আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিজরি সনই পৃথিবীর আদি বর্ষপঞ্জি

Technology হোক জীবন উন্নয়নের হাতিয়ার✌ বর্ষপঞ্জি জীবনের একটা অপরিহার্য প্রসঙ্গের নাম। দিন, মাস, সনের হিসাব ছাড়া আধুনিক পৃথিবীতে কোনো কাজই চলে না। বাংলাদেশে তিনটি বর্ষপঞ্জির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরিক কাজ, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে ইংরেজি বর্ষপঞ্জি একটা অপরিহার্য মাধ্যম। হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বণ, বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ আর কৃষিজীবীদের মৌসুমের হিসাব ছাড়া বাংলাদেশে বাংলা পঞ্জিকার ব্যবহার খুব একটা চোখে পড়ার মতো নয়।

মুসলমানদের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, লাইলাতুল কদর, শবেবরাত, মিলাদুন্নবীসহ ধর্মীয় বিষয়াবলির জন্য হিজরি সনের হিসাব অপরিহার্য বিষয়। জীবনের প্রাসঙ্গিকতায় ইংরেজি ও বাংলা সনের বিদায় ও বরণে যতটা গুরুত্ব প্রদান করা হয় হিজরি সনের ক্ষেত্রে তা মোটেও লক্ষ করা যায় না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রতি এতটা অবজ্ঞা সত্যিই দুঃখজনক। সাধারণ মানুষ তো বটেই; অনেক আলেম যাঁরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করে থাকেন, তাঁরাও হিজরি পঞ্জিকার দিন-তারিখের খবর রাখেন না। এভাবে অনেকেরই অজান্তে মুসলিম বর্ষপঞ্জির আরো একটি বছর পূর্ণ হলো।

বিদায় নিল ১৪৩৩ আর আগমন হলো ১৪৩৪ হিজরি সনের। আলবিদা ১৪৩৩, আসসালাম-স্বাগত ১৪৩৪ হিজরি। ইসলামী বর্ষপঞ্জি তথা আরবি পঞ্জিকাই পৃথিবীর আদি ও আদর্শ সন গণনার পদ্ধতি, যা পৃথিবীর সৃষ্টিকাল থেকে চলে আসছে। যদিও হজরত ওমর (রা.) তাঁর খেলাফতকালে রাসুল (সা.)-এর হিজরতের বছরকে সূচনা ধরে হিজরি সনের প্রচলন করেন। তিনি বর্ষ পরিক্রমায় কোনো নতুন পদ্ধতি চালু করেননি।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে বছর গণনার মাস ১২টি নির্ধারিত। এর মধ্যে চারটি মাস নিষিদ্ধ। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এগুলোর বিষয়ে নিজেদের ওপর জুলুম করো না (সুরা : তওবা, আয়াত : ৩৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও বিদায় হজের ভাষণে একই কথা বলেছিলেন।

রাসুল (সা.) বলেছিলেন, হে মানবমণ্ডলী, তোমরা মনোযোগসহকারে শোনো! যেদিন আল্লাহ তায়ালা আকাশ-পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে সময় গণনার হিসাব যে বিধান অনুযায়ী হয়ে আসছে, এখনো ওই একই বিধানের আলোকে তা পরিচালিত হবে। আল্লাহ তায়ালা যেদিন আকাশ-পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে আল্লাহর বিধানে বছর গণনার মাস ১২টি নির্ধারিত। এর মধ্যে চারটি মাস নিষিদ্ধ। ওই চার মাসের ব্যাপারে তোমরা নিজেদের ওপর কোনো জুলুম করো না (বুখারি)। কোরআনের আয়াত ও হাদিসে উল্লিখিত নিষিদ্ধ চার মাস মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ।

এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তবে জাহেলি যুগে নিষিদ্ধ মাসগুলোর ধারাবাহিকতায় আরবরা কিছু রদবদল করেছিল। মুজার গোত্র রজব মাসকে জমাদিল আখার ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী তথা সপ্তম মাস হিসেবে গণ্য করত, আর রবিয়া গোত্র শাবান ও শাওয়াল মাসের মধ্যবর্তী অর্থাৎ অষ্টম মাস হিসেবে গণ্য করত (ইবনে কাছির)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ১২ মাসের ক্রমধারায় মুজার গোত্রের হিসাব সঠিক বলে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের তথ্যমতে, আরবি বর্ষপরিক্রমাই আদি এবং আদর্শ বর্ষপঞ্জি।

পক্ষান্তরে ইংরেজ বর্ষপঞ্জির সূচনা হয় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের বছর থেকে। পৃথিবীতে আদিকাল থেকে বছর গণনার রীতি চলে এলেও সন নির্ধারণের জন্য কোনো সর্বজনীন পদ্ধতি চালু ছিল না। তাই মানুষ কোনো বিশেষ বা ঐতিহাসিক ঘটনার বছর প্রথম ধরে বছরের সংখ্যা নির্দেশ করত। যেমন_আবরাহা বাহিনীর কাবা আক্রমণের বছরকে কেন্দ্র গণ্য করে বলত আমুল ফিলের এত বছর পরে বা আগে। অথবা দুর্ভিক্ষের বছরের আগের বা পরের ঘটনা।

সন নির্ধারণের সর্বজনীন কোনো রীতি চালু না থাকায় মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির স্মৃতি সংরক্ষণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার পরে দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডের নথি সংরক্ষণে জটিলতার সৃষ্টি হয়। একবার হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে তাঁর সামনে একটি দলিল উপস্থাপিত হলো, যাতে শুধু শাবান মাস উল্লেখ ছিল। খলিফা দলিলটি দেখে বললেন, এটা বর্তমান বছরের শাবান মাস, নাকি গত বছরের সেটা কী করে বুঝব? তিনি তাৎক্ষণিক সন নির্ধারণের জন্য বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামের এক পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন। অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়, একবার কুফার গভর্নর হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) হজরত ওমর (রা.)-কে লিখে পাঠালেন, আমিরুল মুমিনীন, আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে জরুরি পত্রাদি আসে।

যাতে প্রজাতন্ত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ থাকে। আমাদের প্রতি জরুরি ফরমান থাকে, অথচ এতে কোনো দিন, তারিখ ও সন উল্লেখ থাকে না। ফলে আমরা বুঝতে পারি না চিঠিটা কবে আমাদের পাঠানো হলো, কত দিন পর আমরা সেটা পেলাম, আর কবে থেকে খলিফার ফরমান বা নির্দেশ কার্যকর হবে। অতএব আপনার চিঠিপত্রে নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ থাকা জরুরি। চিঠিটি পাঠ করে হজরত ওমর (রা.) বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন এবং তাৎক্ষণিক হজরত ওসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.)সহ বিশিষ্ট সাহাবিদের নিয়ে জরুরি পরামর্শ সভায় মিলিত হলেন।

সভায় সবাই যুক্তিসহ নিজের মতামত পেশ করলেন। কেউ বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের বছরকে সূচনা ধরে মুসলিম সনের প্রবর্তন করা হোক, কেউ বললেন আল্লাহর রাসুলের নবুওয়াত প্রাপ্তির বছরকে প্রথম ধরে মুসলিম বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করা হোক। আবার কেউ বললেন, রাসুলে করিম (সা.)-এর ওফাতের বছরকে কেন্দ্র ধরে ইসলামী সনের প্রচলন করা হোক। হজরত ওমর (রা.) সবার মতামত শোনার পর এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বললেন, যদি রাসুলের জন্মের বছরকে সূচনা ধরা হয়, তাহলে খ্রিস্টানদের অনুসরণ করা হয়।

যদি মৃত্যুর বছরকে কেন্দ্র গণ্য করা হয়, তাহলে শোককে স্থায়ী রূপ দেওয়া হয় আর যদি নবুওত প্রাপ্তির বছরকে ধরা হয় তাহলে বিষয়টি একেবারে আধ্যাত্মিক হিসেবে গণ্য হয়। তিনি ভিন্ন একটা প্রস্তাব পেশ করলেন। হজরত ওমর (রা.) বললেন, আল্লাহর রাসুলের হিজরতের বছরকে আরম্ভ ধরে মুসলমানদের স্বতন্ত্র বর্ষপঞ্জি নির্ধারণ করা যেতে পারে। সে প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং সেই থেকে মুসলমানদের কার্যপঞ্জি হিসেবে হিজরি সন চালু হয়। ঘটনাটা ছিল ১৬ হিজরির বা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের।

মূল লেখক :মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ পেশ ইমাম ও খতিব রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।