আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কে এই মাওলানা !! কী তার পরিচয় - ২

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা গর্ভণর মুনায়েম খান তার অহংকার ও প্রবল ক্ষমতা সত্বেও এ নির্ভিক মাওলানাকে সমীহ করে চলতেন, চলতে বাধ্য হতেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় তিনি এ মাওলানার মেধা ও মেজাজ দেখে অবাক হয়েছিলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় মুনায়েম খান পাশ করতে পারেননি, আর এ মাওলানা তিন ঘন্টার পরিবর্তে এক ঘন্টা উত্তর লিখে লেটারমার্ক পেয়েছিলেন। তার এ ঘোর তখনও কাটেনি। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মুখের উপর যে মাওলানা ‘ধোঁকাবাজ’ বলে হনহন করে বেরিয়ে আসতে পারতেন, তার সাহস ও আত্মশক্তি দেখে অন্যরাও তটস্থ থাকতেন।

বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। দুর্গত লোকদেরকে সাহায্যের নামে মুনায়েম খান তার গভর্ণর হাউসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। দেশের নামকরা গায়ক গায়িকা ও নৃত্যশিল্পীদেরকে ডেকে পাঠালেন। ৫০০ ও ১০০০ হাজার টাকা মূল্যের টিকেট ছাড়া হল বিনোদনের বাজারে। গভর্ণর হাউসের সামনে সুবিশাল মাঠে প্যান্ডেল লাগিয়ে জাঁকজমক আয়োজন করা হল।

যথাসময়ে সব আয়োজন সুসম্পন্ন হল। অনুষ্ঠানের দিন দেশের সকল দৈনিকে গভর্ণরের পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন ছাপা হল। প্রথম পৃষ্ঠায় নজরকাড়া বিজ্ঞাপন। দুর্গতদের জন্য সাংস্কৃতিক আয়োজন। বিত্তশালী বিনোদনপ্রেমীরা এমন দুঃখজনক সময়েও নাচগানের আয়োজনে মত্ত হতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

তৎকালের আদমজী, ইস্পাহানী, বাওয়ানী গ্র“পসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এ আয়োজনের টিকেট পেতে হুমড়ী খেয়ে পড়ল। সকালের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে মাদরাসার অফিসে এসে বসলেন মাওলানা। পত্রপত্রিকা পড়া তার প্রতিদিনের রুটিন। দেশ বিদেশের চলমান নানা ইস্যু ও সংবাদ তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়েন। হালচাল বোঝার চেষ্টা করেন।

ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত মানুষগুলোর জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে আছেন। তবুও আজকের দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতায় এ বিজ্ঞাপন দেখে তার মুখ কালো হয়ে গেল। পাশে বসা লোকদেরকে দেখিয়ে বললেন, আল্ল¬াহর আযাব এ ঘূর্ণিঝড়। এমন দুঃসময়ে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আর গভর্ণর সাহেব এ কি করছেন? এমন দূর্গত বিপদের সময়ে নাচ-গানের আয়োজন! এতে আল্ল¬াহর সাথে আরও বেয়াদবী করা হচ্ছে না? তিনি তার সেই কামরায় ফিরে এলেন।

তার ছোট টেবিলটি সামনে নিয়ে বসলেন। কাগজ কলম হাতে নিলেন। গভর্ণরকে চিঠি লিখলেন। সাহায্যের নামে এ অনাচার তিনি যেন বন্ধ করেন, তাই সতর্ক করে উপদেশ দিলেন। একজন প্রকৃত আলেম হিসেবে শাসককে বোঝানোর যে গুরুদায়িত্ব তার কাঁধে, তিনি তা পালনের চেষ্টা করলেন।

চিঠিটি শেষ করে তিনি একজন ছাত্রকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, চিঠিটি পড়ে দেখ, কোন সংশোধন লাগলে করে নিয়ে আস। তরুণ ছাত্র কিছু শব্দের পরিবর্তন করে তার হাতে ফেরত দিলে তিনি খুশী হলেন। নিজের লেখায় স্বীয় ছাত্রের সংশোধন ক্ষমতা দেখে তার পিঠে হাত রেখে দুআ করলেন। যোহরের নামাজ শেষ।

মানুষজন মসজিদ থেকে বের হচ্ছে। যার যার কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছে সবাই। মাওলানা এক লোককে ডেকে বললেন, এ চিঠিটি নিয়ে যাও। গভর্ণরের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা কর। মাওলানার চিঠি পেয়ে গভর্ণর নড়েচড়ে বসলেন।

এ আয়োজন নিয়ে তার বোধোদয় হল। তিনি তখনই সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন। তারপর.. সেদিন বিকেলের আলো অন্ধকারে মিশে যাওয়ার আগেই রেডিও থেকে ভেসে আসছিল জরুরী ঘোষণা, ‘সবার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, গভর্ণর হাউসে আয়োজিত আজকের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক আয়োজন অনিবার্য কারণবশতঃ বাতিল করা হল। ’ রাজনীতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের নানা বিষয় নিয়ে টালবাহানা করছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। এ ইস্যুতে ক্ষোভ তৈরী হচ্ছিল বাংলার মানুষের মনে মনে।

মাওলানা শুধু এসব ধোঁকাবাজি নয়, ইসলাম নিয়েও পাক শাসকদের তামাশা দেখে ব্যথিত হচ্ছিলেন। তিনি তাদের সাথে সব রকমের সুসম্পর্কের ইতি টানছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীপরিষদের প্রভাবশালী সদস্যরা মাওলানার সাথে দেখা করে তার মনোভাব পরিবর্তন করাতে অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পদ ও পদবী এবং নগদ হাদিয়া তোহফার প্রলোভন তো আছেই, কিছুতেই তাকে নমনীয় করা যাচ্ছে না। ইসলাম এবং এ দেশের যে কোন অধিকার আদায়ে তিনি হুংকার ছেড়ে শাসকদের মসনদ কাঁপাতেন।

তৎকালের পুরো বাংলায় তার মতো এমন প্রভাবশালী অথচ নির্লোভ বিনয়ী মাওলানা আর একজনও ছিল না। তার আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রবল। ইসলামের নামে যে কোন ভন্ডামী তিনি প্রবল গর্জনে প্রতিরোধ করতেন। জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী প্রথম প্রথম এ মাওলানার কাছে আসতেন। তার সাথে সখ্য বজায় রাখতেন।

ধর্ম নিয়ে তার নিজস্ব উদ্ভট ব্যাখ্যা তখনও মাওলানার চোখে পড়েনি। যখন পড়েছে, তিনি তাকে সংশোধন করতে বলেছেন। এতেও যখন মওদুদী নিজের মতের উপর জোর করে থাকতে চাইল, মাওলানা তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। মুখের উপর তা জানিয়ে দিলেন। যথাসময়ে তা সবিস্তারে আসবে।

১৯১৫ সাল। বাঘুডিয়া হাইস্কুল। এ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে বেশ কয়েকজন ছাত্র পড়াশোনা করছে। হিন্দু-মুসলমান সবাই এখানকার ছাত্র। হেড মাস্টার একজন হিন্দু মশাই।

এ স্কুলের এত ছাত্রের মধ্যে হেডমাস্টারের চোখ সারাক্ষণ অনুসরণ করে একজন মুসলমান ছাত্রের দিকে। তার চালচলন, কথা বলার বিনয়, ভদ্রতা ও মেধাশক্তি দেখে তিনি বিস্মিত। তার সততায় এখানকার শিক্ষকরাও বিমুগ্ধ। এ বিস্ময় ও ভালোলাগা চেপে রাখতে না পেরে হেডমাস্টার একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেললেন সবার সামনে, এ বালকটিকে আমার এত বেশি বিশ্বাস ও আস্থার পাত্র মনে হয় যে, আমি নিশ্চিত, ওর হাতে পরীক্ষার আগের দিন সবগুলো প্রশ্নপত্র তুলে দিলে ও সেসব খুলেও দেখবে না। কাউকেও দেখাবে না।

এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। ’ হাইস্কুলের সব শিক্ষক ছাত্র এ সত্য মাথা নেড়ে সায় দিল, তার সততা ও ব্যবহারে তারাও আনন্দিত। সেবছরও এ বালক পুরো স্কুলে সবার চেয়ে বেশি নাম্বার পেয়ে প্রথমস্থান ধরে রেখেছিল। প্রথম পর্ব........ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।