আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইকারাসের ডানা...

একটা মেয়ের একটু কথা। ক্রিট দ্বীপে সম্রাটের প্রাসাদে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী নির্মাতা এবং ভাস্কর দাইদালাস বাস করতেন। তাদের প্রাসাদ হতে কোথাও বের হওয়ার অনুমতি ছিল না। তাই দাইদালাস মোম এবং পাখির পালক সহযোগে তৈরী করলেন দুইটি ডানা। তিনি একটি দিলেন তার পুত্র ইকারাসকে এবং অন্যটি নিজে নিলেন।

তিনি তার পুত্রকে আগেই মানা করেছিলেন সুর্যের বেশী কাছে যেতে। কারণ সুর্যের উত্তাপে ডানা গলে যেতে পারে। দেহে ডানা পরে তারা ক্রিট দ্বীপ ছাড়লেন। ইকারাস প্রথমে পিতাকে অনুসরণ করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনেক উপরে চলে গেল। ফলস্বরূপ তার মোমের ডানা উত্তাপে গলে গেল।

ইকারাস সমুদ্রে ডুবে গেল আর পালক সমুদ্রে ভাসতে থাকল। আর দাইদালাস নিরাপদে সিসিলি দ্বীপে অবতরণ করলেন। গ্রীক রূপকথা। (১) পাখি না হয়ে ও ইকারাস ডানা পেয়েছিল, আর সে পাখি হয়ে ও ডানা পায় নি। অবশ্য তার ডানাটি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।

সে পাখি রক্ত মাংসের নয় মাটির তৈরী। হোক না মাটির তৈরী কিন্তু পাখি তো। মাটিই তো আদি প্রাণের ধারক। প্রতিদিন এক ভাস্কর তাকে একটু একটু করে তৈরী করেন। তবে কখন যে মাটির পাখির ভিতর এক জীবন্ত স্বত্তা জেগে উঠলো ভাস্কর বুঝতে পারেনি।

পাখি নিজেও জানে না তার স্বত্তার জন্ম কিভাবে। পাখিটি প্রতিদিন একটু একটু করে পরিনত হয় ভাস্করের সুনিপুন হাতের ছোঁয়ায়। ভাস্কর মিহি মাটি ছেঁকে নিয়ে তারপর মাটিতে পানি ঢালেন। আহা পানি! জীবনের সাথে যার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তৈরী হয় নরম কাঁদা।

সেই কাঁদা ধীরে ধীরে পরিনত হয় পাখির এক একটি অঙ্গে। পাখিটি নিজের সৃষ্টি নিজের চোখে দেখে। সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। পরক্ষণেই তার স্বত্তা হেসে ওঠে। ভাগ্য? সে আবার কি জিনিস? মাটির পাখির ভাগ্যলিপি কোথায় লেখা হয়? যদি ভাস্কর লিখতেন তবে তিনি কি করে জানেন না পাখির জীবন্ত স্বত্তার কথা? মাটির পাখিটি ভাস্করের টেবিলে রাখা।

পাশের জানালাটি সবসময় খোলা থাকে। এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। ভাস্কর তার চোখ যেদিন বানিয়েছিলেন সেদিন সে প্রথমেই যা দেখেছিল তা হলো আকাশ। গাঢ় নীল ছিল সেদিনের আকাশ। কে বলবে বিশাল আকাশ তার মাঝে এত শুণ্যতাকে ধারণ করে আছে? আবার একদিকে কিন্তু সে শুণ্যও নয়।

পাখি অধীর অপেক্ষায় আছে কখন তার ডানা দুটো তৈরী হবে। সেদিন সে উড়বে। ইকারাসের মতো। বিপ্লবী হয়ে উঠবে। ইকারাস মুক্তির আনন্দে উড়ছিল, সুর্যের উত্তাপ গায়ে মাখছিল।

কখন যে সর্বনাশ হয়ে গেল বুঝতেই পারেনি। তবে এর জন্যে কি কোন দুঃখ হয়েছিল ইকারাসের? মনে হয় না। মুক্তির আনন্দের কাছে সবকিছুই গৌণ। এক মুহুর্তও যদি পাখিটি মুক্তির স্বাদ লাভ করতো! মরে গেলে ও তার আফসোস থাকতো না। ভাস্কর তার ডানা দুটি বানানো শুরু করেছেন।

ভাস্কর কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দে আছেন বলে মনে হল। ডানা দুটি কি সম্পূর্ণ করবেন নাকি অসমাপ্ত রেখে দিবেন? অসমাপ্ত ডানাই কি হবে পাখিটির বিশেষত্ত? অবশেষে ভাস্কর বানানো শেষ করেন। নিজের কাজ দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যান। পাখিটিকে শুকাতে দেন তিনি। পাখিটির ডানা একটি সম্পূর্ণ কিন্তু অন্যটি অসমাপ্ত।

ভাস্কর যেন মুক্তি দিতে গিয়েও দিলেন না পাখিটিকে। কারণ এটা তার ইচ্ছা। তার ইচ্ছার উপর তো কোন কথা নেই! পাখিটি নিজ থেকে চেষ্টা করতে পারে না। ভাস্কর তাকে যেভাবে বানান সেভাবেই যে তাকে থাকতে হবে। সে তাহলে মুক্তির স্বাদ কখন ও পাবে না! ইকারাসের মতো? তার স্বত্তা ছটফট করে।

চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে। ছটফট করতে থাকা স্বত্তাটি ভিতরে ভিতরে গুমরাতে থাকে। স্বত্তাটি হারিয়ে যায় বা মরে যায়। কারণ স্বত্তাটি স্বাধীন স্বত্তা, পরাধীন দেহে তার মৃত্যু যে অনিবার্য। ভাস্কর পাখিটিতে রং লাগাতে আসে।

অবাক হয়ে দেখে পাখিটির চোখে যেন আধাশুকানো পানি। ভাস্কর ভাবে হয়তো বাষ্প জমেছে। এক ফোটার থেকেও কম পানি এখন ও লেগে আছে। ভাস্কর পানি একটু জিভে লাগিয়ে অবাক হয়ে দেখে যে পানিটা নোনতা। যেন অশ্রু।

(গল্পটিতে একটু পরাবাস্তবতার ফ্লেভার আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষমেষ কি দাঁড়ালো সেটা আপনাদের হাতে। ) (২) নিশি অলস পায়ে বের হয় অফিস থেকে। তার কোন তাড়া নেই। যদিও সন্ধা পার হয়েছে বহু আগেই।

সে ধীর পায়ে হাঁটে। কত মানুষ! সবাই দ্রুতগামী। কিসের এত তাড়া? হয়তো কারো ঘরে অপেক্ষা করছে লক্ষী ঘরণী, ছেলেমেয়ে। কারো মা অপেক্ষা করছে আদরের সন্তানের প্রিয় খাবার চুলায় চড়িয়ে। তাই সবার এত তাড়া।

কিন্তু তার কোন তাড়া নেই। কারণ তার জন্যে তো কেউ অপেক্ষা করে নেই। প্রিয়জনের জন্যে অপেক্ষা কত যে মধুর হয় তার জানা আছে। কত মধুর ছিল তার সময়গুলো দশ বছর আগে। সে একটা ট্যাক্সি নেয়।

বেশ ভালো জ্যাম লেগেছে আজ। যেতে হয়তো ঘন্টা খানিক লাগবে। অন্ধকার ট্যাক্সিতে সে তার পেটে হাত রেখে কি যেন অনুভব করতে চায়। কি অনুভব করতে চায়? একটি আদিম অনুভুতি? যার স্বাদ প্রত্যেক মানবী পেতে চায়? সে কি দোষ করেছিল? সে কেন পায়নি এই অনুভুতি? নাহ্, নিশির চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ে না। নিশি আর রাশেদ পাঁচ বছরের প্রেম থেকে যখন পরিনয়ে আবদ্ধ হয়েছিল তখন কে জানতো আর পাঁচ বছর পরে কি হবে? কেউ জানতো না।

নিশি এম্বিশনের পিছনে ছুটতে গিয়ে তার গর্ভকে পরিনত হতে দিলো না কয়েকবার। যখন একটি শিশু পেতে চাইলো ততক্ষণে তার গর্ভ বিদ্রোহ ঘোষনা করে যে, সে আর কোনদিন সিঞ্চিত হবে না, কোন মানবাত্মাকে ধারণ করতে সে অপারগ। নিশি আর রাশেদের সম্পর্ককে বালির বাঁধ দিয়ে আর বেঁধে রাখা গেল না। তার এস্বিশন তার কাছে এখন ইকারাসের ডানার মতো মনে হয়। যে ডানা পাবার আনন্দে ইকারাস মত্ত হয়ে গিয়েছিল।

যার পরিনতি মৃত্যু। নিশি ও ভাবে ইকারাসের ডানায় ভর করে তার মাতৃস্বত্তার মৃত্যু ঘটেছে! রাশেদ এখন অন্যকারো প্রেমময় স্বামী, দুটি শিশুর স্নেহময় পিতা। নিশি আর ভাবতে চায় না। নিশি তার ফ্ল্যাটে পৌঁছে। রমিলা মেয়েটা আজও আসেনি।

ভীষন অলস মেয়ে। একে বিদায় করতে হবে। নিশি নিজেই সব কিছু গুছিয়ে তুলে। সিডি প্লেয়ারে মিহি কণ্ঠে রবীন্দ্র বাজছে। এই অসময়ে কে এল? নিমি দরজা খোলে।

রমিলা দাড়িয়ে আছে। চোখমুখ ফোলা। রমিলা তুমি এই অসময়ে? জ্বি আপা। আপনের সাথে কিছু কথা বলতাম আসছি। ভিতরে এসো।

রমিলার মুখ থেকে এরপর যা শুনলো তাতে নিশির মাতৃস্বত্তা জেগে উঠলো প্রথম বারের মতো। রমিলার অবিবাহিত বোনের একটি বাচ্চা হয়েছে। যে বাসায় আগে কাজ করতো সে খানের বাড়িওয়ালার ছেলের কীর্তি। তাই তারা সে এলাকা ছেড়ে এই এলাকায় আসে। রমিলার বোনটির ভীষন রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

সে কি করবে ভেবে না পেয়ে নিশির কাছে আসে। নিশি তার ভ্যানিটি ব্যাগটি এবং কিছু ক্যাশ নিয়ে রওনা হয়। তার মাতৃ স্বত্তা আজ প্রবল হয়েছে। সে যে করেই হোক বাচ্চাটি আর মেয়েটিকে বাঁচাতে চায়। নিশি মেয়েটিকে দ্রুত হসপিটালাইজড করে।

প্রচুর রক্ত লাগবে। সে রক্ত আনতে ছোটে। এই ফাঁকে বাচ্চাটির ব্যাপারে রমিলার মায়ের সাথে কথাও বলে নেয়। সে বাচ্চাটিকে ভিক্ষা চায় রমিলার মায়ের কাছে। রমিলার মা কিছু বলে না।

নিশি তার বন্ধু নবনীকে ও ফোন করে। শেস পর্যন্ত মেয়েটিকে ডাক্তার বাঁচাতে পারে এবং বাচ্চাটিকেও। পরদিন নিশি হসপিটালে বাচ্চাটিকে দেখতে যায়। কিন্তু বাচ্চাটির মা জমিলা নামের মেয়েটি যে অধিকারে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে তার দিকে তাকায় সে দৃষ্টির সামনে নিশির ভেতরের জেগে ওঠা মাতৃস্বত্তাটি গুমরে কেঁদে উঠে। স্বত্তাটি একসময় মরে ও যায়।

স্বত্তাটি চলে যাবার আগে নিশির চোখের কোনে এক ফোটা নোনতা অশ্রু বিন্দু রেখে যায়। (এটি বাস্তব গল্প। )  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।