আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্ধ হোক কওমী মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন

আমার ব্লগ আমি আমার ডায়েরীর মতো করে ব্যবহার করি। এখানে আমি একটা গল্প অথবা কবিতা লিখতে পারি, অথবা আজকে কিসের তরকারী দিয়ে ভাত খেলাম, সেইটাও লিখতে পারি। । তখন আমার বয়স ছয় কি সাত। আমি এখনও ভালোভাবে নিজের শরীরের যত্ন নেয়া শিখিনি।

সারাদিন বাই সাইকেলের টায়ার নিয়ে মাঠে দৌড়ে বেড়াই। গ্রামের আরও ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের সাথে কখনও খেলি গোল্লাছুট, কখনও কানামাছি ভোঁ ভোঁ। খাওয়ার সময় হলে আমার মা ডেকে ডেকে নিয়ে যায় প্রায় প্রতিদিন। মা গোসল করিয়ে মাথায় তেল দিয়ে দেন। শিথী কেটে কপালের কোনায় ছোট্ট একটা টিপ দিয়ে দেন।

আর চোখ রাঙিয়ে বলে দেন প্রতিদিনের মত গায়ে ময়লা না লাগানোর কথা। ছয়-সাত বছর বয়সেও আমি নিজ হাতে ভাত খেতে পারতাম না। খেতে পারতাম না বললে ভুল হবে। নিজ হাতে খেতে গেলে প্লেটের চারিদিকে ভাত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হুলুস্থুল কারবার হয়ে যেত। তাই মা-ই সবসময় খাইয়ে দিতেন।

তখনও মা-কে ছাড়া একরাত কোথাও থেকেছি বলে মনে হয়না। মার গলা পেঁচিয়ে না ঘুমাতে পারলে আমার একদম ঘুম আসতো না। বংশের বড় ছেলে বলে অনেক আদুরে ছিলাম আমি। আমার বড় দুই বোন। বাবা-মায়ের কোন পুত্র সন্তান না থাকাতে আমার দাদী পাশের থানার ঐতিহ্যবাহী “ভাঙ্গা মসজিদ” নামক স্থানে গিয়ে মানত করলেন, এবার একটি পুত্র সন্তান হলে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষার উদ্দেশ্যে মাদ্রাসায় পড়াবেন।

তাই ছয়-সাত বছর বয়সে আমাকে ভর্তি করানো হলো পাশের গ্রামের একটি কওমী মাদ্রাসায়। সেই মুহুর্তের হৃদয় বিদারক অনুভূতির কথা আমি বলতে পারবো না। অনেকদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। প্রথম দিন ভাত খেতে গিয়ে আমার হাত খুব কাঁপছিলো। রাতভর কেঁদেছিলাম আমি।

ওদিকে আমার মাও কি আমাকে মনে করে কাঁদছে কিনা তা বোঝার বয়স আমার হয়নি তখনও। দু’দিন বাদেই আমার ভেতর প্রচন্ড ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করলো। শিক্ষকদের অমানুষিক নির্যাতনের নমুনা ধীরে ধীরে দেখতে শুরু করলাম। কওমী মাদ্রাসার শিক্ষকদের মত মায়া-দয়াহীন মানুষ কখনও দেখিনি আমি। যে বয়সের একটা শিশু মায়ের হাতে ভাত খায় প্রতি বেলা, সেই শিশুকে কিভাবে ছোট্ট ছোট্ট ভুলের কারনে লাথি মেরে ফেলে দেয়।

যে শিশুটা আইস্ক্রীমের টাকার জন্য মায়ের আঁচল ধরে টানাটানি করে, সেই বয়সেরই একটা শিশুকে কিভাবে কথার একটু এদিক-সেদিক হলেই মাথার চুল ধরে বাইরে ছিটকে ফেলে দেয়া হয়। সেখানে এসব দেখে আর থাকতে পারিনি আমি। একবছর সেখানে পড়ার পর আর যাইনি ওখানে। অবশেষে আমাকে শহরের একটি বড় মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হলো। সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়ানক।

এখানে দেখেছি কিভাবে এক বেলা পড়া ঠিকমত না দিতে পারায় চড় মেরে কান দিয়ে রক্ত বের করে দেয়া হয়। কিভাবে হুজুরদের কথার একটু এদিক-সেদিক হলেই কাঠ দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করে দেয়া হয়। কনকনে শীতের সময় ফজরের দু’ঘন্টা আগে উঠে ঠান্ডা পানিতে অজু করে ক্লাসে বসতে হতো আমাদের। সাত-আট বছর বয়সে আপনি কোনদিন এই সময়ে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসেছেন? আমাদের কিন্তু ঠিকই উঠতে হতো প্রতিদিন। একদিন উঠতে একটু দেরী হলেই কাঁচা বেত দিয়ে পাছায় একচেটিয়া ভাবে আঘাত করে ঘুম ভাঙ্গানো হতো।

কখনও বেত্রাঘাতের কারণে কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতো। যারা পালিয়ে যেতে চাইতো, তাদেরকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। তবে আমাদের দেখার কেও ছিলোনা। মা-কে কখনও এসব কথা বলতাম না। কেন বলতাম না জানেন? ভয়ে।

আমাদেরকে ভয় দেখানো হতো, হুজুরদের আঘাত শরীরের যেসব স্থানে পড়বে, জাহান্নামী হলে সেসব স্থানে আগুন জ্বলবেনা। আর যারা এর বিরোধীতা করবে, তাঁরা হবে অভিশপ্ত। হুজুরদের সাথে কথা বলতে গেলে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলাও ছিল নিষিদ্ধ। এতে নাকি তাদের সাথে বেয়াদবী হয়। বেত্রাঘাতে শরীর চিরে রক্ত বের হয়ে পরনের জামা ভিজে যাওয়া তেমন আহামরি কিছু ছিলনা।

তবুও ছয়-সাত বছর ছিলাম সেখানে। শুধুই পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ভেবে। কোরান মুখস্থ করা ছাড়া আর কিছুই শিখিনি। আমি জানি। এখনও কওমী মাদ্রাসার অবস্থা সেরকমই আছে।

হুজুরদের মানষিকতার একটুও পরিবর্তন হয়নি। আমি জানি, এখনও আমার মতো অনেক শিশুরা দুলে দুলে কোরান পড়তে গিয়ে মায়ের কথা মনে করে কোরানের পাতা ভিজিয়ে ফেলে চোখের পানিতে। কখনও বা চোখের কোনেই কল্পনা হয়ে জমাট বেঁধে থাকে সারা গ্রাম ছুটাছুটি আর মায়ের আচলের তলে লুকানোর কথা। তাদের কথা কেও জানবেনা কোনদিন। তারাও বলতে পারবেনা তাদের কথা গুলো,ব্যথা গুলো।

আমরা শিশু অধিকার নিয়ে যারা কথা বলি, তারাও তাদেরকে নিয়ে কোন কথা বলিনা। তাঁরা একমুখী জ্ঞান নিয়ে হচ্ছে মসজিদের সাধারন ইমাম মুয়াজ্জিন। দিন যাচ্ছে, সবকিছুরই উন্নতি হচ্ছে। তাঁরা অজ্ঞ, অজ্ঞই থেকে যাচ্ছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.