,,,কুয়াশার আড়ালে লুকানো ঘটনা কুয়াশার চাদরে জড়ানো সকালের মোহনীয় রূপের মত নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক, নির্মোহ নয়,,,
সুন্দরবন- নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে রাজসিক রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মনের পর্দায় দেখি হরিণের ছুটোছুটি, দেখি কুমির আর গুইসাপের বিচরণ- মাটি ফুড়ে বেরিয়ে আসা শ্বাসমূল আর নানা রঙের জানা অজানা পাখির ঝাক। বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ কিংবা সবুজ সমারোহের বাংলাদেশ- এই পরিচিতির বেশীরভাগ জুড়েই আছে সুন্দরবন। সুন্দরবন আমাদের গর্ব, প্রাকৃতিক দূর্যোগে আমাদের রক্ষাকবচ, আমাদের পরিচিতির অন্যতম স্মারক। কিন্তু শুধু গৌরব নিয়ে তো আর বাচা যায় না। বাচতে হলে আমাদের চাই আনুষঙ্গিক আরো অনেক কিছু।
আর বর্তমানে অনেক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে বিদ্যুৎ। তাই এবার গর্ব ও গৌরবের সুন্দরবনকে ‘উপযুক্ত’ কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুসারে সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে হবে ২৬৪০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার প্রথম পর্যায়ে উৎপাদিত হবে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ৯ কি.মি. দূরে স্থাপিত হলেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে উপজীব্য করে গড়ে উঠবে রাস্তাঘাট, কল-কারখানা, আবাসন শিল্প, ট্যানারী শিল্প, হাট-বাজার সহ আরো নানান উন্নয়নের বাহন, যেই উন্নয়নের পরিধি দ্রুত ধাবিত হবে সুন্দরবনের দিকে এবং সেই সাথে সুন্দরবনের বিশাল আয়তনের জায়গায় অবশেষে ‘উন্নতি’র ছোয়া লাগবে। একেই বলে বুঝি সর্বদিক ব্যাপী উন্নয়ন- যেখানে বাদ যায় না বন-জঙ্গলও।
গত ২৯শে জানুয়ারী ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) এর সাথে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে কোন পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই। প্রস্তাবিত বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় এবং ইতোমধ্যে চিহ্নিত ১৮৩৪ একর জায়গার মধ্যে মাত্র ৮৬ একর খাস জমি। প্রকল্প এলাকার সাপমারী, কাটাখালী, কৈগরদাসকাঠি, কাপাসডাংগা, বাশেরহুলা মৌজার বিস্তৃত এই জমি দো ফসলী। এই বিশাল এলাকার মধ্যে বসতবাড়ি, ধানি জমি, মৎস খামার, চিংড়ি চাষ প্রকল্প, সবজি ক্ষেত, গরু মহিষের খামার, মসজিদ-মন্দির, কবরস্থান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতি মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার মাছ, ধান, গরু মহিষের মাংস এই এলাকা থেকে উৎপাদন করা হয়।
কিন্তু এগুলো সবই এখন ধ্বংসের অপেক্ষায়। এ অঞ্চলের মানুষ এখন প্রভাবশালী-নেতৃস্থানীয়-রাজনৈতিক মদদপুষ্ট কিছু অর্থলোভী মানুষের অত্যাচার ও জোর পূর্বক উচ্ছেদের শিকার। অথচ ভারতের এনটিপিসি’র ১৩২০ মেগাওয়াটের ঠিক এমনি এক প্রকল্প ২০১০ সালে মধ্যপ্রদেশে বাতিল করে দেয়া হয়। স্থানীয় মানুষের দাবি, নরমদা নদী দূষণ আর নরসিংগুপুর জেলার ঝিকলি ও তুমরা গ্রামের ১০০০ একর জমির অবক্ষয় রোধে সেখানে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয় নি। অথচ আমাদের নীতিনির্ধারকগণ সকল ঝুকির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মধ্যপ্রদেশ থেকে বিতাড়িত সেই এনটিপিসি’র সাথে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বিতর্কিত বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকায় প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব বিষয়ক একটি গবেষণা করা হয়েছে। এই গবেষণায় পরিবেশগত প্রভাবের দিকগুলো ৩৪ টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই প্রভাব কতটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক হবে সেটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। এই ৩৪ টি ক্যাটাগরির ২৭ টিতেই পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। ৭ টি ইতিবাচক প্রভাবের মধ্যে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নই একমাত্র বাস্তবিক ইতিবাচক পরিবর্তন। বাকি ৬ টিকে ইতিবাচক হিসেবে বলা হলেও সুন্দরবন ধ্বংসে সে প্রভাবগুলো ‘টনিকে’র মত কাজ করবে।
ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে রামপাল ও তদঃসংশ্লিষ্ট এলাকায় নগরায়ন, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যবসার প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও হাট বাজার সৃষ্টি। কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যাংগ্রোভ বনকে ঘিরে যদি শিল্পের প্রসার হয় কিংবা জনবসতি গড়ে ওঠে তবে সে বন আর কতদিন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে তা ভেবে দেখবার বিষয়।
সুন্দরবন কোন চিড়িয়াখানা নয় যে কোন কারণে এটা খুলনাতে টিকিয়ে রাখা না গেলে অন্যত্র গড়ে তোলা যাবে। এই বন প্রকৃতি প্রদত্ত আমাদের সম্পদ যা পৃথিবীতে অনন্য। এই বনের সাথে জড়িয়ে আছে ৫ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে এই বন উপকূলীয় মানুষের একমাত্র পরিক্ষীত রক্ষাকবচ।
এই বন আমাদের অহংকার। সর্বনাশা এই বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে আমাদের দৃশ্যমান প্রাপ্তি ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আর সুন্দরবন ধ্বংসের ভবিষ্যৎ শংকা। সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা জানা আমাদের অধিকার আর যদি এটি ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির কোন প্রকল্প হয় তবে তা যে কোন মূল্যে হতে না দেয়া আমাদের দায়িত্ব।
মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশেও সেখানকার রেইন ফরেস্ট সংলগ্ন লাহাত দাতু এলাকায় ৩০০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ৩ বছরের নানান চেষ্টা, আলাপ-আলোচনা আর অন্দোলনের মাধ্যমে অবশেষে ২০১১ সালে সেই প্রকল্প সরকার বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়।
‘সাবাহান’রা তাদের রেইনফরেস্ট রক্ষা করেছে, আমাদেরকেও আমাদের সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে।
আমরা উন্নয়ন চাই। অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশে অগ্রগতি আমাদের সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু উন্নয়ন মানেই যত্রতত্র কলকারখানা স্থাপন করে ফেলে নদীগুলোকে বর্জ্যবাহী নালায় পরিণত করা নয়। উন্নতি মানেই পাহাড় কেটে আবাসন শিল্পের জায়গা করে দেয়া নয়।
অগ্রগতি মানেই সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিপন্নকারী কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়। স্বল্পমেয়াদী সংকট সমাধানের কোন টোটকা পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদী যে ক্ষতের সৃষ্টি করবে সেই ক্ষত থেকে ভবিষ্যতে মুক্তি মিলতেও পারে আবার নাও মিলতে পারে কিন্তু হাজার বছরের আবর্তন-বিবর্তনে আমাদের আজকের যে সুন্দরবন তা যদি হারিয়ে ফেলি তবে সেটি যে আর ফিরে পাব না তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার পালা- আমরা কোনটা চাই? সুন্দরবন নাকি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র?
লেখাটি মেঘবার্তা হতে সংগৃহীত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।