আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরব ডায়েরি-৩৭ (মনির-নামা ২)

... প্রথম পর্ব মনিরের পোস্টিং হলো ‘মাহাইল’। জয়েন করতে গিয়ে মনির সৌদি আরবের আসল রুপ দেখল। তিনদিকে পাহাড় ও মরুভুমির প্রান্তে শহরটি গড়ে উঠেছিল। সামাজিক সুযোগ সুবিধা তেমন নেই বলতে গেলেই চলে। যে মনির হাসি, তামাশা আর আড্ডার মধ্যমনি হয়ে থাকে, তার এমন পরিবেশ ভালো না লাগারই কথা।

ওখানে ৩/৪ জন বাংলাদেশি শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু তারাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেন। যার ফলে আমাদের আবহা’র সাথে মাহাইলকে মিলাতে গিয়ে প্রথম থেকেই মনির হোচট খেতে থাকে। আমি মনিরকে বলেছিলাম, ‘তুমি যদি আবহা না এসে সরাসরি মাহাইল জয়েন করতে তাহলে তোমার বেশ ভালো লাগতো। তুমি এখন আবাহা’র সৌন্দর্য্য দেখে ফেলেছ, মাহাইল আর ভালো লাগবে না। ’ মাহাইল গরম ও বদু প্রধান এলাকা।

লোকাল গ্রাম্য সৌদিরা ওখানে থাকে। ছাগল, দুম্বা আর উট চড়ায়। তাদের সভ্যতা ভব্যতা অনেক কম আর উগ্র মেজাজী। রাস্তা ঘাটে মানসন্মান নিয়ে চলাচল করাটা বেশ কষ্টের। মনির এসবের মাঝে গিয়ে পড়ল, ভার্সিটির পাশেই বাসা ভাড়া নিল, আর চঞ্চল জুঁই হয়ে পড়ল গৃহবন্দী।

মনির একদিন ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে গেছে। সেদিন ছিল সৌদি বদুদের সরকারি টাকা (মনে হয় কোন ধরনের সরকারি ভাতা) তোলার দিন। ব্যাংকের মাঝে বিকট দর্শণ বদুরা চেচামেচি অথবা ঘোত ঘোত করছিল। তাদের কেউ কেউ ছাগল/দুম্বার খামার হতে সরাসরি ব্যাংকে চলে এসেছে, হাতে ছাগল চড়ানোর লাঠি, কোমরে বিশেষ ধরনের ছুরি (জাম্বিয়া) । ছাগলের শরীরের বোটকা গন্ধে পুরো ব্যাংকের ভেতর অসহনীয় অবস্থা।

মনির কাজ শেষ করে কোনমতে বাঁচল। তবে তারা সু্যোগ পেলেই বুধবার বিকালে আবহা চলে আসত, শুক্রবারে ফেরত যেত। ফেরার সময় তাদের চেহারা মনমরা হয়ে থাকত। এমনি একদিনে আমি ও মিলন ঠিক করলাম আমরা মাহাইল ওদের বাসায় বেড়াতে যাব। এক বৃহঃবার সকালে ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম মাহাইলের পথে।

আমি ও শাকিলা, মিলন ও লিজা। আগের লেখাগুলোতে আবহা নিয়ে অনেক কথাই লিখেছি, ৭০০০ ফিট উপরের শহর। আর মাহাইল হচ্ছে ঠিক নীচে। আবহা হতে মাহাইল যাবার পথটা অনেক বিপদজনক। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে অথবা গা বেয়ে রোডটি ধীরে ধীরে নীচে নেমে গেছে।

কোনমতে দুটি গাড়ী পাশাপাশি চলেতে পারে। এই পথ দিয়ে আমরা প্রায়শঃ মক্কা যাই। প্রথমবার যখন রোডটি দেখি ভাবতেই পারিনি এমন একটি রোড সৌদিতে থাকতে পারে। আমরা ব্লগে বলিভিয়া, ব্রাজিল অথাবা চীনের কিছু বিপদজনক রাস্তার ছবি দেখেছি। অতটা বিপদজনক না হলেও এই রাস্তায় আসা যাওয়া করাটা আমার কাছে থ্রিলিং মনে হয়েছে।

আবহা-মাহাইল রোড ... থ্রিলিং মাহাইল রোডের পাশে বসে থাকা বেবুন ... আমরা যখন মনিরদের বাসায় পৌছাই, তাদের আনন্দ আর ধরে না। আমরা সাথে সাথে আড্ডা আর দুষ্টুমিতে বসে গেলাম। প্রথমে হামলা চালালাম ওদের রান্না ঘরে। পান্তা ভাত আর কয়েক রকম তরকারী এক গামলায় মেশালাম,তারপর একসাথে খাওয়া। ... বিকালে শহরটা দেখতে বের হলাম।

মনিরের বাসা হতে ক্যাম্পাসে যেতে মাত্র ২ মিনিট লাগবে। রাস্তার এপাশ ওপাশ। মনির নাকি প্রতি ক্লাস শেষে বাসায় চলে আসতো, জিড়িয়ে টিড়িয়ে আবার ক্লাসে যেত। মাঝখানে ফোনে কেউ খুঁজলে বলতো- ক্যাম্পাসেই আছি। ২ মিনিটের মাঝে হাজির হয়ে পড়ত।

এত মজা আমরাও নিতে পারিনা। আমাদের কাছে কিন্তু শহরটা ভালই লাগলো। তিনদিকে পাহাড়, মাঝখানের সমতল ভূমিতে শহরটি গড়ে উঠেছে। মরুভূমি’র ছোঁয়াও আছে। বললাম, কেন তোমরা এখানে থাকতে চাও না, ভলোইতো লাগছে?।

জুঁই বললো, ‘ ভাইয়া ১ দিনের জন্য বেড়াতে আসছেনতো, তাই সব ভালো লাগছে। সব সময়ের জন্য থাকতে ভালো লাগবেনা। ’ তাদের নিঃসঙ্গতার বেদনা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আমাদেরকে নিয়ে মনির জিলাপির দোকানে গেল। এখানকার জিলাপিটা নাকি দারুণ।

পেলামনা, শেষ হয়ে গেছে। সমুচা কিনলাম কেজি হিসাবে। সৌদি আসার পর এই প্রথম সমুচা খাচ্ছি। বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে সমুচা/সিঙ্গারা পাওয়া যায়। মনির আরেকটা খাবার কিনল, কুনাফা (এক ধরনের মিস্টি), মাহাইল নাকি এটার জন্য বিখ্যাত।

অনেকটা পাত্রের মধ্যে রাখা জমানো শক্ত হালুয়ার মতো। কেনার পর আগুনে সেকে, চিনির সিরা’তে চুবিয়ে দেয়। দারুণ সে স্বাদ। মাহাইলের মান্দি ও হানিস (একপ্রকার সৌদি খাবার যা আস্ত ছাগল/দুম্বা দিয়ে বানানো হয়। ) নাকি দারূণ স্বাদের।

আমি মান্দি খেলেও হানিস খেয়ে দেখিনি। রাতে খাবার দাবারের ব্যাপক আয়োজন। খেতে খেতে আমার মতো ভোজন রসিক মানুষও হাঁপিয়ে উঠলো। খাওয়া দাওয়া শেষে আবার বের হলাম। এখানে নাকি ৫ রিয়ালের বিশাল মার্কেট আছে।

যাই কিনিনা কেন, দাম মাত্র ৫ রিয়াল প্রতিটি। আক্ষরিক অর্থেই বিশাল মার্কেট। কত শত রকমের জিনিষ, ৫ রিয়ালে কিভাবে যে দিচ্ছে তারাই জানে। শাকিলা ও লিজা দু’হাত ভরে শপিং করলো। যা যা প্রয়োজন কিনল, আর যার প্রয়োজন নেই, দাম কম দেখে তাও কিনলো।

সে এক এলাহী কারবার। আমি নিজের জন্য ৪ জোড়া মোজা কিনতে পারলাম মাত্র। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভালো সৌদি মার্কেটের বেশীর ভাগই দখল করে রেখেছে চীন। এমন কোন জিনিষ নেই যে চীনের তৈরি না। টুপি, জায়নামাজ, পোশাক, আসবাবপত্র, হাড়ি পাতিল, কসমেটিকস, ইলেক্ট্রনিক্স থেকে শুরু করে সেফটিপিন পর্যন্ত চীন থেকে আসে।

সৌদিরা এতই অলস জাতি যে প্রায় সবকিছুই বাহির থেকে আনতে হয়। পরেরদিন ছিল শুক্রবার। দুপুরে জুঁইয়ের রান্না করা উটের মাংস খেলাম। বিকালে রওনা দিব, ওদের মন খারাপ। ওদেরকে একাকী রেখে আমরা ফেরত আসলাম।

আনন্দহীনতা, নিঃসঙ্গতা আর বৈরী পরিবেশের কারনে তারা আর কন্টিনিউ করতে চাইলোনা। ঢাকা ফেরত গেল। পেছন ফিরে দেখি, আমাদের আড্ডাগুলো কতোই না মধুময় ও স্বপ্নীল ছিল। শেষ করছি মনিরকে নিয়ে আগেই উল্ল্যেখ করা একটি মজার ঘটনা বলে। মনির তার ক্যাম্পাসে অনেক জনপ্রিয় ছিল।

সবাই তার রিজাইনের কথা শুনে মনঃক্ষুন্ন হলো। একদিন কয়েকজন ছাত্র এল। -দক্তর, তুমি চলে যাচ্ছ, We are very hungry। মনির সাথে সাথে চিন্তায় পড়ে গেল। খাইছে!! এরাতো মান্দি ছাড়া কিছু খেতে চায় না।

কমপক্ষে ১০০০ রিয়ালের মামলা। পরে কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝল, সে চলে যাচ্ছে বলে সবাই বিমর্ষ। They are very angry। মনির হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, যাক তারা hungry না। (শেষ)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।