আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

করুণাধারার খোঁজে(কিঞ্চিৎ ১৮+) - অনিক মল্লিক

অগোছালো এই আমি করুণাধারার খোঁজে ১ জীবন কখন কোন দিকে মোড় নেয়, কেউই আগে থেকে বলে দিতে পারে না। শুরু হতেই পাথরের মতন জীবন গড়িয়ে যেতে থাকে, যেতে যেতে পথে সে মাড়িয়ে যায় অসংখ্য ছোট ছোট ঘাসফুল। আবার বড় কোন হিমবাহ এসে সেই পাথররূপী জীবনটাকেই ধসিয়ে দিয়ে যায়। মানুষ কেন যেন এই জীবনটাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে শিখল না, জীবনই তাকে সর্বদা চালনা করে আসছে, ভবিষ্যতেও করবে। ঈশ্বর নামক এক সর্বশক্তিমান সবার মাথার ওপরে বসে থেকে তার ছড়ি ঘুরাচ্ছেন, আর জীবনও ঘুরছে সেই তালে।

মানুষ তার হাতের পুতুলমাত্র। এই কাহিনী কেবল একটি ঘটনাকে ঘিরে নয়, বরং অনেকগুলো ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে পুঞ্জীভূত এটি। এটা জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষের গল্প, ভাগ্যের কাছে কখনো নতি স্বীকার না করার গল্প, বিশাল ঝড়ে ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিকের গল্প, হতাশার সাথে লড়াইয়ে আশার জয়ের গল্প, এটা জীবন নামক জটিল এক জালের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়ের গল্প। ২ রাতুল অস্বস্তিতে নড়ে-চড়ে উঠল। তার বস্ তাকে অকারণে ধমক দিচ্ছে।

মন-মেজাজ হয়ত অফিসে আসার আগে থেকেই খারাপ ছিল। অফিসে একটা কানা-ঘুষা চলছে ইদানিং- বস্রে নাকি তার বৌয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো চলছে না। ডিভোর্সও হয়ে যেতে পারে। “রাতুল সাহেব, এভাবে তো আর চলতে পারে না। আমি এই ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হয়ে আসার মূল কারণই ছিল এখানকার ইনডিসিপ্লিন দূর করা।

আপনি সবসময় লেইট করে অফিসে ঢোকেন- খেয়াল করেছি আমি। ” রাতুল মোটেও প্রতিদিন দেরি করে অফিসে আসে না। আজ অবশ্য কিছুটা দেরি হয়েছে। বাস-ধর্মঘট না কী যেন ছাই চলছে, আর সিএনজিও রাস্তায় ফাঁকা পাচ্ছিল না। বস্রে পারিবারিক সমস্যার বলি হচ্ছে- এটা ভেবে চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল সে।

“এর রিপিটেশন যদি আরেকদিন দেখি, আপনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে- বলে দিচ্ছি। জি.এম. সাহেবও আপনার চাকরি বাঁচাতে পারবে না। ” রাতুল কোন কথা না বলে বেরিয়ে আসল। আসলে এই চাকরিটা ওর খুবই দরকার। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে সে বড় চাচার টাকায়।

এমন নয় যে তাকে তার আত্মীয়-স্বজন কেউই দু’চোখে দেখতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই সে অনেক আদরে বড় হয়েছে। তাকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে বড় চাচাকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে। বড় চাচার নিজেরও একটি ছেলে, আরেকটি মেয়ে আছে। মেয়েটি বড়, প্রায় রাতুলেরই বয়েসী।

বড় চাচা ছোট একটি সরকারি চাকরি করতেন, আয় ছিল অল্প। বিপতœীক মানুষটি রোজ সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে পড়াতে বসাতেন তাদের তিনজনকে। রাতুল একটু বড় হয়েই সিদ্ধান্ত নেয় যে পড়াশোনা শেষ করে আর বড় চাচার বোঝা হয়ে থাকবে না। একাউন্টিং থেকে বি.কম. পাশ করে সে চাকরি-যুদ্ধে নামে। এই চাকরিটা পেতে তাকে বেগ পেতে হয়েছে অনেক।

একটা ভালো চাকরি এ মন্দার বাজারে হিরের মতনই দামি। এ চাকরিটা হারালে তাকে আবার পথে বসে যেতে হবে। সামিট গ্রুপের কর্পোরেট অফিসের এ্যাসিস্ট্যান্ট একাউন্টেন্ট রাতুল। মাস তিনেক হল জয়েন করেছে। সারাদিন সে ঘাড় গুঁজে হিসেব কষতে থাকে।

ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর। তার হাতের ওপর াদয়ে এত টাকার লেনদের হয়ে যাচ্ছে, অথচ এর একটা কড়িও তার না! তবে মাঝে মাঝে কম-বয়েসী সুন্দরী শায়লার সাথে তার চোখাচোখি হয়। তখন মনে হয়, জীবনটা তো এতো বাজে না! বস্রে ধমক খেয়ে মুখ গোমড়া করে নিজের ডেস্কে বসে ছিল রাতুল। আর একটু পরেই জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার শায়লা বিপরীত দিকের ডেস্ক থেকে তার দিকে তাকিয়ে স্মিত একটা হাসি উপহার দিল। রাতুলের মন কেন যেন আবার চনমনে হয়ে উঠল! ৩ সুমিত ভার্সিটির সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল।

একটি মেয়ে অপেক্ষা করছে চার তলায়। তাহমিদা নামের এ মেয়েটি তার এ মাসের দ্বিতীয় শিকার! সুমিতের এই একটিমাত্র শখ- সুন্দরী কারোর সাথে বন্ধুত্ব করা, তার সাথে কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত কাটানো, তারপর নতুন কাউকে ভালো লাগলে বর্তমানকে অতীত বলে বিদেয় করে দেওয়া। ভালো মানুষ সে নয়, তবে তার একমাত্র ভালো দিক হচ্ছে- কোন প্রকার ভালোমানুষি সে দেখানোর চেষ্টাও করে না! সুমিত তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। উচ্ছন্নে যাবার জন্য বাবার ঠিক যতটুকু টাকা-পয়সার প্রয়োজন, তার বাবার তার থেকেও কিছু বেশি টাকা আছে। দেশের সম্ভ্রান্ত এবং ধনী হিন্দুদের মধ্যে সুমিতের বাবা শীর্ষস্থানীয়।

এস.এস.সি., এইচ.এস.সি.- কোনোটাতেই সুমিতের ফলাফল খুব একটা আশানুরূপ ছিল না, তবে তাতে সমস্যাও খুব একটা হয় নি। অঢেল অর্থের জোরে ঠিকই সে ভর্তি হয়ে গেছে ভালো একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। তার নিজস্ব একটা স্পোর্টস কার এবং একটা বাইকও আছে। একেকদিন সে একেকটায় চড়ে ক্লাস করতে আসে। তবে দুর্ভাগ্যবশত, ক্লাস আর করা হয় না।

তার মূল্যবান সময় থেকে কখনো সে ইলাকে কিছুটা দেয়, কখনোবা মিলাকে। এ ধরণের ছেলেদের জন্য বাংলা ভাষায় কোন সুন্দর নাম নেই। হয়তো বাংলা মাতা তাঁর এ ধরণের সন্তানদের কখনো তাঁর বিশাল বক্ষে আশ্রয় দেন না। তবে ইংরেজিতে এদেরকে আদর করে ‘প্লে-বয়’ ডাকা হয়। সুমিত নিজেও অবশ্য নিজেকে প্লে-বয় ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

সে সুদর্শন, অফুরন্ত টাকাও আছে, সেই সাথে সুন্দর করে কথা বলার ক্ষমতা- এ সবক’টা গুণ একত্রিত হয়ে তাকে করে তুলেছে অনন্য! যেসব মেয়েদেরকে সে ইচ্ছেমত ধরে এবং ছেড়ে দেয়, তাদের মনের অবস্থা পরবর্তীতে কী হয়, সেটি জানতে সে কখনো তেমন কোন আগ্রহ বোধ করে নি। তবে সে শুনেছে, একজন নাকি ভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে। বাকিদের সম্ভবত তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই এ ব্যাপারে। তারাও তো সম্ভ্রান্ত ঘরেরই আধুনিকা কন্যা! সহসা বরাবরের মতন সুমিতের নজরে নতুন একটি মেয়ে পড়ল। মেয়েটি দোতলার বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পরনে গোলাপী কামিজ, চূড়িদার সালোয়ার, হাতে সবুজ চুড়ি। মেয়েটিকে আগে সে কখনো দেখে নি। খুব সম্ভবত, মেয়েটি ক্যাম্পাসে নতুন। সুমিত চারতলায় এখনি যাবে না বলে ঠিক করল। তাহমিদা বোধ হয় আরেকটু অপেক্ষা করতে পারবে।

৪ নাঈম কোনোমতে প্রথম আক্রমণটা ঠেকালো। কার মা আজ একটু বেশিই রেগে গেছেন। বলা চলে, উন্মাদ হয়ে গেছেন। অমানুষের মতন পেটাচ্ছেন তাকে। রাগলে অবশ্য কোনদিনই হুঁশ থাকে না তাঁর।

তবে ইদানিং ব্যাপারটা বেশি বেশি হচ্ছে। “তুই আর কোনদিন সিগারেট খেয়ে ঘরে ঢুকবি? বল!” নাঈমের মা কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন। “সারা দুনিয়া আমার পেছনে সবসময় লেগে আছে। আমার বুঝি কষ্ট হয় না? সিগারেটটা দেখছ, কষ্টটা দেখতে পাও না?” “কী বললি তুই? আমি তোর পেছনে লেগে আছি? আমি তোর শত্রু নাকি? হ্যাঁ?” “শত্রু না তো কী? কোন মা তার নিজের সন্তানকে এভাবে পেটায়?” “ওহ্! লাট সাহেবের বাচ্চাকে বাইরের মানুষ এসে পেটালে ভালো লাগবে? তোর মত ছেলে যেন আমার দুশমনের পেটেও না হয়!” বলতে বলতে আরো দু’-এক ঘা দিয়ে দিলেন নাঈমকে। “সেই ছোটবেলা থেকে মার খাচ্ছি।

এত বড় হয়েও তোমার পিটানি সহ্য করছি। তোমার মত মা যেন আমার দুশমনেরও না হয়। ” নাঈম রাস্তায় বেরিয়ে এল। জন্মদাতার ওপর প্রচ- ক্রোধ জমা হয় নাঈমের । নাঈম যখন খুব ছোট, নাঈমের বাবা তার মাকে ফেলে চলে যান।

কোথায় যে গিয়েছেন, তার কোন হদিশ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তার দু’বছর পর নাঈমের মা পরিবারের পীড়াপীড়িতে আবার বিয়ে করেন। তার সৎ বাবাকে খারাপ কোন দিক থেকেই বলা যাবে না, কিন্তু নাঈমের মনে পড়ে না কখনো তার সৎ বাবা আদর-মাখা কণ্ঠে তাকে ডেকেছেন কিনা। সংসারের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন। তবে নাঈমের মায়ের এ ব্যবহারে তিনি কখনো প্রতিবাদ করেন নি।

হয়তো তার ভালোই লাগে। নাঈমের মা কেমন যেন পাগল-পাগল হয়ে গিয়েছেন। ঠিক কবে থেকে, নাঈম খেয়াল করে নি। প্রথম যেদিন নাঈম মার খেল, সেদিন হকচকিয়ে গিয়েছিল। দিনটি ছিল বুধবার।

স্কুল থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলেছিল ছুটির পর। আর ফিরেই দেখে তার মা রুদ্রমূর্তি ধরে আছেন। একটা হাত পিছনে লুকানো ছিল। পরে দেখতে পেয়েছিল, সে হাতে ছিল মাছ কাটার বটি।

নাঈম এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এখন এই মারপিট। এটা ছাড়া তার জীবন এখন ভাবাই যায় না যেন। নাঈম রাস্তায় বেরিয়েই সিগারেট ধরাল। আগে অনেক কান্না পেত।

তারপর একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করল, সিগারেট কান্না আটকে দিতে ওস্তাদ! কান্না-কাটি মেয়েদের ডিপার্টমেন্ট। এক দিক থেকে সিগারেট তাকে পুরুষ বানিয়েছে। এই সিগারেট তার বহু দুঃখের মুহূর্তের সঙ্গী, যে কখনো কোনো প্রশ্ন করে নি, কেবল দুঃখের ভার কমিয়ে গেছে। এই সঙ্গীটির কাছে সে অনেক কৃতজ্ঞ, একে সে কীভাবে ত্যাগ করবে? তবে সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, বাসায় এখন পর্যন্ত তার দু’টি বন্ধু রয়েছে। একটি তার পোষা ময়না পাখি, আরেকটি হচ্ছে তার সাত বছর বয়সী সৎ ভাই।

নাঈম সিগারেটে বিশাল এক টান দিয়ে পরপর ছয়টা ধোঁয়ার রিং ছাড়ল শূন্যে, সেই সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস। ৫ রাতুল দরজায় টোকা দিতেই মিথিলা দরজা খুলে দিল। মিথিলা তার বড় চাচার বড় মেয়ে। তার থেকে মাস-ছয়েকের ছোট হবে। বি.বি.এ পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আর কিছুদিনের মাঝেই হয়ত পাশ করে বের হয়ে যাবে। বড় চাচা অবশ্য মিথিলার জন্য ছেলে দেখা শুরু করেছেন অনেক দিন আগে থেকেই। “মাসে কেবল একবার আসতে হবে, এরকম নিয়ম বানিয়ে নিয়েছ নাকি?” অভিমান ঝরে পড়ল মিথিলার কণ্ঠে। “না, তা কেন হবে? রানা বাসায় নেই?” মিথিলা কথার উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে গেল। রাতুলও জানে, মিথিলা মিথ্যে বলে নি।

এখন ব্যাপারটা এমনই হয়ে গেছে। মাসের শুরুতে একবার বড় চাচার বাসায় এসে বেতনের সিংহভাগ দিয়ে যায় এখানে। বড় চাচা রিটায়ার্ড করার পর সংসারটা বেহাল অবস্থায় পড়েছিল। এখন রাতুলের দেয়া টাকাটাই একমাত্র ভরসা। বড় চাচা সাদা পাঞ্জাবী, সাদা লুঙ্গি আর মাথায় টুপি পরে আছেন।

মাত্রই নামাজ শেষ করে উঠেছেন মনে হয়। ঘরের কোনার আলনায় জায়নামাজটা রেখে রাতুলের পাশে খাটে এসে বসলেন। পরম ¯েœহে রাতুলের কাঁধে একটা হাত রাখলেন। “কী রে, তুই কি খাওয়া-দাওয়া করা ছেড়েই দিয়েছিস নাকি? শরীরের এই হাল কেন?” “আমার শরীর ঠিকই আছে চাচা। আপনার কথা বলেন।

পায়ের ব্যাথাটা কি আর উঠেছিল?” “উঠলেই বা তোমার কী? তুমি কি খোঁজ-খবর নাও কোনো?” মিথিলা কখন যে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে রাতুল খেয়ালই করে নি। “আসলে অফিসে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে দম ফেলার সময়ই পাই না, চাচা। ” রাতুল মিথিলার কথার বাণ এড়ানোর চেষ্টা করল। “ব্যস্ততা না ছাই! আসলে তুমি আমাদের ভুলেই গেছ। ” রাতুল মিথিলার দিকে তাকাল।

মিথিলা বেশ সুন্দরী হয়ে গেছে। কথায়ও বেশ চটপটে হয়ে উঠেছে। আজকে আবার বেশ সুন্দর করে সেজেছে সে। “না, মিথি। মেসের খাবার খেতে খেতে যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখন অন্তত তোর রান্নার কথা মনে পড়ে।

তোরা আমার রক্তের সাথে মিশে আছিস। তোদের মরেও আমি ভুলতে পারব না। ” “ওসব বাদ দে তো। মিথি, মা, ছেলেটা কতদিন বাদে এসেছে। ওকে খেতে-টেতে দিবি না?” বড় চাচা মিথিলাকে বললেন।

মিথিলা সরে গেল না। একদৃষ্টিতে রাতুলের দিকে চেয়ে আছে। রাতুল জানে, মিথিলা তার কাছে কী চায়। রাতের খাবার খেয়ে রাতুল তার মেসের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ৬ সুমিত অনেকক্ষণ হল বসে আছে সামিট গ্রুপের রিসেপশনে।

সে রাতুলের সাথে দেখা করতে এসেছে। প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেল, এখনও রাতুলের দেখা নেই। মেজাজটা ধীরে ধীরে গরম হতে শুরু করেছে। থার্মোমিটার ফেটে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে রাতুল এসে গেল। “কী রে, কতক্ষণ হল এসেছিস?” “আধঘন্টা।

” “সরি রে। আসলে কাজের অনেক চাপ। চল বাইরে যাই। ২০ মিনিটের একটা ব্রেক দেয় এরা লাঞ্চের জন্য। ” “আচ্ছা, ঐ মালটা কে রে?” রাতুল বুঝতে পারল, সুমিতের নজর পড়েছে শায়লার ওপর।

“তোর ভাবী, শালা!” রাতুল সুমিতকে নিয়ে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে এল। দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিল আর নিজে একটা কেক হাতে নিয়ে খেতে শুরু করল। “সুমিত, তোর যা যা খেতে মন চায় খা। আমার বাকীর খাতা আছে এ দোকানে!” “তুই লাঞ্চে এসে কেক আর চা খাচ্ছিস?” “হ্যাঁ। আসলে দুপুরে বিশেষ কিছু খেতে মন চায় না।

তাছাড়া, কেক জিনিসটা ভালোই। অনেকখানি গ্লুকোজ!” সুমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে তার বন্ধুটিকে চেনে। সামান্য ক’টা টাকা জমানোর জন্য সে দুপুরের খাবার বিসর্জন দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। “তোকে বলেছিলাম, বাবার কোনো একটা কম্পানিতে জয়েন করে নে।

তাহলে আর এত কষ্ট করতে হত না। ” “না রে, তোর বাবার কম্পানি তো আমার ব্যাক-আপ ছিল! ব্যাক-আপ এত সহজে ব্যবহার করতে নেই!” “থাক, ওসব আর বলতে হবে না। সব বুঝি আমি। ” “আচ্ছা, বাদ দে। এখন বল, কী দরকারে এসেছিস।

রুমের চাবি লাগবে তো?” সুমিত একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। “ইয়ে, ঐ আর কি! নতুন একটা মাল পটিয়েছি রে! নীলা। তুই খুশি হবি এবারে। এই মালটা হিন্দু!” “তোর কাছে আবার মেয়েদের জাত বলতে কিছু আছে নাকি? হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক, কাউকে ছাড়িস নাকি তুই? এরপর খ্রিস্টান-বৌদ্ধ কিছু একটা ধরতে পারিস নাকি দেখ। ” “নাহ! এবার মনে হচ্ছে সেটলড হয়েই যাব।

হিন্দু মাল, তাও আবার সুন্দরী, পাওয়া যায় না সচরাচর!” “তোকে তো আর শুধরানো সম্ভব না। আর কতবার তোকে বলব যে এসব ভালো না। আল্লাহ ক্ষমাশীল। তবে তুই যাদের সাথে এই কাবাডি-কাবাডি খেলেছিস, তারা যদি তোকে মাফ না করে, আল্লাহও তোকে মাফ করবে না। ” “শোন, আল্লাহ, ঈশ্বর- এদের কেউই আর এক্সিস্ট করে না।

দে অল আর মিথস। আগের জামানায় থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এখন আর নেই। এই দুনিয়ায় মানুষেরই থাকার জায়গা নেই, আর ঈশ্বর!” রাতুল আর কথা না বাড়িয়ে সুমিতের দিকে চাবিটা বাড়িয়ে দিল। এসব নিয়ে যতই কথা হবে, ততই তর্ক বাড়তে থাকবে। রেললাইন অসীমে গিয়ে মিললেও মিলতে পারে, কিন্তু আস্তিক-নাস্তিক? এরা কখনো মিলবে না।

“বাই দ্য ওয়ে, তোর অফিসের মালটা কিন্তু চরম রে। বিয়ে করে ফেল! তারপর আমি দেখব, কী করা যায়!” সুমিত বাইকে চড়ে নিমেষেই অদৃশ্য হয়ে গেল। ৭ সন্ধ্যে হয়ে এল প্রায়। সুমিতের দেহের সাথে লেপ্টে আছে নীলার দেহ। সুমিত যথেষ্ট আনন্দিত।

বহুদিন পর এমন সুখের কিছু সময় পার করল সে। মেয়েটা খুবই নিরীহ টাইপ। যা বলেছে সে, তা-ই শুনেছে, পাল্টা কোন কথাই বলে নি। এটার সাথে আরো দিন পনেরো সহজেই পার করে দেওয়া যাবে। আর এর মধ্যে রাতুলের রুমটা আরো তিন-চার বার ধার করতে হবে।

নীলা সুমিতের এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিচ্ছিল। সুমিতের কাছে এ মুহূর্তটা খুবই পরিচিত। এ সময় মেয়েরা টিপিক্যাল প্রেমের ডায়লগ দেয়। “তুমি সারা জীবন এভাবেই আমার থাকবে তো?” “আমাকে ছাড়া আর কাউকে কখনো ভালোবাসবে না তো?” “তোমাকে যদি না পাই, তবে কিন্তু আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর উপায় থাকবে না!” গা জ্বালা করে সুমিতের এসব কথা শুনলে। সুমিত প্রস্তুত হল এ মুহূর্তটার জন্য।

নীলা খুব নীচু কণ্ঠে বলা শুরু করল। “জানো, আমার বাবা আমার মা’কে খুব পেটাতো। অমানুষের মত পেটাতো। আমার মাও অনেক কাঁদত। একমাত্র ঐদিনই কাঁদত না, যেদিন মা অজ্ঞান হয়ে যেত।

একদিন মার খেতে খেতে মা মরেই গেল। আমার মা ভালোবাসা পায় নি, ভালোবাসা দিতেও পারে নি। আমি ঠিক করলাম, ভালোবাসতে হবে আমার। ভালোবাসা পাব কিনা জানি না, তবে প্রাণভরে একজনকে ভালোবাসব। ভালোবাসা কী- আমি কখনো দেখি নি।

তাই জানতাম না, ভালোবাসা কী। ভালোবাসার কোন সংজ্ঞাও জানতাম না। অনেক কষ্টে নিজে নিজেই একটা সংজ্ঞা বানিয়ে নিলাম। আর সে সংজ্ঞা থেকেই তোমাকে আমি ভালোবেসেছি। তোমার কাহিনী আমি সবই জানি।

মেয়েদের সাথে বিছানায় যাওয়া তোমার এক ধরণের হবি। সব জেনে-শুনেই আমি তোমার কাছে এসেছি, মন উজাড় করে ভালোবাসতে এসেছি। না, না! ভয় পেও না। তোমাকে বলব না আমার সাথে থাকতে- এমন পিছুটানে তোমায় আমি বাঁধব না, চিন্তা করো না। তুমি যাও।

নতুন কারো খোঁজ করো। আমি তোমায় ভালোবাসতে এসেছিলাম একদিনের জন্য। কিন্তু জানো, একটা সমস্যা হয়ে গেছে। ভালোবাসা আসলে একদিনের হয় না- এই ছোট্ট জিনিসটা আগে বুঝি নি। তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি সারা জীবনের জন্য।

কেন হল, কীভাবে হল, কখন হল- জানি না। তবে, ভালো সত্যিকার অর্থেই বেসেিেছ, তুমি চলে গেলেও বাসব। কিন্তু তুমি এ নিয়ে কখনো চিন্তা করো না। আমি ভালো থাকব। আমার মা ভালোবাসতে পারে নি, আমি তো পেরেছি।

আমি এ ভালোবাসা নিয়েই জীবন কাটাবো। আর দূর থেকে প্রার্থনা করব তোমার জন্য। তুমি অনেক ভালো থাকবে। ” নীলার কথায় কী ছিল সুমিত জানে না। শুধু জানে, কথাগুলো তার মজ্জা ভেদ করে তাকে নাড়া দিয়ে গেছে।

এমন কথা সে আগে কখনো শোনে নি, জানে, শুনবেও না। কেউ তাকে এভাবে ভালোবাসে নি, বাসবেও না। ভালোবাসার এমন নিঃস্বার্থ রূপ সে আগে কখনো দেখে নি, জানত না, ভালোবাসা যে এমনটাও হতে পারে। সুমিতের ভেতরটা ওলট-পালট হয়ে যেতে লাগল। নীলার গাল বেয়ে চোখের পানি পড়ছিল ধীরে ধীরে।

সুমিতের সহ্য হচ্ছিল না সেই অশ্রূ। না! নীলা কাঁদতে পারে না, অন্তত সে বেঁচে থাকতে নয়। ৮ নাঈম কিছুদিন হল এই মেসে উঠেছে। সে চাইলে রাতুলকে জানাতে পারত, ওর মেসেই উঠতে পারত। কিন্তু রাতুল-সুমিতের সাথে ওর কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে- ঠিক কীভাবে, ও জানে না।

ওরা স্কুল জীবনের অনেক ভালো বন্ধু। থ্রি মাস্কেটিয়ার্স- নাম দিয়েছিল নিজেদের। নাঈমের বাসার অবস্থা রাতুল, সুমিত- দু’জনেই জানত। কেন যেন ওর মনে হত- ওরা ওর প্রতি করুণা দেখায়। মমতার সৃষ্টি সবসময় ভালোবাসা থেকে হয় না।

আর করুণা, সান্ত¦না- এ ব্যাপারগুলোকে নাঈম সবসময়ই প্রচ- ঘৃণা করে এসেছে। কাউকে সে সান্ত¦না দেয় না, কারোর কাছ থেকে নেয়ও না। ওর মায়ের ব্যবহার চরম সীমা পেরিয়ে আরো অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। অবস্থা শেষদিকে এমনটা দাঁড়িয়েছিল যে ওকে দেখলেই ক্ষেপে যেতেন। যখন-তখন মার দিতেন, আর তার সাথে চলত অশ্রাব্য যত গালাগাল।

উপায় না দেখে ওর সৎ বাবাই শেষমেষ ওকে বললেন বাসা ছেড়ে দিতে। তবে বাসা ছেড়ে এলেও খরচ এখনো চলে সৎ বাবার টাকাতেই। যদিও টাকাটা নিতে খুবই লজ্জা লাগে নাঈমের, সেই সাথে চাপা একটা ক্ষোভও কোথায় যেন দানা বাঁধে। নাঈম পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সি.এ. করছে সে একটা প্রাইভেট ফার্মে।

সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাশাপাশি অন্য কিছু করার শক্তি বা ধৈর্য্য- কোনটাই থাকে না। তারপরও একটা টিউশনি করে সে- হাজার তিনেক টাকা আসে সেখান থেকে। ফার্মটাও এখন কিছু টাকা দিচ্ছে। চেষ্টা শুধু সৎ বাবার কাছ থেকে সাহায্য না নেবার। সৎ বাবা ক’দিন পর কৃতিত্ব নেবে, তার টাকায় পড়াশোনা করে নাঈম মানুষ হয়েছে- এটা সে চায় না।

মন নাঈমের খারাপ হয় না। তার পোষা ময়নাটা মারা গেছে তিন মাস হল। বাসার কারোর কথা মনে পড়ে খারাপও লাগে না। কেবল ছোট ভাইটার কথা মনে পড়ে মাঝে মাঝে। নাহ! ভুল হল।

মায়ের কথা মনে পড়ে সবসময়। এই মহিলা তাকে এত কষ্ট দিয়েছেন। তবু একটা বার যদি তাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতেন, আর বলতেন, বাবা, আমাকে মাফ করে দিস, নাঈমের চেয়ে সুখী হয়তো এ পৃথিবীতে কেউ থাকত না। কিন্তু, এ সম্ভব নয়- নাঈম জানে। ¯্রষ্টার অস্তিত্বে সে বিশ্বাস করে না।

এ জগতের কোন নাঈমেরই হয়তো স্রষ্টায় বিশ্বাস থাকার কথা নয়। নাঈমের চোখে কিছু বেয়াড়া বাষ্প জমা হয়। তার সম্বিত ফেরে জামান সাহেবের কথায়। জামান সাহেব এই রুমেই আরেকটা বেডের বোর্ডার। “কী নাঈম সাহেব? বাড়ির কথা মনে পড়ছে?” “না তো।

কখন এলেন আপনি?” “এসেছি তো অনেকক্ষণ হয়। আপনার তো এদিকে খেয়ালই নেই। ” “হুম, একটা জিনিস নিয়ে চিন্তা করছিলাম। ” “নাঈম সাহেব, আপনার বয়স কম। এ বয়সে অনেক অদ্ভ’ত রকমের কিছু আবেগ থাকে।

সেই আবেগের ভার সবাই সহ্য করতে পারে না। আর যারা পারে না, তাদের জন্য আমার কাছে ওষুধ আছে। ” “কী ওষুধ?” “আপনি চলেন আমার সাথে। ” “এত রাতে? কোথায়?” “আহ! চলেন তো। গেলেই দেখতে পাবেন।

আর শোনেন নাঈম সাহেব, আমি আপনার খারাপ চাই না- এটা মনে রাখবেন। ” নাঈম জামান সাহেবের পেছন পেছন হাঁটছে। রাস্তা-ঘাট খুব একটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। চারপাশে ময়লা-আবর্জনা, আর কিছু উন্মাদের রক্ত-জল-করা বিশ্রি হাসি। ওরা গিয়ে পৌঁছল একটা ঘরের সামনে।

আধো-আলো, আধো-অন্ধকার সে ঘরে। ভুরভুর করে বিকট গন্ধ বেরোচ্ছে। কয়েকটি ছেলে নাকের সামনে টিউবের মতন কী যেন একটা ধরছে, কয়েকজন আবার একটা কাগজের ওপর কিছু একটা রেখে নিচ থেকে আগুন জ্বেলে উত্তাপ দেবার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ শুয়ে এদিক ওদিক করছে আর অসংলগ্ন বুলি আওড়াচ্ছে। আর একজন অল্পবয়েসী ছেলে শুয়ে আছে, নাঈমের দিকে ফিরে, কোন কথা বলছে না, নড়ছেও না। ছেলেটিকে নাঈম চিনতে পারল।

৯ “হ্যালো রাতুল?” “হ্যাঁ। কে বলছেন?” “আমি নাঈম। ” রাতুলের হতচকিত ভাব কাটতে বেশ কিছুক্ষণ লাগল। নাঈমের সাথে যোগাযোগ নেই বহু বছর হল। আর এত রাতে সে ফোন দিয়েছে- ব্যাপারটা অস্বাভাবিকই বটে।

“বল রাতুল। কোন সমস্যা? এত রাতে ফোন দিলি যে?” “তুই এই মুহূর্তে আয়শা মেমোরিয়ালে আসতে পারবি? রানা, তোর চাচাত ভাই, ওর একটা সমস্যা হয়েছে। ” “কী হয়েছে ওর?” রাতুলের কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা শোনা গেল। “তুই আয়। তারপর বলছি।

আর এটা আমার নাম্বার। এসে এই নাম্বারে ফোন দিস। ” ১০ রাতুল মিথিলাকে নিয়ে এসেছে আয়শা মেমোরিয়াল হসপিটালে। গত রাতে রানাকে এখানে ভর্তি করিয়েছে নাঈম। বড় চাচার কাছে মিথ্যে বলতে হয়েছে।

তিনি শুনলে হয়তো সহ্য করতে পারতেন না। রাতুলই বিশ্বাস করতে পারে নি প্রথমটায়। রানাকে নাঈম খুঁজে পেয়েছে একটা বস্তিতে, ড্রাগস নিয়ে সে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। ডাক্তাররা বলছেন, অবস্থা অনেক সিরিয়াস। এডিকশান অনেক দূর গড়িয়েছে।

এখন আপাতত সুস্থ আছে, তবে কোন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করানো ছাড়া না কি আর উপায় নেই। মিথিলা রাতুলের বুকে আছড়ে পড়ে আর্তস্বরে কাঁদতে শুরু করল। “রাতুল, এ আমাদের কী হল? এমনটা তো হবার কথা ছিল না। রানা তো এমন ছেলে নয়। ও তো পড়াশোনায় ডুবে থাকা ছেলে।

ও কেন এরকম হয়ে যাবে?” রাতুল সান্ত¦না দেবার বৃথা চেষ্টা করে। পরিবারের এরূপ আশা যদি কেউ ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে, সে শত চেষ্টা করলেও স্বাভাবিক থাকতে পারে না। মানুষের জীবনে আশা ছাড়া আর আছেই বা কী? রানাকে রিলিজ করে দেয়া হল কিছুক্ষণ বাদেই। রানা আর মিথিলাকে নিয়ে রাতুল বড় চাচার বাসার দিকে রওনা হল। পথে রানা একটা কথাও বলল না।

আজকে অফিসে আর যাওয়া হল না। এত ঝামেলার মাঝেও শায়লা কী রঙের শাড়ি পরে এসেছে- এ চিন্তাটা রাতুলের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ১১ রাত ৯টা বাজে। রাতুল নাঈমের মেসে বসে আছে। নাঈম কোন কথা বলছে না।

রাতুলের মনে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু সেগুলো সে নাঈমকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না। “তো, কবে উঠলি এখানে?” “এই তো, মাসখানেক হল। ” “আমাকে জানাতে তো পারতি। ” “তোকে জানিয়ে আর কী হবে?” “মানে?” রাতুল কিছুটা ক্ষেপে গেল।

যদিও সে নিশ্চিত নয়, নাঈমের ওপর সেই অধিকারটুকু তার আর আছে কি না। “মানে, তুই এমনিতেই তো কত ঝামেলায় থাকিস, আবার আমার ঝামেলা-” “আমি ঝামেলায় থাকি সেটা তুই জানলি কী করে? তুই কোন যোগাযোগ রেখেছিস আমার সাথে?” “যোগাযোগ না রাখলে কি বোঝা যায় না? আমি তোকে চিনি না?” “না, তুই চিনিস না। চিনলে এতকাল দূরে সরিয়ে রাখতি না। ” রাতুল উঠে পড়ল। সে দরজার দিকে পা বাড়ালো।

“দেখ নাঈম, আমি তোকে কিছু বলব না, তুইও আমাকে বলবি না। কিন্তু এটা কখনো মনে করিস না যে দুনিয়ায় তুইই একমাত্র মানুষ, যার দুঃখ-কষ্ট আছে। আমরা কেউই পাথরে-গড়া মূর্তি না। তোর ছোটবেলার বন্ধু আমি। আমি সবই বুঝি।

বুঝিস না কেবল তুই। ” “রাতুল, তুই ভুল বুঝছিস-” “আমার কথা তো বাদই দে। তুই সুমিতের সাথেও কোন কন্টাক্ট করেছিস কখনো? তোর বিপদ দেখে আমরা কোনদিন আকাশ ফাটিয়ে হাসি নি, বরং তোকে সাপোর্ট করেছি। আর আমাদেরকেই তুই পর করে দিলি?” রাতুল ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল। ১২ নাঈম মাথা নিচু করে কথা শুনছে।

রাতুল আর সুমিত- দু’জন মিলে তাকে ইচ্ছেমত বকা-ঝকা করছে। করবেই তো, তাদের ঐ অধিকার আছে। নাঈম জানে, এটা তার প্রাপ্য। প্রাণের বন্ধুদের সে ভুল বুঝেছে। এত কষ্টের মাঝেও তাদেরকে কিছু জানাতে যায় নি সে।

“আচ্ছা, যা হবার হয়েছে। এখন থেকে মানুষ হয়ে যা। আর কেউ তোর পাশে থাকুক আর নাই থাকুক, আমরা তোর পাশে সবসময় থাকব। তোর নিজের জন্য হলেও এই অধমদের সাথে একটু দেখা-সাক্ষাৎ করিস। ” সুমিত আবহাওয়া প্রশমিত করার চেষ্টা করল।

এরপর অনেক কথা হল তাদের মধ্যে। কে কী করেছে এই কয়েক বছরে, কে কেমন আছে, কার কী ইচ্ছে কী করার- আড্ডায় উঠে এল। ঠিক হল রাতুলের মেসে সপ্তাহে অন্তত একদিন ওরা দেখা করবে। “কী রে সুমিত, আমার রুমে সময় কেমন কাটল ওদিন?” “বন্ধুসকল, আমি একটা বিপদে পড়ে গেছি। আমার তো মনে হয় মোহব্বতই হয়ে গেল রে!” “সে কী রে? প্রেম, ভালোবাসা, ইশক, লভ?” নাঈম টিপ্পনী কাটল! “হ্যাঁ, জানি, আমার মতন ছেলের জীবনে এই ভালোবাসা মানায় না।

আমি ঘুরব, ফিরব, মেয়ে ধরব, ছাড়ব- আমার স্বভাব তো এটাই। কিন্তু কী করে যে এই ভালোবাসা নামের বিপদটায় পড়ে গেলাম? আমি টের পাচ্ছিলাম, আমার বিপদ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ঠেকাতে পারছিলাম না, বিশ্বাস কর। ” “এসব বিপদ বিপদ- কী লাগিয়ে রেখেছিস। তোর সাত-পুরুষের কপাল, অবশেষে তোর একটা গতি হচ্ছে। ” রাতুল খেঁকিয়ে উঠল।

“হ্যাঁ রাতুল। আমি ভালোবেসে ফেলেছি। জানিস, নীলা খুবই সহজ-সরল একটা মেয়ে। ও কোনো জটিল ইকুয়েশনে লাইফ লিড করে না। যেমন সরল ও, তেমনি সরল ওর ভালোবাসা।

এভাবে আমি কাউকে কখনো ভালোবাসতে দেখি নি। জানিস, ও আমার কাছ থেকে কিছুই চায় না। শুধু ভালোবাসা দিয়েই যায়, দিয়েই যায়। একে ছাড়া আমি অন্য কাউকে নিয়ে জীবন কাটাতে পারব না। নীলাই আমার সব।

নিঃশ্বাসের প্রতিটি কণায় আমার এখন নীলা জড়িয়ে আছে। ” “বাহ! ভালোই তো! তোর মুখে এসব কথা শুনতে যদিও অদ্ভ’ত লাগছে খুব। তারপরও, বেশ ভালো লাগছে যে তোর জীবনে ভালোবাসা এসেছে। ” নাঈম বলে উঠল। “হ্যাঁ।

আল্লাহ ওর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। ওর একটা গতি তো হল-” “রাতুল, এসব ঈশ্বর-টিশ্বরের কোন কীর্তি নয়। আমার নিজের যোগ্যতায় আজ এতদূর এসেছি, নীলাকে পেয়েছি। তোরা কী, হ্যাঁ? কোন ভালো কিছু হলেও ঈশ্বরের নাম, আর খারাপ কিছু হলে তো কথাই নেই। ” সুমিত কোনোদিন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে নি।

হয়তো করবেও না। যার বাবার অঢেল টাকা থাকে, তার এসব উপাসনা-ইবাদত না করলেও চলে। কেননা, ঈশ্বরের কাছে তখন কিছু প্রার্থনা করবার দরকার পড়ে না, যা চাইতে হয়, ধনী পিতার কাছে গিয়ে বললেই চলে। তার জীবন শুরু থেকেই অনেক সুন্দর, অনেক তৃপ্তিদায়ক। “সুমিত, এভাবে চিন্তা করিস না, ভাই।

¯্রষ্টা আছেন, তাঁকে বিশ্বাস করতে শেখ্, মান্য র্ক তাঁকে। নইলে কে জানে, হয়তো ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে তোকে। ” রাতুল চিন্তিত কণ্ঠে বলল। ১৩ মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। জানালার কাচগুলো পর্যন্ত ঘোলা হয়ে গিয়েছে।

অফিসে অবশ্য খুব বেশি কেউ নেই। রাতুল আটকা পড়ে গেছে এই বৃষ্টিতে। আজকে বড়চাচার বাসায় যাবার কথা ছিল। যাওয়া হল না। তবে তার খুব একটা বিরক্ত লাগছে না।

কারণ, শায়লাও তারই মতন আটকে আছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখতে খারাপ লাগে না। বৃষ্টি থামল বেশ খানিকটা সময় নিয়েই। কিন্তু গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি তাও পড়ছিল। রাতুল বের হয়ে পড়ল।

“এই যে রাতুল সাহেব, আপনি কোন রাস্তা দিয়ে যাবেন?” রাতুলের হৃদপি- সহসা থমকে দাঁড়ালো। শায়লা তার পিছু পিছু রাস্তায় নেমে এসেছে। “আমি মালিবাগের দিকে যাচ্ছিলাম। আপনি?” “আরে, আমিও তো একই দিকে যাব! চলুন না, এক সঙ্গে যাওয়া যাক, যদি আপনার কোন সমস্যা না থাকে। ” “আমার কোন সমস্যা থাকবার প্রশ্নই ওঠে না! চলুন।

” রাতুলের আরাধ্য নারী তার সাথে হাঁটছে, কথা বলছে, খিলখিল করে হেসে উঠছে। তার চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে রাতুল পুলক অনুভব করছে। মনে হচ্ছে যেন স্বর্গ থেকে কোন দেবী তাকে আলোকের ঝর্ণাধারার ধুইয়ে দিচ্ছে। “তারপর, রাতুল, বলুন, আপনার ফ্যামিলিতে কে কে আছেন? এতদিন ধরে একসাথে কাজ করছি আমরা, অথচ নিজেদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। কী বিশ্রি ব্যাপার, তাই না?” “আমার বাবা-মা দু’জনেই মারা গেছেন আমি যখন খুব ছোট।

রোড এক্সিডেন্ট। অনেক ছোটবেলার স্মৃতি, কিন্তু এখনো যেন সেই দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভাসে। মা আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। কিন্তু রাস্তায় অনেক গাড়ির চাপ ছিল, পার হতে পারছিলেন না। বাবা ছিলেন রাস্তার ওপারে।

তিনি আমাদের দাঁড়াতে বলে নিজে আমাদের কাছে আসতে লাগলেন। রাস্তাটা পার হবার সময় হঠাৎ একটা লোকাল বাস এসে বাবাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। মা ঘটনার আকস্মিকতায় কী করবেন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আমাকে রেখেই বাবার অচেতন দেহের দিকে দৌড় দেন। ব্যস। আরেকটা প্রাইভেট কার এসে মাকেও চাপা দিয়ে যায়।

” “ওহ! আই এ্যম সো সরি। ” “নো নো, ডোন্ট বি। ইটস অলরাইট। তারপর থেকে বড়চাচার বাসায় আমি মানুষ। অনেক অভাবে, কিন্তু অনেক ভালোবাসায় আমি বড় হয়েছি।

এখন একটা মেসে থাকি। চাকরি করি, দু’পয়সা রোজগার হয়, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই- জীবন চলে যায় কোন রকমে। তারপর? আপনার কথা বলুন কিছু। ” “আমি? মা নেই। সংসারে প্রাণী কেবল বাবা আর আমি।

বাবার লাংস ফেইলড। প্রতি মাসে একবার করে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। চাকরিটা কোনোমতে সেই খরচ বিয়ার করে। এই তো, আর কী!” “বারে, দু’লাইনেই শেষ? বিয়ে-থা করেছেন, নাকি করবেন?” “হা হা হা! বিয়ে? সে অনেক দেরি!” “কেন? এত সুন্দরী মেয়েদের এরকম সিঙ্গেল থাকতে নেই। ” “কেন? সিঙ্গেল থাকলে সমস্যা কী?” “না, মানে, সিঙ্গেল পুরুষরা অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলে তো, তাই!” “হা হা! আপনি কথাও পারেন বটে!!” রাতুল সে রাতে অনেকখানি আনন্দ নিয়ে ঘুমোতে গেল।

হায় মানুষ, সে যদি নিজের ভবিষ্যৎটা দেখতে পেত! ১৪ নাঈমের সৎ বাবা নাঈমকে নিয়ে এসেছেন পি.জি.তে। নাঈমের মা খুবই অসুস্থ। ব্রেন টিউমার। হঠাৎই ধরা পড়ল। ডাক্তাররা বলছেন, একদম শেষ পর্যায়ে আছেন তিনি।

অপারেশন করালে বেঁচে যাবার সম্ভাবনা আছে, তবে খুবই কম, না করালে সর্বোচ্চ দুই মাস। নাঈম তার ছোট ভাইটাকে জড়িয়ে ধরে বেঞ্চে বসে আছে। তার মায়ের জ্ঞান ফেরে নি কাল রাত থেকে। তার সৎ বাবা অনেক দৌড়াদৌড়ি করছেন। নাঈমের মাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করেছেন।

এ জন্য নানা জায়গায় কথা বলছেন। বিদেশের কোন ডাক্তারের সাথেও নাকি যোগাযোগ করেছেন। রাতুল আর সুমিতও চলে এসেছে নাঈমের ফোন পেয়ে। চুপচাপ বসে আছে সবাই। কোনো কথা বলছে না।

সুমিতই প্রথম নীরবতা ভাঙল। “আন্টির সাথে দেখা হয়েছে তোর?” “মা তো আই.সি.ইউ তে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছি। ” “আন্টির সাথে তোর কথা বলা উচিত। ” “কেন? কী কথা বলব আমি?” “জানি না, কী কথা বলবি।

শুধু মনে হচ্ছে, কথা বলতে হবে। না হলে হয় না। এ কাহিনীর একটা উপসংহার থাকবে না?” “কী বলছিস যা তা! কীসের কাহিনী? কীসের উপসংহার?” “সুমিত, চুপ র্ক। ” রাতুল বলে উঠল। “নাঈম, চিন্তা করিস না।

দেখবি, আন্টি ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। ” রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে। রাতুল আর সুমিত উঠে দাঁড়াল। নাঈম ঘুমোতে পারছিল না।

ওর ভাইটা ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। নাঈমের বারবার মনে পড়ছিল সুমিতের কথাগুলো। নাঈম উঠে ওর মায়ের কেবিনের দিকে রওনা হল। মায়ের জ্ঞান এখনো ফেরে নি। আগের থেকেও অনেক সুন্দরী হয়ে গেছেন তিনি।

নাঈম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল তার মায়ের দিকে। তারপর সেখান থেকে বের হতে লাগল, কিন্তু আচমকা তার মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেল সে! “নাঈম, বাবা, কাছে আয় আমার। ” নাঈম দো’টানায় পড়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না সে কী করবে। হয়তো তার মা আবার জান্তব হয়ে যাবেন তাকে কাছে পেলে, আবার কে জানে, হয়তো সারা জীবন সে যে ভালোবাসা খুঁজছিল তার মায়ের কাছে, আজ তাই পেয়ে যাবে।

নাঈম গুটি গুটি পায়ে তার মায়ের কাছে গেল। “বস, আমার পাশে, এখানে বস। ” নাঈম তার মায়ের বেডে বসল। “তুই আমার ওপর অনেক রেগে আছিস, তাই না?” নাঈম কোন কথা বলল না। “আমি জানি, তুই রেগে আছিস, অনেক রেগে আছিস।

কী করব বল? তোকে দেখলেই আমার তোর বাবার কথা মনে হত। তোর সেই বাবা, যে আমার কোলে সাত মাসের একটা ফুটফ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.