আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাচনী কার্নিভ্যাল

গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন অপরিহার্য। নির্বাচনী প্রচারাভিযান নির্বাচনের একটি পর্ব। ভোট গ্রহণ একটি পর্ব। ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণা আরেকটি পর্ব। তার পরের পর্বটি দীর্ঘ।

চার-পাঁচ বছরব্যাপী। কোনো কোনো রোমান ক্যাথলিক দেশে কার্নিভ্যাল একটি সর্বজনীন উৎসব। বাংলাদেশে কার্নিভ্যালের প্রচলন এখনো শুরু হয়নি। তবে বঙ্গীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনী প্রচারাভিযানকে বলা হয় সর্বদলীয় কার্নিভ্যাল।
বাঙালি বহুরূপী।

বিচিত্র রূপ ধারণ করতে বাঙালি বিশ্বের যেকোনো জাতির থেকে বহু এগিয়ে আছে। বাঙালির বহু রূপের একটির প্রকাশ ঘটে তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানের মধ্যে। যে হাত চড়-থাপ্পড়ে বিশেষভাবে দক্ষ, সেই হাতই নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় চায় ভোটারের পিঠে বোলাতে, গালে আদর করতে। যে নেতার চোখ রক্তজবার মতো টকটকে লাল থাকে অন্য সময়, নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তাঁর মদির-আঁখিতে প্রেমিকের আবেশ। যিনি সালামালেকুমের জবাব নেননি কস্মিনকালেও, যিনি ক্ষমতাধরদেরই শুধু সালাম ঠুকতে অভ্যস্ত, তিনিই শুধু সালাম নয়, সালাম দিয়েই জড়িয়ে ধরছেন।

মাঝবয়সী রিকশাচালককে বলছেন—এবার পাস করলে রিকশাচালকদের জন্য খালের পাড়ে আবাসন প্রকল্প করার ইচ্ছা আছে ইনশা আল্লাহ।
এখন কয়েকটি নগরে নির্বাচনী দামামা বেজে উঠেছে। তোরণ, ব্যানার, বিলবোর্ড, পোস্টারে ভরে গেছে নগরের রাস্তাঘাট, দেয়াল, গাছপালা, যানবাহনের শরীর। ডেকচি ডেকচি রান্না হচ্ছে খিচুড়ি ও তেহারি। এখন ঘরে ঘরে টিভি থাকায় নির্বাচনী কার্নিভ্যালটা দেশি-বিদেশি সব মানুষই ঘরে বসে বাধ্যতামূলকভাবে উপভোগ করছে।

এক মাজাভাঙা বুড়ি কোনোরকমে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন। যম নয়, প্রার্থীর মুখোমুখি ‘খালা’ বলেই দুহাত ধরে কোমর সোজা করে তাঁকে খাড়া করেন। তাঁর কোমরে যত সমস্যাই থাক, তাঁর দোয়া চাই। দোয়াটা মাথায় হাত দিয়ে করলে বরকত বেশি। সুতরাং বৃদ্ধার হাত প্রার্থীর মাথা পর্যন্ত নিতে তাঁকে টান মেরে খাড়া করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।


এক যুবতী-মা তাঁর দেড় বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পথের কার্নিভ্যাল দেখার কৌতূহল। প্রার্থী তাঁর কোলের শিশুকে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে আদর করছেন। বাচ্চাটি ভোটার নয়। ভোটার ওর মা।


গত পঁচিশ বছরে যে বৃদ্ধকে কেউ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেনি, তাঁকেও করা হচ্ছে কদমবুসি। বলতে গেলে দুর্নীতিও সহ্য করা যায়, কারণ তা মানুষ করে গোপনে। ভণ্ডামি ও কপটতা মানুষ করে প্রকাশ্যে। সুতরাং দুর্নীতির চেয়ে ভণ্ডামি কম মারাত্মক নয়।
বঙ্গীয় ভোটপ্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় সাধারণত সংবিধানসম্মত পোশাকটাই পছন্দ করেন।

বাঙালি যেহেতু প্রবল ধার্মিক, তাই তাঁর রয়েছে একটি রাষ্ট্রধর্ম। তা রয়েছে সংবিধানে খোদাই করা। যে ধর্মকে করা হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম, সে রাষ্ট্রধর্মের অনুসারীদের পোশাক শুরু হয়েছে মাথা থেকে। উন্নত দেশগুলোর মানুষের মাথার ভেতরটাই মূল্যবান, কিন্তু বাঙালির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মাথার উপরিভাগটা। মাথার পরিচ্ছদ অবশ্য বহু জাতিরই রয়েছে।

কোনো নেপালি বা ইন্দোনেশীয়র সর্বোচ্চ পোশাকটি একই রকম। বাঙালিরটি বিচিত্র। কারণ, সে বহুরূপী।
ইংরেজরা তাদের দেশের মতো উপমহাদেশেও গণতন্ত্রচর্চা শুরু করেন স্থানীয় পর্যায় থেকে। ইউনিয়ন বোর্ড ছিল খুব ভালো ব্যবস্থা।

পৌরসভাগুলোও তা-ই। এলাকার সবচেয়ে যোগ্য, সমাজসেবকদের কেউ নির্বাচিত হতেন। সেকালে অনেক সৎ, যোগ্য ভালোমানুষ নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ঝামেলায় যেতে চাইতেন না। জনগণই তাঁদের জোর করে দাঁড় করাতেন। অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন।

টাকার খেলা ছিল না। মাস্তানি তো নয়ই। আইনভঙ্গের প্রশ্নই আসে না।
যত রকম নির্বাচন আছে তার মধ্যে পৌর নির্বাচনই হওয়ার কথা সবচেয়ে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে। কারণ, এলাকা ছোট।

সবাই সবাইকে চেনে। এখানে কদমবুসি, বাচ্চা আদর, কোলাকুলি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন হয় না। কপটতা ও ভণ্ডামি একটি সমাজকে যতটা ক্ষতি করে, সিডর বা মহাসেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তা করে না।
যে দেশে স্থানীয় সরকারের গণতন্ত্রচর্চা শুদ্ধ ও সুন্দর নয়, সে দেশে জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারকে করে রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন এক-একটি প্রতিষ্ঠান।

ওগুলোকে স্বাধীন ও সচল করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কারণ তাতে সাংসদদের আধিপত্য নষ্ট হয়। সংবিধানে ‘স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করিবার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল সংরক্ষণের ক্ষমতা’ স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিটকে দেওয়া হয়েছে। ৫৯ এবং ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার বিধানকে কার্যকর করতে জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের বিধান রয়েছে। সাংসদেরা নিজেদের স্বার্থে স্থানীয় সরকারে কর্তৃত্ব বহাল রাখার অসাধু উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় আইন আজও প্রণয়ন না করায় জনগণের ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। ফলে বিজয়ীদেরই শুধু ভাগ্য খোলে, নাগরিকদের নয়।

পাওয়ার মধ্যে নগরবাসী পায় রাশি রাশি মিথ্যা আশ্বাস। ভোটারদের কেউ পান ভোটের আগে সালাম ও কদমবুসি, কারও দুধের বাচ্চা পায় ভীতিকর আদর। ক্ষমতার প্রশ্ন যদি ওঠে, তাহলে একজন নাগরিক ও একটি কলার খোসার মধ্যে পার্থক্য বিশেষ থাকে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.