আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলোর ছায়া

পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু হচ্ছে নিজের মন... সবার আগে নিজের মনকে চিনুন... নিজের মনের কাছে অচেনা থাকবেন না ... এই নিয়ে তিনবার হল। কিন্তু সবুজের জন্য কাজটা করতে পারল না মিনহাজ। আবার নিচে তাকাল মিনহাজ। মানুষগুলোকে কতো ছোট্ট দেখাচ্ছে। ২০ তালা বিল্ডিং এর ছাদ থেকে এরকমই মনে হবার কথা।

মিনহাজের মনে হল সেও ক্ষুদ্র একজন। এই জগতে তার কোন প্রয়োজন নেই। পরক্ষনেই মনে পরল ছোট্ট ভাইটির কথা,অসুস্থ মায়ের কথা। মিনহাজ বুঝতে পারছে না,সে কি করবে। চোখ বুঝলেই দুঃসহ সৃতিগুলো তারা করে ফিরছে তাকে।

লাবণ্যর সাথে তার প্রথম পরিচয় মেডিকেল কোচিং এ। আর দশটা ছেলের যেভাবে প্রেম হয় তার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। লাবণ্যকে প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল আল্লাহ যেন ওকে মিনহাজের জন্যই তৈরি করছেন। লাবণ্যের মা প্রায়ই ফোন করতেন মিনহাজের আন্টিকে। একদিন ফোন রিসিভ করতে গিয়ে আচমকা পরিচয় হয়ে গেল লাবণ্যের সাথে।

পরের দিন মিনহাজ আবার ফোন দিল। কেউ কোন কথা বলছিল না। মিনহাজ ও কি বলবে বুঝতে পারছিল না। এভাবে ১ মিনিট ৪২ সেকেন্ড পার হয়ে গেল। অবশেষে নিরবতা ভেঙ্গে মিনহাজ ই প্রথম কথা বললো,'আমি কি কারো সাথে কথা বলছি?'ওই দিন ওই পর্যন্তই ।

ওই রাতে মিনহাজের চোখের দু পাতা এক হল না। লাবণ্যের মুখটা সে কিছুতেই ভুলতেই পারছিল না। বইয়ের পাতা থেকে শুরু করে নামাজের সিজদা সব জায়গা ... সব জায়গাই লাবণ্যের ছবি । একদিন মিনহাজ বই পরছিল। ঠিক তখনি একটা ফোন এল।

আশপাশে কেউ না থাকায় সেই ফোন রিসিভ করলো। ওপাশে লাবণ্যের কণ্ঠ সুনে হিতাহিত শুন্য হয়ে গেল। মেয়েলি কণ্ঠটি বলল,'আমি কি কারো সাথে কথা বলছি?'মিনহাজের মনটা অদ্ভুত শান্তিতে ভরে গেল। সেদিনের ৫ মিনিটের সংলাপ তাকে অন্য একটা পৃথিবীতে নিয়ে গেল ,যেখানে শুধু লাবণ্য নামের মেয়েরাই থাকে। মাঝে মাঝে লাবণ্য তাকে ফোন করে শুধু একটা কথাই বলে,'আমি কি কারো সাথে কথা বলছি?'তারপর ফোনটা রেখে দেয়।

একদিন আলাপ চারিতার মাঝে রান্নার কথা আসলো। মিনহাজ লাবণ্যকে জিজ্ঞেস করল সে কি রাধতে পারে। লাবণ্য বলল সে শুধু নুডুলস রান্না করতে পারে। মিনহাজ হঠাত বলে বস্ল,'আমি সারা জীবন তমার হাতের নুডুলস খেতে চাই,তুমি কি খাওয়াবে আমাকে?'...লাবণ্যের দুচোখ বেয়ে শুধু অশ্রু ঝরছিল......যে কান্না পরম আরাধ্য ভালবাসাকে নিজের মত করে বুঝে পাওয়ার কান্না। এরপর মিনহাজ লাবণ্যের জুটি পিছে ফিরে তাকায়নি।

বিমূর্ত প্রেমের জোয়ারে টিএসসি,আশুলিয়া,নন্দন,বেড়িবাধ,বোটানিক্যাল গার্ডেন সব ভেসে গেল। সেই জোয়ার মিনহাজের মেডিকেল প্রস্তুতিকে ভাসিয়ে নিতে দিধা করেনি। ফলে যা হবার কথা তাই হল। ৩-৪ টি ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে কোথাও সুযোগ হল না । স্বপ্নের রঙ্গিন দুনিয়া থেকে পাথুরে বাস্তবে নেমে এলো সে।

তার এই কষ্ট দরিদ্র বাবার ক্লিষ্ট মুখ,অসুখি মায়ের কান্না দেখে আরও বেড়ে গেল। কিন্তু এই কেউ এলো না সান্তনার হাত বারিএ। হিনমন্ন হয়ে পরল সে। দুঃখ ভরা ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ঢাকা ফিরল সে। ঢাকা এসেই অ্যান্টির তেঁতো বকার তিক্ত সাধ পেল।

কথায় আসে অভাগা যেদিকে তাকায় সে দিকে সমুদ্র শুকিয়ে যায়। সপ্তাখানেক পর মেডিকেল পরিক্ষা। কিন্তু কে তাকে প্রেরনা জোগাবে?সেকি তার শেষ আশাতার জন্য কন প্রেরনা পাবে না। এতসব ঘটনা তাকে চরম অভিমানি করে তুলল। মিনহাজ ঠিক করল এই জীবন আর রাখবেনা ।

হতভাগা এই মুখকে সে লাবণ্যের সামনে হাজির করতে চাইলনা। লাবণ্য অবশ্য তাকে সে সুযোগ দিল না। সেদিন বিকালে লাবণ্য আসেই আন্টিদের বাসার ছাদে নিয়ে গেল। লাবণ্য সবই শুনল কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। তাই মিনহাজ মনে মনে অবাকই হল।

আচমকা লাবণ্য তার ধরে বলল,'মিনহাজ তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও' এই প্রথম লাবণ্যের হাত ধরল মিনহাজ। চোখ রেখে বলল,'মিনহাজ আমি জানি তুমি পারবে। তোমাকে আমার জন্য পারতে হবে। বাকি দিন গুলো মন দিয়ে পড়',লাবণ্যের ছলছল চোখের দিকে মিনহাজের মনে হল সে পারবে। লাবণ্যের জন্য হলেও তাকে পারতে হবে।

তার বুক থেকে হাজার মনের পাথরটা এক নিমিষেই নেমে গেল। অশ্রু সিক্ত চোখে লাবণ্য বল্ল,'তুমি যদি চান্স পাও,তোমার জীবনের সবচেয়ে বর উপহারটা আমিই দেব। ৯ই জানুয়ারী মেডিকেলের রেজাল্ট বের হল। মিনহাজ অবিশ্বাস ভাবে একটি নামকরা মেডিকালে চান্স পেয়ে গেল। মিনহাজ নিজে অবশ্য এত অবাক হল না।

তার বিশ্বাস ছিল সে পারবে। রাস্তার পাশের দোকান থেকে সবার আগে লাবণ্যকে ফোন করল। ফোন পাওয়ার পর লাবণ্য কিছুক্ষন নিরব থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল। বিকেলে ধানমন্ডি লেকের পারে দেখা হলে মিনহাজ সবার আগে তার জীবনের সবচেয়ে দামি গিফট চাইলো। লাবণ্য গম্ভীর মুখেই বল্ল,'তোমার যদি আপত্তি না থাকে আগামি শুক্র বারে আমরা বিয়ে করছি।

আমরা সপরিবারে ২ বছরের জন্য ফ্রান্স চলে যাচ্ছি। আমাদের বিয়ের কথা কেউ জানবে না। তুমি প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই আমাকে পাবে। মিনহাজ সবই মেনে নিল। তাদের মধ্যে আরও অনেক স্বপ্নের কথা হল।

লাবণ্য হাসতে হাসতে বলল,'আমাদের প্রথম সন্তান হবে মেয়ে,যার নাম হবে মিলা,মিনহাজের মি আর লাবণ্যের লা'। ফুরফুরে মন নিয়েই বাসায় ফিরল মিনহাজ। কিন্তু তারপরও মনের ভিতর কি জন্য একটা খচখচ করছিল। সে ভাবছিল দু বছর পর ফিরে লাবণ্য তাকে মনে রাখবেতো?কিন্তু পরক্ষনেই মনের সব সন্দেহ ও জুজু কাটিয়ে ঠিক করলো,বিয়ে সে করবেই এবং সেটা শুক্রবারেই। কিন্তু অসুস্থ মায়ের মুখ,দরিদ্র বাবার অভাবি চেহারা তাকে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল।

বিকালে মিনহাজ রেডি হচ্ছিল কাজী অফিসে যাবার জন্ন। বিধাতা বোধহয় তার এই রেডি হওয়া দেখে নিরবে মুচকি হেসেছিলেন। ঠিক ওই দিন বিকালে মিনহাজের মা মারাত্মক শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে আইসিউ তে ভর্তি করা হল। দিশেহারা মিনহাজ কি করবে বুঝতে পারছিল না। শেষে ঠিক করল লাবণ্যের বাসায় ফোন করে তার মায়ের অসুস্থতার কথা জানিয়ে দেবে।

কিন্তু তার আগেই বাসা থেকে বেড়িয়ে যাওয়ায় ফোনে লাবণ্যকে পেল না। অসহায় বোধ করল সে। কিভাবে অসুস্থ মাকে আইসিইউতে রেখে ৪২ কিমি দুরের কাজী অফিসে যায়?নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ঠিক করল রাতেই লাবণ্যকে জানিয়ে দেবে আগামীকাল সকালেই তারা বিয়ে করছে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় আবারো মুচকি হাস্লেন। রাতে লাবণ্যের প্রচণ্ড জ্বর থাকায় ওর সাথে মিনহাজ কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারল না।

চূড়ান্ত দুর্ঘটনা হল শনিবার সকালে। রবিবার হরতাল থাকায় শনিবার সকালের ফ্লাইটেই লাবণ্যরা সপরিবারে ফ্রান্সে চলে গেল। দুনিয়াটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছিল মিনহাজের। কি করবে বুঝতে পারছিল না সে। লাবণ্য যে তার প্রতি একটা বাজে ধারনা করেছে এই বেপারে তার কোন সন্দেহ রইল না।

তারপরও তার আশা ছিল রাগ ভেঙ্গে লাবণ্য হয়ত তার সাথে যোগাযোগ করবে। কিন্তু মিনহাজের আশা পুরন হল না। দুবছর পর খবর পেল লাবণ্য চট্টগ্রাম মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। মিনহাজ একবার ভাবল গিয়ে সরাসরি দেখা করবে। কিন্তু সাহসে কুলালো না।

তীব্র অপরাধ তাকে একেবারে আছন্ন করে ফেলল। ফোন,মোবাইল,ইমেইল কোনটাই লাবণ্যের অভিমান ভাঙ্গাতে পারল না। মিনহাজ হারিয়ে ফেলল জীবনের প্রতি সকল আগ্রহ। ৩৫ বছর পরের কথা। প্রখ্যাত মেডিকেল স্পেশালিষ্ট ডা মিনহাজের ওপেন হার্ট সার্জারি হবে।

ফ্রান্স থেকে কার্ডিয়াক সার্জন আসছেন। ওটি টেবিলে শুয়ে ডা মিনহাজ ভাবছিলেন তার দীর্ঘ ৫৫ বছরের জীবনে পাওয়া না পাওয়ার কথা। এই জীবনে তিনি যা চেয়েছেন তা সবই পেয়েছেন্‌,শুধু একটা জিনিস পাননি। মিনহাজ ভাবছে অপারেশন সাকসেস না হলে এই অপুরনতা নিয়েই হয়তো মারা যেতে হবে। এই কথা যখন ভাবছিল তখন বিখ্যাত মহিলা কার্ডিয়াক সার্জন ওটিতে এসে পৌঁছেছেন।

উনি এসেই মিনহাজের হাত ধরে কুশল জিজ্ঞেস করে বলল,'আমি ডা লাবণ্য হায়দার,আপনি ভাল আছেন?'সহকারি ডাক্তাররা তখন মিনহাজকে অ্যানসথেসিয়া দিচ্ছিল। ৩৫ বছর পর হলেও মিনহাজ লাবণ্যকে চিনতে একটুও ভুল করলো না। আবেগতাড়িত মিনহাজ কোন জবাবই দিতে পারল না,শুধু একপলকে তাকিয়ে রইল। এদিকে অ্যানসথেসিয়ার প্রভাব শুরু গেছে। পুরোপুরি চেতনা হারানোর আগে মিনহাজ শুধু বিড়বিড় করছিল,'আমি কি কার সাথে কথা বলছি',...এই কথা শুনে কানে যেতেই ডাঃ লাবণ্য চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে মিনহাজের দিকে।

তিন যুগ হারিয়ে যাওয়া ভালবাসাকে চিনতে একমুহূর্তও দেরি হল না লাবণ্যের। দুফোটা অশ্রু চোখের বাধ ভাঙছিল তখন সহকারি সার্জন বলল 'আসুন ম্যাডাম অপারেশন শুরু করি। ওদিকে মিনহাজের মনে হলো লাবণ্যের মুখটা আস্তে আস্তে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে, রঙ্গিন মুখটা আস্তে আস্তে সাদা তারপর ধুসর তারপর একসময় মিলিয়ে গেল। পুরোপুরি চেতনা হারানোর আগে মিনহাজের মনে হল,এখন সে মারা গেলেও তার কোন আক্ষেপ থাকবেনা্‌,কেননা ভালবাসার মানুষের হাতে মৃত্যুতেও তার আপত্তি নেই। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.