আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ফকির ইলিয়াস ====================================== ২৯ অক্টোবর সোমবারের রাত ছিল আমার জীবনের একটি ভয়াবহ রাত। অনেক রাত জেগে ছিলাম। ব্যাপক ঝড়-তুফান। হাওয়ার কু-লি কাঁপিয়ে তুলেছিল আমাদের নগর। উডহ্যাভেনে, আমরা যে এলাকায় থাকি সেই এলাকায় গাছপালা অনেক।

আমার চোখের ওপর দিয়েই তিন বাসা দূরে একটি বড় গাছ উপড়ে পড়লো। দমকা হাওয়ার গতি যেন ভাঙতে চাইছিল দরজা-জানালা। একবার বেসমেন্টে যাই, একবার ওপরে আসি। ফোন দিলাম মাকে। তিনি কেঁদে দিলেন।

বললেন- দোয়া করছি বাবা। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। ৩০ অক্টোবর ভোরেই স্নেহভাজন গাফফার ফোন দিলো ইংল্যান্ড থেকে। বললো- কেমন আছো মামা! গাফফার হিথ্রো এয়ারপোর্টের ঊর্ধ্বতন ইমিগ্রেশন অধিকর্তা। গাফফার বললো- তোমাদের জেএফকে এয়ারপোর্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অনেকগুলো আমেরিকাগামী ফ্লাইট আমাদের ঘুরিয়ে অন্যান্য রুটে দিতে হয়েছে।

লম্বা ডিউটি করে এলাম। ভাবলাম, আসলেই আমেরিকার এই ধাক্কা বিশ্বের সবার গায়েই কিছু না কিছু লাগবে। আর এখানের ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষিত অঙ্গরাজ্যগুলোর অবস্থা তো একেবারেই ছানাবড়া! স্যান্ডি বিধ্বস্ত নিউইয়র্ককে ‘বড় ধরনের বিপর্যস্ত এলাকা’ ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কতোজন মারা গেছেন, তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তেরো ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় নিউইয়র্ক শহরের নিচু এলাকা।

ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত আটলান্টিক সিটিও চলে যায় প্রায় নয় ফুট পানির নিচে। নিউইয়র্কের ১০৮ বছরের পুরোনো সাবওয়ে সিস্টেমেরও একটা বড় অংশ জলোচ্ছ্বাস কবলিত হয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে, যা আগে কখনো হয়নি। যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তার চেয়েও বড় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিউইয়র্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ। হাডসন নদীর পানি উপচে তলিয়ে গেছে লোয়ার ম্যানহাটনের বেশ কিছু এলাকা। রাস্তার বিভিন্ন সুড়ঙ্গপথ এবং সাবওয়েগুলো সয়লাব হয়ে গেছে পানিতে।

ফলে সাবওয়েগুলো বন্ধ থাকবে ৪/৫ দিন। ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে নিউইয়র্কের কুইনস এলাকায় ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৫০টি বাড়ি। বন্যার কারণে বিদ্যুতের সাব-স্টেশন বিস্ফোরিত হয়ে লোয়ার ম্যানহাটনের বেশিরভাগ এলাকায়ই বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে ম্যানহাটনের ৫ লাখ বাড়ি। এ অবস্থা কয়েকদিন পর্যন্ত চলবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ঝড়ে এটিই সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিভ্রাট বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি কোম্পানি কন এডিসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জন মিকাসড। একটা মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি এখন আমেরিকা। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নিউইয়র্কের হাসপাতাল থেকে সরানো হয়েছে প্রায় ২০০ রোগীকে। পরমাণু প্ল্যান্টগুলোতে দুর্ঘটনা এড়াতে নেয়া হয়েছে সতর্ক ব্যবস্থা। নিউ জার্সির উত্তরাঞ্চলে বাঁধ ভেঙে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে মুনাকি শহর।

বার্গান কাউন্টির চিফ অব স্টাফ জেনা বারাত্তা সিএনএনকে জানান, মুনাকি বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রতিটি রাস্তায় ৪/৫ ফুট পর্যন্ত পানি উঠেছে। অন্তত ৮০ লাখ বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। প্রলয়ঙ্করী এ ঝড়ের আশঙ্কায় প্রেসিডেন্ট ওবামা আগেই ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি এবং পেনসিলভানিয়ায় জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। স্যান্ডির কারণে নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ওয়াশিংটন, ডেলওয়ারে, কানেকটিকাট ও বস্টন বিমানবন্দরে গত তিন দিনে ১৪ হাজারেরও বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ এই ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইকিউইসিএটির প্রাথমিক পূর্বাভাসে বলা হয়, স্যান্ডির আঘাতে ক্ষতির পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। ফেডারেল ইমারজেন্সি এজেন্সি কাজ শুরু করেছে মানুষের সাহায্যের জন্য। এদিকে আগামী ৬ নভেম্বর ২০১২ মঙ্গলবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনের প্রধান দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট ওবামা ও রিপাবলিকান দলের মিট রমনির মধ্যকার টেলিভিশন বিতর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে।

দুই প্রার্থীই এখন বিতর্কের অঙ্গন ছেড়ে আবার তৎপর ছিলেন প্রচারণার মঞ্চে। এর মাঝেই হ্যারিকেন স্যান্ডি ল-ভ- করে দিয়েছে সবকিছু। ওবামা বলছেন, এখন আমার সামনে সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন। নির্বাচনে যা হবার হবে। হোয়াইট হাউস জয়ের জন্য দরকার ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট এবং এই ইলেকটোরাল ভোট যে যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি, সেখানেই এখন দুদলের দুই প্রার্থীর পদচারণা সবচেয়ে বেশি।

প্রেসিডেন্ট ওবামা ওহায়োর উদ্দেশে রওনার আগে ফ্লোরিডাতেই সমাবেশে ভাষণ দেবেনÑ তারপর ওহায়ো গিয়ে যোগ দেবেন, এমন অনেক পরিকল্পনা এখন ভেস্তে গেছে। কথা ছিল, রমনি যাবেন নেভাডা আর কলোরাডোর উদ্দেশেÑ তার নির্বাচনী জুটি কংগ্রেস স্পিকার পল রায়ানের সঙ্গে একত্রে প্রচারণা চালাতে। বিতর্কে ম্যাসাচুসেটসের সাবেক গভর্নর রমনি পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বারাক ওবামার সমালোচনায় বলেছিলেনÑ ওসামা বিন লাদেনের নিধন আর আল-কায়েদা নেতৃত্বের পিছু ধাওয়ার জন্য তাকে আমি মোবারকবাদ জানাচ্ছি ঠিকই, তবে ঐ ঘোলাটে পরিস্থিতি থেকে বের হবার পথ হারিয়ে ফেললে চলবে না। বারাক ওবামা বলেন, মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র অনেক কাজ করেছে ঐ অঞ্চলে শান্তি কায়েমের লক্ষ্যে। এ প্রসঙ্গে তিনি নির্দিষ্টভাবে লিবিয়ার নামোল্লেখ করে বলেন লিবিয়াবাসী মানুষ বেনগাযির সড়কে সড়কে এখনো ধ্বনি তোলেÑ আমেরিকা আমাদের বন্ধু, আমরা আমেরিকার সঙ্গে রয়েছি।

ইরানকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের বিরূপ সমালোচনা করেন মিট রমনি। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার হেতুরূপে উল্লেখ করেন। জবাবে, ইরানের বিরূদ্ধে তার প্রশাসন যে কঠোর সব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তার উল্লেখ করলেন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পাকিস্তানের উল্লেখে ওবামা নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার মূল হোতা ওসামা বিন লাদেনের পিছু ধাওয়া করতে পরিচালিত বিশেষ অভিযানের কথা বলেন। বললেন, অনুমতি চেয়ে ওটা করতে গেলে ঐ সন্ত্রাসীর কাছে হয়তো পৌঁছানোই যেতো না।

শেষ বিতর্কে বারাক ওবামা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিদেশনীতি নিয়ে ঠাট্টা করে বলেন, বিশ্ব সম্পর্কে রমনির ধারণা এখনো সেকেলে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জন্য আরো যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে রমনির আহ্বানের অসারতা তুলে ধরে ওবামা বলেন, রমনি যুক্তরাষ্ট্রকে ঠা-া লড়াইয়ের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চান। ওবামা বলেন, আগের ২৮৫টি জাহাজের জায়গায় যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর এখন ৩০০টি জাহাজ আছে। বিশ্ব বাস্তবতা সম্পর্কে রমনির সীমাবদ্ধ ধারণাকে উপহাস করে ওবামা বলেন, আমাদের ঘোড়া ও বেয়নেটেরও স্বল্পতা আছে। ওবামা বলেন, ২০ বছর আগেই ঠা-া লড়াইয়ের যুগ শেষ হয়েছে।

আপনি সুযোগ পেলে পররাষ্ট্রনীতিতে ১৯৮০ সালকে আবার আমদানি করবেন বলে মনে হচ্ছে। জবাবে রমনি বলেন, আমাকে আক্রমণ করা বিতর্কের আলোচ্য বিষয় নয়। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যার সমাধান হবে না। রমনির অভিযোগ, ওবামা মধ্যপ্রাচ্যের বিশৃঙ্খলা বন্ধে ব্যর্থ হয়েছেন। ওবামা ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে আখ্যা দেন।

বিতর্কে একটি বিষয়ে দুই প্রার্থী একই ধরনের বক্তব্য দেন। সেটি হচ্ছে সিরিয়া ইস্যু। উভয়েই সিরিয়ার একনায়ক বাশারের সমালোচনা করেন। ওবামা বলেন, আমি নিশ্চিত আসাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। অন্যদিকে রমনি বলেন, সিরিয়া আমাদের জন্য একটি সুযোগ এনে দিতে পারে।

তবে দুপ্রার্থীই সেখানে সেনা পাঠানোর বিষয়টি এড়িয়ে যান। বিদেশ নিয়ে তাদের অনেক কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি অনেক হিসাব পাল্টে দিয়েছে। নিউইয়র্কের পাতাল রেলের লাইনে যে পানি জমেছে, তা নিষ্কাশনের জন্য এক্সপার্ট দল বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে নিউইয়র্কে ছুটে এসেছে। কাজ চলছে রাতদিন।

নিউইয়র্কে যে বিষয়টি গভীরভাবে দেখছি তা হচ্ছে, মানুষের কাজের ঐক্য। যে যা পারছে কাজ করছে। একটা কফিশপে ঢুকেছিলাম কফি কিনতে। দেখলাম একদল ফায়ার ফাইটার এসেছেন কফি কিনতে। একজন আমেরিকান মহিলা কাউন্টারে গিয়ে বললেন, ‘ফায়ার ফাইটারদের কেনা খাদ্যের সকল বিল আমি দেবো’।

মহিলা বললেন, ফায়ার ফাইটাররা কাল সারারাত (২৯ অক্টোবর) কাজ করেছেন। আমি তাদের কফি আপ্যায়ন করতে চাই। এটাই হলো আমেরিকার ইউনাইটেড স্পিরিট। কাজের একাগ্রতা দেখলে মাথা নত হয়ে আসে। এমন ঐক্য আমরা বাংলাদেশেও দেখেছি।

রাত জেগে দেশের মানুষ বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে বন্যা আটকেছেন। পার্থক্য হলো আমেরিকা ও বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মাঝে। যদি বাংলাদেশের সিংহভাগ রাজনীতিক মার্কিনিদের মতো বলীয়ান হয়ে কাজ করতেন তবে বাংলাদেশের আর কোনো দুঃখ থাকতো না। ----------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ১ নভেম্বর ২০১২ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.