা দিয়ে সিএনজি করে যাচ্ছিলেন। সাবিতা ভাবীকে একা পেয়ে জামাল সাহেব আকাশের চাঁদ যেন হাতে পেয়ে বসলেন। সাবিতার ঠিক সামনে গিয়ে সিএনজি থামিয়ে বললেন
- আরে সাবিতা ভাবী যে, কোথায় যাবেন?
- দেখন তো ভাই, বাসায় যাব কিন্তু বিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করেও সিএনজি পাচ্ছি না
- সিএনজি পাচ্ছেন না এটা কোন কথা হল, আপনি কোমল চোখে হাত দিয়ে একটু ইশারা করলে সবাই আপনাকে লিফট দিতে ছুটে চলে আসবে
- এখন কি আপনাকে কোমল চোখে হাত দিয়ে ইশারা করতে হবে ?
- হা হা, কি যে বলেন ভাবী। আমাকে ইশারা না করলেও আমি চলে আসবো
- আপনি কি বাসার দিকে যাচ্ছেন?
- আপনি যেহেতু বাসায় যাবেন এখন বাসায় না গেলেও আপনাকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে
সাবিতা কথা না বাড়িয়ে সিএনজিতে উঠে পড়ল। সে যখন সিএনজিতে উঠতে যাচ্ছিল তখন তার ধবল পেটের অনেকখানি দেখা যাচ্ছিল।

সেখানে ঢেউ খেলা করছে। জামাল সাহেবের চোখ সেই ঢেউতে আছরে পড়ল। নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে সে একটু সরে বসে সাবিতাকে বসতে দিল। জামাল সাহেব নিজেকে অনেক ধন্য মনে করছে। এলাকার মানুষ যার জন্য পাগল।

যার রূপের প্রশংসা সবার মুখে মুখে সেই সাবিতা ভাবী তার পাশে বসে আছে। এই ঘটনা ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কামালের মা জানতে পারলে তাকে ঝাড়ু পেটা করে বাসা থেকে বিদায় করবে। জগতের এই এক কঠিন নিয়ম। সকল উচ্ছ্বাস ঢোল পিটিয়ে বলা যায় না।

জামাল সাহেব মনে মনে কথা সাজাচ্ছেন।

কিভাবে কথা শুরু করবেন। এরপর মুখে হাসিমুখ এনে তিনি জিজ্ঞেস করলেন
- ভাবীকে দেখলাম ছাদে বড়ই শুকিয়ে দিয়েছেন
- জ্বী ভাই, আঁচার বানাবো
- ভাবী মনে হয় ভালো আঁচার বানাতে পারেন।
- ভালো এই কথাটা আপনিই প্রথম বললেন। ভালো আঁচার বানিয়েও আপনার আওয়াল সাহেবের মন পেলাম না
- ওনার মন পেতে হলে ওনাকে পুত্র সন্তান উপহার দিতে হবে
- কিন্তু ভাই, ওটা কি আমার হাতে? ভাই তো মনে হয় জানেন, এক্স এক্স আর এক্স ওয়াই এর কাহিনী।
- সেটাতো জানি
- কিন্তু এই জিনিসটা তো আপনাদের ভাই বুঝতে চায় না।

কন্যা সন্তান হলে আমার উপর দোষ দেয়। তার যে ওয়াই শুক্রানু দুর্বল সেটা সে বুঝতে চায় না। আমাকে লোভ দেখিয়ে পুত্র সন্তান সে চায়। বলে পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারলে সে উত্তরায় একটা ফ্লাট কিনে দিবে।
- ভাবী, আমি আপনার দুঃখটা বুঝি।

আপনার এত রূপ লাবণ্য কিন্তু আওয়াল সাহেব এর দামই দিচ্ছে না।
- আমার দুঃখটা কেউ বুঝতে চায় না বুঝলেন ভাই। সবাই ভাবে সাজগোজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কেনাকাটা করছি, আমি অনেক সুখে আছি। আমি ভাই সুখে নাই।
- বুঝতে পেরেছি ভাবী।


এভাবে কথা বলতে বলতে সিএনজি যখন এলাকার কাছাকাছি এলো তখন জামাল সাহেব সিএনজি থেকে নেমে পড়লেন এরপর বললেন- ভাবী, একা যান, এলাকার মানুষ দেখলে খারাপ কিছু ভাববে।
সাবিতা জামাল সাহেবের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেল। একটা অমায়িক হাসি দিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আর এদিকে জামাল সাহেবের বুকে একটা চিনচিন ব্যথা অনুভূত হল। এই ব্যথা হৃদয়ক্ষরণের ব্যথা।



একদিন জামাল সাহেব বাসায় একা ছিলেন। তখন দরজায় একজন কলিংবেল বেজে উঠলো। জামাল সাহেব পিপহোল দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন পাশের বাসার সাবিতা ভাবী। জামাল সাহেব যেন আবারও আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেলেন। দরজা খুলে হাসিমুখে বলে উঠলেন,
- আরে সাবিতা ভাবী যে
- বড়ই আঁচার নিয়ে আসলাম।

প্রতিবেশী মানুষ আপনারা। আপনাদের না দিয়ে কিভাবে খাই?
- প্রতিবেশি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বললে সেটা ঘরের জন্য অমঙ্গল। আগে ঘরে আসেন, বসেন তারপর কথা বলি
- হাহা, মঙ্গল, অমঙ্গল বুঝনে দেখি। তা ভাবী কোথায়? ওনাকে তো দেখি না। শুধু আপনার সাথে বেশি কথা হয়।


- ছেলেসহ আপনাদের ভাবী তার ভাইয়ের বাসায় গিয়েছে
- তা, আপনি গেলেন না
- নতুন বাড়ির কাজ ধরেছি। দেখাশোনা করা লাগে
সাবিতা সোফায় গিয়ে বসল। জামাল সাহেবও তার পাশে গিয়ে বসল। সাবিতার দিকে তাকিয়ে একটু পর পর মুচকি হাসি দিয়ে এক প্রাগৈতিহাসিক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছিল তা সাবিতা বুঝতে পারছিল না কিনা তা বোঝা যাচ্ছিল না। সাবিতা আঁচারে বাটি সামনে রেখে বলল,
- ভাই, একটু আঁচার চেখে দেখেন তো কেমন হল?

জামাল সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে আঁচার তুলতে গিয়ে আঁচারের ঝোল চোখে লাগিয়ে ফেলে।

চোখের জ্বালা পোড়ায় যখন উহ আহ করছিলেন তখন সাবিতা গ্লাস থেকে পানি ঢেলে চোখ মুছে দিল এরপর আঁচল দিয়ে চোখ মুছে দিল। সাবিতা যখন চোখ মুছ ছিল তখন তার পুরুষ্ট বুক জামাল সাহেবের মুখের কাছাকাছি চলে আসছিল। সাবিতার উষ্ণ পরশে জামাল সাহেবের নিঃশ্বাস ভারি থেকে ভারি হল। এই ভারি নিঃশ্বাসের অর্থ সকল মানুষই বুঝতে পারে। এরপর কি করতে হবে এরজন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন নেই।

মানুষের মস্তিষ্কে তা জন্মের পরেই গেঁথে থাকে। জামাল সাহেব ও সাবিতা সেই জন্মসূত্র জ্ঞানের পূর্ণ প্রতিফলন দেখালো।

আচ্ছা প্রেম কিভাবে হয়? পাশাপাশি একসাথে চললে, কথা বললে, একসাথে খেলে তবে কি প্রেম হয়? না, প্রেম এভাবে হয় না। প্রেম শুরু হয় চোখ থেকে। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে।

দুইজনের চোখাচুখি যখন হবে তখন দুইজন একটি হাসি দিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলবে এরপর আবার চোখাচুখি হবে। এই চোখাচুখি থেকে প্রেমের শুরু হয়। আর যে প্রেম চোখ থেকে শুরু হয় সেটাই প্রকৃত প্রেম কারণ চোখ যে মনের কথা বলে। কামাল আর মিথিলার প্রেম এভাবেই শুরু হয়েছিল। আর তাদের প্রেমের নিরাপদ স্থান ছিল তাদের ঘরের বাতায়ন।

এই বাতায়ন দিয়ে দুটি চোখের যে ভাষা আদানপ্রদান হত তার অর্থ শুধু এই দুটি প্রানীই বুঝত।

প্রেম আর ধূমপানের অভ্যাস কখনো গোপন রাখা যায় না। এই গোপনীয়তা ফাঁস হয় প্রেমের প্রশ্রয় থেকে। কামাল ভালো গিটার বাজাতে পারত। প্রায়ই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মিথিকে গিটার বাজিয়ে শোনাত।

সেদিন ছিল পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় চারিদিকে যেন বাণ ডেকেছে, চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে। এই চাঁদকে বলা হয় প্রেমের চাঁদ। এই চাঁদের আলো হৃদয়কে অনেক আবেগ তাড়িত করে। এই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এর চূড়ান্ত ফলাফল হয় কামলীলা।

এক হাত ব্যবধানের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেদিন কামাল মিথিকে গিটার বাজিয়ে শোনাচ্ছিলো কিন্তু মিথির মন পড়ে ছিল আকাশের চাঁদের দিকে। সে বলে উঠল
- আকাশে কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে। মনে হচ্ছে চাঁদের আলোয় নিজেকে সপে দেই। চলো না ছাদে যাই?
- মাথা খারাপ, এত রাতে কেউ ছাদে যায়?
- আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকবো আর তুমি আমাকে গিটার বাজিয়ে শোনাবে
- পাগলামী করো না
- এটাকে তুমি পাগলামী বলছো কেন? তুমি ভালোবাসার কিছুই বোঝ না। তুমি আমি পাশাপাশি বসে চাঁদ দেখবো।

তুমি গিটার বাজাবে আমি গুণগুণ করে গান গাবো- চাঁদের হাঁসি বাধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো ও রজনী গন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো। উফ ভাবলেই কেমন যেন ভালোবাসা জেগে উঠছে।
- এত রাতে কেউ আমাদের দেখে ফেললে সমস্যা হবে। তুমিই আমার চাঁদ। তোমাকে দেখলেই আমার চাঁদ দেখা হয়ে যাবে।

আকাশের চাঁদ আর দেখা লাগবে না।
- হয়েছে ভীরু কোথাকার। আসলে তোমার সাহস নেই। আর এত রাতে কে ছাদে আসবে? চলো না দুইজন মিলে চাঁদ দেখি?
- তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। আচ্ছা চল কিন্তু একটা শর্ত আমাকে চুমু খেতে হবে
- চাঁদের আলোয় চুমু! এই আইডিয়া আমার মাথায় আসেনি।

তুমিও দেখি অনেক রোমান্টিক!

আকাশের চাঁদের কারণে জোয়ার ভাটা হয়। সে তার আকর্ষণে পৃথিবীর জলকে তার দিকে টেনে নেয়। এই আকর্ষণে মানুষের হৃদয় গহীনে জমে থাকা দুঃখের জল, প্রেমের জল তারাও আকর্ষিত হয়। তাই পূর্ণিমা রাতে দুঃখী এবং প্রেমী এই দুই ধরনের মানুষ দেখতে পাওয়া যায় যারা চাঁদের আকর্ষণে ছুটে আসে। কামাল আর মিথিলা ছুটে এসেছে কারণ তাদের হৃদয় গহীনে প্রেমের জল সঞ্চিত আছে কিন্তু তাদের বাসাতে একজন মানুষ আছে যে দুঃখের জল বহন করে চলছে তা তারা জানতেও পারেনি।

জানলে হয়ত চাঁদের আকর্ষণে ছাদে আসত না।

আকাশে চাঁদ তার আলোর বন্যা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই আলোর বন্যায় গোসল করছে পাশাপাশি ছাদে থাকা দুই কপোত-কপোতী। এইদিকে রূপ ও সৌন্দর্যে ভরপুর সাবিতা তার রূপের মূল্য না পেয়ে দুঃখের জল খুলে বসেছে। চাঁদের আকর্ষণে তার দুঃখের জল আকর্ষিত হয়ে তাকে ছাদে টেনে নিল।

তার ইচ্ছা ছিল ছাদে বসে বসে চাঁদের সাথে দুঃখ ভাগাভাগি করবে। কিন্তু ছাদে যে তারজন্য এমন চমক থাকবে সে বুঝতেও পারেনি। ছাদে উঠে সে চুম্বনরত দুই ছায়া দেখতে পেল। প্রথম দিকে এই দৃশ্য দেখে তার দুঃখ চলে গেলেও পরক্ষণে তার প্রেমের জল যখন আকর্ষিত হল তখন তার আবার দুঃখ ফিরে এল। তার প্রেমের জলে সাঁতার কাঁটার মত এখন কেউ নেই।

সেই জলে এখন শ্যাওলা জমে গেছে।

তাদের আলিঙ্গণে কোন বাঁধা না দিয়ে সাবিতা নীরব দর্শক হয়ে কিছুক্ষণ থেকে সেখান থেকে বিদায় নিল। এরপরেই তার মনে হল এর পরিণতি শুভ নয়। তাই সে কামালের বাবা জামাল সাহেবকে সব কিছু খুলে বলল। জামাল সাহেব ছেলের এমন পরিণতি দেখে বিস্মিত হলেন।

এই সম্পর্ক কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। যে বাড়ির বউ এর সাথে তিনি নিজেই সহবাস করেছেন এখন সেই বাড়ির মেয়ের সাথে তিনি নিজের ছেলের বিয়ে দিবেন? এটা বিবেকে বাধে। রুচিতেও আসে না। কিন্তু এই কথা শুধু কামাল কেন কাউকে বলা যাবে না। এটা রাখতে হবে অতি গোপন।



চাঁদের আলো প্রেমের গভীরতা বাড়াতে অনেক সাহায্য করে। সেদিনের চাঁদের আলোয় তাদের প্রেম গভীরতা পেলেও এখন এই বিষয়ে সবাই জেনে গেছে। জামাল সাহেব মিথির বাবাকে সব কিছু খুলে বললেন। আওয়াল সাহেব সাথে সাথে মিথির ঘর পরিবর্তণ করে দিলেন। ফলে জানালা দিয়ে প্রতিদিন যে চোখাচুখি হত, ভাবের আদান প্রদান হত তা বন্ধ হয়ে গেল।

কামাল আর মিথির প্রেমে ঝড় শুরু হল তখন। সেই সাথে কামালের প্রেমের পরীক্ষা শুরু হল।

কামালের প্রেমের পরীক্ষা দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হল। প্রতিদিনের হাত খরচের জন্য যে টাকা দেয়া হত সেটা কমে গেল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে যে নিরাপদ কথাবার্তা হত তা বন্ধ হয়ে গেলে ফলে তারা কলেজের সামনে গিয়ে কথা বলত।

কিন্তু হাত খরচ না দেয়ার কারণে কামালের জন্য কষ্ট হয়ে যেত।

প্রেমের ক্ষেত্রে ছোট ভাই বা বোন অনেক উপকারে আসে। কামালের হাত খরচ যখন কমিয়ে দেয়া হল তখন কামালের ছোট ভাই মামুন বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে তা বড় ভাইকে দিত। এভাবেই চলছিল তাদের প্রেম। কিন্তু প্রেমে যখন একবার ঝড় আসে তার রেশ থেকেই যায়।

একদিন জামাল সাহেব রিকশায় মিথি আর কামালকে দেখে ফেলে। এরপর ছেলেকে শাসন করতে গেলে ছেলেও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। মিথিকেই সে বিয়ে করবে বলে বাবাকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেয়। তাদের এই সম্পর্ক মেনে নেয়া কখনো সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় এই প্রশ্ন যখন কামাল জিজ্ঞেস করে তখন জামাল সাহেব থতমত খেয়ে যান।

কেন সম্ভব নয় তাতো অতি গোপন। এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে তার সংসারই থাকবে না। তাই তিনি বানিয়ে বানিয়ে বলতেন- আওয়াল সাহেব লোকটা ভালো না। দুইটা বিয়ে করেছে। তখন কামাল বলত- দুইটা বিয়ে করেছে তো কি হয়েছে।

বৈধভাবেই বিয়ে করেছে। আর এমন না যে দুই বউকে খাওয়াতে পারছে না। আওয়াল সাহেব কেমন তাতো আমার জানা দরকার নেই। মিথি ভালো মেয়ে এটাই আমার জানা দরকার।
কামালের যুক্তিতে ও পছন্দে কামালের মা সায় দিলেও জামাল সাহেব সায় দিচ্ছিল না।

এরপর কামাল রাগ করে বাসা থেকে চলে যায়। দুইদিন পরেও যখন কামাল বাসায় ফিরছিল না তখন কামালের মা ঘরে অনশন শুরু করেন। তিনি কামালের সাথে মিথির বিয়ে দিবেন। কামালের মায়ের পীড়াপীড়িতে জামাল সাহেব অবশেষে রাজি হলেন। কিন্তু বিবেকের দংশনে বারবার জ্বলছিলেন।

তিনি নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে যুক্তি দাঁড় করালেন- সাবিতা ভাবী মিথির সৎ মা। তার সাথে সেদিন কি ঘটেছে এটা নিছক দূর্ঘটনা। তারা পরিস্থিতির শিকার। সাবিতা ভাবী আর তাদের সম্পর্ক মিথি আর কামালের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত না।

নিজের মনকে নিজের যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে তিনি কামালকে খুঁজে নিয়ে আসলেন।

কামালকে বললেন- মিথির সাথেই তার বিয়ে দিবেন কিন্তু শর্ত আগে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হবে এরপর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তিনি মিথির বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। কামাল পিতার প্রস্তাবে সায় দিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলো।

এভাবে তিন চারমাস কেটে যাবার পর একটি বিরাট ঘটনা ঘটে গেল। এলাকার সবার মুখে মুখে সেই ঘটনা। আওয়াল সাহেব রবার্ট ব্রুস এর মত ছয়বার ব্যর্থ হয়ে সাত বারের মাথায় বিজয়ী হয়ে পুত্র সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছেন।

পুত্র সন্তানের আগাম সংবাদে এলাকার সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হল। সবার মুখে মুখে আওয়াল সাহেব এর বন্দনা। যাক এতদিনে আওয়াল সাহেব এর সম্পত্তির একটা কূল কিনারা হল। তার বংশ রক্ষা হবে। আর এই বংশ রক্ষা যে করলো সেই সাবিতা ভাবীর প্রশংসাও থেমে থাকলো না।

যাক সাবিতা ভাবী তাহলে উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট পাচ্ছেন। পুত্র সন্তানের খবরে এলাকার সবাই খুশি হলেও দুইজন মানুষ খুশি হতে পারেনি। এই দুইজন মানুষ হল সাবিতা ভাবী আর জামাল সাহেব। একদিন সাবিতা জামাল সাহেবকে জানালো তার গর্ভের পুত্র সন্তানের জনক হচ্ছে সে। জামাল সাহেব এই খবরে বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

দুঃখ বিষাদে ওনার মনে ভরে উঠল।

মানুষ পালিয়ে বেড়ায় অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে। জামাল সাহেব তার যৌন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সাবিতা ভাবীর প্রতি যে অপরাধ করে ফেলেছে এরজন্য তিনি সাবিতার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইলেন। ঐ বাড়িতে ছেলের বিয়ে দিলে আরও কাছে আসা হবে। তাই তিনি হিসাব নিকাশ করতে লাগলেন কিভাবে ছেলেকে এই প্রেম থেকে ফেরানো যায়।

কামালের মা এই বিয়েতে রাজি কিন্তু তিনি যে রাজি না এই কথা বোঝাতে পারছেন না।

কামালের পরীক্ষা শেষ হল এরপর সে একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হল। এদিকে আওয়াল সাহেবেরও পোয়া ভারি। তার ঘরে পুত্র সন্তান এসেছে এখন তিনি সংসারের প্রতি নাকি মনোযোগ দিচ্ছেন। মেয়েদের বিয়ের ব্যপারে তোরজোড় শুরু করেছেন।

পুত্রকে দেয়া প্রতিশ্রুতির মত তিনি কামালের মা সহ মিষ্টি নিয়ে গেলেন আওয়াল সাহেব এর বাসায়। মিষ্টি হাতে দেখে আওয়াল সাহেব বলে উঠলেন

- আরে জামাল ভাই যে, মিষ্টি আপনি এনেছেন কেন? মিষ্টি তো দিবো আমি
- এত সাধনার জিনিস আর খুশির খবর মিষ্টি ছাড়া কি দেখতে আসা যায়
- হা হা, তা বলেছেন ভাই, সাত বারে গিয়ে সফল হলাম। পুত্র সন্তান ছাড়া বংশ রক্ষা হবে কি করে?
- তা পুত্রকে দেখান। দেখি পুত্রের চাঁদমুখ খানা
- কই গো সাবিতা, আমাদের চাঁদের কনাকে এখানে নিয়ে আসো
সাবিতার নাম শুনেই জামাল সাহেব কেমন যেন ইতস্তত করে উঠলেন। এতক্ষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে যে অভিনয় করলেন তা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল।

সাবিতাও ধীরে ধীরে তার সন্তানকেও নিয়ে আসলো। জামাল সাহেব ভুলে যেতে চাইলেও ভুলতে পারছেন না এই সন্তানের জনক হচ্ছেন তিনি। তার বীর্য থেকে এই সন্তান ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। নিজের বীর্যের প্রতি একটা আকর্ষণ তো অবশ্যই থাকবে। তিনি যতই চাচ্ছেন এই আকর্ষণ উপেক্ষা করতে কিন্তু পারছেন না।

নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য তিনি শরবৎ এর গ্লাস মুখে নিলেন। ধীরে ধীরে শরবৎ চুমুক দিচ্ছেন। কামালের মা বাবুটিকে কোলে নিয়ে চুমু দিলো এরপর যখন বললো

- কার মত দেখতে হয়েছে ?

তখনই জামাল সাহেব এর গলায় শরবৎ আঁটকে গেল। অনবরত হেচকি উঠতে লাগলো। পানি খেয়েও হেচকি তিনি থামাতে পারছেন না।

এই দেখে আওয়াল সাহেব বললেন
- কি ভাই, আমার চাঁদের কণার সৌন্দর্য দেখে হেচকি উঠে গেল নাকি?
জামাল সাহেব হেচকি থামিয়ে বললেন- জ্বী ভাই, আসলেই চাঁদের কনা। আল্লাহ আপনার ঘর আলো করে ওকে পাঠিয়েছে।
- আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। সাত বারের চেষ্টায় সফল হয়েছি। আমার টাকা পয়সার সমস্যা নাই।

বেশি সন্তান নিলে সমস্যা কি? ভাই একটু কোলে নিয়ে দোয়া করে দেন।

জামাল সাহেব শিশুটিকে কোলে নিলেন। এই সন্তান হচ্ছে তার। ঠিক তার মত চেহারা হয়েছে। তিনি শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

শিশুটিও হয়ত বুঝতে পেরেছে সে তার বাবার কোলে উঠেছে কারণ শিশুটি তার বাবার কোলে হিসু করে দিল। জামাল সাহেব এই দেখে হাসি দিয়ে বললেন- আমার দুষ্টু বাজান, শিখে গেছে কার কোলে হিসু করতে হবে। এই কথার অর্থ শুধু সাবিতা ভাবী আর জামাল সাহেবই বুঝলেন। এরপর শিশুটিকে সাবিতার কোলে তুলে দিলেন তখন কামালের মা আওয়াল সাহেবের উদ্দেশে বলে উঠলো,
- ভাই সাহেব, আমরা আরেকটা কারণে আপনার বাসায় এসেছি।
- কি কারণ ভাবী?
- আমাদের মিথি মামুনীকে আমাদের ঘরে তুলে নিতে চাই
এই প্রস্তাব শুনে আওয়াল সাহেব মুখ কালো করে ফেললেন।

আওয়াল সাহেবের মুখ ভার দেখে জামাল সাহেবের মন হাসিতে ভরে উঠলো। যেভাবেই হোক এই বিয়ে আটকাতে হবে। এই বাড়ি থেকে যতই দূরে থাকা যায় ততই ভালো। মায়ার বাধনে আঁটকে গেলে একদিন আসল সত্য ফাঁস হয়ে যাবে। আওয়াল সাহেবের মুখ গম্ভীর দেখে কামালের মা বলে উঠল,
- আমরা প্রতিবেশী মানুষ, কাছাকাছি থাকলাম।

আর আমাদের কামাল এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। দেখতে মাশাআল্লাহ। দুইজনকে ভালোই মানাবে।

আওয়াল সাহেব বলে উঠলেন, দেখুন ভাবী। আমি সোজা কথার মানুষ।

সোজা ভাষায় সরাসরি বলে দেই। এই বিয়ে সম্ভব না। আপনারা প্রতিবেশী মানুষ প্রতিবেশী হয়েই থাকেন। মিথির বিয়ে আমি ঠিক করে রেখেছি অন্য জায়গায়। আমরা মন্ডল বংশের লোক।

আমাদের মুখের জবানের একটা দাম আছে। বন্ধুর পুত্র এর সাথে বিয়ে দেবার জন্য বন্ধুকে জবান দিয়ে রেখেছি। কামালের মা বললেন,
- কিন্তু মিথি আর কামাল একজন আরেকজনকে পছন্দ করে।
- এই রকম প্রেম বিয়েও আগে আমিও অনেক করেছি। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে গেছে।

মিথি বাচ্চা মাইয়া। ও প্রেমের কি বুঝে
এতক্ষণ পর জামাল সাহেব কথা বলে উঠলেন। তিনি জোর না দিয়ে ভদ্রতা করে বলে উঠলেন- জবান অবশ্যই রক্ষা করা উচিত। তবে মিথির সাথে কামালের বিয়ে হলে দুইজনেই সুখে থাকত।
- ভাই, সুখ হল মনের ব্যপার।

মনকে বুঝালেই সুখে থাকা যায়। আর সত্য কথা বলি, আপনার ছেলেকে আমার বিশেষ পছন্দ না। মুরুব্বি দেখলে সালাম দেয় না
- আধুনিক ছেলেতো
- হোক আধুনিক, ওর বাপ মা ওরে আদব কায়দা শেখাবে না ?
- ভাই, আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।
- অপমান কিসের। উচিত কথা বলছি।

আমার সাতটা সন্তান। আল্লাহর রহমতে কেউ বলতে পারবে না, আমার মেয়েগুলো খারাপ। আদব কায়দা জানে। মুরুব্বিদের সালাম দেয়।
- বিয়ে দিবেন না ভালো কথা, জ্ঞান দিতে আসেন কেন? নিজে হাঙ্গা করে বসে আছেন আর আমাকে জ্ঞান দিতে আসেন।


এরপর পারস্পরিক যে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি হয় তা শালীন ভাষায় এখানে প্রকাশ করা সম্ভব না। আর এই অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহারে জামাল সাহেব মুখিয়ে ছিলেন। তিনি একটা সুযোগ খুঁজতেছিলেন এগুলো প্রয়োগ করার।

ঘটনার সাথে সাথে।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।