আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ভারত ভ্রমণ -৫ম পর্ব (( ইয়ে দিল্লী হ্যায় মেরে ইয়ার ))

চোখ কেড়েছে চোখ ,উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক...। ঘুরে আসতে পারেন---> কালের কপোলে শিশির বিন্দু, তাজমহল-আগ্রা আগ্রা ফোর্ট +ফতেপুর সিক্রি রূপবান রাজস্থান-জয়পুর রূপবান রাজস্থান-বিড়লা মন্দির,সিটি প্যালেস,জন্তর-মন্তর,অম্বর প্যালেস ২২শে সেপ্টেম্বর রাতে আমরা ট্রেনে উঠলাম ভারতের রাজধানী দিল্লী দেখতে যেতে । রেলের বাঙ্কে শোয়ার একটা মজা আছে । দুলুনিতে ঘুমটা খুব জম্পেশ হয় । জমিয়ে একটা ঘুম দিচ্ছিলাম সবাই ।

মনে হল মাত্র কয়েক মিনিট ঘুমাবার পরই কানের কাছে কেউ ড্রাম বাজানো শুরু করলো । অ্যাক্রোফোবিয়া থাকার কারণে,আমি সবসময় নীচের ব্যাঙ্কটাই নিতাম (এখানে ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার প্রিয় গ্যাং টার,আমাকে সবসময় এই সুবিধাটুকু দেয়ার জন্য ) । জানালাটা ছিল ঠিক আমার মাথার কাছে । তাই শব্দটা আমারই কানে বেশি বাজছিল । আধো ঘুম ,আধো জাগরণে বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হচ্ছে ।

কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছিল না । মনে হচ্ছিলো ,অনেক দূর থেকে কেউ চীৎকার করে বারবার এক কথাই বলছে --'' হ্যালো মেমসাব,উঠিয়ে । লাস্ট স্টপেজ আ গ্যায়া । '' একসময় চরম বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলাম । দেখলাম আমার বগীতে সবাই উঠে পরেছে ।

ঘুম ঘুম চোখে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা কি ! জানালায় দেখলাম লাল পাগড়ী পরা একজন ষ্টেশনের কুলী দাঁড়িয়ে । কিছুটা রেগেই (বোকার মত) বললাম লাস্ট স্টপেজ তাতে কি! আমরা তো দিল্লী যাবো । বেচারা কুলী উত্তর দিলো --''ইয়ে তো দিল্লীই হ্যায় !আপলোগ নিকালিয়ে ,নেহিতো ট্রেন ছোড় দেগা । '' এক ঝটকায় ঘুম টুম সব উড়ে গেল । ওপরের বাঙ্কগুলো থেকে লাফিয়ে নামলো এক এক জন ।

নাবিলা অন্য বগী থেকে দৌড়ে এসে বলল--''তোরা তারাতারি নাম । আমরা ছাড়া সবাই নেমে গেছে । '' কেমন করে যে শিকলে বাঁধা লাগেজ গুলো টেনে বের করলাম সীটের নীচ থেকে , আর কেমন করে যে নামলাম ট্রেন থেকে তা শুধু ঈশ্বর জানেন । প্ল্যাটফর্মে নেমে আমাদের গ্রুপের সবাইকে দেখে জানে যেন পানি এল ! আবার হাসিও পেয়ে গেল, সবার বোকা বোকা হয়ে যাওয়া মুখগুলো দেখে । উফফ...কি একটা স্মৃতি ।

ভাবলে এখনও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় । যাইহোক, আমরা উঠলাম হোটেল রামরাজে । ১৭ ঘন্টা জার্নি করে দিল্লি এসে মনে হলো দোজখে চলে এসেছি। তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রি ( অবশ্য বাতাসে আদ্রতা না থাকায় গায়ে ঘাম হয় না। )।

রাজধানী দিল্লী ভারতে ভ্রমণীয় স্থানসমূহের মধ্যে অন্যতম । ‘দিল্লী’ শব্দটি ''ধিল্লিকা'' থেকে এসেছে,যার অর্থ --মধ্যযুগের প্রথম শহুরে ব্যবস্থা। অনেকে বলেন, দিল্লীর দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত মেহরাউলি বা দেহালি থেকেই দিল্লি নামকরণ । এর অন্য একটি নাম হলো যোগিনীপুর । যা একজন মহিলা ধার্মিকার নামের সাথে যুক্ত যিনি একসময় এখানে বাস করতেন।

জায়গাটির প্রাচীন শহুরে অবস্থান সম্পর্কেও জানা যায় , যার নাম ছিল ইন্দ্রপ্রসাতা এবং এর অবস্থান ছিল যমুনার তীরে। ধারনা করা হয় ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতের রূপকথার বীর পান্ডব ভ্রাতাদের দ্বারা এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। ছোট শহর পুরান কিল্লার খননকাজের মাধ্যমে উঠে আসে দিল্লীর প্রাচীন শহুরে জীবনযাপনের কথা যার অস্তিত্ব ছিল খৃস্টপূর্ব তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে। বিশালায়তনের শহরটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে এক দিক পুরাতন অংশে অপর দিক নতুন অংশে পড়েছে। পুরাতন অংশ শহরের প্রাচীন অংশ ।

যেখানে একসময় ১২ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত মুসলিম শাসকদের রাজধানী ছিল। এখানে প্রাচীন পুরাতন দুর্গ, মসজিদ এবং বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ রয়েছে। নতুন দিল্লী শহরের নতুন অংশ যেটা বৃটিশরা প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছে। বৃটিশ শাসন একে একটি ভিন্ন অবয়ব দান করেছে । নতুন নতুন আধুনিক ভবন ও অবকাঠামো নির্মানের মাধ্যমে।

এইভাবেই দিল্লি সড়কপথে বা বিমানপথে ভ্রমণের একটা কেন্দ্রবিন্দু এবং ভারতের প্রবেশ দ্বারে পরিনত হয়েছে। তবে পুরো দিল্লীই বেশ দামি শহর । রাজধানি বলে কথা । বেশ আধুনিক বড় বড় সব যানযট মুক্ত রাস্তাঘাট । ট্রাম,বাস,ক্যাব,প্রাইভেট কার আর বাইকে জমজমাট ।

শক্তিশালী বাস সার্ভিস আর অতি আধুনিক রেল। বেশ খোলামেলা পরিবেশ। রাজস্থানের মত দিল্লীতেও প্রথম দিন কাটল নিজেদের মত ঘুরে ফিরে আর শপিং করে । সাথে দিল্লীর মজাদার সব খাবার তো আছেই । এ দুটোর জন্যই নামকরা জায়গা হোল দিল্লীর চাঁদনি চক বাজার।

বলুন তো কোন খাবারটার নাম আগে মাথায় আসছে? ''দিল্লীকা লাড্ডু '' তো ! আমরাও প্রথমেই এটা খুঁজে বের করেছিলাম । এখানে বলে রাখি আমরা কিন্তু বেশিরভাগ খাবারই টেস্ট করেছি রাস্তার পাশে টঙের মত দোকান থেকে। তবে সেগুলো বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন । দামেও সস্তা । রাস্তার পাশে দোকান হলে কি হবে,সারি দেয়া নানান লোভনীয় খাবারের কিন্তু কমতি নেই দিল্লি তথা উত্তর ভারতের মিষ্টি তৈরির মূল উপাদানই হল খোয়া আর ক্ষীর।

ছানা দিয়ে এখানে অতি সামান্যই মিষ্টি তৈরি হয় আর বানানোর গুণে তার স্বাদও বাংলার মিষ্টির থেকে অনেকটাই আলাদা হয়। এখানে অনেক দোকানে "বঙ্গালি মিঠাই' নামক এক বা একাধিক ধরণের মিষ্টি বিক্রি হয়, কিন্তু দূর দূর তক আমাদের কোনও মিষ্টির সাথে তার মিল নেই। ''দিল্লীকা লাড্ডু '' খেয়ে তো আসলেই পস্তালাম । একটুও মজা না। তবে কষ্ট ভুলে গেলাম,''রাবড়ি'' আর ''জিলেবি'' খেয়ে।

জিলাপি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আর রাবড়ি হল দুধ অনেকক্ষণ জ্বাল দিয়ে চাপ চাপ সর দিয়ে বানানো মিষ্টান্ন । সাথে বাদাম ,কিশমিশ আর বরফ কুঁচি । অসাধারণ স্বাদ ! ( রাবড়ি ) ''গোলগাপ্পা'' খাবার অনেক শখ ছিল । সিনেমাতে দেখি নায়ক নায়িকা মজা কি মজা করে গপাগপ খায় !আমাদের ফুচকার মত একটা খাবার।

মশলা দেয়া সবুজ রঙের টক পানিতে ডুবিয়ে একটা একটা করে খেতে হয় । স্বাদ মোটেই বাঙালি ফুচকার কাছাকাছি না। গোলগাপ্পাকে ''গোলগাপ্পা'' ভেবেই খাওয়া ভালো, ফুচকার সাথে চেহারার মিল ছাড়া আর কোনও মিল নেই। বাংলাদেশী ফুচকার কোন তুলনাই নাই । শিমের বিচি দিয়ে রান্না করা নতুন খাবার রাজমা চালের খিচুড়িও খেয়েছিলাম ।

স্বাদ-গন্ধহীন রাজমা দিল্লিবাসির সাধারণ খাবার। রাজমা খিচুড়ি দিল্লীতে শপিং কিন্তু বেশ ব্যায়বহুল। নজর কাড়া সুন্দর সুন্দর সব শাড়ি কিন্তু দামটা বেশী । তবে একটু ঘুরলে মনের মত দামেও জিনিস পাওয়া যায়। কিছুতেই অবশ্য দোকানদারদের বুঝতে দেয়া যাবে না,আপনি টুরিস্ট।

চাঁদনী চক তো আছেই,পালিকা বাজারও আদর্শ কেনাকাটার জন্য । তবে আমার মতে রাজস্থান ও কোলকাতা,ভারতে শপিঙের জন্য বেস্ট। *** বাহাই টেম্পল *** কোন সাইট সিয়িং এর প্ল্যান না থাকলেও হঠাৎ করেই শেষ বিকেলে গেলাম লোটাস টেম্পল তথা পদ্ম মন্দির। কৃত্রিম লেকের মাঝে তৈরি মন্দিরের আকৃতি পদ্মফুলের মতো বলেই এমন নামকরণ । ( পদ্ম মন্দির ) (এই কৃত্রিম লেকের মাঝেই উঁচু বেদীতে বানানো হয়েছে মন্দিরটি ) এই মন্দিরে প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় লেগে থাকে।

তবুও শৃঙ্খলা একটুকুও নষ্ট হয়না । মন্দিরে প্রবেশের আগে বাইরে জুতা রাখার ব্যবস্থা আছে । বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী স্বেচ্ছাসেবকেরা মন্দির সম্পর্কে কিছু কথা বলে,নিয়ম কানুন জানিয়ে পথ প্রর্দশনে সাহায্য করেন। বাহাই সম্প্রদায়ের এই আরাধনা ঘরটির অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলী আকর্ষণীয় এবং মার্বেল পাথরের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। লোটাস মন্দিরের ভেতরের অংশে আছে প্রার্থনা ঘর।

সেখানে শুধু সারি সারি পাথরের টানা বেঞ্চ । নামে মন্দির হলেও কিন্তু এর ভেতরে কোন বিগ্রহ নেই আদৌ,এটি মূলত সর্বধর্মীয় প্রার্থনালয়। (শেষ বিকেলে পদ্ম ফুলে মৌমাছি না, নীড়ে ফেরা পাখিদের ভীড় ! ) সকল ধর্মের মানুষ ঢুকতে পারে । যার যেভাবে ইচ্ছা সেখানে প্রার্থনা করতে পারে, কোন বাধা ধরা নিয়ম নেই। সব ধর্মের মানুষ এখানে একসাথে বসে নিজের নিজের প্রার্থনা করে ।

দারুণ অসাম্প্রদায়িক একটা পরিবেশ ! আইডিয়াটা খুব ভালো লাগলো । কোনরকম শব্দ করা নিষেধ বলে পিনপতন নিরবতা থাকে সবসময় এখানে । আমরা সবাই পাশাপাশি বসে নিজ নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা করলাম। অদ্ভুত শান্তিতে মন ভরে গেল । সন্ধ্যাবেলা ফ্লাডলাইটের আলোতে লোটাস মন্দিরের সৌন্দর্য অনেক বৃদ্ধি পায়।

হোটেলে ফিরে রাতের খাওয়াটা কিন্তু বেশ জম্পেশ হল । পাশের এক কাবাব হাউসে পনীর টিক্কা,তান্দুরি চিকেন,মাছের কাবাব,বটি কাবাব,বাটার নান আর তিন রকমের চাটনি দিয়ে ভুরিভোজ ! পনীর টিক্কা শিক কাবাব তান্দুরি চিকেন এর পরে আবার বাদাম দেয়া লাচ্ছি । শুধু কাবাবগুলোর জন্যই মনে হয় দিল্লীকে ভুলতে পারবোনা কখনও । *** কিছু খাবারের ছবি নেট থেকে নেয়া *** ।


আরো পড়ুন


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.