আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তগদ্য: মনিকুন্তলা

ডুবোজ্বর আমি লিখলাম, তুমি উড়ে গেলে আমি ফুল হয়ে যাই; তুমি পুড়ে গেলে আমি ধোঁয়া হয়ে ছাই। এই গল্পটা আমার রক্তের ভিতরে যে গল্পের নদী আছে তার থেকে আমাকে দিলো একটি মৃগেল মাছ। মৃগেলের চোখে অশ্র“। তার অশ্র“ নদীর ভিতর আমি দেখি, কেউ দেখে না। যেইসব হাত খালি ছিলো— আমরা তাদের হাতে ফুল তুলে দিই।

তোমরা এসো। গোল হয়ে বসো। গান হবে। জানলার ধারে লেবুগাছটায় হলুদ কুড়ি এসেছে। কচি লেবুপাতার গন্ধে রোদ আর বাতাস পাগল পাগল।

গোল হয়ে বসো, গোল হয়ে বসো। আমার মাথার ভিতর পৃথিবীর আকার আবর্তিত হয়। এইসব মনে পড়ে আমি লেবুপাতাটার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলি। সে আমার হাসির উত্তর দেয়, রোদের ভিতর একটুখানি নড়ে উঠে। কী বেদনা সে কি জানো? তার কাঁচাপাকা চুলে বাদামের গন্ধ।

কেউ কারো চুম্বন ধরে উত্তরের ঘরে গভীর অসুখ হয়ে যায়? এই হাহাকার কে কাকে দেবে? আমি ঘরটার দরজা খুলে ঢুকলাম। একটাই জানলা বন্ধ আছে। খুলে দিলাম তাকে। জানলা দিয়ে কেমন প্রাচীনপ্রত্নপুরনো ফুলের ঘ্রাণদল বাহিরে উড়ে গেলো এক নিমিষে আমি ধরতেই পারলাম না। পশ্চিমের দেয়ালে একটা পেইন্টিং গ্রিক কোনো দেবীটেবি হবে।

রঙটা এখনো উজ্জ্বল। আলোছায়ার ভিতর এই দীপ্তি একটা অন্যপথ দেখালো। আমার মাথার ভিতর গ্রামগুলি, আমার মাথার ভিতর উপশহরগুলি কেমন করে পেঁচিয়ে গেলো এখন ভাবতে পারছি না। লেভেন্ডার যখন হয়ে গেলো চন্দন— সেন্টের শিশিতে তখন কারো অশ্রু। আমি মুক্তি পাওয়ার জন্যে হাতের আঙুল সুতীব্র কামড়ে পড়ে থাকি।

এক আঙুলে তিনটা করে কাটাদাগ। তার মাথা থেকে মাঝখানে সিঁথি ভেঙে নেমেছিলো নদী, এই নদী তার চুল। যার গন্ধে কবি বেড়ে উঠে খাতায় পাতায় আকাশে বাতাসে নির্ঝরে। তার শ্যামল রঙে ছিলো মায়ের ত্বকের ঘ্রাণ। তার হাতে হারমোনিকা।

আমার হাতে বাঁশি, বাঁশিতে সাতটি জানলার গান, আমার সপ্তপদী অভিমান। তার কলাপাতা রঙ শাড়ি, তার পায়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম। সে শিশির দেখে লজ্জা পেলে তাকে বলি সমুদ্রের স্বর। আমরা একদিন জীবন বদল করেছিলাম ফুলতোলা কুয়াশার ভিতর। কুয়াশার ওপারে সমুদ্র গাইছিলো গান।

ধূলিকণা বৃষ্টির প্রতীক্ষা করে। ধূলিকণার ঝড়ের ভয়। একজন কবি সারাটাবছর তবে বাদল হয়ে রয়। কবির বুকে কাদার আলতা। পাহাড়ি পথে হেঁটে গেলে পাহাড়ের সিঁড়ি নেমে যায় জলে।

আমি তার চোখের পাতায়, চুলের সিঁথিতে চুম্বন আঁকি; তার গায়ের গন্ধ নিই। আমি তাকে একটা হারমোনিকা দিয়েছিলাম, ওটার বাক্সে ছিলো মেঘদূত জড়ানো। সে আমাকে দিয়েছিলো বাঁশি। আমরা এইভাবে জীবন বদল করেছিলাম। তার সিঁথি মুখে কাটাদাগ রৌদ্র আর আমি দেখি।

আমরা দুজন মিলে তাকে মিছিলে পাহারা দিই। তার বুকের ভিতরকার কান্নাকে বের করে বিছানার চাদরে, খাতার পৃষ্ঠায়, উদাস পুকুরে, আমার চোখের ভিতর, আমার বুকের ভিতর ছড়িয়ে দিই। সে জানলার ওপারে স্বর্ণচাপার ডালে তাকিয়ে থাকে। ওখানে পাতার আড়ালে তিনটি ফুলের পাশে রবিনাথের গানের একটি পাখি। পাখির পাশে উড়ে কবীর সুমনের গান।

মনিকুন্তলা একটি ফুলের নাম, মনিকুন্তলা একটি পাখির নামও হতে পারে। আমাকে সে মনিকুন্তলা দিয়েছিলো নাম। আমরা বৈশাখের ঝমঝম বৃষ্টির ভিতর আম কুড়াই। আমরা সুন্দর। আমরা জিবের ভিতর জিব জড়িয়ে আরো সুন্দর হয়ে যাই।

পাহাড়ের সিঁড়ি উঠে গেছে— নেমে গেছে জলে। বাতাসের তারে ঝড়ের কাঁপন জেগে থাকবে দেখবো। বসে আছি তারার আলোয়। লিখেছিলাম, কাল চলে গেলে অনেকদিন ভুলে যাবো চুম্বন। রুক্ষঠোঁটে জেগে থাকবে বৈশাখীদুপুর।

তারাগুলি নিয়ম করে খসে পড়বে বালির রেকাবে। যাকে পাবে সে নাম জানে না ফুলের। শাদাফুল ফুটে থাকবে দুইটিগাছে। ঝরে পড়লে খুঁজবে না কোনো চোখ। একটি পাখি নীরবে ডেকে ডেকে বলে যাবে নিজের নাম।

লতানোপথে ভাঁটফুল গন্ধ ছড়াবে একা। পাহাড়ের সিঁড়ি নিয়ে যাবে পোড়োবাড়ি তলে— পাহাড়ের সিঁড়ি নামিয়ে দেবে অনিশ্চিত জলে। কোনোদিন ভোরে কেউ সপ্তক ছিঁড়ে ফেলে নামতে চায় জলে। তার খাতাগুলি জলে ভেসে ভেসে ডুবে গিয়েছিলো। শাদাশাড়িতে তার আকাশ আঁকতে মানা; সপ্তক ও সমাপ্তির কাছে মৃত্যু যায় না জানা।

খাতাগুলি ডুবে গিয়েছিলো সকলে অক্ষরের ভারে। অক্ষরগুলি কিভাবে শব্দকে করেছিলো ধারণ অ›ধকারে? সপ্তক ও খাতাসব ছিলো কোনোদিন। আমি তার প্রিয়তম খাতা হয়ে যাই। সে আমার বুকে লিখে রাখে শূন্যতা। শর্ষেক্ষেত দেখে তার কার কথা মনে পড়ে আদিগন্ত হলুদের ভিতর, অবিনাশী জোছনায় সে কাকে ভেজাতে চায় চাঁদের দুধে? সমুদ্রে যেতে যেতে তার চাদরখানি হারিয়ে গেলে সমুদ্রের ঢেউ হয়ে যায় তার চাদর।

ওখানে আমরা যেইঘরে থাকতাম— জানলা দিয়ে একটি নদী দেখা যেতো একশোমাইল লম্বা। আমরা দেখতাম মাঝে মাঝে। আমাদের কাছে এক মাইলদীর্ঘ একটি সুতো ছিলো শাদা। আমরা সুতোটা জানলা দিয়ে বের করে দিতাম। একমাইল নদীই আমরা ঘরে নিয়ে আসতে পারতাম।

ওটা আমাদের শয্যায় প্রবাহিত হতো। আমরা কেউই সাঁতার জানি না। নদীতে স্নানে নেমে দুজনেই ডুবে যেতাম। অনেকক্ষণ পর সে মরে ভেসে উঠতো। আর আমি তলিয়ে যেতাম।

প্রতিটাদিন সুতোটা আমাদের মৃত্যুর আয়োজন করতো, করতো জীবনের উদ্ভাস। দুজন পাশাপাশি বসে তানপুরায় তুলছে বাদলের মীড়, আরাধ্য মেঘমল্লার। এই দৃশ্য দ্রষ্টব্য হলে মনে হয়, পাশাপাশি দুজন মিলে পৃথিবীর সকল সুন্দরকে ছোঁয়া যায়। তুমি বলেছিলে বলেই আমি ঠিক করেছিলাম তোমার হাত ধরে দিগন্ত ছোঁবো। তবে কেনো হাত ছেড়ে দেবে? যাকে তুমি প্রতিদিন দেখো আয়নার ভিতর— সেইই আমার সুন্দর।

যার দেহের ঘ্রাণ কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। একদিন তারা প্রায় সারাদিন ধরে চুমো খায়, আর কিছু খায় না। তাদের ক্ষিধে ক্লান্তি কিছুই লাগে না। একদিন সিদ্ধার্থ-উপকূলে আমাদের ভালো লাগে নি বনভূমি, নদীপাঠ। আকাশের নীল পরস্পরের রন্ধ্রে মিশিয়ে দিতে গিয়ে পেয়েছি নিমপাতার স্বাদ।

হে মাধব, আমাদের বর দাও সুনিপুণ করতোয়া কুসুম। আমাদের ভালো লাগে নি কথিত ফুলের বিষ। আমরা অমর হওয়ার স্বপ্ন দেখে নিভিয়ে ফেলেছি চোখের দ্যুতি। শূন্যতা কাঁদলো স্বপ্নভঙ্গের সকাল। সকাল আমাদের জানিয়ে দিয়েছে আমরা ভালো নেই...।

আমাদের ভালো লাগে নি বনভূমি। তারপরও নিমফুল হিরণ্ময় স্মৃতি। আমাদের ভালো লেগেছিলো বনভূমি, নদীপাঠ। তারপর সে প্রিয়তম রাত। প্রিয় রাত, কেনো তুমি ভোর হও? তুমি আমার বুকের উপর হাত রেখে ঘুমিয়ে থেকো চিরদিন— আমি জেগে জেগে তোমার ঘুমন্ত চোখে চোখ রেখে সোনালি মাছ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।