আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তৌহিদী জনতার ক্রান্তিকালে সুন্নী ওলামা মাশায়েখকেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে, c-p

কিংকর্তব্যবিমূঢ়, সীমাহীন বেদনা ও যন্ত্রণায় অধীর, অস্থির বেকারার ইসলামী জনতার প্রত্যাশা ছিল, একান্ত কামনা ছিল জনসাধারণ্যে পরিচিত সুন্নী ওলামারাই নাস্তিক-ব্লগারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন, সক্রিয় হবেন সবার আগে। কারণ ইসলামের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিরুদ্ধে, প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে, উম্মুল মুমিনীনদের বিরুদ্ধে, নামাজ, রোজা, কোরবানী, ইবাদত বন্দেগী ইত্যাদির বিরুদ্ধে ওদের মত এমন সীমাহীন ঔদ্ধত্য, এমন ধৃষ্টতা, এমন বেয়াদবী আর কোন কাফির-মুশরিক, বেঈমান, মুরতাদ কোনকালেই দেখায়নি, এমন অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ জঘন্য ও বানোয়াট মন্তব্য আর কেউ করেনি। এমন নোংরা, কুৎসিত, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল ইতোপূর্বে আর কোন ইসলামের দুশমন এদের মত করেনি। পাঠ অযোগ্য, শ্রবণ অযোগ্য, অকল্পনীয় নাস্তিক-ব্লাগারদের ব্লগে লিখিত এসব কুৎসা মিথ্যাচারের বিবরণ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যখন ইসলামী জনতার নজরে আসলো তখন তারা শিউরে উঠলো, বেদনায় নীল হলো, ক্ষোভে অধীর হলো, ক্রোধে ফুঁসে উঠলো। এর বিরুদ্ধে কী করা দরকার, কী পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক, কোন কর্মসূচি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রয়োজন তা জানার জন্য, শোনার জন্য বেচাইন, বেকারার হয়ে তারা ওলামা-মাশায়েখদের মুখের দিকে তাকালো।

তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, লোক পাঠিয়ে, টেলিফোনে আলাপের মাধ্যমে কামনা করলো নির্দেশ। বিশেষ করে প্রখ্যাত সুন্নী আলেমদের কাছে। কারণ, হুব্বে রাসূল, ইশকে রাসূল, শানে রিসালাত-এর মাহফিল, সম্মেলন তারাই বেশি করেন। এই অতি প্রয়োজনীয় ঈমানী ওয়াজ নসিহত তারাই সবচেয়ে বেশি বয়ান করেন। তারাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেমে আত্মহারা হয়ে প্রয়োজনে জান-প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য জনগণকে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেন।

এতকাল ইসলামের মহব্বতে, নবীজীর প্রেমে জান-প্রাণ কোরবানী করার যে সবক তারা দিয়েছন এসবের বাস্তব প্রমাণের বা পরীক্ষার সুযোগ এখন উপস্থিত। এবার প্রমাণ দিতে হবে বাস্তবে। প্রমাণ দিতে হবে ময়দানে। যারা এতকাল এ কাজে উদ্বুদ্ধ করলেন, উৎসাহিত করলেন, অনুপ্রাণিত করলেন স্বাভাবিকভাবে সর্বাগ্রে দৃষ্টি যাবে তাদেরই দিকে। প্রত্যাশা ছিল তারাই এগিয়ে আসবেন সবার আগে।

ডাক দিবেন উদাত্ত কণ্ঠে। ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, প্রতিরোধ, প্রতিকারকামী ইসলামী জনতাকে করবেন কাফেলাবন্দি। এগিয়ে যাবেন এই উৎসর্গিতপ্রাণ কাফেলাভুক্ত জনতাকে নিয়ে এই চরম হঠকারিতা, সীমাহীন, ঔদ্ধত্য, এই জঘন্য মিথ্যাচার, আল্লাহর পেয়ারা হাবীবের শানে এই ঘৃণ্য অবমাননা ইসলামের বিরুদ্ধে এমন চরম আঘাতের মোকাবেলায় ঘোষণা করবেন কর্মসূচি। দাঁতভাঙা জবাব দেবেন এই চরম বেয়াদবীর। আর যেন কোন কুলাঙ্গার আল্লাহর হাবীবের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস না পায়, কোন কিছু লিখতে, বলতে, প্রচার করতে আর যেন না পারে তা নিশ্চিত না করে তাদের আন্দোলন থামবে না।

এ অভিষ্টে না পৌঁছা পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না তাঁরা। কিন্তু হায় যাদের প্রতি এমন আস্থা-বিশ্বাস, যারা এগিয়ে আসবেন সবার আগে কোথায় রইলেন তাঁরা? কেন তাঁরা এগিয়ে এলেন না সর্বাগ্রে? কিন্তু সময়তো আর বসে থাকে না। রইলোও না। ইসলামী জনতার শিরায় শিরায় বহমান আল্লাহর রাহে জানপ্রাণ উৎসর্গ করার যে দুর্ধমনীয় প্রেরণা। বিদ্যমান আল্লাহর প্রিয় হাবীবের জন্য নিজ প্রাণের চেয়েও অধিক মহব্বত।

তাদের মাঝে নেই কোন ফিরকায়ী সংকীর্ণতা। উপদলীয় কোন্দল। তারা প্রস্তুত-দ্বীনের এই দুর্দিনে শানে রিসালাতের এই চরম অবমাননার প্রতিবাদে, প্রতিকারে, প্রতিরোধে যিনিই ডাক দেবেন তার কাফেলায় শরীক হয়ে মনজিলে মকসুদে পৌঁছার। ঠিক এই চরম ক্রান্তিকালে ডাক দিলো প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ, উস্তাজুল আসাতিজা, প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, দেশের প্রাচীনতম কওমী মাদরাসা হাটহাজারী মঈনুল উলূমের মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলাম। সুন্নী নামে পরিচিত না হলেও যিনি তাঁর প্রায় শতবর্ষী জীবনটি সুন্নতের শিক্ষা প্রচার, সুন্নতের আমল ও সুন্নত জারি করার সাধনায়ই তিলে তিলে ব্যয় করেছেন।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইসলামী জনতা পেল পথের দিশা। তাদের নয়নে উদ্ভাসিত হলো নবআশার প্রোজ্জ্বল ভাস্কর। দেখা গেল, কবির কথায় সেই জাগে এক সাথে নবীন আশাতে লক্ষ সূর্য শঙ্কাহীন সত্যিই যেন জেগে উঠল। তাঁর উদাত্ত আহ্বানে কাফেলাবন্দি হলো ইসলামী জনতা। সত্যিই এ মহাজাগরণ অভূতপূর্ব।

এ উত্থান বিস্ময়কর! আমাদের সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসে এমন স্বতঃস্ফূর্ত ইসলামী জাগরণ, ইসলামী জনতার এমন বিস্ফোরণ এদেশে আর দেখা যায়নি। এদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন বহু হয়েছে। মিছিল, শোভাযাত্রা, সমাবেশ, মহাসমাবেশও কম হয়নি কিন্তু কোন রাজনৈতিক লক্ষ্যে নয়, কোন অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যে নয়, কাউকে ক্ষমতা থেকে হটানো বা ক্ষমতায় বসানোর জন্যও নয়, কেবলমাত্রা দ্বীনের জন্য, নিছক আল্লাহ-রাসূলের জন্য নির্দলীয় অরাজনৈতিক ওলামা-মাশয়েখের আহ্বানে এমন সাড়া, এমন মহাজাগরণ, এমন আন্দোলন সত্যিই নজির বিহীন। হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা করল ৬ এপ্রিল শনিবার ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মহাসমাবেশ হবে রাজধানীর শাপলা চত্বরে।

এর প্রতি সমর্থন জানালেন দেশের সব প্রখ্যাত পীর মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরাম। সমর্থন জানালেন, জমিয়াতে হিযবুল্লাহর আমীর ছারছীনার পীর সাহেব, সমর্থন জানালেন চরমোনাইর পীর সাহেব, ফুলতলী দরবার, সোনাকান্দা দরবার, মৌকরা দরবারসহ বাংলাদেশের মশহুর সব দরবার ও খানকার পীর মাশায়েখ। সমর্থন জানালেন, সব মতাদর্শের ওলামায়ে কেরাম। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত, খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমি পর্যন্ত নবী প্রেমিকদের কণ্ঠে নিনাদিত হলো তকবির ধ্বনি, ধ্বনিত হলো শানে রিসালাতের গগন-বিদারী আওয়াজ। আকাশ বাতাস মুখরিত হলো চলো চলো ঢাকা চলো শ্লোগানে।

ভেসে গেল সব উপদলীয় ও ফিরকায়ী সংকীর্ণতা। স্বয়ং আল্লাহ যেখানে আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে হামলার টার্গেট, ইসলাম, দ্বীন, শরীয়াহ যেখানে সংকটের মুখে সেখানে কিসের শাখা মাসয়ালার মতপার্থক্য? কিসের ফিরকাবন্দির সংকীর্ণতা? এসব তো শতাব্দী প্রাচীন প্রসঙ্গ। অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। আজকের দুঃসময়ে কোথায় দেওবন্দী, ব্রেলবী, কওমী, আলিয়ার প্রশ্ন? ওসবের চুলচেরা একাডেমিক বিশ্লেষণ হবে ‘শান্তির সময়ে’। এখনকার মত জরুরি সময়ে নয়।

এ সময়ে সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে শানে রিসালাত-হেফাজতের জন্য হতে হবে একাট্টা। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থাকতে হবে সীসাঢালা প্রাচীরের মত ঐক্যবদ্ধ, মজবুত। হ্যাঁ, এ উদারতা দেশের অধিকাংশ পীর মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরাম দেখাতে পেরেছেন। তাঁদের মুরীদ-মুতাকেদ, ভক্ত-অনুরক্তরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হয়েছেন। এই প্রতিবাদী, প্রতিরোধী কাফেলায়।

লংমার্চকারী ইসলামী জনতা রাজধানীর শাপলা চত্বরে রচনা করেছেন এ বিস্ময়কর ইতিহাস। এদেশে ঈমান ইসলাম সুরক্ষার বজ্র দৃঢ় প্রত্যয়ে দীপ্ত গণমনুষের বৃহত্তর এমন সমাবেশের আর কোন নজির নেই। ছারছীনার দরবারের প্রখ্যাত পীর হযরত মাওলানা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহ.) ইন্তেকাল পূর্ববর্তী সময়ে ডাক দিয়েছিলেন ‘কালেমাগো মুসলমান এক হও’ (অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পাঠকারী মুসলমান এক হও)। ডাক দিয়েছিলেন, ‘আল মুসলিমু মিল্লাতুন ওয়াহিদা’ (অর্থাৎ সব কাফির যেমন ইসলামের দুশমনিতে একাট্টা, তেমনি ইসলামের হেফাজতে বিশ্বের তামাম মুসলমানও হও ঐক্যবদ্ধ)। কিন্তু কী উপায়ে? মুসলমানদের মধ্যে তো মতপার্থক্য আছে।

বিভিন্ন দল-উপদল আছে। এ বাস্তব সত্য। এরকম মতপার্থক্য খ্রিস্টানদের মধ্যে আরো বেশি আছে, ইয়াহুদীদের মধ্যে আছে, হিন্দুদের মধ্যে আছে, আছে প্রায় সকল ধর্মের অনুসারী, অনুগামীদের মধ্যেই। তবু তারা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে এক হয়ে যায়। মুসলমানদেরও তেমনি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পন্থা কি? সে পথের দিশা দিলেন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ হযরত মাওলানা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী কায়েদ সাহেব হুযুর (রহ.)।

পেশ করলেন, আল ইত্তেহাদ মায়াল ইখতিলাফ। অর্থাৎ যার যে মত, তা যথাস্থানে বহাল রেখে, ইখতিলাফহীন মৌলিক বিষয়াবলী ও দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এটাই বাস্তব সম্মত পন্থা। ‘আহলে সুন্নাত’, ‘গায়বে আহলে সুন্নাত’, ওলামা-মাশায়েখ, ইসলামী চিন্তাবিদ নির্বিশেষে সবার সভায়, সবার সম্মেলনে, মাহফিলে, সবার কণ্ঠেই এ ডাক শোনা যায় যে, ‘এক হও মুসলমান’, ‘দুনিয়ার মুসলিম এক হও’। আর প্রয়োজনীয়তাও যে অধিক তা ব্যাখ্যা করার অবকাশ রাখে না।

ঐক্যবদ্ধ হতে হবে অরাজনৈতিকভাবে সার্বজনীন কতিপয় ইস্যুর ভিত্তিতে। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে হলেও যে দাবিসমূহ জানিয়ে আসছেন সবাই। সাম্প্রতিক সময়ে তেমন দাবিসমূহের মধ্যে রয়েছে সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, আল্লাহ রাসূলের অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে আইন পাস, এই অভিযোগে অভিযুক্ত নাস্তিক-ব্লগারদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা এবং দোষীদের বিচার নিশ্চিত করা, নারীনীতি থেকে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী অংশ বাদ দেয়া ইত্যাদি। ’ আর এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সবারই দাবি এক ও অভিন্ন। বলাবাহুল্য, ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বরের ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে ঘোষিত ১৩ দফার অধিকাংশ দফায়ই রয়েছে এমন সব অভিন্ন দাবি-দাওয়ার প্রতিফলন।

আহলে সুন্নাতের সম্মানিত আলেমদের মধ্যে যারা লেখালেখি করেন, যাদের নিবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যেই বিবৃত রয়েছে এর যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ। এই ১৩ দফার কোন দফাটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, কোনটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখ-তা ও সংহতি বিরোধী তা চিহ্নিত করে কোন প্রখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ কোন কিছু লিখেছেন বা বলেছেন বলে তো এ পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। অবশ্য যারা এদেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শাসন প্রবর্তিত হোক তা চান না, সর্বত্র সর্বক্ষেত্রে ইসলামী জীবনব্যবস্থা বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক তা যারা বরদাশত করতে পারেন না তাদের কথা আলাদা। সে যাই হোক, দেশব্যাপী যখন আল্লামা শাহ্ আহমাদ শফীর নেতৃত্বে, হেফাজতের আহ্বানে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হলো, লংমার্চের কার্যক্রম আরম্ভ হয়ে গেল এবং তার প্রতি দেশের প্রখ্যাত ওলামা মাশায়েখদের সমর্থন ঘোষিত হতে থাকল তখন অনেককে বলতে শোনা গেল ‘কতোই না ভাল হতো যদি আহলে সুন্নাতও শরীক হতো এর সাথে’। দ্বীনের এই নাজুক পরিস্থিতিতে যদি আহলে সুন্নাতের বিখ্যাত নেতৃবৃন্দ এবং হেফাজতের নেতৃবৃন্দ দাঁড়াতেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তবে বাংলাদেশে ঘটে যেতে পারত ইসলামী বিপ্লব।

চট্টগ্রাম ইসলামের প্রবেশদ্বার। সেখানে রয়েছেন উভয় গ্রুপের বিশ্ববিখ্যাত ওলামা মাশায়েখ। তারা এক কাতারে দাঁড়ালে ইসলামের মহাবিজয় ঠেকায় কে? সারাদেশের ইসলামী জনতা তখন শামিল হবে এই কাফেলায়। কিন্তু না। দিলি তামান্না দিলেই থেকে গেল।

পূরণ তো হলোই না, যা হলো তা কারোর অজানা নয়। ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল হেফাজতের ঐতিহাসিক লংমার্চ ও মহাসমাবেশ। এরপর যখন ২১ এপ্রিল চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে আহ্বান করা হল আহলে সুন্নাতের মহাসমাবেশ তখন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার প্রতি। যদিও সম্মেলন স্থল দেশের পূর্বদক্ষিণ সীমান্ত চট্টগ্রামে এবং উদ্যোক্তারা সে অঞ্চলের লোকদেরই একাট্টা করার উদ্যোগী হলেন। তবুও সমগ্র দেশের রাসূল প্রেমিক জনতা মুহতারাম ওলামা-মাশায়েখদের ভাষণ ও মহাসম্মেলনের ঘোষণা শোনার জন্য রইলেন উদগ্রীব ইন্তেজারে।

কিন্তু কী শুনলেন তারা? তাদের ভাষণ বক্তৃতা ও ঘোষণার প্রাধান্য পেলনা সময়ের মূলদাবি। ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদের, সৌহার্দ্য, শুভেচ্ছার স্থলে ঘৃণা বিদ্বেষের, সম্প্রীতির স্থলে সংঘাতের আহ্বানই প্রাধান্য লাভ করল বীর চট্টলার লাখ লাখ ইসলামী জনতার এই ঐতিহাসিক সুন্নী মহাসম্মেলনে। যারা চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে, বুক ভরা আশা নিয়ে উদগ্রীব ছিলেন এমন ভাষণ ও ঘোষণা শোনার জন্য যা হবে এই ক্রান্তিকালে ইসলামী উম্মার জন্য, হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত লোকদের জন্য আলোর মশাল, পথের দিশা, মুক্তির সনদ কিন্তু তারা হতাশ হলেন। অধিকাংশ বক্তৃতা ও ঘোষণা শুনে তারা ব্যথিত হলেন, আহত হলেন। মহাসমাবেশের মঞ্চ থেকে ঘোষণা কর হলো।

‘এটা হেফাজতে ইসলাম নয়, খেয়ানতে ইসলাম’। সরকারের নিকট দাবি জানানো হলো ‘হেফাজতে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণার’। হাজার-হাজার আলেমে দ্বীনের উস্তাদ, অগণিত উস্তাদের উস্তাদ, জীবন কেটেছে যার ইলমে শরীয়ত ও মারিফত শিক্ষা করে ও শিক্ষা দিয়ে, ক্বালাল্লাহু তায়ালা এবং ক্বালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে বলে অতিবাহিত করেছেন যিনি প্রায় একটি শতাব্দি, এশকে খোদা, এশকে রাসূল (সা.) যার জীবনে নীরব সাধনা। জিকির ও দরূদ যার গলার মালা, দ্বীনের এই চরম দুঃসময়ে বার্ধক্যের জড়তাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে এসেছেন যিনি কা-ারির ভূমিকায় পেয়ারা নবী (সা.)-এর অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে যিনি সৃষ্টি করেছেন এক মহাজাগরণ, সেই মহান বীর জাঁ-নেসারে রাসূল (সা.) আল্লামা শাহ আহমাদ শফীকে বলা হলো অমুসলমান। তাকে শামিল করা হলো নাস্তিক-ব্লগার, কাফির-মুরতাদদের শ্রেণীতে।

দাবি জানানো হলো তাঁর ফাঁসির। কওমী মাদরাসাকে আখ্যায়িত করা হলো জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে, এসব কওমী মাদরাসায় জাকাত, ফিতরা কোরবানীর চামড়া দেয়াসহ সকল সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করার জন্য জনগণের প্রতি জানানো হলো আহ্বান ইত্যাদি। এসব দেখে শুনে বিস্ময়ে হতবাক হলেন দেশের কোটি কোটি আল্লাহ ও রাসূল প্রেমিক মুসলমান। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই বিশাল আয়োজন এই মহাসম্মেলনটির মূল উদ্দেশ্য কি? এ দ্বারা শেষ পর্যন্ত কারা হলো লাভবান? এই সুন্নী মহাসম্মেলনের এবং চট্টগ্রাম এলাকার বাইরেও যে আছে কোটি কোটি মুসলমান, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে যে দেড়শ’ কোটির বেশি আল্লাহ-প্রেমিক, রাসূল (সা.) প্রেমিক তৌহিদী জনতা এসব বক্তব্য ও ঘোষণা তাদের মনে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বা হতে পারে তা কি একটু ভেবে দেখবেন আহলে সুন্নাতের ঐসকল পরম শ্রদ্ধেয় ওলামা মাশায়েখ হাজারাত? একথা সবাই বলছেন এবং এই মহাসম্মেলনেও কেউ কেউ বলেছেন, মুসলিম জাহান এখন চরম সংকটে, আমাদের দেশও অতিক্রম করছে ইতিহাসের এক কঠিন সময়, ক্রান্তিকাল। এ সময়ে চাই উম্মার বৃহত্তর ঐক্য।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটাই কি ঐক্যের পথ? অনৈক্যের, বিভেদের, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কী যে ভয়াবহ পরিণতি- তাতো সবার চোখের সামনেই দেদীপ্যমান। একটু তথ্য নিলেই জানা যাবে ইরাকে পশ্চিমাদের অবরোধ আগ্রাসনে যুদ্ধে, গৃহযুদ্ধে গত এক যুগে নিহত হয়েছে ১৭ লাখ মানুষ। অবরোধের কারণে ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে মারা গেছে ১২ লাখ শিশু। ১৯৩৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে নিহত হয়েছে ২০ লাখ মুসলমান, ১৯৯২ উত্তর সোমালিয়ায় নিহত হয়েছে ২২ লাখ। আফগানিস্তানে যে কত লাখ নিহত হয়েছে তার সঠিক শুমার করা সত্যিই দুষ্কর।

২০১১ উত্তর সময়ে লিবিয়ায়, সিরিয়ায় নিহত হয়েছে কম করে হলেও একলাখ করে মুসলমান। পাকিস্তানে রক্তের হোলি খেলা ও ধ্বংসলিলা তো সবার চোখের সামনে। চিন্তাবিদরা বলছেন, সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তির লক্ষ্যবস্তু এখন বাংলাদেশ। তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হলে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। ইসলাম দুশমনদের মোকাবেলায় দেশের ওলামা মাশয়েখদের সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে হতে হবে ঐক্যবদ্ধ।

সেটা রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়, করতে হবে অরাজনৈতিকভাবে, দ্বীনের ভিত্তিতে। এটা বাস্তব সত্য ইসলামের বিভিন্ন ফিকহী মাজহাব আছে, রুহানিয়তের শায়খ-মাশায়েখদের বিভিন্ন তরিকা, মাসলাক আছে, মুজতাহিদদের মধ্যে বিভিন্ন মতপার্থক্য আছে, ইসলামিক অর্থের, দর্শনের বিভিন্ন স্কুল আছে, আর এসব আছে বলেই ইসলাম হচ্ছে জগতের সব চেয়ে প্রগতিশীল ধর্ম। আর চিন্তার দর্শনের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ইসলামের মনীষীগণ, মাজহাবের ইমাম মুজতাহিদগণ ছিলেন পরস্পরের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। তাঁরা ইখতেলাফকে রহমাত হিসেবেই জ্ঞান করেছেন, মুখালাফাত বা পরস্পরে শত্রুতায় পরিণত করেননি। আর এজন্যই সবযুগে উদ্ভুত সব সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছে ইসলাম এবং পারবে কিয়ামত পর্যন্ত।

একে সংকুচিত করা, সংকীর্ণ করা চলবে না। ভুলে গেলে চলবে না, আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাতের মূল সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন খোদ আল্লাহর হাবীব, ছাহেবে শরীয়ত বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। স্ব-স্ব উদ্ভাবিত ও আবষ্কিৃত কোন সংজ্ঞা দ্বারা তাকে সীমিত করা যাবে না। আর সেই নব আবিষ্কৃত সংজ্ঞার মাপকাঠী দিয়ে মেপে কোন মুসলমানকে করা যাবে না আহলে সুন্নাতের আওতা থেকে খারিজ এবং সেই আলোকে কাউকে বলা যাবে না কাফির মুরতাদ ও ধর্মচ্যুত। আরো স্মরণ রাখা আবশ্যক, ইফরাত নয়, তাফরিক নয়, ইসলাম হচ্ছে মধ্যপন্থা সীরাতুল মুস্তাকীম।

আদর্শগত বা কর্মগত চরম প্রান্তিকতার পরিণাম দেশ জাতির জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। ইতিহাসে এর নজিরের অভাব নেই। উম্মাহর এই ভয়াবহ দুর্দিনে এই ক্রান্তিকালে এ ব্যাপারে সবাইকেই থাকতে হবে হুঁশিয়ার সাবধান। সেই সাথে নতুন আশার-মশালবাহী হেফাজতে নেতৃবৃন্দকেও সদা সতর্ক থাকতে হবে, কোনো রাজনীতি যেন প্রবেশ করতে না পারে এই আন্দোলনে। কাউকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য নয়।

ক্ষমতায় বসানোর জন্যও এ আন্দোলন নয়। তাদের ঘোষিত এই মূলনীতিতে তারা যেন থাকেন অটল, অবিচল। -রূহুল আমীন খান Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.