আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চকবাজারের নাইটগার্ড (উপন্যাস- ১ম পর্ব)

খবরে ধান্দাবাজি মিন্নত আলির পোলা দরকার পঞ্চাশ বছর পর নাইটগার্ড মিন্নত আলি ভাবল, তার পোলা দরকার। তার মাথায় চিন্তা ঢুকছে, মরে গেলে এই দুনিয়ায় কেউ থাকবে না। এটা হতে পারে না। নিরক্ষর হলেও সে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে গেল। বিয়ে না করে সে একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।

বউয়ের প্রয়োজন মনে করে নাই। নাইটডিউটি করায় এলাকার তাবৎ বেশ্যার সাথে তার সেক্স হয়েছে। এই শেষ কালে এসে তার পোলার সখ হল। সখ হলেই তো হবে না। পোলার জন্য তো আগে নিজের একটা বউ দরকার।

সে মনে করল, বিয়ে করা ছাড়া তার আর কোনো পথ খোলা নাই। কিন্তু মনে করলেই তো বিয়ে করা যায় না। বিয়ে করতে গেলে মেয়ে লাগে। জীবনের শেষ বেলায় এসে সে মেয়ে পাবে কোথায়? কে তাকে মেয়ে দেবে? কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করবে? নাইটডিউটি শেষে ভোরবেলায় সে বাড়িতে এসে ঘুমাতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।

এসব চিন্তা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কীভাবে বিয়ে করা যায়? মিন্নত আলি ভেবে পায় না কিছু। অতীত জীবনটা যেন আজ মিন্নতের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। আর মাঝেমধ্যে দাঁত বের করে ভেঙচি কাটছে সেই আনাড়ী বেশ্যার মতো। মিন্নত নিজেই নিজের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সে কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার মধ্যে প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করছে। সে তো আগে কখনো মৃত্যুর কথা ভাবে নাই। জীবনে বড় কোনো আঘাতও পায় নাই। অনেক আগে একবার ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়েছিল।

কিন্তু বয়স এতো কম ছিল যে মৃত্যুর কথা মাথায়ই আসেনি। চুলে কবে পাক ধরেছে, তা সে বলতেও পারবে না। ভাঙা আয়নায় অন্ধকার ঘরে পাকা চুল ভাল বোঝা যায় না। সব চুলই যে পেকেছে তা নয়। বলা যায়, কাচাকাচা-পাকা চুল।

কিন্তু বেশ কয়েকদিন হল সে টের পাচ্ছে তার শক্তি কমে গেছে। আগের মতো পরিশ্রম করতে ভাল লাগে না। আগে যে কোনো ব্যাপারে কৌতূহল কাজ করতো। এখন আর তা হয় না। সহজেই আজকাল সে অনেক কিছু ভুলে যায়।

কোন কোন দোকানদার টাকা দেয়। তা পরের মাসে সে মনে করতে পারে না। এনিয়ে দোকানদাররা তাকে নানান কথা শোনায়। কোনো হিসাবই মনে থাকে না। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে সে কখনো ভাবেনি।

সেদিন একটা দাঁত তার এসব ঘটনার শেষ পেরেকটা ঠুকে দিল। কী কুক্ষণেই না সে বাজার সমিতির সভাপতির মেয়ের বিয়ের বউভাত খেতে গিয়েছিল। খাসীর একটা হাড় পড়েছিল তার পাতে। সেটা খেতে গিয়েই বিপত্তিটা শুরু। যেইনা হাড়ে কামড় বসিয়েছে, অমনি মাড়ি দাঁতে পেল ব্যথা।

ব্যস, সেই যে ব্যথা শুরু হলো। তা কিছুতেই কমে না। সাতদিন টানা ব্যথার পর দাঁতটা পড়ে গেল। পড়ে যাওয়া দাঁতটা তাকে জানান দিয়ে গেল যে, তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আর নয়।

এখন বিদায় নেওয়ার পালা। অনেক দিন আগে নানার মুখে শোনা একটা গান আজ তার বারবার মনে পড়ল, ‘সময় গেলে সাধন হবে না/ দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না/ তুমি কেন জানলে না/ সময় গেলে সাধন হবে না। ’ তখন সে গানটা ভাল করে বোঝে নাই। আজ এই এতো বছর পরে এসে গানটার মর্মার্থ সে হাড়ে হাড়ে টের পেল। এই গানটাই তাকে বলে দিল, যা করার এখনই করতে হবে।

বিয়ের কথা ভেবে তার বারবার সুন্দরীর কথা মনে পড়ল। জীবনের শুরুতে সুন্দরীকে বিয়ে না করে সে কী ভুলটাই না করেছে! সেদিন যদি সে সুন্দরীকে বিয়ে করতো, তাহলে কি আজ তার এ করুণ পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়! সুন্দরী তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। কেবল নামে না, দেখতেও সে বেশ সুন্দরী ছিল। লোকজন তাকে ওই নামেই ডাকত। তার আসল নাম ছিল তহুরা।

কিন্তু সুন্দরী নামের আড়ালে তার আসল নামটা হারিয়ে গেছে। মিন্নত তখন ইসলামবাগে থাকতো। ফুটপাতে ঘুমাতো। তার পেশা ছিল কাগজ কেনা। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে শুরু হত কাগজ কেনা।

এ মহল্লা থেকে ও মহল্লা, এ গলি থেকে ও গলি ঘুরে বেড়াত। সদরঘাট, ইংলিশ রোড, গুলিস্তান, নাজিমউদ্দিন রোড, উর্দু রোড, চকবাজার, লালবাগ, নবাবগঞ্জ, আজিমপুর, হাজারিবাগ, কাঁটাবন, নীলক্ষেত, ক্যাম্পাস এলাকা, পলাশী, বকসিবাজার, ইসলামবাগ- মাসের তারিখ হিসাব করে এইসব এলাকা সে ঘুরতো। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ডুরি আঙ্গুল লেনের এক কাজের বুয়ার সাথে তার প্রেম হয়েছিল। বুয়া তাকে প্রথম দিনই চোখ মেরেছিল। মিন্নত তো দেখে অবাক।

তখন মিন্নতের বয়স একেবারেই কম। সবে দাঁড়ি-গোঁফ গজানো শুরু হয়েছে। চোখের ইশারা পেয়েই মিন্নত বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। অনেক কথা বললো মেয়েটা। তার বাড়ী বরিশাল।

সাহেব ও ম্যাডাম বরিশালেরই লোক। একই গ্রামে বাড়ি। দুইজনেই চাকরি করে। কোনো সন্তান নাই। একই গ্রামের মানুষ বলে তাকে বিশ্বাস করে কাজের জন্য এনেছে।

এভাবে বেশ কয়েকদিন কথা হল। মেয়েটির বয়স একেবারেই কম। দেখতেও মন্দ না। কয়েকদিন এভাবে চলার পর মিন্নত একদিন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিল। মেয়েটার হাত ধরে সে যখন কথা বলছিল, তখন মেয়েটি কেবল হাসছিল।

যাহোক মেয়েটি রাজি হয়ে গেল। কথা বলতে বলতে একদিন মেয়েটিকে চুমু দিল মিন্নত। মেয়েটাতো সহজে চুমু দিতে দেয়নি। অনেক কথা বলতে হয়েছে তাকে। প্রথম প্রেমের প্রথম চুমু।

সে কী আবেগ! সে কী অনুভূতি! ভালোবাসার কথা বলতে বলতে হুট করে চুমু দেওয়া। অনেকটা জোড় করে। চুমু দেওয়ার পর মেয়েটা কান্না শুরু করে দিল। সেদিন সে মাফ চেয়ে তারপর বিদায় নিল। এরপর কয়েকদিন মেয়েটা তেমন কথা বলেনি।

কিছুদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। মিন্নত আবার তাকে চুমু দিলো। এবার মেয়েটি তেমন বাঁধা দিল না। এভাবে চুমু দিয়ে শুরু। বেশ ভালই চলছিল।

কিন্তু শুধু চুমুতে একসময় সাধ মিটত না। শুরু হল জড়িয়ে ধরা। পোষাক খুলে ফেলা। আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা। মেয়েটা তো প্রথম প্রথম কাঁদতো।

এসবের বাইরে কিছু করতে গেলেই বাধা। কিন্তু এতেও একসময় বিরক্তি এসে গেল। এদিকে সুন্দরী কিছুতেই সালোয়ার-কামিজ খোলে না। ধরতে গেলেই বাঁধা দেয়। তার এককথা, ‘আগে বিয়া, তারপর যা ইচ্ছা কইরো।

বিয়ার আগে কুনু কাম অইবো না। ’ মিন্নত সারা দিন কাজ করে যা পায় তা দিয়ে তার তিন বেলা কোনোমতে খাবার জোটে। সে বিয়ে করলে বউ খাবে কী? তাছাড়া সে তো থাকে ফুটপাতে। এই অবস্থায় বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। তারপরও বিয়ের প্রতিশ্র“তি দিয়ে সে জোড় করে প্রথম দিন সেক্স করলো।

এভাবে ধীরে ধীরে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হল। সুন্দরীও একসময় উপভোগ করা শুরু করল। আগের মতো বাধা দিতো না। এদিকে মিন্নতের কাগজ কেনা কমে গেছে বলে মহাজন গালাগালি শুরু করলেন। সপ্তাহে দুই বারের বেশি আর যাওয়া যেত না।

সুন্দরী খুব মন খারাপ করে থাকতো। বলতো, ‘তোমাক না দেখলি আমার ভাল্লাগে না। চল আমরা বিয়া করি। ’ কিন্তু মিন্নতের তো ঘর নাই। বউ নিয়ে থাকবে কোথায়? এভাবে সেক্স করতে গিয়ে একবার বিপত্তি দেখা দিল।

সেবার মিন্নত প্রায় মাস খানেক পরে গেছে। সুন্দরীর তখন মাসিক হওয়ার কথা। প্রতিমাসের শেষের দিকে তার মাসিক হয়। সুন্দরী এসব বুঝতো না। মিন্নতই হিসাব রাখতো।

কিন্তু সুন্দরী জানাল, তার এখনও শুরু হয় নাই। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরও শুরু হচ্ছে না শুনে মিন্নতের তো চোখ ছানাবড়া! বলে কী মেয়েটা! সে সুন্দরীকে বললো, ‘পেটে যদি বাচ্চা অয়, তাইলে মাইয়াগো মাসিক বন্ধ অয়। ’ এ কথা শুনে সুন্দরীর মুখ শুকিয়ে গেল। মুহূর্তে তার চোখে পানি চলে এল। তারপর শুরু হল কান্না।

তাকে কোনো মতেই থামান যায় না। শেষে তারা সিদ্ধান্ত নিল, এই মাসেই তারা বিয়ে করবে। মিন্নতের হাতে কিছু টাকা জমলেই বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করা হবে। সেদিনের মতো মিন্নত বিদায় নিল। রাতে ইসলামবাগে পরিচিত এক ওষুধের দোকানদারকে মিন্নত মাসিক বন্ধ হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলো।

সে বললো, ‘মাসিক বন্ধ অইলে কী করতে অয়?’ দোকানদাররা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো, ‘কয় দিন হল বন্ধ?’ ‘এই ধরেন যহন শুরু অওয়ার কতা শুরু অয়নাই। ’ ‘কয় দিন হইছে?’ ‘২৫ তারিক অওয়ার কতা। কিন্তু আইজ ২৭ তারিক। আইজও শুরু অয় নাই। ’ ‘আরো কয়েকদিন যাক।

শরিল দুর্বল থাকলি এক-দুই সপ্তা কম-বেশি হইবার পারে। ’ ‘তারপরও যদি না অয়?’ ‘তাইলে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাইতে হইবো। ’ ‘ভাই, বাচ্চা যদি অয়, তহন কী করন যায়? ধরেন, বাচ্চা নষ্ট করতে চাইলি কী করন যায়?’ ‘তা, শুরুর দিকে হইলে কম টাকা লাগে। আমার পরিচিত ক্লিনিক আছে। কমেই করাইয়া দিমুনি।

চিন্তা কইরো না। ধরো, ২-৩ হাজার টাকা। ’ পরের দিন মিন্নত গেল সুন্দরীর কাছে। সুন্দরীর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। সারা রাত ঘুমায় নাই।

খালি কান্না করে। তার নাকি মাথা ঝিমঝিম করে। বমি বমি লাগে। কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করে না। মিন্নতকে জড়িয়ে ধরে সে অনেকক্ষণ কাঁদল।

মিন্নত বললো, ‘চল ডাক্তারের কাছে যাই। ’ কিন্তু সুন্দরী কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যাবে না। তার কথা, ‘ডাক্তারের কাছে যাইয়া কী অইবো? ডাক্তার কি-না-কি জিগাইবো? ডাক্তাররেই আমি কি কমু?’ এইসব ভেবে সে কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যাবে না। কয়েক দিন মিন্নত ওই বাড়িতে যায় নাই। মিন্নত যেন কিছ্টুা আড়াল করতে চাইছে ঘটনাটা।

সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, সে কী করবে বা তার কী করা উচিত। ৬-৭ দিন পর গিয়ে দেখে সুন্দরী শুকিয়ে গেছে। ঠিকমতো গোসল করে না, খায় না। সাহেব-ম্যাডাম তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, যায় নাই। শরীর মাঝেমধ্যেই অস্থির হয়ে আসে।

একবার হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। পায়ে ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু কাউকে এ কথা বলে নি। সুন্দরী মিন্নতকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘শোন, আমি একটা স্বপ্ন দেকছি। দেখি, আমাদের একটা বাবু অইছে।

কী যে সুন্দর দেকতে! আমি কোলে কইরা বইসা আছি। সে আমার দিকে তাকায়া আছে। ’ এই স্বপ্ন দেখার পর সে আর ঘুমাতে পারেনি। সারা রাত কাঁদছে। সে বললো, ‘শোনো আমরা বিয়া করুম কবে? সত্যি আমার প্যাটে বাবু অইছে।

আমার প্যাটের মদ্যে কেবা কেবা লাগে। আমি তোমাক ছাড়া বাচুম না। ’ কিন্তু মিন্নত কয়েকদিন ঘুরেও টাকার কোনো ব্যবস্থা করতে পারলো না। এই কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় কাগজের ব্যবসা মন্দা। বৃষ্টি হলে লোকজন কাগজ বেচতে চায় না।

ভিজে যাওয়ার ভয়ে কাগজও কেনা যায় না। সব এলাকায় যাওয়া যায় না। কাগজ কেনার আসল মন্ত্র হল, যত অলি-গলি, যত মহল্লা ঘোরা যায়, ততো কাগজ। কিন্তু বৃষ্টি হলে বেশি জায়গায় যাওয়া যায় না। এদিকে এসব ভাবতে ভাবতে মিন্নতেরও ঠিকমতো ঘুম হয় না।

কেবল সুন্দরীর কথা মনে হয়। মেয়েটা তার জন্য কী কষ্টটাই না করছে। কিন্তু মিন্নতের তো সামর্থ্য নাই। তার যে টাকার অভাব। এই জগতে টাকা ছাড়া কিছুই করা যায় না।

ভালবাসতে গেলেও টাকা লাগে। প্রিয়জনের জন্য কিছু কিনতে হয়। টাকা নামের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটার সবচেয়ে বেশি অভাব মিন্নতের। তিন দিন পর মিন্নত যখন আবার গেছে, সুন্দরী তেমন কথা কয় না। মিন্নত জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছো?’ ‘ভাল।

তুমি এতো দিন আসো নাই ক্যান?’ ‘কামে ছিলাম। ’ ‘এহন কী কাম শ্যাষ অইলো?’ ‘হ, শ্যাষ অইছে। ’ ‘তোমার খবর কী?’ ‘কীসের খবর?’ ‘বিয়া করবা কবে?’ ‘ট্যাহা-পয়সা জমলেই বিয়াটা কইরা ফালামু। তা তোমার খবর কী?’ ‘কীসের খবর?’ ‘ওইটা কী শুরু হইছে?’ ‘কোনটা?’ ‘মাসিক। ’ ‘ক্যান, তা তোমাক কমু ক্যান?’ ‘কওনা’ ‘মাইয়া মাইনষের বেবাক কতা পুরুষ মানুষকে কইতে নাই।

’ ‘পিলিজ, কও না’ ‘কমুনা’ ‘দ্যাহো, না কইলে কিন্তু আমি রাগ করুম। ’ ‘হ, তুমি তো রাগ কইরাই খালাস। ’ ‘তে, কওনা ক্যা?’ ‘কমু ক্যা?’ ‘সুন্দরী, আমার লক্ষ্মীসোনা, কওনা। আমি তোমারে নিয়া চিন্তায় আছি। রাইতে ঠিকমতো ঘুমাইবার পারি না।

তুমি বোঝনা?’ এইবার হাসতে হাসতে সুন্দরী কইলো, ‘হ, শুরু অইছে। ’ ‘কও কী! কবে থিকা!’ ‘কইছিনা, মাইয়া মাইনষের সব কতা কইতে নাই। ’ আনন্দের আতিশয্যে মিন্নত সুন্দরীকে কোলে নিয়ে ঘরের মধ্যে একটা চক্কর মারল। তারপর বছর খানেক মিন্নতের সাথে সুন্দরীর সম্পর্ক ছিল। মাঝেমধ্যেই সুন্দরী মিন্নতকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতো।

তার ওই এককথা, ‘আমরা বিয়া করুম কবে? আমাদের একটা বাবু অইবো!’ মিন্নত যা করে, তাতে তার কোনো মতে তিন বেলা খাওয়া চলে। মাঝেমধ্যে দুই-এক বেলা না খেয়েও থাকতে হয়। মিন্নতের টাকা জমানো হয়ে ওঠে না। বিয়েও করা হয় না। হঠাৎ একদিন ওই বাসায় থাকা অবস্থায় সাহেব-ম্যাডাম চলে এল।

ওই সময় তাদের আসার কথা না। একেই বলে, চোরের দশদিন আর গেরস্থের একদিন। মিন্নতকে দেখে তারা চোর মনে করেছিলেন। কিন্তু সুন্দরীর কথা শুনে তারা অবাক। মিন্নতকে তারা অনেকক্ষণ আটকে রেখেছিলেন।

অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কী করে, কোথায় থাকে, দেশের বাড়ির ঠিকানা, দেশে কেউ আছে কিনা, ঢাকায় কেউ আছে কিনা, সুন্দরীর সঙ্গে সম্পর্ক কতদিনের এইসব। পুলিশেও দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সুন্দরী কান্নাকাটি করায় পুলিশে দেয় নাই। মিন্নতের কাছ থেকে সব কথা শুনেছিলেন তারা।

সুন্দরীর সে কি কান্না। ওরকম কান্না মিন্নত আর কখনও দেখে নি। মিন্নতকে তারা বাসা থেকে বের করে দেওয়ার সময় বলে দিলেন, ‘জীবনেও আর এই বাসায় আসবি না। আইলে পুলিশে ধরাইয়া দিমু। ’ তবে মিন্নত মাসখানেক পর চুপিচুপি গিয়েছিল।

দেখে বাসার বাইরে তালা ঝুলছে। পাশের বাসার কাজের বুয়াকে সুন্দরীর কথা জিজ্ঞেস করলে সে বললো, ‘সুন্দরী গেরামে চইলা গ্যাছে। ’ এ কথা শোনার পর মিন্নতের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেদিন সে আর কোনো কাজ করতে পারলো না। কাগজ কেনার জন্য বের হলেও এক সের কাগজও কিনতে পারে নি।

সারা দিন নবাবগঞ্জ পার্কে বসেছিল। সেদিন মিন্নতের খুব কষ্ট হয়েছিল। সে সারা রাত ঘুমাতে পারে নাই। বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথা পাচ্ছিল। এই প্রথম তার উপলব্ধি হল, সে সুন্দরীকে প্রচণ্ড ভালবাসে।

কিন্তু এটা সে আগে বুঝতে পারে নাই। সেদিন অনেক বিড়ি খেয়েছিল। কোনো পথ না পেয়ে সে বারবার কেঁদেছে। বুকেও তার ব্যথা হতো। শেষে সাত-আট দিন পর গলির এক বেশ্যার সাথে সেক্স করে তার বুকের ব্যথাটা লাঘব করেছে।

তারপর আর কোনোদিন সে ডুরি আঙ্গুল লেনের ওই গলিতে ঢোকে নাই। এই এতদিন পর এসে তার মনে হল, সে যাবে ডুরি আঙ্গুল লেনে। যদি সুন্দরীকে পাওয়া যায়! সুন্দরীকে না পাক অন্তত সেই বাড়িটা একবার দেখে আসবে। সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দরীর কাছে সে কর জোড়ে ক্ষমা চাইবে। সুন্দরীর কাছে তো ক্ষমা চাওয়ার আর সুযোগ নেই।

সুন্দরী এতো দিন বেঁচে আছে কিনা মরে গেছে, তা মিন্নতের জানার কথা নয়। মিন্নত ভাবল, সুন্দরীর অভিশাপ লেগেছে তার জীবনে। সে ইচ্ছে করলেই এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে না। মিন্নত তখন যদি বিয়েটা করতো! এতদিনে তার বউ থাকত, পোলা-মাইয়া থাকত। একটা ঘর থাকতো।

সময় গেলে অনেক কিছুই ভুল মনে হয়। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েও মিন্নত আলি ভুল-শুদ্ধ ঠাহর করতে শেখে নাই। এসব ভাবতে ভাবতে মিন্নত আলি একসময় ঘুমিয়ে গেল। মিন্নত আলি কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল তা সে বলতে পারবে না। তবে আজানের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল।

ইসলামবাগে তিন তলা বিল্ডিংয়ে সিঁড়ির নিচের রুমে সে থাকে। বলা যায় এখানেও সে গার্ডের কাজ করে। মালিকের নানা রকম ব্যবসা আছে। মাল এনে বাড়িতে রাখে। বাড়িতে যাতে চোর-ডাকাত না ধরে সেজন্য মিন্নত পাহারা দেয়।

মিন্নত ভাড়াও দেয়। তবে একটু নিরিবিলি থাকার লোভে সে কিছু মনে করে না। তাকে তো কেউ বস্তিছাড়া ঘর ভাড়া দিতে চায় না। সে জীবনের বড় একটা সময় বস্তিতেই কাটিয়েছে। অবশ্য এই বাড়িটাও বস্তির মতোই।

ছাদের উপরে টিনশেড ঘরে অনেক গরীব পরিবার থাকে। এই বিল্ডিংয়ের পাশেই একটা মসজিদ। অবশ্য ঢাকা শহরে এতো মসজিদ যে, এই মসজিদের আলাদা বৈশিষ্ট্য নাই। প্রত্যেক গলি-মহল্লায় তিন-চারটা মসজিদ। মসজিদে আজান বা অন্য কোনো ঘোষণা দিলে সবাই স্পষ্ট শুনতে পায়।

আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কারণ সে স্বপ্নে দেখছিল, বিয়ে করছে। মেয়েটার নাম রুকু। রুকু কনে সেজে বসে আছে। মিন্নত টোপড় মাথায় পাঞ্জাবি গায় দিয়ে বসে আছে।

কাজী সাহেব বিয়ে পড়ান শুরু করেছেন। কাজী বলছেন, ‘ছবুর হোসেন ও ছুবা বেগমের একমাত্র কন্যা রুকু খাতুনের সঙ্গে’ বলতেই আজানের শব্দে মিন্নতের ঘুমটা ভেঙে গেল। তার মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। রুকুকে বউ হিসেবে পাওয়ার আগেই তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙল ঠিকই।

কিন্তু তার অস্থিরতা কাটল না। আজ তার টাকা তোলার দিন। কিন্তু তার কিছুতেই টাকা তুলতে ইচ্ছে করলো না। এই জীবনে তো সে কম টাকা তোলে নি। মাস শেষ হওয়ার আগেই টাকা শেষ হয়ে গেছে।

রোজা ও কোরবানীর ঈদের মাস ছাড়া দোকানদাররা ঠিকমতো টাকাও দেয় না। ওই দুই মাসে কিছু টাকা জমানো যায়। এছাড়া ঈদে কিছু বোনাসও পাওয়া যায়। তবে সে বোনাস দিয়ে জামা-কাপড় কিনলে জুতা কেনা যায় না। আর জুতা কিনলে জামা-কাপড় কেনা যায় না।

সিটি কর্পোরেশন থেকে যে টাকা দেয় ওটাই নিয়মিত। এটা নিয়েও মিন্নতকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয় নাই। মিন্নত ভেবে দেখল, আজ সে টাকা তুলতে যাবে না। বরং আরো একটু ঘুমিয়ে নেবে। স্বপ্নের বাকি অংশটা সে শেষ করে নিতে চায়।

কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও ক্ষুধায় সে ঘুমাতে পারলো না। ক্ষুধার কথা বলতে বলতেই বাটিতে খাবার নিয়ে বুড়ি চলে এলো। বুড়ির বয়স কম না। ষাট পার হয়েছে। ছেলে-মেয়ে কেউ নাই।

নিজের বলতে আছে এক নাতনি। মেয়ের ঘরের মেয়ে। বুড়ির মেয়েটি দুই বছর আগে ক্যান্সার হয়ে মারা গেছে। বুড়ি তারপর নাতনিকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। মেয়েটি রান্না করে।

তারপর দুজন মিলে বিভিন্ন জায়গায় খাবার পৌঁছে দেয়। আজ বুড়ি এসেই ডাকল। ‘মিন্নত, ও মিন্নত। উটছাও নাকি। ’ ‘হ খালা, উঠছি।

’ ‘সামনের মাস থিকা ৫ টাকা কইরা বেশি দেওয়া লাগবো। ৫০ টাকায় দুই বেলার খাওন ঢাহা শহরে আর দিতে পারুম না। দুপুর বেলা মাছ না দিলে তো তোমরা গালাগালি করো। ’ ‘ক্যান খালা?’ ‘জিনিস পাত্তির দাম যা বাড়ছে। চাইল, ডাইল, ত্যাল, নুন, তরকারি বেবাক কিছুর দাম বাড়ছে।

আমি অহন কী করুম? অয় দাম বাড়াইতে অইবো, নয় ব্যবসা বন্ধ করতে অইবো। ’ মিন্নতের এইসব ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। সে কথা শেষ করার জন্য বললো, ‘ঠিক আছে খালা। সবাই যদি রেট বাড়ায় আমার অসুবিদা নাই। ’ বুড়ি চলে গেলে সে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

কিন্তু কিছুতেই ঘুমাতে পারলো না। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে গরীব মানুষ বাঁচবে কীভাবে? দুই বেলার খাবার জোগার করতে যেখানে একজনের ৫০ টাকা লাগে সেখানে বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে কীভাবে সবাই বেঁচে থাকে? তাছাড়া প্রতিদিন জিনিসের দাম বাড়ে। একবার একটা জিনিসের দাম বাড়লে সেটা আর কমে না। এই শহরে যারা পরিবার নিয়ে থাকে তাদের একা উপার্জন করলে পরিবার চলে না। তাই জামাই-বউ দু’জনকেই কাজ করতে হয়।

বউ-ঝিরা সাধারণত রাজমিস্ত্রির জোগাল, ইট ভাঙা, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির লেবার, অপারেটর, বাসা-বাড়ির বুয়া অথবা অফিসের ক্লিনার হিসেবে কাজ করে। আজকাল যারা একটু-আধটু পড়াশোনা জানে তাদের কেউ কেউ সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিও করে। চাকরিজীবীদের বউ-ঝিরাও চাকরি করে। তাদেরও সংসার একজনের চাকরিতে চলে না। সংসার চালাতে সবাইকে হিমশিম খেতে হয়।

মিন্নত আলি তো সেই ছোটবেলা থেকেই ক্ষুধার কষ্টে আছে। আজও তার সেই কষ্ট দূর হয় নাই। মাঝখানে একটা জীবন তার শেষ হয়ে গেল। মিন্নত আবার ঘুমাতে চেষ্টা করল। সে চায় রুকুকে নিয়ে যে স্বপ্নটা সে দেখা শুরু করেছে তা শেষ করতে।

কিছুতেই ঘুম এল না। এসময় রুকুর কথা ভাবতে তার ভালই লাগলো। রুকু মেয়েটা মন্দ না। দেখতেও বেশ। পাতলা ফিগার।

লম্বায়ও মিন্নতের সমান। বয়স এতোদিন তিরিশ পার হয়েছে। পোলা জš§ানোর জন্য এমন একটা মেয়েই তার দরকার। কিন্তু কথা হল, রুকুকে মিন্নত পাবে কোথায়? তাকে গত ২ বছরে মিন্নত দেখে নাই। রুকু চকবাজারের গলিতেই বড় হয়েছে।

তার মায়ের সাথে মিন্নতের বড় খাতির ছিল। রুকুর মা ছুবার সাথে মিন্নত কতবার শুয়েছে। কিন্তু রুকু বৈধ মেয়ে। ছুবার রিক্সাওয়ালা স্বামী মেয়ে হওয়ায় পালিয়ে গেল। মোড়ের গলিতে বসে ছুবা সপ্তাহ খানেক কাঁদল।

তারপর সবাই মিলে ছুবাকে কাজ জুটিয়ে দিল। তারা ছুবাকে বললো, ‘হুদাহুদি কান্দিস না। জামাই গ্যাছে। তাতে কী? আত-পাও আছে না!’ তাদের কথামতো ছুবা প্রথমে ইট ভাঙার কাজ ধরলো। ইট ভাঙতে গিয়ে সে নিজেও ভেঙে গেল।

রাজমিস্ত্রির জোগালিয়াদের সাথে ইটিশ-পিটিশ করা শুরু করলো। যুবক শ্রমিকরা ছুবাকে এমনি এমনি ছাড়ে নাই। সেও কম না। টাকা নিত আবার ক্ষুধাটাও মেটাত। এই খবর অনেক পরে মিন্নত পেয়েছে।

এক রাতে সোয়ারিঘাটের গিরিসা তাকে এই খবর দিল। গিরিসাও ইট ভাঙে। সুযোগ পেলে সেক্স বেচে। পরের রাতে মিন্নত ছুবার সাথে সেক্স করল। ছুবা কাজ শেষে টাকা চাইল।

সবাই প্রথম প্রথম এই ভুল করে। তারা তো জানে না, রাতে পৃথিবীর তাবৎ জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নাইটগার্ডদের। তারা যা ইচ্ছা, তাই করতে পারে। নাইটগার্ডরা কোনো জিনিসের ক্ষতি করে না। তবে, এই একটা জিনিসেই তাদের একটু লোভ।

অলিখিত অসংখ্য নিয়মের মতো, সব নাইটগার্ডই এই নিয়মটা মেনে চলে। ছুবার টাকা চাওয়ার ভঙ্গি মিন্নতের ভাল লাগলো না। তাকে একটা থাপ্পর মেরে বললো, ‘চকবাজারে থাকবার চাইলি মিন্নত গার্ডরে ফিরি দেওন লাগবো। থানার ওসিও মিন্নতরে মাইন্য করে। ’ এ ঘটনার পর ছুবা আর কখনও মিন্নতের কাছে টাকা চায় নি।

অনেক দিন ছুবার কোনো খবর সে পায় না। সে শুনেছে, ছুবা ইট ভাঙতে গিয়ে হেডমিস্ত্রির সাথে ভাব জমিয়েছে। হেডমিস্ত্রি তাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেছে। সে ওই বাড়িতে কাজ করে। সারাদিন কাজ করে।

রাতে কিচেনে ঘুমায়। মেয়েটা তার সাথে থাকে। ফারুকের সাথে ছুবার ঝগড়া শুরু থেকেই। ছুবার স্বামী চলে যাওয়ার পর ফারুক তাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল। তার ওই এক স্বভাব নতুন মেয়ে পেলেই তাকে নিয়ে কয়েকদিন থাকবে।

তারপর তাকে দিয়ে সেক্স বেচবে। সে নিজে কোনো কাজ করে না। তার সাথে থাকা মেয়েরা যা উপার্জন করে, তাই দিয়ে তার লাফালাফি। শেষে ফারুকই একদিন খবর দিল, ছুবাকে হেডমিস্ত্রি রুবেল প্রত্যেক রাতে লাগায়। তার বউ এক রাতে টের পেয়ে ছুবাকে বিদায় করে দিয়েছে।

সে এখন আজিমপুর গোরস্তানে থাকে। ছুবা ফারুককে বলেছে, ‘দান-খয়রাত খাইয়া বাইচা থাকুম। তাও ভালা। মাইয়াটা ভালা থাকব। ’ কিন্তু না।

আজিমপুরের ফকিন্নিদের জ্বালায় সে টিকতে পারে নাই। ফেরত এসেছে চকবাজারে। লোকে কয়, ‘চকবাজারের বাতাস যার প্যাটে ঢোকে, সে অন্য কোথাও থাকবার পারে না। ’ ফারুকই তাকে নিয়ে এল। ফারুকের সাথেই ছুবা থাকা শুরু করল।

এলাকার তাবৎ বেশ্যার লিডার হল ফারুক। ফারুকের সাথে ধনী-গরীব-পুলিশ-ডাক্তার-উকিল সবার খাতির। ফারুকের সাথে থাকতে থাকতে ছুবার মেয়ে রুকুও এই লাইন ধরল। দুপুরের পর মিন্নত আলি আর ঘুমাতে পারলো না। নানান চিন্তা মাথায় এলে সহজে ঘুমান যায় না।

সেও শেষ পর্যন্ত ঘুমাতে পারে নি। সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। বাটি সার্ভিসের খাবার দিয়ে গেল এক পিচ্চি। সে খেয়ে ডিউটি দিতে বেরিয়ে গেল। মিন্নত চারপাশ ভাল করে দেখে চক সার্কুলার রোডের মাথায় ছোট একটা দোকানের বারান্দার নিচে সাটারে হেলান দিয়ে বসে পড়লো।

আজ ডিউটিতে তার মন বসছিল না। সে তো জীবনে কম ডিউটি দিল না। অন্যের সম্পদ পাহারা দিয়ে রেখে মিন্নত নিজের জীবনে কী পেল! কিছুই পায় নাই। যা ছিল, তাই আছে। অথচ এক জীবনে কোটি কোটি টাকার সম্পদ পাহারা দিয়ে রেখেছে সে।

লোকজন যে কেন নাইটগার্ডকে গুরুত্ব দেয় না তা মিন্নত ভেবে পায় না। অথচ নাইটগার্ড যদি ইচ্ছে করে, কতো বড় ক্ষতিই না করতে পারে! মিন্নত ভেবে দেখলো, গার্ড এবং ড্রাইভার এই দুই পেশার লোক সবচেয়ে মারাত্মক। এরা ইচ্ছে করলে, মালিকপক্ষের অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে। ড্রাইভার ইচ্ছা করলে এ্যাকসিডেন্ট করতে পারে, গার্ড ইচ্ছা করলে কাজে অবহেলা অথবা ক্ষতি করার চেষ্টা কতে পারে। সে রকম কিছু করলে কী ভয়ানক পরিণতি হবে! অথচ মানুষ এই দুই পেশার লোকদেরকে মূল্যই দিতে চায় না।

মিন্নত আলি আজকাল ভাবে। মানুষের মন খারাপ থাকলে মাথা খুলে যায়। একের পর এক চিন্তা আসে। এই যে একটা জীবন মিন্নত আলি নাইটগার্ডের চাকরি করে পার করে দিল। কী চেয়েছিল আর কী পেল? সে তো রাজা-বাদশা হতে চায় নাই।

তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারলেই তার শান্তি। ঘর নাই। বাড়ি নাই। বউ নাই। পোলা-মাইয়া নাই।

আত্মীয়-স্বজন কেউ নাই। মরে গেলে কবর দেওয়ার মানুষটাও নাই। অথচ কত স্বপ্ন নিয়ে সে নাইটগার্ডের চাকরি শুরু করেছিল। আজ জীবনের প্রথম নাইট ডিউটির কথা মনে পড়ল। তার ওস্তাদ শুক্কুর গার্ড প্রথম যেদিন তাকে বুট জুতা, শার্ট, প্যান্ট, মোজার সাথে তিন ব্যাটারির একটা লাইট আর বেতের লাঠি এনে দিল সেদিন মিন্নতের মনে কতো স্বপ্ন ছিল।

প্যান্ট-শার্ট পড়ে প্রথম দিন জুতার ফিতা লাগাতে তার কী যে ভাল লাগলো। মনে হল, পুলিশ-আর্মিরা এইভাবে ফিতা লাগায়। সেও লাগাচ্ছে। হাতে যখন লাঠিটা নিল তখন মিন্নত প্রচণ্ড শক্তি পেল। শরীরে যেন কোথা থেকে বল চলে এলো।

নিজেকে তার আনসার-আনসার মনে হল। আনসাররাও লাঠি নিয়ে ঘোরে। পুলিশ-আর্মি-বিডিআর-আনসার সবাই সমান। নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে হয়েছিল সেদিন। তার সামনে যত বড় সন্ত্রাসীই আসুক সে এই একটা লাঠি দিয়েই লড়াই করতে পারবে।

তারপর ওস্তাদ তাকে নিয়ে বাজার কমিটির লোকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তারা মিন্নতকে একটা বাঁশি দিল। বাঁশি পেয়ে মিন্নতের শক্তি আরো বেড়ে গেল। নিজেকে পুলিশ পুলিশ মনে হল। পুলিশ কোন ঝামেলা হলেই বাঁশি বাজায়।

তারও আজ থেকে দায়িত্ব ঝামেলা হলেই বাঁশি বাজানো। প্রথম প্রেমের মতো নাইট ডিউটির পরতে পরতে মিন্নত ভালোলাগা খুঁজে পেল। মূলত একধরনের নিশ্চয়তাবোধ তার এমন ভালোলাগার উৎস। সে নিশ্চয়তা ক্ষুধা নিবারণের এবং পরিচয়ের। আত্মীয়-স্বজনহীন ভবঘুরে মিন্নত আজ চকবাজারের নাইটগার্ড।

এই শহরে সে একজন উদ্বাস্তু। দু’টো ভাতের জন্য অনায়াসে সে জন্মভিটা ছেড়েছে। এই শহরে আসার পর সে খাওয়া পেলেও পরিচয় সংকটে ভুগতো। নাইটগার্ডের চাকরি সেই সংকট থেকে মিন্নতকে মুক্তি দিল। মিন্নত এখন থেকে প্রতি মাসে চাকরিজীবীদের মতো নির্ধারিত একটা বেতন পাবে।

এই টাকায় সারা মাস সে খাবে। এখন থেকে সে পেট ভরে খাবে। পেট ভরে খাওয়ার যে আনন্দ তা জীবনে খুব পায়নি। এখন আর তার কোনো বাধা থাকলো না। হাড় জিরজিরে শরীরের মিন্নত সারা রাত ডিউটি দিতো আর গান গাইতো।

কত গান সে এ জীবনে শুনলো। নানার কাছে গান শিখেছে। ঢাকার রাস্তায় টোকাইদের মধ্যেও নানান জনপ্রিয় গান শোনা যায়। সেগুলোও সে বেশ রপ্ত করেছিলো। মিন্নত প্রথম প্রথম ঘন ঘন বাঁশি বাজাত।

যেসব দোকানে কর্মচারীরা রাতে ঘুমাত তারা দিনে বলত, ‘ওই মিয়া, হুদাই বাঁশি বাজাও ক্যা। কম কইরা বাজাইবা। ’ কিন্তু না, মিন্নতের বাঁশিতে ফু দিতে ভাল লাগে। লাইটের আলো মেরে মেরে চারপাশ দেখত আর বাঁশিতে দিত ফু-উ-উ। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার কী যে হল।

আগের মত বাঁশিতে ফু দিতে ইচ্ছে করে না। ভাবে তার পোলাকে সে আর্মি-বিডিআর না হলেও অন্তত পুলিশ বানাবে। তার মত যেন লাঠি নিয়ে ডিউটি দিতে না হয়। বন্দুক, পিস্তল এইসব কাঁধে ঝুলিয়ে ডিউটি দিবে। ততদিনে লাঠির সীমাবদ্ধতা সে টের পেয়ে গেছে।

লাঠি দিয়ে বড় জোড় টোকাই মারা যায়। অন্য কিছুই করা যায় না। পাতি মাস্তানরাও আজকাল পকেটে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেখানে লাঠি কিছুই না। তাই সে স্বপ্ন দেখত, তার পোলা বড় আর্মি অফিসার হয়ে কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এইসব স্বপ্ন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেছে। সব দোকানদার নিয়মিত টাকা দেয় না। টাকার জন্য গেলেই তারা বলে, ‘আইজ না, কাইল আহিস। ’ পরের দিন গেলে বলে, ‘এই সপ্তা না, আগামী সপ্তায় নিস। ’ দুই-একজন তো বলেই ফেলে, ‘সিটি কর্পোরেশন থিকা যে বেতন পাও তাতে চলে না? না চললি ডিউটি ছাইড়া দ্যাও।

দ্যাশটা শ্যাষ হইয়া গ্যাছে। বেবাক জায়গায় দুই নম্বরি। ’ মিন্নত বুঝতে পারে না, তাকে তো সিটি কর্পোরেশন থেকে পুরো বেতন দেয় না। তাদের নিয়ম হলো, অর্ধেক বেতন সিটি কর্পোরেশন বহন করবে। বাকিটা দোকানদাররা।

কিন্তু এরা সেটা বোঝে না। এভাবে মাসের পর মাস বাকি পড়ে থাকে। তবে সিটি কর্পোরেশন থেকে যে টাকাটা দেয় সেটাই পাওয়া যায়। সেখানেও ঝামেলা আছে। কিছুদিন পর পর কমিশনার বা কাউন্সিলর পাল্টায় আর মিন্নতের ঝামেলা বাড়ে।

এক কমিশনার তো তার বেতনের অর্ধেক টাকা কেটে রাখতো। একজন কমিশনার হয়েই তার বেতন বাতিল করে দিল। দুনিয়ায় যে কত কিসিমের মানুষ আছে, তা এই শহরে না থাকলে মিন্নত বুঝতেই পারতো না। এমন দোকানও আছে মাস হয়ে বছর যায় কোনো টাকা-পয়সা দেয় না। একসময় দোকান বন্ধ হয়ে যায়।

নাইট গার্ডের পয়সা দেওয়ার নাম করে না তারা। রাতে আবার টোকাই ও ফকিরদের উৎপাত। এর সাথে প্রায়ই নতুন নতুন মানুষের আগমন। ঢাকা শহরটায় এমন প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ আসে। কোথা থেকে আসে! কোথায় যায়! মিন্নত কিছুই বুঝতে পারে না।

ঢাকায় এসে যাদের থাকার জায়গা নাই, তারা আগে ঘাট, বাসস্ট্যান্ড অথবা রেলস্টেশনে রাত কাটাতো। এসব জায়গায় কড়া নিরাপত্তা থাকায় এখন পুরা শহরটাই রাতে এদের দখলে থাকে। বড় বড় বিল্ডিংয়ের নিচে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ওভারব্রিজের ওপর, আন্ডারপাসের নিচে, ফুটপাত বা ডিভাইডারের ওপর যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই রাত কাটায়। পুলিশ মাঝেমধ্যে ঝামেলা করে। তবে আজকাল এদের বড় শত্র“ সিকিউরিটি গার্ড।

বড় বড় বাসা-বাড়ি অথবা মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ডগুলো এদের দেখলেই তেড়ে আসে। তবে নিজের কথাটাও ভোলে না মিন্নত। তাই প্রথম দিকে চাকরি যাওয়ার ভয়ে সে তার এলাকায় রাতে কাউকে ঘুমাতে দিতো না। এখন দেয়। তবে সেটা বেশি দিন না।

বড়জোড় এক সপ্তাহ। সেওতো ঢাকায় একদিন নতুন ছিল। গ্রামে কাজের এতো অভাব। তার মনে হয়, সব মানুষই পেটের দায়ে ঢাকায় আসে। সে শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক।

ক্ষুধার জ্বালা না থাকলে কেউ এই অদ্ভুত শহরে বেশি দিন থাকতো না। মিন্নত প্রথমদিকে বেশ্যাদের কিছুই বলতো না। কিন্তু একদিন এক বেশ্যাকে দেখে সে ঠিক থাকতে পারে নাই। মেয়েটা বড়ই সুন্দরী। বয়সটাও কম।

তাকে মিন্নত আগে কখনও দেখে নাই। অন্য এলাকার হবে হয়তো। রাত তখন প্রায় শেষ। ধীরে ধীরে উর্দু রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল মেয়েটি। মিন্নতও বুঝতে পারে নাই, মেয়েটা বেশ্যা।

চক সার্কুলার রোড পার হওয়ার পর গলির শেষ মাথায় গিয়ে মেয়েটা মিন্নতকে দাঁত বের করে একটা ভেংচি কাটলো। ভেংচি কেটেই ভো দৌঁড়। মিন্নতও কম যায় না। এক দৌঁড়ে মেয়েটাকে ধরে বাজারে যে নতুন বিল্ডিং হচ্ছিল সেখানে এনে লাগাল। মেয়েটা ভীষণ কান্না করলো।

মিন্নতকে খামচে ধরে বুকে ও পিঠে দাগ করে দিল। তাতে কী? মিন্নত যে আনন্দ পেল তা ভুলবার নয়। সেই কবে সে সুন্দরীকে লাগিয়েছিল। আর আজ যেন সেরকম আরেকটি অল্পবয়সী মেয়েকে লাগালো। তার ওস্তাদ বলতো, ‘কচি মাল লাগানোর মজাই আলাদা!’ সেই শুরু।

এরপর থেকে মাসে দুই-একটা মেয়ে অন্তত তার ভাগ্যে জুটতো। তাই বৌয়ের প্রয়োজন মনে করে নাই। প্রতি মাসেই নতুন নতুন মেয়ে জুটতো তার কপালে। একটা বউকে নিয়ে কয়দিন কাটানো যায়? এছাড়া বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকার মতো টাকা-পয়সাও তার ছিল না। ভেবেছিল, হাতে কিছু টাকা জমলে তারপর বিয়ে করবে।

টাকা জমাতে জমাতে ততদিনে তার বিয়ের প্রতি আর কোনো ঝোঁক ছিল না। রাতে ডিউটি। দিনে ঘুম। বিকেলে দোকানে দোকানে টাকা তোলা। এই চক্রে সে পড়ে গেল।

এর বাইরে সে আর কিছু করার সুযোগ পায় নাই। আর কিছু ভাবারও সুযোগ পায় নাই এতদিন। মন খুব খারাপ থাকলে, নানার কথা মনে হতো। তখ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।