আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমেরিকান পুলিশঃ চোরের ধরার কায়দা, চোরের পেছনে চোর লাগায়

মানবিক দায় ও বোধহীন শিক্ষা মানুষকে প্রশিক্ষিত কুকুরে পরিণত করে....আইস্ট্যাইন। নিউইয়র্ক পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সামিউর রহমানের (১৯) গতিবিধি নজরদারি করতে তাঁর পেছনেও চর (সোর্স) লাগিয়েছিল। সেই চর পুলিশের কাছ থেকে সামিউরের চেয়ে বেশি অর্থ পেতেন। বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন সামিউর। প্রথম আলো সন্দেহভাজন মুসলিম জঙ্গিদের ধরিয়ে দিতে পুলিশের তথ্যদাতা হিসেবে অথের বিনিময়ে কাজ করতেন সামিউর।

একপর্যায়ে তাঁর মনে হয়, তিনি অর্থের জন্য মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। তাই স্বেচ্ছায় ওই কাজ ছেড়ে দেন তিনি। এপিকে সামিউর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সামিউর কীভাবে পুলিশের চর হিসেবে কাজে যোগ দেন, কীভাবে কাজ করেন এবং কেন কাজ ছেড়ে দেন, তা বিস্তারিত তুলে ধরেন এপির কাছে। এপিও তাঁর উল্লেখ করা নানা বিষয় খতিয়ে দেখে এগুলো সত্য বলে মনে করছে।

নিউইয়র্ক সিটির একেবারে পূর্বাঞ্চলের কুইন্স কাউন্টিতে জš§ সামিউরের। মাদকসংক্রান্ত অপরাধে জড়িত থাকায় গত জানুয়ারির শেষ দিকে তৃতীয়বারের মতো তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁকে নেওয়া হয় কুইন্স কারাগারে। সেখানে সাদা পোশাকের একজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। ওই পুলিশ সদস্য তাঁর কাছে জানতে চান, কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি কীভাবে জীবন কাটাতে চান।

বিষয়টি নিয়ে দুজনের কথা হয়। জানুয়ারিতেই সামিউরকে পুলিশের তথ্যদাতা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরের মাসে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পান সামিউর। ১৫ অক্টোবর এপিকে সাক্ষাৎকার দেন তরুণ সামিউর। তিনি জানান, সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে পুলিশের চর হিসেবে কাজ শুরু করেন।

সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য কোনো কিছুর পেছনে লেগে থেকে তাঁকে তথ্য সংগ্রহ করতে হতো না। যেকোনো কিছুর পেছনেই গোয়েন্দাগিরি করতে পারতেন। তিনি মসজিদে মসজিদে যেতেন, ছবি তুলতেন, ইমামদের সঙ্গে কথা বলতেন, নামাজ পড়তে যাওয়া লোকদের তালিকা করতেন। পরে সেগুলো পুলিশের কাছে সরবরাহ করতেন। তিনি এমন বহু লোকের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করেছেন, অতীতে যাঁদের অপরাধের কোনো রেকর্ডই নেই।

এত বেশি মানুষের পেছনে ছোটা এবং তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। সামিউর জানান, শুরুর দিকে এই কাজ করে সন্তুষ্ট ছিলেন। ভাবতেন, নিউইয়র্ক সিটি সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। তখন নিজেকে ‘নায়ক’ মনে হতো। শুরুর দিকে ম্যানহাটনে জন জে কলেজের মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (এমএসএ) একটি অনুষ্ঠানে গোয়েন্দাগিরি করতে যান সামিউর।

সেখানে প্রধান বক্তা ছিলেন ব্র“কলিনের আত-ত্বাকওয়া মসজিদের নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান আলী আবদুল করিম। নিউইয়র্ক পুলিশের নথিপত্র খতিয়ে দেখে এপি নিশ্চিত হয়েছে, এই আবদুল করিমের ব্যাপারে অনেক আগে থেকেই সচেতন ছিল পুলিশ। এ জন্য আত-ত্বাকওয়া মসজিদও পুলিশের আলাদা নজরে ছিল। নিউইয়র্ক পুলিশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টিভ নামের একজন সামিউরের কাজ তদারক করতেন। তিনিই সামিউরকে তথ্য সংগ্রহের জন্য ওই অনুষ্ঠানে যেতে বলেন।

তবে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর গোয়েন্দাগিরি করার নির্দেশ ছিল না সামিউরের প্রতি। তাঁকে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া লোকজনের ছবি তুলতে এবং সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ও এর নেতাকে শনাক্ত করতে বলা হয়। পাশাপাশি আবদুল করিমের বক্তৃতায় ‘জিহাদ’, ‘বিপ্লব’ বা মৌলবাদী কথা থাকলে তা পুলিশকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ২৩ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠানে হাজির হন সামিউর। তিনি আবদুল করিমের বক্তৃতা শোনেন।

সেখানে পরিচিত হন এমএসএর তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট তালহা শাহবাজের সঙ্গে। পাকিস্তানের নাগরিক শাহবাজ তিন বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। সামিউর তাঁকে জানান, তিনি মাদকমুক্ত জীবন কাটাতে চান। তাঁর বিশ্বাস, ইসলামসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমেই এটা সম্ভব। এরপর তাঁরা নিজেদের মধ্যে ফোন নম্বর বিনিময় করেন।

সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে পরস্পরের বন্ধু হন। শাহবাজ অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন সামিউরকে। আসাদ দানদিয়া নামে তাঁর একজন বন্ধু বলেন, ‘সামিউর আমাদের বলতেন, ইসলাম তাঁর জীবনই পাল্টে দিয়েছে। ’ পুলিশের নির্দেশে সামিউর গোপনে তাঁর এমন বন্ধুদের পেছনেও গোয়েন্দাগিরি করতেন। তাঁরা কোথায় যান, কী করেন, তার ছবি তুলে রাখতেন গোপনে।

এরপর পুলিশের নির্দেশে জন জে কলেজে আরও কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন সামিউর। এর মধ্যে গত মে মাসে সিরাজ ওয়াহাজের বক্তৃতার অনুষ্ঠানও ছিল। ৬২ বছর বয়সী ওয়াহাজ নিউইয়র্কের বেশ পরিচিত একজন ইমাম। কয়েক বছর ধরেই পুলিশের নজরে আছেন ওয়াহাজ। ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলায় তিনি ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে জড়িত থাকতে পারেন বলে মনে করে পুলিশ।

যদিও এ ব্যাপারে কখনো তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়নি। সামিউর গোয়েন্দাগিরি করতেন এমএসএর ওপর। এ জন্য শাহবাজ ও তাঁর অন্য বন্ধুদের কাজে লাগাতেন। এপি নিউইয়র্ক পুলিশের নথিপত্র খতিয়ে দেখে জানতে পেরেছে, এমএসএর ওপর নজরদারির জন্য ২০০৮ সালে সংগঠনটির একটি অনুষ্ঠানে তিনজন চর পাঠিয়েছিল পুলিশ। সামিউর জানান, গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে তিনি কাউকে কোনো অপরাধ করতে দেখেননি।

মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেই কাউকে কাউকে কোনো একটি বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এটা করতেন এমন তথ্য বের করার জন্য, যা দেখে পুলিশ খুশি হবে, তাঁকে পছন্দ করবে। ‘আমি অর্থের জন্যই এটা করতাম। ’ বলেন সামিউর। পুলিশের পক্ষ থেকে সামিউরকে একদিন বলা হয়, ‘তোমাকে যাদের পেছনে লাগানো হয়েছে, তারা যে কোনো ভুল করছে, আমরা সেটা বলছি না।

কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হতে চাইছি। ’ সামিউর যেসব তথ্য পুলিশকে দিতেন, তা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে পরে আর কোনো আলোচনাও হতো না। গোয়েন্দাগিরির প্রয়োজনে অনেক দূরে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টাও ব্যয় করতেন সামিউর। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ব্রুকলিনের আল ফারুক মসজিদে গোয়েন্দাগিরি করতে যান তিনি। সেখানে ইমামের ছবি তোলেন।

এই মসজিদে ইসলামি বিধিবিধান সম্পর্কে নিয়মিত ক্লাস করেন, এমন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির তালিকা ও তাঁদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তা পুলিশকে দেন। একই দিন ব্রুকলিনের মসজিদ আল-আনসারে গিয়ে সেখানে হাজির হওয়া লোকজনের বিরুদ্ধেও গোয়েন্দাগিরি করেন। সামিউরের মুঠোফোনের বার্তা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ম্যানহাটনে গত মাসে ২৭তম বার্ষিক মুসলিম ডে প্যারেডে গিয়ে তিনি বেশ কিছু ছবি তোলেন। সামিউর জানান, তাঁর বন্ধুরা যখন নিঃস্বার্থভাবে দরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলোর জন্য খাবার দিতে যান, তখনো তাঁদের পেছনে তিনি গোয়েন্দাগিরি করেছেন। এসব করতে করতে একপর্যায়ে জানতে পারেন, তাঁর নিজের পেছনেই তথ্যদাতা লাগিয়েছে পুলিশ।

পুলিশকে তথ্য সরবরাহের জন্য সামিউর মাসে পেতেন এক হাজার ডলার। আর ওই তথ্যদাতা পুলিশের কাছ থেকে প্রতি মাসে সামিউরের চেয়ে ২০০ ডলার বেশি পেতেন। সামিউর জানান, একপর্যায়ে পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে আরও বেশি অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তা নিতে চাননি। এপিকে সামিউর জানান, তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে চান।

পাড়ি জমাতে চান ক্যারিবীয় অঞ্চলে। চলতি মাসের শুরুর দিকে সামিউর ফেসবুকে বন্ধুদের জানান, তিনি পুলিশের তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করতেন। এখন ছেড়ে দিয়েছেন। ২ অক্টোবর তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য খুব অল্প সময়ের জন্য আমি নিউইয়র্ক পুলিশের তথ্যদাতা ছিলাম। এখন মনে হয়, তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করা ঠিক হয়নি।

অর্থের জন্য মানুষকে ব্যবহার করেছি। এখন এটাকে ঘৃণা করি। আমি ভুল করেছি। ’  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.