আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি

মিজান রহমান শ্রেষ্ঠ ট্রিং ট্রিং ডাবল বেলের সুরে এগিয়ে চলে রফিকের রিক্সা। ভোলা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বকশী লঞ্চ ঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে উচু ভেরী বাধে উঠতে হয়। বকশীর ভেরীবাধ থেকে নামতেই প্রচন্ড ঝাকুনিতে যাত্রীরা খেই হারিয়ে ফেলতে না ফেলতেই আবার শক্ত করে রিক্সার হুড ধরে চেপে বসে। তখনও বেজে চলে ট্রিং ট্রিং ডাবল বেলে সুর। - 'এই মিয়া রিক্সা থামাও।

' রিক্সার যাত্রীদের একজন বলে, 'ব্রেক মারো, এই মিয়া রিক্সা থামাও। ' তার গলায় টাই। গায়ে স্যুট। শহরের বড় লোকদের একজন। ভোলার এই প্রত্যন্ত অঞ্চল কলমীতে কেন এসেছে রপিকের তা জানার কথা নয়।

কিন্তু রফিক তাকে যাত্রী করেছে অনেক বড় আশা নিয়ে। ছোট বেলা থেকেই রফিক তার সংসারে অভাব অনটন দেখে এসেছে। দু'বেলা দু'মুঠো খাবারও কখনো হয়তো জোটেনি তার। যখন স্কুলে যাবার বয়স তখন থেকেই ছুটতে হয়েছে আহারের সন্ধানে। মানুষের ঘরে, হোটেল রেস্তরায় কাজ করে সহযোগীতা করতে হয়েছে সংসারে।

বাবা মা ভাই বোনের অনেক বড় সংসার ছিল রফিকদের। অনেক কষ্টের মাঝে রফিক তখন থেকেই একটা চাকরীর স্বপ্ন দেখতো। যে কোন চাকরীই হোক, মাসে মাসে বেতন পাবে আর তা দিয়ে অভাব গুছাবে সংসারের। কিন্তু চাকরী পাওয়াতো অত সহজ কথা নয়। তা ছাড়া রফিক লেখা পড়া কিছুই জানেনা।

রফিক রিক্সা চালায়, বিলকিছ গৃহিনী, মিরাজ ক্লাস টুতে পড়ে। বাবা বেঁচে নেই। মা আছে আরো আছে বিলাতী বেগম বিধবা কিংবা স্বামী হারা বোন। ভাইয়েরা আলাদা হয়ে গেছে যার যার সংসার নিয়ে। নিজের সংসারের হাল ধরে রফিক বেছে নিয়েছে রিক্সা চালানোর কাজ।

কোন মতে সুখে সাচ্ছন্দেই কাটছে রফিকের সংসার তবু চাকরীর আশা ছেড়ে দেয়নি রফিক। যদি কেউ তাকে একটা চাকরী জুটিয়ে দেয় এই আশায় আজও স্বপ্নটাকে লালন করতে থাকে বুকের মাঝে। সে জানে লেখাপড়া ছাড়া চাকরী হয়না তবুও আশা করতে তো দাষ নেই। বকশী লঞ্চ ঘাটে ঢাকা থেকে আসা লঞ্চ ভিড়লেই রফিক লঞ্চের দিকে আপলক তাকিয়ে থাকে। একজন যাত্রীর আশায় প্রতিদিন এভাবেই দাড়িয়ে থাকে সে।

যেন তেন যাত্রী সে চায়না। এমন কাউকে সে যাত্রী করবে যে কিনা তার মনের আশা পূর্ণ করতে পারবে। রিক্সায় উঠে অনেকেই নানান কথা জানতে চায় হয়তো এভাবে কেউ জেনে যাবে তার মনের কথা, পুরণ হবে তার মনের আশা। পেয়ে যাবে সে একটা চাকরী। চাকরীর বেতনে চলবে তার সুখের সংসার।

আজও বড় আশা নিয়ে অপরিচিত ভিনদেশী ভদ্রলোক দেখে রফিক তুলেছে তার রিক্সায়। - ‌'রিক্সা থামাও' ভদ্র লোকের কড়া ধমকে রফিক রিক্সায় ব্রেক করে আর তখন রিক্সা থেকে নেমে আসে একজন ভদ্রলোক। এসেই সজোড়ে এক থাপ্পর বসিয়ে দেয় রফিকের গালে। মলিন হয়ে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখে আপলক চেয়ে থাকে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই রফিকের। রিক্সায় বসে থাকা অন্য লোকটি বলে 'রিক্সা সাবধানে চালাতে পারোনা।

' - ব্যাটায় রিক্সা চালান হিকছে। ' রিক্সায় উঠতে উঠতে ভদ্রলোক বলতে থাকে, 'টানো, এখনও খাড়ায় রইছো ক্যান?' রফিক উঠে বসে পা রাখে তার রিক্সার প্যাডেলে। আজ আর স্বপ্ন দেখা নয়। আজ আর কোন আশা পুরণ হবার নয়। ।

২। সন্ধ্যায় রিক্সা গ্যারেজে জমা রেখে চায়ের দোকানে ঢুকতেই দোকানদার সোনা মিয়া জানতে চায়, 'কি রফিক মিয়া ঘটনা কি? ঢাকার সাহেবেরা তোমারে খোজতে খোজতে অস্থির, ব্যাপার কি?' রফিক কোন কথা বলে না। অজানা আতংক চেপে ধরে মনের ভিতরে। চুপচাপ সে চায়ের মধ্যে বেকারী বিস্কিট ভিজিয়ে খেতে থাকে। ঠিক তখনই ভদ্রলোকেরা এই চায়ের দোকানে আসে।

সকালের সেই থাপ্পর মারা লোকটি বলেন, 'রফিক কিছু মনে কইরোনা। যা হবার হয়ে গেছে। আমি কখনো এই রকম রাস্তায় রিক্সায় চরিনিতো আর তোমার ঐরকম রিক্সা চালানোতে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। ' বেকারী বিস্কিটটা রফিকের হাত থেকে পড়ে যায় একদম মাটিতে।

এমন কথা সে কখনো কারও কাছ থেকে আশা করেনি। কত জনে কতবার মেরেছে। ক্ষমাতো ভালো কথা তারা তাকে নিয়মিত শাসিয়েই গেছে। পারলে তার ভিটে মাটি কেড়ে নেয়ারও চেষ্টা করেছে। আজ সে ভিনদেশী এই ভদ্রলোকদের কাছে কি রকমের ব্যবহার সে পাচ্ছে।

আসলে তারইতো উচিৎ ছিল ওরকম একটা ঢালু পথে সাবধোনে রিক্সা চালানো। সে তাদের দিকে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে বলে, 'ছি ছি এসব বলে আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আমিইতো আপনাগো লগে অনেক বেয়াদবী করছি। আমারে আপনারা ক্ষমা করে দিয়েন। ' - 'তুমি কাল আমাদর সাথে ঢাকায় যাবে। ' অপর ভদ্রলোক বলেন, 'আমরা তোমার জন্য একটা চাকরীর ব্যবস্থা করবো।

' - 'এই আমাদের চা দাও। ' চায়ের অর্ডার দিতে দিতে ভদ্রলোক বলেন, 'এখন গিয়া চাকরীতে জয়েন্ট করবা এর মাস খানেক পর তোমার সংসারের সবাইকে নিয়া আসবা। সবার থাকার ব্যবস্থা আমরাই করবো। ' নিজের অজান্তে রফিকের গাল বেয়ে অশ্রু ধারা বইতে থাকে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে রফিকের।

সে ভাবতে থাকে, শুধু ভাবতে থাকে সাড়া জীবনের আশা আকাঙ্খা নিয়ে। যা চেয়েছি সে চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।