আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেন্টমার্টিনে: পূর্ণিমা রাতে...১

সেন্টমার্টিন যাবার জন্যে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত এই তিন মাসই সবচেয়ে ভাল সময়। কিন্তু শুধু সময় ভাল হলে তো হয় না কর্মকর্তাদের অফিস, ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল কলেজ, গৃহিনীদের সংসার এবং অন্যান্যদের ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে হিসাব মিলিয়ে ভ্রমণসূচী তৈরি করতে সবারই গলদঘর্ম অবস্থা। দলে যাত্রী সংখ্যা যতো বাড়ে সিডিউল মেলানো ততোই কঠিন হয়ে পড়ে। সেই কারণে সরকারি ছুটি এবং স্কুল কলেজের ছুটির সাথে সমন্বয় করে সেন্ট মার্টিনযাত্রার দিন ঠিক হলো এবছরের ঈদের পরদিন অর্থাৎ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। রাত সাড়ে নয়টায় রাজারবাগের গ্রিনলাইন বাসস্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে মাঝে চৌদ্দগ্রামে পঁচিশ মিনিটের বিরতি দিয়েও কি করে যে রাত দুটায় চট্টগ্রাম এবং ভোর পাঁচটারও আগে কক্সবাজার পৌাঁছালো তা এক বিস্ময়।

গত কয়েক বছরে যেখানে ট্রেনে অথবা বাসে কোনভাবেই সাড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টার আগে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে পারিনি। পথচলতি যানবাহনে যারা ঘুমাতে পারেন তাদের জন্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্ক্যানিয়া যথেষ্ট আরামদায়ক এবং বলা যায় ঘুম সহায়ক বাহন। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে আসন যতটা সম্ভব লম্বা করে চোখ বন্ধ করলেই হলো। কক্সবাজারে একদিন একরাত কাটিয়ে সকাল সাতটায় রওনা হলাম টেকনাফের পথে। পঁচিশ আসনের বাসে আমরা ছোট বড় মিলিয়ে চৌদ্দজন।

টেকনাফ থেকে আমাদের নির্ধারিত জলযান ছেড়ে যাবে ঠিক সকাল সাড়ে ন’টায়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সড়ক পথে সময় লাগে পৌনে দু’ঘণ্টার মতো। অনেকগুলো ভাঙাচোরা ব্রিজ-কালভার্টের মেরামত কাজ চলছে, কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে নতুন সেতু। এ ছাড়া রাস্তা মোটামুটি ভাল। তারপরেও রাস্তাঘাটের অনিশ্চয়তার কথা তো কিছুই বলা যায় না।

কাজেই কিছুটা সময় হাতে রেখেই টেকনাফ পৌঁছানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নয়টা বাজার আগে পৌঁছেও দেখা গেল টেকনাফের জেটিতে যথেষ্ট ভিড়। কাঠের দীর্ঘ পাটাতন বিছানো পথে কেয়ারি সিন্দবাদের ভেতর দিয়ে উঠে গেলাম কেয়ারি ডাইন এ্যান্ড ক্রুইজ-এর দোতলায়। প্রবেশ পথেই খবরের কাগজের হকার ‘পরথম আলোও... পরথম আলোও...’ বলে তারস্বরে চিৎকার করছিল। তার কণ্ঠ আর একটু উঁচুতে তুলতে পারলেই তা প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাবে এবং আগামী বছর টেকনাফের এই হকার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

তার চিৎকার থেকে বাঁচার জন্যে আমাদের দলের খোকন তাড়াতাড়ি একসঙ্গে দুটো প্রথম আলো কিনে ফেললো। কেয়ারি সিন্দবাদের তুলনায় কেয়ারি ডাইন এ্যান্ড ক্রুইজের বসার ব্যবস্থা ভাল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ চমৎকার এবং সিট নম্বর মিলিয়ে বসার পরে প্রয়োজনে ছোটখাট এ্যাডজাস্টমেন্ট করে নিলে কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু আসা যাওয়া উভয় পথেই দেখা গেল নির্ধারিত সিট নিয়ে মহা হৈচৈ। দু’পক্ষই গলা উঁচিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি এবং শেষপর্যন্ত হাতা গুটিয়ে অপরপক্ষকে আক্রমণের প্রস্তুতি। নির্ধারিত সময়ে ঘাট থেকে নৌযান ছেড়ে যাবার পরপরই সিট খালি হতে থাকে... ভিড় বাড়ে দু পাশের ডেকে, জাহাজের সামনে পেছনে এবং ছাদে।

তিন তলায় ভিআইপি লাউঞ্জে বুফে লাঞ্চসহ সব ধরনের হালকা চা নাস্তার ব্যবস্থা আছে। তবে ভিআইপি মার্কা বিহীন আমাদের মতো আম জনতার জন্যে সকর্তবাণী হলো, এখানে এককাপ সাধারণ চায়ের দাম বাহান্ন টাকা। অন্যান্য খাবারের দাম আনুপাতিক হারে হিসাব করে নেয়া যেতে পারে। স্বচ্ছ নীল জলের নাফ নদী দিয়ে ক্রমেই দক্ষিণে ভেসে যাচ্ছি আমরা। দীর্ঘ সময় ধরে হাতের বাঁ দিকে দেখা যায় উঁচু নিচু সবুজ পাহাড়।

কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর কাঁটা তারের বেড়া এবং ওয়াচ টাওয়ারের অস্তিত্ব থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে এখন মায়ানমারের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। দেশটা গণতান্ত্রিক হলে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ইওরোপিয় ইউনিয়ন বা নিদেনপক্ষে আসিনের দেশগুলোর মতো হলে খুব সহজেই ঘুরে আসা যেতো নাফ নদীর পূর্ব তীরে মায়ানমারের মংডু। নাফ নদীর মোহনায় সমুদ্রে পড়ার সময় খানিকটা দোল খেতে শুরু করলো আমাদের জলযান। তবে জাহাজের বিশালত্ব এবং চমৎকার আবহাওয়ার কারণে ঢেউয়ের দোলায় সামান্য কিছু ওঠানামা নিতান্ত ভীতু লোকের জন্যেও তেমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃস্টি করতে পারেনি। সারা পথে খুব বেশি একটা নৌকা বা অন্য জলযান চোখে পড়েনি।

সেন্ট মার্টিনের কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেল মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার এবং স্পিডবোটসহ ছোট ছোট নৌযান। বারটা বাজার আগেই কেয়ারি সিন্দবাদের গায়ে এসে ভিড়লো কেয়ারি। মিনিট দশেক আগে ঘাটে পৌঁছে গেছে কেয়ারি সিন্দবাদ। এই দুটি ছাড়াও ঈগল এবং কুতুবদিয়া নামে বড় আকারের আরও দুটি জলযান সেন্টমার্টিন টেকনাফের মধ্যে আসা যাওয়া করে। স্থানীয় মানুষেরা প্রায় সারা বছরই ট্রলারে চেপে টেকনাফ সেন্টমার্টিন যাতায়াত করেন।

এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ভ্রমণবিলাসীরাও ইচ্ছে করলে ট্রলারে সাগর পাড়ি দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে লাইফ জ্যাকেট এবং আনুসঙ্গিক সতর্কতা সত্ত্বেও সলিল সমাধি ঘটলে কাউকে দায়ী করা যাবে না। বেলা বারটায় বাদাম ভাজার কড়াইয়ের বালির মতোই তেতে উঠেছে সাগর পাড়ের বালি। বাজারের মাঝ দিয়ে এক চিলতে সরু পথ দিয়ে না হেঁটে শর্টকার্টে হোটেল ব্লু মেরিনে পৌঁছবার জন্যে যারা বালির উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল তাদের স্যান্ডেল জুতা ভেদ করে পায়ের তলা বাদাম ভাজা হয়ে গেছে। সেন্টমার্টিন ভ্রমণে ভারি কেডস অথবা পুরো সোল বিশিষ্ট জুতা না থাকলে শুধু তপ্ত বালিতে হাঁটার সমস্যা নয়, ছড়িয়ে থাকা ঝিনুক অথবা ধারালো প্রবালে পা কেটে যাবারও সম্ভাবনা থাকে।

জোয়ারের সময় পানির মধ্যে হাঁটার জন্যে ওয়াটারপ্রুফ বা স্পঞ্জ জাতীয় স্যান্ডেল থাকলে ভাল। আট বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে স্থানীয় বাসিন্দার সংখ্যা সাত হাজারের মতো। এদের বেশিরভাগই পেশায় মৎসজীবী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এখানে পর্যটকের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবার ফলে হোটেল রেস্টুরেন্ট এবং পর্যটনের সাথে সম্পর্কিত ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। তবে টুরিস্টের সংখ্যা বৃদ্ধি ক্রমেই দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপের জীববৈচিত্র্য... কচ্ছপ,ঝিনুক, শামুক এবং খোদ প্রবালের অস্তিত্বই বিপন্ন।

এখন অবশ্য নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ এবং দ্বীপের প্রবাল ঝিনুক ও ফলমূল সংগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দ্বীপে তেমন কোনো রাস্তাঘাট নেই, ফলে ‘মেইন রোডে’ মনুষ্য চালিত ভ্যান গাড়ি যাতায়াতের একমাত্র বাহন। এবং অন্যান্য জায়গায় পায়ে হাঁটার বিকল্প নেই। পর্যটন করপোরেশনের অবকাশ এবং ব্লু মেরিন ছাড়াও বেশ কিছু হোটেল এবং রিসর্টে রাত্রি যাপন করা যেতে পারে, তবে পর্যটকদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে এখানে কোথাও কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। বড় হোটেল গুলোতে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত জেনারেটর চলে।

আমরা অবশ্য হোটেল কর্তৃপক্ষকে ‘তেল’ দিয়ে সারারাত জেনারেটর চালাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। যথেষ্ট গরম থাকায় দিনের বেলা হোটেলে অবস্থান মোটেও সুখকর হয়নি। সবকিছুর পরেও সেন্ট মার্টিনের শান্তসমুদ্র, নীলজল, সবুজ কেয়াবন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সৌন্দর্যের কোনো তুলনা নেই। একটি পূর্ণিমা রাতের সাথে তারিখ মিলিয়ে সেন্ট মার্টিনে যেতে পারলে বেলাভূমিতে অপার্থিব জোৎস্নায় ভিজে ঘরে ফিরতে পারেন। তবে তেমন ভাগ্য তো সবার হয় না... আমাদের হয়েছিল! অসমাপ্ত... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.