আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জলোচ্ছ্বাস ১৯৭০চোখের জল মিশে গেছে জলোচ্ছ্বাসের জলে

আজ আমার মন ভাল নেই। সময় আর অসময়ের আধো আলো মুজাহিরুল হক রুমেন॥ ১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর । মনপুরায় তখন বেড়ী বাঁধ নেই। নুরুল ইসলামের বয়স তখন ৮ বছর। অতি চঞ্চল নুরুল ইসলামের শখ ছিল গাছে গাছে ঝুলে বিভিন্ন ফল খাওয়া আর বাতাসে দোলা।

মায়ের বকুনি কিংবা মার কিছ্ইু তাকে ফেরাতে পারতোনা গাছে ঝোলা থেকে। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। মা যতোই বকুক সে মায়ের এক বিশেষ আদর ঠিকই বুঝতো। ১৯৭০ সালের ভয়াল ১২ নভেম্বর দক্ষিনাঞ্চলের প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড়ে নুরুল ইসলামের সেই সখ- গাছে ওঠা’ই জীবন বাঁচাতে কাজে লেগেছে বলে তিনি জানান। ১২ নভেম্বর রাতের সেই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণে এখনও শিউরে ওঠেন নুরুল ইসলাম।

মনে পড়ে- মায়ের হাতের সেই গরম পিঠা খাওয়ার আমেজ। ভাই বোনদেও সাথে পিঠা আগে নেয়া পড়ে নেয়া নিয়ে হইহুল্লর। তিনি জানান, দুপুরে বড় বোন বিবি ফাতেমা হঠাৎ করেই কান্না শুরু করে ‘বইন্নায় কেউ বাইচবো না, বাইচবোনা’ বলে। ফাতেমার কান্না দেখে পাশের ঘরের মানুষ হাসাহাসি করে। মা ফাতেমাকে কান্না থামাতে ধমক দেয়।

তখন কেউই বুঝতে পারেনি কি হতে যাচ্ছে। ১১ নভেম্বর দুপুর একটার দিক থেকে আকাশ কিছুটা অন্ধকার হয়ে বাতাস শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে বাতাসের তীব্রতা বাড়ে। বিকালে বেশ ঝড়ো হওয়া শুরু হয়। বাবার সখের কারনে মা মাঝেমধ্যেই পিঠা বানাতো।

দিনের সব কাজকর্ম সেরে সন্ধার পর শুরু করতো পিঠা বানানো। সেই রাতেও মা চেতোই পিঠা বানিয়েছিল। রাত ৯ টার দিকে নারিকেল গুড় দিয়ে পিঠা খায় ঘরের সবাই একসাথে বসে। রাত ১২ টার দিকে ঘরের দরজা খুলে দেখে- ঘরের ঢিবির অনেকটাই পানিতে ডুবে গেছে। তারপর দ্রুত গতিতে পানি বাড়তে থাকে।

রাত ২টার দিকে ঘরের চালা ডুবে গেলে নুরুল ইসলামকে জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়ে চলে। স্রোতের মুখে থাকা অবস্থায় এক সময় একটি নারিকেল গাছ ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। তিনি বলেন, ‘অ্যাই পানিত থাইকতাম হারিনা (পারিনা)। আই গাছে উডি যাই। ’ তিনি জানান, গাছে ওঠার পর পানি আরও বাড়তে থাকে।

এক পর্যায়ে গাছের মাথার উপর দিয়ে পানি বইতে শুরু করে। এক একটা ঢেউয়ের ঝাপটায় গাছের পাতা জাপটে ধরে কোন রকমে টিকে ছিলেন। বাবা-মা সবার কথা মনে করে বারবার কান্না আসছিল। নুরুল ইসলামের সেই চোখের জল বার বার মিশে গেছে জলোচ্ছাসের তীব্র গতির জলে। তিনি জানান, রাত ৪টার দিকে আকাশ হালকা দেখা যায়।

এরপর আধা ঘন্টার মধ্যে পানি অনেক কমে যায়। ভোরের আলো স্পষ্ট হয়ে উঠলে সে নিচে নেমে দেখে পানি কোমড় বরাবর। এর মধ্যেই হেটে হেটে খুঁজতে থাকে আপনজনদের। দূর- দূরান্তের অপরিচিত সব মানুষকে আশেপাশে মরে পড়ে থাকতে দেখে। কাঁদতে কাঁদতে ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকতে ডাকতে খুঁজতে থাকে মাকে।

সেদিন ছিল শুক্রবার। সকালের আলো আসার পর আর পানি ছিলনা। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাইত আয়া বাবারে পাইলেও মারে আর পাই নাই’ অনেক খোঁজাখুজির পর বড় ভাই শাহে আলমকে (১৫) কড়াই গাছের মাথায় আটকে থাকতে দেখা যায়। তাকে অজ্ঞান অবস্থায় গাছ থেকে দড়ি বেঁধে নামানো হয়। অনেক খোঁজাখুজির পরও তিন ভাই, দুই বোন ও মাকে আর পাওয়া যায়নি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।