আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাহাড়ীদের প্রাণের উৎসব বৈসাবি

পাহাড়ে শুরু হলো প্রাণের উৎসব বৈসাবি। পাহাড়-হ্রদ আর অরণ্য ঘেরা রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণে উদ্‌যাপন করা হয় বৈসাবি উৎসব।

চাকমারা এ উৎসবকে ‘বিঝু’, ত্রিপুরাদের ভাষায় ‘বৈসুক’, মারমাদের ভাষায় ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যাদের ভাষায় ‘বিসু’ এবং অহমিয়াদের ভাষায় বলা হয় ‘বিহু’। তবে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা- এই তিন নৃগোষ্ঠীর উৎসবের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে পাহাড়িদের এই উৎসবের নামকরণ হয়েছে ‘বৈসাবি’।
তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা ‘ফুল বিঝু’, দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিঝু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যা পোজ্যা দিন’ বলে।



ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে ‘হারিকুইসুক’ দ্বিতীয় দিনকে ‘বুইসুকমা’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘বিসিকাতাল’ নামে অভিহিত করে থাকে।

বৈসাবি উৎসব ঘিরে তিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পাহাড়িরা নানান আয়োজনে উদ্‌যাপন করে তাদের সবচেয়ে বড় এই সামাজিক উৎসব।

বৈসাবি উপলক্ষে রাঙামাটিতে গত ৯ এপ্রিলের প্রথম প্রহরে বৈসাবি উদ্‌যাপন কমিটির উদ্যোগে বের হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। বৈসাবি উপলক্ষে রাঙামাটিতে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠান।

শুক্রবার বিকেল ৩টায় রাঙামাটি স্টেডিয়ামে ঐতিহ্যবাহী বলি খেলা। শনিবার সকাল সাড়ে ৬টায় রাজবাড়ী নদীঘাটে বৈসাবি উদ্‌যাপন কমিটির পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছে পানিতে ফুল ভাসানো উৎসব।

একই দিন ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পানিতে ফুল ভাসানো ও বয়স্কদের স্নান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে গর্জনতলীর ঘাটে। এ ছাড়াও আয়োজন করা হয়েছে ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গড়াইয়া নৃত্যানুষ্ঠান।

১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার বৈসাবি উপলক্ষে মারমা সংস্কৃতিক সংস্থার (মাসস) উদ্যোগে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী পানি খেলা উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

প্রতিবছরই সংস্থাটি এ অনুষ্ঠান করে থাকে।

বৈসুক : ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় উৎসব বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্রের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন উদ্‌যাপন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথম দিনকে তারা বলে ‘বিসিকাতাল’।



উৎসরে প্রথম দিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। গৃহপালিত সব প্রাণী ছেড়ে দেওয়া হয় খুব ভোরে।

পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ছেলেমেয়েরা। ছেলেমেয়েদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরয়া’ নৃত্য দল গ্রামের প্রতি ঘরের উঠোনে নৃত্য পরিবেশন করে। প্রত্যেক ঘরের উঠোনে ‘গরয়া’ নৃত্য শেষে শিল্পীদের মদ, মুরগির বাচ্চা, চাউল প্রভৃতি দেওয়া হয়। এসব পেয়ে নৃত্যশিল্পীরা গৃহস্থকে আশীর্বাদ করেন।

নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরয়া দেবতার পূজা করেন। কোনো শিল্পী যদি একবার এই নৃত্যে অংশ নেন, তবে তাকে তিন বছর পর পর অংশ নিতে হয়। নয়তো তার অমঙ্গল এমনকি মৃত্যুও হয় বলে প্রচলিত বিশ্বাস। এই লোকনৃত্যে ১৬ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারেন। এ নৃত্য দেখতে সারা দেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিড় করেন।



সাংগ্রাই : বৈসাবি উৎসবের ‘সা’ অক্ষরটি অন্যতম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেওয়া। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই। বছরের শেষ দুই দিন এবং নববর্ষের প্রথম দিন এ উৎসব উদ্‌যাপন করা হয়। সাংগ্রাই উৎসব উদ্‌যাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা বানাতে চালের গুঁড়া তৈরি করেন। এই সময় ‘জলখেলা’ হয়।

সাংগ্রাই উৎসব এবং জলখেলা এখন যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে গেছে। এই খেলায় যুবক-যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছোড়েন। ভিজিয়ে দেন পরস্পরকে। এ ছাড়া, মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শোনেন।

চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে এই উৎসব হয়।

সেজন্য সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়।

বিঝু : পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা সংখ্যায় বেশি। বিঝু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনূভূতি আর মোহনীয় আবেশ। এই উৎসবে সাড়া পড়ে যায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ‘ফুলবিঝু’।

এই দিন বিঝুর ফুল তোলা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। পরে সে ফুল দিন শেষে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিঝুর সময় ছোট ছেলেমেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের সম্ভাষণ করেন এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান, চাল ছিটিয়ে খেতে দেওয়া হয়। এই সময় ঘরে ঘরে রান্না হয় ‘পাজোন’।

এটি চাকমাদের বিখ্যাত খাবার। হরেক রকম সবজি দিয়ে রান্না করা হয় এই পাজোন। এই উৎসবে সবার প্রিয় খাবার এটি। ছেলেমেয়েরা ঘিলা খেলা, গুদু (হা-ডু-ডু) খেলায় মেতে ওঠে। তারা আকাশপ্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে।

বয়স্করা মদ ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ পান করেন। বিঝু উৎসবের সময় কোনো প্রাণী হত্যা করা হয় না। তবে নববর্ষের দিন মজার মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছরই ভালো খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস করেন তারা।

প্রতিবছর বৈসাবি উৎসব আসে।

নব আনন্দে জাগে পাহাড়িদের প্রাণ। সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলে বসে মিলনমেলা।

সূত্র: প্রথমবার্তা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।