আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা হতে পারে তিলোত্তমা

আমরা আদর করে ডাকি তিলোত্তমা ঢাকা । কিন্তু ঢাকা মোটেই তিলোত্তমা নয় । গরীব দেশের রাজধানী , তার উপর আবার মেগাসিটি । আমাদের গ্যাসের অভাব, পানির অভাব, অভাব বিদ্যূতের । আসলে সব কিছুরই অভাব ।

তবে প্রকৃতি একে বুক ভরে দিয়েছে । সমতল উর্বর ভূমি । চারপাশে বুড়িগংগা, শীতলক্ষা, তুরাগ বড় আদরে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে । একসময় এর ভেতরে শিরার মত ছড়িয়ে ছিল ষাটেরও বেশি খাল । এখনো টিকে আছে ছাব্বিশটি ।

এত সুন্দর প্রকৃতির স্নেহধন্য নগর দুনিয়ায় খুব বেশি নেই । এর মৃত্তিকা যেন পরশ পাথরে ছোঁয়া । যত্নে-অযত্নে বেড়ে উঠে এর বৃক্ষরাজি । পত্র পল্লবে নিজেই রূপসী সেজে বড় মনকাড়া করে রূপের পরশ বোলায় চারপাশে । ইংলিশ রোড বরাবর পূর্ব পশ্চিমে একটি রেখা কল্পনা করে এর উত্তর পাশের সবুজ বেষ্টনীগুলো লক্ষ্য করি ।

পুর্ব দিকে বলধা গার্ডেন, মাঝে বংগভবন ও এর সম্মুখভাগ, ওসমানী উদ্যান । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো এলাকায় নানাবিধ গাছ-গাছালীর সমাহার, মাঝের রাজপথে বেশ কিছু সুবিশাল প্রাচীণ বৃক্ষ । <!--break--> কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে গাছ পালায় ঘেরা রাজপথ গিয়ে মিশেছে কাছেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সীমানার কাছে । সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পর শুরু রমনা পার্ক । পলাশীর কাছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রমনা পার্ক ও এর সংলগ্ন কাকরাইল বেইলী রোড মন্ত্রীপাড়া পর্যন্ত ঢাকার একটানা বৃহৎ সবুজ বেস্টনী ।

মাঝ বরাবর এর কিছুটা উত্তরে গেলে সোনারগাঁ হোটেলের সামনে ডিসিসির একটি পার্ক, এতেও সামান্য গাছ পালা আছে । পান্থপথ শেষে পশ্চিমে এলে শুরু ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা । লেকের জল আর বৃক্ষরাজির অপরূপ মিলনমেলা । আবাসিক এলাকার প্রশস্ত রাস্তাঘাটেও যথেষ্ট গাছ পালার দেখা মেলে । ধানমন্ডির উত্তরে লালমাটিয়াতেও ইতি উতি দেখা মিলবে অল্প সল্প সবুজের ।

কিন্তু এর উত্তরে পুরো মোহাম্মদপুর , শ্যামলী , রিংরোডের বাইরে মোহাম্মদপুরের বর্ধিতাংশ ; ধানমন্ডির পশ্চিমে রায়েরবাজার, জিগাতলা প্রায় টেকো বুড়োর মত, গাছ গাছালী যা আছে তা মাইল পোষ্টের মত দূরে দূরে । মানিক মিয়া এভিন্যু থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা , চন্দ্রিমা উদ্যান, আশে পাশের রাজপথ সমূহ- বিজয় স্মরনীর পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন গাছ গাছালীতে আচ্ছাদিত । পুরাতন বিমান বন্দর সড়কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছ থেকেই শুরু, এরপর উত্তরে বিমান বাহিনী এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের আবাসিক এলাকা হয়ে ঢাকা সেনানিবাস , মহাখালী ও বনানী ডিওএইচএস এলাকায় যথেষ্ট নয়নাভিরাম সবুজ বৃক্ষাদির সমাহার । ঢাকার উত্তর পশ্চিম দিকে বিশাল সবুজ এলাকা এর মিরপুর চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘিরে । সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল এলাকার সামনে পেছনে মধ্যবর্তী রাস্তায় বেশ কিছু সবুজ বৃক্ষরাজির দেখা পাওয়া যায় ।

পান্থপথের উত্তরে রাজাবাজার, ইন্দিরা রোড, শুক্রাবাদ, তেজতুরিবাজার, তেজকুনিপারা, নাখালপাড়া, আরজতপাড়া, মহাখালী, পান্থপথের দক্ষিনে কলাবাগান, কাঠালবাগান, এলিফ্যান্ট রোড, সেন্ট্রাল রোড, ক্রিসেন্ট রোড ইত্যাদি এলাকার গাছপালা যেন ড্রয়িং রুমে রাখা একুরিয়ামের মাছ । এদিকে আরো আছে মগবাজার, ইস্কাটন, মৌচাক এলাকা- একই অবস্থা এসবেরও । খিলগাও, শাহজাহানপুরে কিছু গাছপালা থাকলেও গোড়ান, বাসাবো, মাদারটেকের অবস্থা রাজাবাজার তেজতুরিবাজারের মত, একই অবস্থা মিরপুর অঞ্চলের কল্যানপুর, পাইকপাড়া, শেওড়াপাড়া, তালতলা, মনিপুর, কাফরুলের । আরো আছে বাড্ডা, রামপুরা, কালাচাঁদপুর ইত্যাদি এলাকা । তবে রাজউকের অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান , বনানী, বারিধারার অবস্থা এক্ষেত্রে যথেষ্ট ভাল ।

কিন্তু প্রাইভেট আবাসিক এলাকা সমূহ, যেমন পল্লবী ২য় পর্ব, বনশ্রির অবস্থা খুবই নাজুক-পরিকল্পিত এসব আবাসিক এলাকায় বাসস্থান নির্মান ও যাতায়াতের পরিকল্পনা দৃশ্যমান, সবুজায়ন সেখানে অনুপস্থিত । তারপরও বিদ্যমান সবুজ বৃক্ষরাজি যথাযথ সংরক্ষন করা হলে, বিশেষত গাছ কাটা বন্ধ রাখলে অবস্থার ক্রমোন্নতির আশা করা যায় । বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার সৌন্দর্য বর্ধনে ডিসিসির উদ্যোগ লক্ষ্য করার মত । রাজপথগুলোর সম্ভাব্য প্রশস্তকরন, উন্নত মানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহার করে সুদৃশ্য ফুটপাত নির্মান, সড়ক বিভাজক ও সড়ক দ্বীপ নির্মান, এসবে গাছ গাছালী রোপন ও পরিচর্যার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি বেশ তৎপর । চমৎকার কিছু ল্যান্ডস্কেপ চোখ জুড়ায় ।

মানিক মিয়া এভিন্যূর পূর্ব প্রান্তে, সায়েন্স ল্যাবোরেটরীর সামনে, বিজয় স্মরনীর উত্তর পাশে ল্যান্ডস্কেপগুলো নজর কাড়ে । উপরে বর্ণিত সবুজ বেষ্টনী সমূহ, পার্ক ও লেক, বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্ক ও সুদৃশ্য ফুটপাত সমুহ, সড়ক বিভাজক ও দ্বীপের সবুজ বৃক্ষরাজি ঢাকাকে তিলোত্তমা করার উল্লেখযোগ্য উপাদান নিঃসন্দেহে । তবে কিছু বিষয়ের চিত্র বেশ হতাশাজনক । দুটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই । প্রথমতঃ ফুটপাত, বিপুল ব্যয়ে এগুলো কেন সুদৃশ্য করে নির্মান করা হয়েছে, পথচারী চলাচলের জন্যতো ? কিন্তু এতে পথচারী চলাচলের সুযোগ নেই ।

ফুটপাতগুলো দখল করে আছে নানাবিধ অস্থায়ী দোকানপাট, মোটর সাইকেল ,গাড়ির গ্যারেজ ইত্যাদি । এতে আবার সাইকেল মোটর সাইকেলের অবাধ যাতায়াত । পথচারীরা ফুটপাতে বড় অসহায় । এদিকটিতে যতটানা আইনি তারচেয়ে বেশি দরকার নাগরিক সচেনতা । তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ডিসিসি, পুলিশ এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন বিভাগেরও ফুটপাতসমূহ কার্য্যকর রাখায় আরো তৎপর ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন ।

দ্বিতীয়ত : পরিবেশ নোংরা করা আমাদের অভ্যাস । সেদিন লক্ষ্য করলাম বিজয় স্মরনীর পূর্ব পাশের চমৎকার সবুজ ঘাসাচ্ছাদিত সড়ক দ্বীপে দুজন লুঙ্গিপরা বন্ধু বসে আয়েশ করে আখ খাচ্ছে । ছোবাগুলো এদিক সেদিক ছুঁড়ে ফেলছে । ওদের পাশেই কয়েক যুবক মিলে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে । বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খাচ্ছে ।

খোসা যথারীতি ফেলছে ঘাসের উপর । এ কাজগুলো ওরা করছে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে । কাজটি ঠিক হচ্ছেনা এমন ভাব ভংগি বা কোন অপরাধ বোধের বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যায়নি । প্রতিটি পার্কে , বাগানে, লেকের পাড়ে ভ্রাম্যমান বাদাম বুট, ঝাল মুড়ি, চানাচুর, আইস্ক্রীম ইত্যাদির পসরা তো বসছেই । পার্কের গেটের কাছেইনা , ভেতরেও ঢুকে পড়ছে ।

মানুষজন পার্কের বেঞ্চিতে, লেক বা পুকুর জলাশয়ের পাশে বসে অথবা হেঁটে হেঁটেও খাচ্ছে বাদাম, ঝালমুড়ি, আইস্ক্রীম । বাদামের খোসা, আইসক্রীমের কাগজের আবরন, ঝালমুড়ির কাগজের ঠোঙ্গা ফেলছে পানিতে, পথে প্রান্তরে, সুন্দর ঘাস ঢাকা মাঠে যথেচ্ছা । তাই রাস্তা ঘাট, পার্ক, ফুটপাত, জলাশয় সর্বত্র ছেঁড়া রংবেরঙ্গের কাগজ, ঠোঙ্গা, পানি বা কোল্ড ড্রিন্কের খালি পেট বোতল , ক্যান, নানা রঙের পলিথিনের ছড়াছড়ি । যা নিতান্তই দৃষ্টিকটু । একি শুধু নাগরিক বদভ্যাসের কারনেই হচ্ছে ? অবশ্যই নয় ।

বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে, পার্কে, লেকের পাড়ের কাছাকাছি আছেকি ময়লা বা উচ্ছিষ্ট ফেলার কোন ব্যবস্থা বা ডাস্টবিন ? নেই । ডিসিসির ব্যবস্থাপনায় এলাকা বা ওয়ার্ড ভিত্তিক কিছু বিশালাকার ডাস্টবিন আছে, যাতে এলাকার হোটেল দোকানপাট এবং বাসাবাড়ির জমানো আবর্জনা ফেলা হয় । কিন্তু একটি পরিচ্ছন্ন নগরীর জন্য প্রয়োজনীয় বর্জ ব্যবস্থাপনার ধারনাই ঢাকায় বিকাশ লাভ করেনি । প্রতিটি পাবলিক প্লেসে, রাস্তা ঘাটের বিভিন্ন পয়েন্টে, পার্কে, লেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাস্টবিন ও এর মাধ্যমে বর্জ সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আশু সূচনা প্রয়োজন । ছোট বা মাঝারি বক্স আকৃ্তির থেফটপ্রূফ ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।

সার্বিক ভাবে এ কাজটি করা একক ভাবে করা ডিসিসির পক্ষে সম্ভব না হলেও সমস্যা নেই । সরকারি বেসরকারি আন্তকর্তৃপক্ষীয় সমঝোতা বা প্রয়োজনে আন্তমন্ত্রনালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এটির বাস্তবায়ন সম্ভব । যেমন, ডিসিসি নিয়ন্ত্রিত স্থাপনা, পার্ক, মার্কেট ইত্যাদিতে ডিসিসি নিজে ব্যবস্থা করতে পারে । বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্বশাষিত সংস্থার অফিস বা অফিসার-কর্মচারীদের আবাসিক এলাকার ভেতর বাইরে নিজস্ব উদ্যোগ ও ব্যয়ে ডাস্টবিন স্থাপন ও নির্দিষ্ট সময়ে ময়লা ডিসিসির বড় নিকটবর্তী ডাস্টবিনে স্থানান্তরকরন এই কার্যক্রমের আওতাভূক্ত থাকতে পারে । একই বিষয় প্রজোয্য হতে পারে বেসরকারী সংস্থা, স্কুল ,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শপিং মল ইত্যাদিতে ।

এক্ষেত্রে মূল প্রকল্প হবে যেহেতু ডিসিসির, সেজন্য বিভিন্ন সংস্থা/প্রতিষ্ঠানকে ডিসিসিই প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ, ডাস্টবিনের নক্সা ইত্যাদি সরবরাহ করতে পারে । এরই সাথে ডিসিসির বিদ্যমান বৃহৎ ডাস্টবিনের আধুনিকায়ন ও সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে । বিষয়টি মোটেই জটিল কিংবা কঠিন কিছু নয় । প্রয়োজন সদিচ্ছা আর উদ্যোগ । এর মাধ্যমেই আমরা শুনতে পারি একটি সত্যিকার তিলোত্তমা ঢাকার পদধ্বনি ।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় অথবা ডিসিসির উদ্যোগের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.