আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই সন্ধ্যা...

আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের প্রাথমিক ভাবে তুচ্ছ বলে মনে হয়। অনেক সময় অস্তিত্বের সাড়াও পাওয়া যায় না। সময় গড়ালে বোঝা যায়, কত গভীরে তাদের শেকড় প্রোথিত। তেমন একজনের কথাই আজ মনে পড়ে গেল। কাকতালীয় ভাবে ! গ্রামে তখন একটাই প্রাইমারি স্কুল ছিল।

তার প্রতিষ্ঠাতা ভদ্রলোক আবার আমার বাবার অনুজ। তাঁর অনুরোধে বাবা আমাকে আর ভাইকে দিলেন সেখানে ভর্তি করে। একটা টিনের দোচালা ঘর, আরও কয়েকটা ঘর নিয়ে ভদ্রলোকের বাড়িতেই চলত ইস্কুল। সামনে ছিল একটা ছোট উঠোন। কোনও ক্লাসে ছাত্র ছিল কুড়ি জন, কোনওটায় হয়তো আর একটু বেশি।

তা বলে হুল্লোড়ের খামতি ছিল না। ফাঁক পেলেই শুরু হয়ে যেত খেলা। নিত্যদিন নতুন নতুন খেলা আমদানি করত এক এক জন সহপাঠী। খেলত না শুধু একজন। সে আমাদের সঙ্গেই পড়তো ।

একটি মেয়ে। নাম সন্ধ্যা। দেখলেই বোঝা যেত, বয়সে সে বেশ খানিকটা বড় আমাদের থেকে। চেহারায়, চলনে গ্রাম্যতার ছাপ স্পষ্ট। ঝোঁপের লতাগুল্মের মধ্যে কাঠাল চাঁপা যেমন, সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সন্ধ্যাও তার ব্যতিক্রম নয়।

ক্লাসের ফাঁকে আমরা যখন খেলায় মগ্ন, কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যেত সে। বেশ কিছুদিন তদন্তের পর জানতে পারলাম, মেয়েটি থাকে ওই বাড়িতেই। বাড়ির বাচ্চাদের দেখভালের পাশাপাশি সংসারের টুকিটাকি কাজ করে। রহস্য আরও ঘনীভূত হল। কোথা থেকে এল ও? কোথায় ওর বাড়ি? কোনও দিনও জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারিনি।

কৌতুহল নিবৃত্ত করতে পাছে আঘাত দিয়ে ফেলি। ভয়ের বেড়া টপকে বড়দেরও জিজ্ঞাসা করে ওঠা হয়নি। প্রশ্ন না-করতেই উত্তর পেয়ে গেলাম একদিন। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, কোনও মনীষীর জন্মজয়ন্তী পালন করতে স্কুলের সামনে উঠোনটায় জড়ো হয়েছি আমরা। ছোট্ট মঞ্চে শুরু হল অনুষ্ঠান।

কয়েকজনের গান ও আবৃত্তির পর মঞ্চে উঠল সেই মেয়েটি। এর আগে তাকে কোনও দিন মঞ্চে উঠতে দেখিনি। সঙ্গেই মঞ্চে উঠলেন প্রতিষ্ঠাতা ভদ্রলোক। সন্ধ্যার পাশে বসে বললেন, "ওর সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলার আছে। বছর কয়েক আগে একদিন সন্ধ্যা আমার বাড়িতে হাজির।

বলল, আমি পড়তে চাই। আমাকে একটু পড়াবেন? পয়সা দিতে পারব না। বদলে ঘর মুছে দেব, বাসন মেজে দেব। তার পর থেকে ও আমাদের সঙ্গেই থাকে। " তখন কথাগুলো তেমন ভাবে আঁচড় কাটেনি বটে, কিন্তু সে পাঠশালা ছাড়ার পরেও ভুলে যাইনি।

কারণ,প্রাথমিক কৌতুহল মিটলেও সামনে দাঁড়িয়েছিল আরও বড় একটা প্রশ্ন। ও বুঝলো কী করে, পড়াশুনো কতটা জরুরি ? কলেজে পা দিয়ে একদিন দেখলাম,বোয়িংয়ে চড়ে টুইন টাওয়ার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে কথিত জঙ্গিরা । আর অন্যদিকে মাস্টারমশাইয়ের হাত ধরে ট্রেনে উঠছে লতি। সমাজের যাবতীয় বাঁধন ছিঁড়ে ! ঠিকই ধরেছেন, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান বলে কথা। বুঝলাম, যারা বোঝে, তারা নিজে থেকেই বোঝে।

আর যারা বোঝে না, তারা কোনও দিনই বুঝে উঠতে পারে না। গ্রামের একটি অতি সাধারণ মেয়ে যে কতখানি গভীর আঁচড় কেটেছে,তা অনেক পরে বুঝেছি। যখনই আলস্যের আবেশে কোনও প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কাজ সারার চেষ্টা করি, তখনই সন্ধ্যা সামনে এসে দাঁড়ায়। জানি না, সন্ধ্যার উষা উচ্চমাধ্যমিকের পরই অস্তাচলে গিয়েছে কি না। কিন্তু ওই অতটুকুতেই তো তার জয়।

যতটুকু আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পারি দিয়েও অর্জন করতে পারিনি। শুধু সন্ধ্যা নয়। কখনও মায়ের বেশে, কখনও স্ত্রীর বেশে, কখনও বা ভূলে যাওয়া প্রিয়জন হয়ে, আবার কখনও বা কেউ না-হয়ে নারীরা আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। অথচ তাঁরা জানতেই পারেন না, তাঁরা জয়ী। কারণ, সে জয়ের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই,আছে শুধু মর্মজ্বালা ! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।