আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিরোধীদলীয় নেতার ভারত সফর : চাইতে হবে শেকড়ে

সাইফ শাহজাহান শুচি সৈয়দ জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন উথান্ট। তার একটি বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘জগতে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব বা চিরস্থায়ী শত্র“তা বলে কিছু নেই। যা আছে তা হচ্ছে চিরস্থায়ী স্বার্থ। ’ একেবারে যাকে বলে ষোলো আনা খাঁটি সত্যি কথা। ‘স্বার্থ’, ‘স্বার্থপরতা’ শব্দগুলো শুনতে তথাকথিত উদার মানসিকতার লোকদের কাছে অস্বস্তিকর লাগলেও রূঢ় সত্যÑ তারও চেয়ে রূঢ় সত্য তারা নিজেরাও কখনোই সেই স্বার্থ এবং স্বার্থপরতার বাইরে একটি পদক্ষেপও রাখার যোগ্যতা রাখেন নাÑ বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতায় তা পদে পদে দেখেছি।

বরং তারা নিঃস্বার্থপরতার বুলি আউড়িয়ে স্বার্থপরদের চেয়ে বেশি স্বার্থ হাসিল করেছেন সেটাই সব ক্ষেত্রে দেখা যায়। বাস্তবতা, সত্য এবং নীতিকথা, নৈতিকতাÑ এসব দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথের সমন্বয় করা মহামানবদের জীবনেই দুরূহ, সেখানে আমজনতা কোন ছাড়! মহামতি উথান্টের কথাটি স্মরণে এলো বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান ভারত সফরকে কেন্দ্র করে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার এ সফর এক তাৎপর্যপূর্ণ বাঁকের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সুদূরপ্রসারী এই ঘটনা। কতটা সুদূরপ্রসারী কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব-কিতাব দিতে পারবেন অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা।

আমরা সেটা করতে গেলে ব্যর্থ হব। আমজনতার অংশ হিসেবে আমি শুধু আমজনতার স্বার্থের কথাটি উত্থাপন করতে চাই। আমরা এর আগে ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী দলের ‘পূর্বমুখী কূটনীতি’র স্লোগান, কর্মকাণ্ড দেখেছি। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ মুখী ওয়ান-ইলেভেন সরকারের কূটনীতিও দেখেছি। দেখেছি তারা ঘোড়া এবং গাধা দুটোই উপহার হিসেবে এনেছেন।

ঘোড়া উপহার হিসেবে এখনও আসছে। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে ঘোড়া-গাধা দুটোই আবার আসবে। বুর্জোয়া রাজনীতির এই কেবলা পরিবর্তন কোন আশ্চর্য এবং অলৌকিক ঘটনা নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভারতপ্রেমী আর ভারতের দালাল, বিএনপি ভারতবিদ্বেষী, দেশপ্রেমিকÑ এই স্লোগানদাতারা নিজেরাও জানতেন এটা নিছকই স্লোগান, সত্য নয়। সত্য যা তা হল তারাও ভারতবিরোধী নন, তারাও ভারতের প্রেমিকÑ তা তাদের বিভিন্ন কাজকর্মে প্রমাণ দিয়েছেন।

সবচেয়ে বড় ভারতবিদ্বেষী যে দল, যার সাধারণ কর্মীরা মনে করেন তারা সাচ্চা মুসলমান। যারা তাদের ইহকাল-পরকালের সব নেকি অর্জন করতে চান শহীদ হয়ে, সেই জামায়াতে ইসলামীও প্রকৃতপক্ষে মোটেও ভারতবিদ্বেষী নয়, যতটা মনে হয় বিএনপি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দলীয় লেনদেনে জামায়াতও বিএনপির চেয়ে অনেক এগিয়ে। সম্পর্কের সেই শূন্যস্থানে বিরোধীদলীয় নেতার এই ভারত সফর বোধকরি একটি বড় উল্লম্ফন। ফলে হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন যেমন আওয়ামী লীগের নেতারা, তেমনই বিএনপির নেতারাও।

এই হিমশিম খাওয়া থেকেই প্রকাশ পায় আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যের। স্বাধীনতার চল্লিশটি বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের রাজনীতি যে পরিপক্ব হয়নি, এ তারই প্রমাণ। বাংলাদেশের রাজনীতিকে আমরা বিভিন্ন কেবলায় সিজদা দিতে দেখতে অভ্যস্ত। এটা নতুন কোনও ঘটনা নয়। এ ঘটনা ঘটতে দেখেছি অতীতে, ঘটছে বর্তমানেও, ঘটবে ভবিষ্যতেও যদি আমরা প্রকৃত বাস্তবতা না বুঝে নিতে পারি।

এরশাদীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক তখনও দেখেছি মার্কিনিদের কাছে ধরনা দিয়েছেন আমাদের রাজনীতিকরা। এ সবই ঘটেছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির লক্ষ্য হাসিলের জন্য। আজ বিরোধীদলীয় নেতার ভারত সফর তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার একটি লেখা লন্ডনের টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস গ্রুপের দ্বিমাসিক জার্নাল স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিস-এর সেপ্টেম্বর সংখ্যা থেকে অনুবাদ করে ছাপা হয়েছে দৈনিক প্রথম আলোতে। সেটির ওপর চোখ বুৃলিয়ে নেয়া যেতে পারেÑ ‘‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক কেবল গুরুত্বপূর্ণই নয়, এর রয়েছে জোরালো ঐতিহাসিক ভিত্তি।

পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধাবোধের দিকটিতে গুরুত্ব দিলে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক আরও জোরদার করার সুযোগ বিপুলভাবেই অবারিত। আমাদের ভৌগোলিক নৈকট্য এবং যৌথ ইতিহাসই হওয়া উচিত আমাদের সম্পর্কের সূচক। তা হলেও নীতিনির্ধারকেরা যেমন, তেমনি সাধারণ জনগণের সামনেও এমন কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, যার শিকড় হয়তো আমাদের ঔপনিবেশিক অতীতের মধ্যে প্রোথিত, যেখানে উভয় রাষ্ট্রের জনগণই উপনিবেশবাদীদের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতির শিকার হয়েছিল। এখান থেকেই ভয় ও অবিশ্বাসের বোধ জš§ নিয়েছে। পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টির মাধ্যমে এই ভয়ের বিকারকে চিরস্থায়ী করার মতো শক্তি উভয় দেশের সমাজেই ক্রিয়াশীল ছিল এবং এখনো আছে।

আমি মনে করি, এই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে প্রথমেই আমাদের একসঙ্গে বসতে হবে এবং যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে তুলে ধরতে হবে। খোলামেলা মুক্ত আলোচনা আর সমঝোতার মাধ্যমেই গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্বে আলোড়ন তোলে, এমন ঘটনার মধ্যে রয়েছে যৌথ নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত এলাকায় নিরস্ত্র মানুষদের গুলি করে হত্যা করা এবং সীমান্ত সমস্যার মীমাংসা (যা আমরা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি)। একই সঙ্গে সীমান্তের উভয় দিকেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকেও আমাদের আমলে নিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো পক্ষই পরস্পরের স্বার্থের বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না। এসব জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করাই আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

মতাদর্শোত্তর (চড়ংঃ-ওফবড়ষড়মরপধষ ধমব) যুগের পরে আজকের দেশ ও সরকারগুলো তাদের অনুমিত ও সত্যিকার জাতীয় বিভিন্ন স্বার্থের কোনোটা বিসর্জন না দিয়েই পরস্পরবিরোধী লক্ষ্যগুলোর মাঝখানে অবস্থান নিতে সক্ষম। শেষ বিচারে পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তসীমান্ত সম্পর্ক এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না, এসবকে গতিশীল হতেই হয়। আমাদের ঐতিহাসিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন কোনো কারণ কি আছে, যার জন্য ভারত ও বাংলাদেশ তাদের অভিন্ন লক্ষ্য হাসিল করতে পারে না? এই লক্ষ্যগুলো তখনই ভালোভাবে অর্জন করা যাবে যখন স্বচ্ছভাবে এবং পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার ভিত্তিতে সম্পর্কের চর্চা হবে। স্থিতিশীলতার স্বার্থেই জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করায় কাজ করা জরুরি। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এসব লক্ষ্য যাতে পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশেই অর্জিত হয়, তা নিশ্চিত করা।

যেসব সমস্যা গুরুতর ও উত্তপ্ত, সেসবকে জিইয়ে না রাখাই হলো পররাষ্ট্রনীতির গতিশীলতা যাচাইয়ের শর্ত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন সমস্যা তার অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমস্যাগুলোর মতো সমাধানের অযোগ্য নয়। অনুধাবন করা দরকার, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব ইস্যু এখন সমস্যা, সেসবের নিরসন হলে দুই দিকের জনমতই অনুকূল হয়ে উঠবে। এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো নিখাদ রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা এবং পারস্পরিক মঙ্গল ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে টেকসই সম্পর্ক নির্মাণকেই উভয়ের স্বার্থ বলে গণ্য করা। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য উপাদান।

আমাদের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ ও ভারত চার হাজার কিলোমিটারের ভূসীমান্তের অংশীদার। বিদায়ের সময় ব্রিটিশরাজ যেভাবে এই সীমান্তরেখা অঙ্কন করেছে, তা মোটেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তারা এক দেশের ভেতরে অন্য দেশের অঞ্চল এমনভাবে রেখে দিয়েছে, যা সমস্যাজনক। এ রকম বৈশিষ্ট্যবর্জিত ভূসীমান্ত চিহ্নিতকরণ বিভিন্ন রকম বিকৃতির জš§ দিয়েছে এবং বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবনের ওপর ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। আর দেরি না করেই আমাদের এসব বিকৃতির মীমাংসা করতে হবে।

বিদ্যমান বাস্তবতাকে মাথায় রেখে, সেসব এলাকায় বংশানুক্রমিকভাবে বসবাস করতে থাকা জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তর না করেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা দিয়ে তা করা উচিত হবে আমাদের। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটানোয় বাস্তবোচিত সমাধানের পথে ঔপনিবেশিক অতীতে জš§ নেওয়া কলাকৌশলগত সমস্যা বাধা হওয়া উচিত নয়। যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই সীমান্তপথে বিপুলসংখ্যক মানুষের চলাচলের বিষয়টি এই সীমান্তজনিত সমস্যার পটভূমিতে বিচার করতে হবে। আমাদের উভয়কেই অর্থনৈতিক প্রয়োজনে সীমান্ত পেরিয়ে মানুষের চলাচল সহজ করার প্রচেষ্টা নিতে হবে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনকানুন, কনভেনশন ও রীতিনীতি রয়েছে; আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে জনচলাচল সে অনুসারেই হয়ে থাকে।

আমাদের দুটি দেশের মধ্যে আন্তসীমান্ত চলাচলের ব্যবস্থাপনার বেলায় সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এসব রীতিনীতি অনুসরণ করা উচিত। আমাদের সম্পর্ক যেমন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মধ্যে তারই প্রতিফলন থাকা উচিত। নিশ্চয়ই নিয়মিতভাবে নিরস্ত্র লোকজনকে হত্যা করা সীমান্ত সমস্যার সঠিক উত্তর নয়। সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা একমাত্র না হলেও, আজকের দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদ এবং এর সম্ভাব্য হুমকির বিষয়টি বেশির ভাগ দেশের জন্যই অন্যতম প্রধান সমস্যা। কিছু কিছু সন্ত্রাসমূলক হুমকির জš§ দেশের ভেতরেই, আবার কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সীমান্ত ছাপিয়ে ওঠে।

এই হুমকি মোকাবিলায় যে বাস্তব ও অবকাঠামো কার্যক্রম দরকার হয়, তা বিপুল আর্থিক ও বস্তুগত সম্পদ শুষে নেয়, যা দিয়ে হয়তো অনেক জরুরি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা যেত। আর এসব আয়োজন আমাদের জনগণের মধ্যেও ভীতির বোধ ছড়িয়ে দেয়। সবারই প্রয়োজন হলো সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করায় একসঙ্গে কাজ করা এবং পরস্পরকে সহযোগিতা করা। আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করার লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম রয়েছে, যার সুযোগ আমরা নিতে পারি। আমি বিশ্বাস করি, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) ১৯৮৭ সালের কাঠমান্ডু সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদ দমনে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং এর সংযোজন হিসেবে স্বাক্ষরিত ২০০৪ সালের ইসলামাবাদ প্রটোকলই এই সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের জন্য আঞ্চলিক অবস্থান গ্রহণে সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে বিস্তৃত প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম জুগিয়ে দিতে পারে।

আমি অবশ্যই অবাক হয়েছি দেখে যে, সন্ত্রাসবাদ দমনে আমাদের যৌথ লক্ষ্যের দিকে কার্যকরভাবে এগিয়ে যাওয়ার উপযোগী এই দুটি আইনি দলিল বাস্তবায়নে আমাদের দেশগুলো তেমন কিছুই করেনি। এ ধরনের সহযোগিতাকে অবশ্যই জলদস্যুতা, মাদক চোরাচালান এবং মানব পাচারের বিরুদ্ধেও প্রসারিত করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা অনেকেরই মনে থাকবে, বাংলাদেশই প্রথম দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর সূচনা করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি এই অঞ্চলের সব সরকারপ্রধানের কাছে চিঠি লিখে আমাদের জনগণের জীবনের মান উন্নত করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোয় সরকারপ্রধানদের ব্যক্তিগতভাবে সচেষ্ট হওয়ার জরুরত সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন।

অনাস্থাবাদী ও সংশয়বাদীদের পেছনে ফেলে ঘটনাক্রমে ১৯৮৫ সালে যে ঢাকায় সার্ক প্রতিষ্ঠিত হলো, তা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের আন্তরিক নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টারই অবদান। তা হলেও একসময় যেমনটা আশা করা হয়েছিল, বিগত বছরগুলোতে সার্কের অগ্রগতি সে অনুসারে বেগ পায়নি। তা সত্ত্বেও, ব্যাপক বিস্তৃত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করায় এটাই সক্ষম হাতিয়ার। আমাদের সব কটি দেশই বিভিন্ন মাত্রায় দারিদ্র্যের মহামারিতে আক্রান্ত এবং কাঙ্ক্ষিত সামাজিক সূচক অর্জনে আমাদের আরও অনেক দূর যাত্রা করতে হবে। যৌথতা ও সহযোগিতার চেতনায় অগ্রসর হলে বর্তমানের থেকে আরও দ্রুতগতিতে সেই লক্ষ্যে ধাবিত হওয়ার ব্যাপারে আমি আস্থাশীল।

ঘটনা হলো, ক্রমেই অধিক থেকে অধিক সংখ্যায় দেশগুলো যে সার্কের সঙ্গে জড়িত হতে চাইছে, তা-ই সংস্থাটির বিপুল সম্ভাবনার প্রমাণ। পূর্বমুখী নীতি এবং সংযোগশীলতা ২০০১ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকারে আসীন হওয়ার পর আমরা ‘পূর্বমুখী’ নীতির আলোকে পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করি। এর অর্থ দাঁড়ায় আরও বেশি হারে সহযোগিতা দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক, দক্ষিণ এশীয় স্তরে এবং দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোর সঙ্গে; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দূরপ্রাচ্য তথা চীন জাপান ও কোরিয়ার সঙ্গে আরও যোগাযোগ বাড়ানো। এটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বর্ধনশীল অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে এশিয়ার উত্থানেরই স্বীকৃতি। বাণিজ্য, অর্থনৈতিক নিবিড়তা এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগের বেলায় এই নীতির সুফল আমরা সবাই পেয়েছি।

এখন আমাদের প্রয়োজন আঞ্চলিক সংযোগশীলতাকে সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে বিস্তৃত করতে কাজ করা। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আরও দূরপ্রাচ্যের চীন, জাপান ও কোরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ-জাল গড়ে উঠবে। এর সুফলকে খাটো করে দেখা যাবে না। ভারতের জনগণের প্রতি বার্তা ভারতের জনগণের প্রতি আমার বার্তা হলো বন্ধুত্বের ও বোঝাপড়ার। নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় পাশাপাশি বসবাসই আমাদের নিয়তি এবং তা করতে হবে শান্তি ও সৌহার্দ্যের মাধ্যমে।

পরস্পরের কোনো অমঙ্গল আমাদের চাওয়া হতে পারে না, নিজেদের মধ্যে শত্রুতাও আমরা বহন করতে পারব না। আমাদের অবশ্যই আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে শিখতে হবে, বাড়াতে হবে জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ। মতভিন্নতা দূর করায় কাজ করে যেতে হবে এবং উভয় দেশের জনগণের মধ্যে জাগাতে হবে আরও বৃহত্তর আস্থা ও বিশ্বাস। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের মর্মমূলে থাকা উচিত পরস্পরের মঙ্গলের জন্য বিরতিহীন এবং খোলামেলা সংলাপ ও আলোচনা। একই সঙ্গে, উভয় রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাও যেন পরিব্যাপ্ত করে রাখে আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক।

’’ (প্রথম আলো, ৬ অক্টোবর, ২০১২) বিরোধীদলীয় নেতা ভারতে দেয়া বক্তৃতায় বলেছেন ‘চাব না পশ্চাতে মোরা’Ñঅর্থাৎ অতীতের দৃষ্টিভঙ্গির ভুলের দিকে না তাকিয়ে ভবিষ্যতের পানে তাকাবার আহবান জানিয়েছেন। এই আহবান কি যথার্থতা পাবে যদি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা না নিই। বিষয়টি কেবল ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখলে সমাধানে আদৌও পৌঁছানো যাবে কি? আমাদের দেশে রাজনীতি ক্ষমতা কেন্দ্রিক, ব্যক্তি কেন্দ্রিক। রাজনীতিতে দেশের স্বার্থ, আপামর মানুষের স্বার্থ উপেক্ষিত, পদদলিত। ফলে কেউ যদি জননেত্রী জননেতা হন কেউ হন দেশনেত্রী, দেশনেতাÑ তো জন ছাড়া দেশ আর দেশ ছাড়া জনÑ এই ঘূর্ণাবর্তে রাজনীতি ঘুরপাক খেলে ব্যক্তি বা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী উপকৃত হলেও দেশ ও দেশের মানুষের কোনও উপকার হয়না।

এটাই নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের। এই ঘূর্ণাবর্ত থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমাদের অতীতের দিকে চাইতে হবে, কেবল গত ৫০ বছর পেছনের দিকে নয়, তারও আগে, তাকাতে হবে শেকড়ের পানে। আর সেই শেকড় থেকে যদি আমরা প্রকৃত সৌহার্দ্যরে আÍীয়তাকে আমরা আবিস্কার করতে পারি তাহলে সেটাই হবে টেকসই সম্পর্ক। আর টেকসই সম্পর্কের সেতু ছাড়া গোঁজামিল দিয়ে আমরা এগুতে পারব না। শুধুমাত্র দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের নিরিখে রচিত সম্পর্ক নয়, আমাদের সম্পর্ক রচনা করতে হবে আপামর মানুষের অস্তিত্বের স্বার্থে।

তাই দলগুলোর প্রকৃত কেবলা পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণেরও আগে হতে হবে এদেশের জনগণ। উথান্ট কথিত চিরস্থায়ী শত্র“তা ও বন্ধুত্বের তত্ত্বেও নয়, আমাদের সম্পর্ক রচনা করতে হবে আমাদের বাস্তবতায়, দেশ ও মানুষের স্বার্থে আমরা চাই চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব। আর সেটা চাই অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য, সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য সর্বোপরি আমাদের দেশ ও তার জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে। আশা করি রাজনীতিবিদরা এবিষয়ে তাদের প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন, এক অপরের গায়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করে নিজেদের বালখিল্যতার প্রমাণ দেবেন না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.