আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনন্তের ভাষাজ্ঞান আর আমাদের হীনমন্যতা

যেথায় পড়শী বসত করে, আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে। ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম। হিন্দী সিনেমা। নাম সম্ভবতঃ বিবি হো তো অ্যায়সী বা এরকম কিছু। রেখা অভিনীত খুব জনপ্রিয় একটা ছবি।

সেই সিনেমায় রেখা রাস্তায় নেচে নেচে পান জাতিয় কিছু বিক্রী করত। গল্পের নায়ক তার রূপে-সরলতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করে নিয়ে বাড়ী চলে আসে। সিনেমায় যে রকম হয় আর কি, এরকম গেঁয়ো ভাষায় কথা বলা অশিক্ষিত মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নিতে পারে না রেখার শাশুড়ী, আভিজাত্যের অহংকারে। এই নিয়েই চলে সংসারে ছেলে-বউ-শাশুড়ী-ননদের টানাপোড়েন। সিনেমার শেষের দিকে একটা পার্টি দেয়া হয়।

ঐ পার্টিতে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আসেন। ঐ পার্টিতে সবার সামনে শাশুড়ীটি ছেলের বউকে চরম অপমান করেন এবং তার বাবা-মায়ের স্টাটাস, শিক্ষা, বংশপরিচয় নিয়ে তাচ্ছিল্ল্য করেন। এ অবস্থায় রেখা তার আসল পরিচয় প্রকাশ করে এভাবে 'হোল্ড ইয়োর টাং ---, আই অ্যাম নট আনেডুকেটেড পারসন অ্যাজ উ থিঙ্ক, মাই ফাদার ইজ ....' উপস্থিত সবাই এই রকম ইংরেজী শুনে 'থ' হয়ে যায়। আর বুঝতে পারে নায়িকা রেখা ও অভিজাত এবং উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। সিনেমার কাহিনীটা বর্ণনা করার পেছনে আমাদের মানসিক পরিণতির স্তর সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

আমাদের শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষের ধারণা, ভাল, চোস্ত উচ্চারণে ইংরেজী বলতে জানা টা শিক্ষা এবং আভিজাত্যের একটা পূর্বশর্ত। অনেক টা বিলাত ফেরৎ ডাক্তার বা বিলাতের ব্যারিষ্টারী পড়া শুনলে আমাদের মধ্যে যেমন একটা শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব চলে আসে। তেমনি, কেউ সবার মাঝে একটু স্টাইল করে কিছু ইংরেজী বাক্য বলতে পারলে আমাদের মধ্যে তার সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব চলে আসে। অন্য দিক দিয়ে, যারা ঠিক মত ইংরেজী বলতে জানেনা, তাদের কে ধরা হয় গেঁয়ো, অশিক্ষিত, খ্যাত হিসেবে। এ কারণে নিজেকে শিক্ষিত এবং অভিজাত হিসেবে প্রমাণ করবার জন্য অনেকের মধ্যে কথায় কথায় ইংরেজী বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো , ভাল, চোস্ত উচ্চারণে ইংরেজী বলতে পারাটা অনেকটা চর্চার ব্যাপার। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, অভিজাত-অনভিজাত যে কেউ ই ঠিকমত কিছুদিন চর্চা করলেই, এই গুণটি আয়ত্ব করতে পারে। ঠিক এই ব্যাপারটির প্রতিফলনই দেখতে পাচ্ছি নায়ক অনন্তের সাম্প্রতিক কিছু সাক্ষাতকারে আর দর্শক-শ্রোতার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায়। নায়ক অনন্ত যে গেঁয়ো, অশিক্ষিত, খ্যাত নয়, সেটা প্রমাণ করার জন্য তাকে দেখা যাচ্ছে সাক্ষাতকারগুলিতে অপ্রয়োজনীয় কিছু ইংরেজী বাক্য বলতে। এক্ষেত্রে, সে হয়তো আর দশজন বাঙালীর মত করেই ভাবছে।

কিন্তু, আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত দর্শক-শ্রোতা শ্রেণী এটা নিয়ে যেভাবে স্থুল-সুক্ষ রসিকতা করছেন, এবং কেউ কেউ সিনেমা জগতে তার কাজকে মূল্যয়ন না করে তার ইংরেজী উচ্চারণের মূল্যয়ন করছেন, তাতে করে সেই সব শিক্ষিত দর্শক-শ্রোতা শ্রেণিকেই আমার সিনেমার সেই শাশুড়ীর প্রতিনিধি মনে হচ্ছে, যারা অনন্তকে সেই পর্যন্ত আভিজাত্যের সার্টিফিকেট দেবে না, যে পর্যন্ত না, সে চোস্ত উচ্চারণে ইংরেজী বলতে পারবে। বৃটিশ শাসনের পর কয়েকশত বৎসর পরে, এই মানসিকতা থেকে আমাদের সবারই বের হয়ে আসা উচিৎ ছিল। এখনো সেটা আমরা কেন পারিনি, সেটা একটা প্রশ্ন। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.