আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপয়া - ২

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। অপয়া - ২ মোহাম্মদ ইসহাক খান উত্তরপাড়ার সাথে দক্ষিণপাড়ার ফুটবল খেলা হচ্ছে। বর্ষার মাঝামাঝি, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।

মাঠ কাদায় মাখামাখি, প্যাচপ্যাচে কাদায় সবাই একটু পর পর আছাড় খেয়ে পড়ছে। ছেলেপুলেরা গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পড়ে নেমেছিল। উত্তরপাড়ার গেঞ্জির রং ছিল সাদা, আর তাদের প্রতিপক্ষের ছিল কালো। কিন্তু কাদায় গড়াগড়ি আর বল কাড়াকাড়ি করার ভীষণ লড়াইয়ের চোটে সবাই এখন ভূতের মতো হয়ে গেছে, কাউকে আর আলাদা করে চেনার উপায় নেই, সবার রং এখন কাদার মতোই হয়ে গেছে। অল্প হলেও দর্শক আছে।

মাঠের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। ওদের বয়সী ছেলেপুলেরাই দর্শক। তুমুল সমর্থন যোগাচ্ছে। মার্‌ মার্‌, উড়িয়ে দে, শুইয়ে দে, ভর্তা বানিয়ে দে - এই জাতীয় মাথা গরম করা স্লোগান দিয়ে দলকে উৎসাহ দিচ্ছে। পাড়ার মাঠ, পাড়ার ছেলেপুলেরা খেলছে।

বৃষ্টি মাথায় করে নিশ্চয়ই কোন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এই খেলা দেখতে আসবেন না, কাজেই গালাগালিতে কোন লাগাম নেই। নিজেদের অনুকূলে কোন সিদ্ধান্ত এলে রেফারি মফিজ ভাইকে সবাই সাধুবাদ জানাচ্ছে, আকাশে তুলছে, আবার বিপক্ষে কোন সিগন্যাল দিলেই গালিগালাজ করে ধুয়ে দিচ্ছে। এরা সবাই পাড়ার লোকের কাছে দুষ্টু ছেলের দল নামে পরিচিত, কিন্তু ওদের কাছে এই খেলাটাই "মর্যাদার লড়াই"। প্রতি বছর কয়েক দফা মুখোমুখি হয় উত্তরপাড়া আর দক্ষিণপাড়া। কেউ কাউকে ছাড় দেয় না, সমানে সমান; কোনবার উত্তর জেতে, কোন বার দক্ষিণ।

কাজেই কে শ্রেষ্ঠ, সেটা নিয়ে একটা ঘাপলা এবং দ্বিধা রয়েই গেছে। অবশ্য সবারই ধারণা, তারাই সেরা। ফুটবলটা তারাই খেলে, প্রতিপক্ষ শুধু জানে লাথি মারতে। প্রত্যেকেরই মাথায় একটাই চিন্তা, প্রতিপক্ষের নাকে ঝামা ঘষে দিতে হবে, এক হালি গোল দিতে পারলেই থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যাবে ওদের। কিন্তু সমান শক্তি হওয়াতে প্রায় সময়ই গোলশূন্য ড্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ওদেরকে।

আজও দুই দল মরণপণ লড়াই করছে, একটা গোল দেয়ার জন্য। একটা, একটামাত্র গোল দিলেই, বলটা গোললাইন পার করতে পারলেই স্বস্তি, তারপর সবাই নিচে নেমে এসে এগারোজন মিলে মাটি কামড়ে গোলপোস্ট রক্ষা করবে। কোনমতে নব্বই মিনিট পার করে দিতে পারলেই জয় এসে যাবে হাতের মুঠোয়, কেল্লা ফতে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বল একবার এদিকে যাচ্ছে, আরেকবার ওদিকে।

একবার উত্তরপাড়ার মতিন গুলির মতন একটা শট নিলো গোলপোস্ট লক্ষ করে, গোলকিপার ফজলের কোন উপায়ই ছিল না ওটা ঠেকানোর, কিন্তু বারে লেগে ফিরে এলো বলটা, ঢুকতে গিয়েও ঢুকল না, নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হল মতিনের। সাথে সাথে বল নিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে গেল দক্ষিণপাড়া। এবার এই দলের টুলু একটা শট নিলো, কিন্তু বিধিবাম, পোস্টের ইঞ্চি কয়েক বাইরে দিয়ে চলে গেল বল। এতক্ষণ ধরে লাথিগুঁতো খেয়ে বেচারা ফুটবলটার কী দশা কে জানে! দুই দলের সমর্থকেরাই এতক্ষণ ধরে হই হই করে আসছে, উৎসাহ দিয়ে আসছে নিজের দলকে, কিন্তু তারাও মনে হয় কিঞ্চিৎ ক্লান্ত এবং বিরক্ত। ফুটবল গোলের খেলা, গোলই যদি না হল তাহলে আর মজা রইলো কোথায়? দুই দলেই কিছু দুষ্টু খেলোয়াড় আছে, তারা খেলোয়াড়ের ভাব ধরে থাকলেও সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, কীভাবে একটা গোলমাল লাগিয়ে দেয়া যায়।

কাজেই যখন উত্তরপাড়া "বিপক্ষের কারো কেশাগ্র স্পর্শ না করা সত্ত্বেও" একটা ফ্রি কিক পেয়ে গেল, তখন দক্ষিণপাড়ার কয়েকজন বিপুল বিক্রমে ধেয়ে গেল রেফারির দিকে। মফিজ ভাইকে এই মারে তো সেই মারে। এদিকে উত্তরপাড়া তো রেগে আগুন। একটা যথার্থ সিদ্ধান্ত, "ক্লিন" ফ্রি কিক, সেটা মানবে না কেন? ধেয়ে গেল ওরাও। প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপর হাতাহাতি।

এক মিনিটেই সেটা খণ্ড প্রলয়ে রূপ নিলো, যখন দর্শকরাও এসে হাত লাগাল। বলা বাহুল্য, বেগতিক দেখে প্রথমেই রেফারি সাহেব চম্পট দিয়েছেন। কখন যে তিনি সরে গেছেন, কেউ জানতেও পারে নি। খানিকক্ষণ ধরে দেখা গেল, ছেলেপুলেরা একজন আরেকজনের গায়ের ওপর চড়ে বসে কাদায় গড়াগড়ি করছে, মারপিট করছে; একেকজনের মুখ খিস্তি করে গালিগালাজ, মার দেয়া আর মার খাওয়ার ধুপধাপ শব্দ ভেসে আসছে। একসময় কোথা থেকে যেন উত্তরপাড়ার ছেলেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে এলো, আর বেদম মারতে লাগলো প্রতিপক্ষকে।

দক্ষিণপাড়ার ছেলেরা হাতাহাতি লড়াইয়ে সমান পারঙ্গম, কিন্তু লাঠির মুখে টিকতে পারলো না কিছুতেই। শেষে দেখল যে শুধু মার খেয়ে গেলে এখানেই পটল তুলতে হবে, কাজেই তারা জান নিয়ে কোনমতে একটু ফাঁক গলে পালিয়ে এলো। উত্তরপাড়ার ছেলেরা হর্ষধ্বনি সহকারে বিপক্ষকে মাঠের বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে এলো। রানার কপাল ফুলে গেছে, আর নাক ফেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে সাংঘাতিক। মানিককে পাঠানো হল বরফ নিয়ে আসতে, রক্ত বন্ধ করতে হবে।

মানিক ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে রওনা হল, ওর পা মচকে গেছে, লাঠির মোক্ষম ঘা কতক পড়েছে ওর গোড়ালিতে। মজনু বসে বসে গোঙাচ্ছিল, ওর মাথার পেছন দিয়ে রক্ত পড়ছে। মাথা নাড়তে গেলেই ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আক্কাসের একটা চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে, কেউ ভিড়ের মধ্যে চোখের মধ্যে বিষম খামচি আর ঘুষি মেরেছে। আরেকটা চোখেও কালশিটে পড়ে গেছে।

ওকে খুব কুৎসিত লাগছে। ফরিদের হাত ভেঙেছে, আর রতনের চোয়াল। দক্ষিণপাড়া ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেন সোহেল চিত হয়ে ভেজা মাটিতেই শুয়ে আছে, ওর বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। এক কথায় বলা যায়, দলের কেউই ঠিক নেই, সবাই মার খেয়ে কমবেশি আহত। সবার মন খারাপ।

এই বয়সে মার খাওয়া তেমন কোন লজ্জার বিষয় নয়, কিন্তু উত্তরপাড়ার নচ্ছারগুলো সবার কাছে যেভাবে খবরটা ছড়াবে, তাতে অপমানের শেষ থাকবে না, একেবারে হেঁট হয়ে যেতে হবে। হঠাৎ শিপলুর দিকে চোখ পড়লো সোহেলের। শিপলু ব্যাকে খেলে। ওকে দেখেই ভুরু কুঁচকে ফেললো সোহেল। কী ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো শিপলু।

সোহেল রাগী স্বভাবের, গাট্টাগোট্টা শরীরের, অল্পতেই ক্ষেপে যায় বলে ওকে দলের সবাই ভয় পায়। তুই মারামারির সময় কোথায় ছিলি? কেন, মাঠে। তাহলে তুই একদম ঠিক আছিস কী করে? মানে? এতক্ষণে যেন খেয়াল করলো শিপলু, সে একদম অক্ষত। ওর শার্টের পকেট ছিঁড়ে ঝুলছে না, চোখে কালশিটে নেই, এমনকি কপালও আলুর মতো ফুলে ওঠে নি। কেউ যেন ওকে ছুঁয়েই দেখে নি।

আমাদের সবার অবস্থা মার খেয়ে কাহিল। উত্তরপাড়ার বদগুলো যখন আমাদেরকে পেটাল, তখন তুই কী করছিলি? আমি তো সবাইকে বাঁচাতে চেষ্টা করছিলাম। আমরাও তো তাই করছিলাম, অন্যদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়েই তো এতগুলো ধোলাই খেলাম। তুই কীভাবে আস্ত রয়ে গেলি? তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস? শিপলু সাহস করে বলে ফেলে।

অবশ্যই করছি। আমাদের সবার এই অবস্থা, আর তুই একদম অক্ষত। হিসাব তো মেলে না। কোন একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। তুই কি ভাবছিস, আমি উত্তরপাড়ার সাথে ঘোঁট পাকিয়েছি? অসম্ভব নয়, এবার বলে বসলো ফরিদ।

ততক্ষণে সবাই এদিকে ঘুরে বসেছে। সবার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিয়েছে। সবাই মার খেলো, কিন্তু শিপলু খেলো না কেন? শিপলুর মুখটা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেছে। মুখে কথা যোগাচ্ছে না। দুয়েকবার বলার চেষ্টা করলো, আমি, আমি ... ... কিন্তু কথাটা আর বলল না।

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে গটগট করে চলে গেল। মানিক ততক্ষণে বরফ ফিরে এসেছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে রে? শিপলু চলে গেল কেন? ওর কথার জবাব না দিয়ে নয়ন বলল, কাজটা বোধহয় ঠিক হল না, সোহেল। সোহেল কিছু বলল না।

কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়েছে, তা তো ঠিকই। কিন্তু সবাই মার খেলো, আর পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই, জটলার মধ্যে থেকেও কীভাবে শিপলুর গায়ে একটা আঁচড়ও লাগলো না, সেটাও তো একটা রহস্য। ***** সেদিন থেকে খেলাধুলার উৎসাহে ভাটা পড়লো দক্ষিণপাড়ার সব ছেলের। সবাই কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে। ভাঙা হাত জোড়া লাগবে, ফাটা মাথা আর ফোলা কপাল সারবে, মার খাওয়ার দুঃখ সবাই ভুলে যাবে, কিন্তু শিপলু আজকাল আসা বড় কমিয়ে দিয়েছে।

দেখা হলে হ্যাঁ-হুঁ করে, মাথা নিচু করে চলে, মাঝে মাঝে দেখেও না দেখার ভান করে উল্টো দিকে ফিরে চলে যায়। বন্ধু হারানো তো বড় দুঃখের ব্যাপার। তাই সবাই মুখ গোমড়া করে থাকে। তবুও শিপলুর সেদিনের ব্যাপারটা সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো, কিন্তু মাঠের জটলায় দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মানিক যে খবরটা দিলো, তাতে সবার সন্দেহ আবার চাগিয়ে উঠলো। অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখলাম রে।

কী ব্যাপার? শিপলু। কী হয়েছে গাধাটার? বাজারে যাচ্ছিলো। বড় রাস্তা পার হচ্ছিল। কেমন যেন অন্যমনস্ক, কোনদিকে মন নেই বোঝাই যাচ্ছিলো। আমি দূর থেকে দেখলাম, গুলির মতো বেগে হোন্ডা নিয়ে আসছে বগা ভাই।

বগা ভাই? সবাই চোখ কপালে তুললো। "বগা ভাই" নামক যুবকটি বাপের বখে যাওয়া ছেলে। নেশা করে, মেয়েদের দেখলে শিস দেয়, আঙুলে চেন ঘোরায়, মাথার চুল খাড়া করে রাখে, উগ্র জামাকাপড় পড়ে, আজেবাজে লোকদের সাথে চলে। পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেপুলের মধ্যে একমাত্র ওরই মোটরসাইকেল আছে। সিঙ্গার কোম্পানির পঞ্চাশ সিসি মোটর সাইকেল।

কিন্তু সে এটা চালায় এমন ভাব নিয়ে, যেন এটার মতো ভাল বাইক দুনিয়াতে নেই। তারপর কী হল? রাস্তার মাঝামাঝি এসেছে শিপলু, আমি দেখলাম বগা ভাই তীরের মতো ছুটে যাচ্ছে ওর দিকে। তারপর? দুর্ঘটনা? রক্তারক্তি? মুখোমুখি সংঘর্ষ? কে আহত হয়েছে, বগা ভাই না শিপলু? নাকি সেই হোন্ডাটা? এখন শিপলু কি হাসপাতালে? আরে না, অবাক হবার ব্যাপার হল কি, শিপলুর ঠিক ইঞ্চিখানেক দূরে এসে থেমে গেল উনার হোন্ডাটা। আর শুধু থেমেই গেল না, বগা ভাই উড়ে গিয়ে পড়লো হোন্ডার ওপর থেকে। শক্ত মাটিতে পড়ে কনুই ছিলে-টিলে একাকার।

আমি ভেবেছিলাম শিপলুকে একটু সাবধান করে দেবো, কিন্তু এত দ্রুত ঘটে গেল যে কিছু বলার সময়ই পেলাম না। ঘটনার পরও দেখি শিপলু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গায়, রাস্তার মধ্যে। লোক জড়ো হচ্ছিল, আমি চলে এলাম। হঠাৎ আসলাম বলে উঠলো, আমিও তো সেদিন একটা ঘটনা দেখেছি। আনিস চাচার ভটভটি সেদিন ব্রেকফেল করেছিলো (এই যানটি সপ্তাহে চারবার ব্রেকফেল করে থাকে)।

ঢালু রাস্তা দিয়ে সাঁ করে নেমে আসছিল। থামানোর কোন উপায়ই নেই। আনিস ভাই তারস্বরে চেঁচাচ্ছিল, সবাই সরে যাও, ব্রেক ফেল করেছে! আমি দেখলাম, শিপলু রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভটভটিটার দিকে। সেই লক্কড় মার্কা জিনিসটা রাস্তায় পাক খেয়ে, কাত হয়ে, কালভার্টে গুঁতো খেয়ে ওর ঠিক এক হাত দূরে এসে স্থির হল। এরপর আর কী বলবি? আর কোন প্রমাণ দরকার আছে? শিপলুর মধ্যে অবশ্যই কিছু না কিছু আছে।

বোধহয় জীন ভর করেছে। আমার নানারও এমন হয়েছিলো, উনি আগুনে পুড়তেন না। শেষে তাবিজ আর ঝাড়ফুঁক করে সারানো হয়। এরপর আর কোন কথা হয় না। সবাই গুম হয়ে বসে থাকে।

শিপলুর কি কোন অলৌকিক ক্ষমতা আছে? সে কি সব দুর্ঘটনা, বিপদাপদ থেকে বেঁচে যাবার শক্তি রাখে? সে কি পিশাচসিদ্ধ? কেউ বিশ্বাস করে না, তবুও তো কত কিছু আছে দুনিয়াতে। সবকিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়েই কি সে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে? ওর চারপাশে কি কোন অদ্ভুত প্রতিরক্ষা বলয় আছে, যাতে কোন বিপদ ওকে স্পর্শ করতে না পারে? সবকিছুর কি ব্যাখ্যা হয়? আশ্চর্য কোন ব্যাপার তো থাকতেই পারে। কমবয়সী এই ছেলেগুলোর উর্বর মস্তিষ্ক একটার পর আরেকটা গল্পগাথা দাঁড় করিয়ে চলে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কিশোরের দল জল্পনা কল্পনা করলো। বলা বাহুল্য, তারা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না।

***** নিজের ঘরে বসে বসে শিপলু কাঁদছে। সে বাইরে খুব একটা যায় না। মাঠে যাওয়া একদমই বন্ধ করে দিয়েছে, তারপরেও বন্ধুদের কথাবার্তা এর-ওর কাছ থেকে কানে আসে তার। ফুটবল খেলায় ওর মার না খেয়ে অক্ষত থাকা এবং দু'দুটো দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া, সবকিছু নিয়েই ওকে সন্দেহ করছে বন্ধুরা। শুধু বন্ধুরা নয়, পাড়ার লোকেরা, পড়শিরা, সবাই।

নিজের মনেই বলে সে, আমি কী করেছি? সবাই আমাকে সন্দেহ করে কেন? আমার কোন ক্ষতি হয় না, সেটা তো আর আমি ইচ্ছে করে করি না। সে মনে মনে খুব করে চাইতে লাগলো, খোদা, আমার একটা বড়সড় ক্ষতি করে দাও। সবাই যেন বোঝে যে আমি একটা খুব সাধারণ ছেলে। আমার কোন ক্ষমতা নেই। আমি অশুভ কেউ না।

এই বয়সে ছেলেপুলেরা কান্নাকাটি ভুলে শক্ত হতে শেখে, কিন্তু শিপলু বাচ্চা ছেলের মতো অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল। কেউ দেখে ফেললে নিশ্চয়ই খুব হাসাহাসি করতো। কিন্তু সে ভয় নেই, ওর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। কাঁদতে কাঁদতেই সে ভাবতে লাগলো, কী করে সবাইকে বোঝানো যায়, ওরও ক্ষতি হতে পারে। আর দশটা ছেলের মতোই ক্ষতি হতে পারে।

কী করা যায়? ***** মেঘ না চাইতেই জল। উত্তরপাড়ার বিচ্ছুগুলো সরাসরি এসে ওদেরকে আরেকবার চ্যালেঞ্জ করেছে। ঠিক করা হয়েছে, আরেকবার খেলা হবে, রেফারি হবে নিরপেক্ষ। তার কথার ওপর কোন কথা চলবে না, সে যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে। সোহেল অত্যন্ত গম্ভীর ভাব ধারণ করে বলল, মানিক, দ্যাখ তো কতজন আছে।

মনে মনে বলল, আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম। একেলা পাইয়াছি রে শ্যাম, এই নিঝুম বনে। গুণে দেখা গেল, দশজন খেলোয়াড় হয়েছে। দলপতি সোহেলের মেজাজ খারাপ। সে খুব কড়া স্বরে মানিককে বলল, যা, শিপলু গাধাটাকে ডেকে নিয়ে আয়।

একজন কম নিয়ে খেলবো কী করে? ও ছাড়া ব্যাকে ভাল কেউ তো নেই। ভুলেই গেল সে, আজ কয়েকদিন ধরে কেন যেন শিপলু মাঠে আসছে না। হয়তো রাগ করেছে গাধাটা। ওর রাগের নিকুচি করি। পাড়ার সম্মানের প্রশ্ন, ওকে আসতেই হবে।

না এলে গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে আসার হুকুম আছে মানিকের ওপর। এতটা করতে হবে না, নিজেই আসবে। আজ জিতলেই উত্তরপাড়া কুপোকাৎ। নাকে ঝামা ঘষে দেয়ার সুযোগ। বরাবরের মতোই মানিক রওনা হল, সব কাজেই কেন যেন ওকে পাঠানো হয়।

সে হল দক্ষিণপাড়ার ছেলেদের সবসময়কার দূত। সে খুশিমনেই এই কাজটা করে, কিছু মনে করে না। দৌড়ে চলে এলো সে শিপলুদের বাড়ি। বারান্দায় বসে শিপলুর মা কী যেন করছেন। ওকে দেখে হাসলেন।

কী ব্যাপার, মানিক? চাচী, শিপলু কোথায়? ওর ঘরে। মনে হয় মন খারাপ। কয়েকদিন ধরে বেরুচ্ছে না। দেখো না গিয়ে। চাচীকে পার হয়ে মানিক শিপলুর ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে যায়।

বারান্দার শেষ মাথায় ওর ঘর, দরজা ভেজানো। মানিক দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল, আর সাথে সাথেই চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়লো। ছুটে এলেন শিপলুর মা। মানিকের অবস্থা হল তাঁরও। মাটিতে পড়ে আছে শিপলু।

ওর ডান হাতের কব্জির ধমনীটা ব্লেড দিয়ে কাটা। টকটকে লাল রক্ত ঘরের মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছে। দু'চোখ খোলা, মুখও। সেখানে উড়ছে কয়েকটা মাছি। ***** উত্তরপাড়ার সাথে দক্ষিণপাড়ার শেষ খেলাটি আর হল না।

কেন যেন মনে হল, উত্তরপাড়ার ভীষণ দুরন্ত ছেলেগুলোও বেশ দুঃখ পেয়েছে। মাঠের এক কোণায় গোল হয়ে বসে ছিল দক্ষিণপাড়ার বিষণ্ণ ছেলের দল। সংখ্যায় ওরা দশজন। ওরা বুঝতে পেরেছে, শিপলুর কোন দোষ নেই। ছিলও না।

সেটা প্রমাণ করতে যে সে এই কাজ করে বসবে, তা তো কেউ ভাবতেও পারে নি। (২০ ডিসেম্বর, ২০১২) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.