বিশ্বটাকে সুন্দর করে সাজানোর জন্যই এত কথা বলি.. । আজ না জিততে পারলে দুপুরের খাবার বন্ধ। চাচার এ কথাটি নতুন নয় মরিয়মের কাছে। এর আগেও অনেক বার সে শুনেছে। বাবা-মা হীন জীবন বেড়ে চলছে নিজের মত চাচার সংসার ও আশ্রয়ে।
হে আশ্রয়ইতো, নইতো কি? কোন দিন ঘোড়ার পিঠ থেকে পিছলে পরলেও চাচা চেয়ে দেখেন না, ঔষধ তো দুরের কথা।
টম নামেই ডাকে মরিয়ম তার প্রিয় বন্ধুটিকে। নামটিতে বিদেশি একটা ভাব আছে। টমও এমন নচ্ছার মরিয়ম ছাড়া অন্য কাওকে তার পিঠে রাখতেই... চায় না। বাবা যে দিন টম কে কিনে এনেছিল তখন মরিয়ম মাত্র ৪ বছরের আদুরে কন্যা।
বাবার সাথে সেইযে টমের পিঠে উঠা শুরু তা এখনও রয়ে গেল। মরিয়ম পিঠে উঠলেই টম কেমন যেন শান্ত হয়ে যায়। যেন তার অশান্ত থাকা মেয়েটিকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে!
দৌড়ের ঘোড়াদের মাঝে এই টম সবসময় সেরা সাত গ্রামে। মরিয়ম যখন ৬ তখন তার বাবা-মা দুইজন তাকে রেখে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। চাচার সংসারে সে যেন একট বুঝা যার একমাত্র সঙ্গী টম।
এখন মরিয়ম টমের সওয়ারি। সেই জকি হিসেবে জিতিয়ে আনে টমকে প্রতিযোগিতায়। অত্র এলাকার সবাই তাকে একনামে চিনে, কারণ খেলায় সেই একমাত্র মেয়ে সওয়ারি। কিন্তু কোন একদিন হেরে গেলেই তার কপালে জুটে অপয়া ও অলক্ষী খেতাব।
টমের বয়স হয়েছে, এখন আর সে ভাবে দৌড়াতে পারে না।
হেরে যাওয়ার পর তার চোখে পানির মানে একটিই তা হলে, মরিয়মের কপালে অপমানের তিলক।
আজ কোন ভাবেই হারা যাবে না পণ মরিয়মের। টমের তেজ্যদিপ্ত দৌড় একই পণে আবদ্ধ বুঝা যাচ্ছে। প্রতি খেলায় সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে মরিয়ম ও টমের উপর। আজও তার ব্যতিক্রম নেই।
সিরাজ হাইদারের ঘোড়াটিই কেবল সামনে কিন্তু টম কেন গতি কমিয়ে দিচ্ছে! ৩ চক্করে তো সে কখনও এমন করেনি।
তাহলে কি আজ মরিয়ম হেরে যাবে?
সিরাজ হাইদারের ছেলের অপমানের প্রতিশোধ কি মরিয়ম নিতে পারবে না আজ?
ফুল ফুটলে তার গন্ধে সবাই মাতোয়ারা হয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। মরিয়ম এর ব্যতিক্রম নয়। ঘোড় সওয়ারি হয়ে থাকতে থাকতে নিজের দিকে তাকানোর সময় হয়নি, সে কি আর সেই ছোট্টটি আছে এখনও! ভুলুটা আজকাল বড্ড বেশি বিরক্ত করছে। মৌমাছির মত পিছনে লেগে আছে!
সিরাজ হাইদারের ঘোড়ার কাছেই হেরেছে সর্বশেষ রেসটাতে, ঘোড়ার কাছে নয় হেরেছে তার ছেলে ভুলুর কাছে বলেই মনে হয় মরিয়মের।
মাঠের পাশে দাড়িয়ে... ভুলুটা এমন সব বাজে কথা বলছিলো যে, মনোযোগ রাখাটাই দায় হয়ে গিয়েছিল মরিয়মের জন্য। ফলাফল-টম আর তার পরাজয়। সে দিন মরিয়মকে কোন খাবার দেয়া হয় নি। চাচীর ঝাড়ি আর অপমানেই পেট ভরিয়ে তুলেছিল আর ভুলুটার প্রতি তিব্র আক্রোশ জমাট বেঁধেছে।
নিজের মাঝে পরিবর্তন গুলো খুব ভাল করেই টের পেতে শুরু করেছে মরিয়ম।
বয়স ১২ তে পরলো, চাচা টমের জন্য একটা বাচ্চা ছেলেকে রেখেছে জকি করার জন্য। ছেলেটা সবসময় মরিয়মের সাথে লেগে থাকে। কিভাবে টমকে নিয়ন্ত্রণ করে, কথা বলে সব দেখে মনোযোগ দিয়ে। ছেলেটিকে তার পিঠে উঠতেই দিতে চায় না টম! হয়তো বুঝতে পারে মরিয়মের পালা ফুরোলো বলে। শিশু থেকে মেয়ে হয়ে উঠতে শুরু করেছে মরিয়ম।
মরিয়মের খুব ইচ্ছে করে টমকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। গতবছর বৈশাখে ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় জেতা রঙিন টিভিটাতে সে দিন দেখেছিল সুন্দর পোষাক পরা মেয়েগুলো ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে, সেদিন থেকে তার পালিয়ে যাওয়ার বাতিকটা বেড়ে গিয়েছে। তারও স্বপ্ন সেও ওই মেয়েদের মত সুন্দর পোষাক পরে টমকে নিয়ে দৌড়াবে হাজার মানুষের সামনে। স্বপ্ন গুলো কল্পনার আড়ালে ভেসে বেড়ায় চারদিকে যেখানে যাত্রী শুধু দু’জন। মাষ্টার মশাই বলেছিলেন, মেয়েরা সুযোগ পেলেও কাজে লাগায় না, আর যারা লাগাতে পারে তারাই আকাশ জয় করতে পারে।
মেয়ে তুমি মেয়ে নয়, মানুষ হতে শেখ। ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে মরিয়মকে, আশ্বাস দিয়েছেন মাষ্টার মশাই।
মরিয়ম মরিয়ম মরিয়ম...মাঠের চারদিক থেকে ভেসে আসছে একটিই নাম। এই ডাকটি বেশ লাগে মরিয়মের। উদ্দিপনা যোগায়, প্রেরণা যোগায়।
হারতে ভুলিয়ে দেয়। আজ হারলে চলবে না মরিয়ম, নিজেকেই নিজে বলে আর চাবুক দিয়ে টমকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।
না টম হোচঁট খায় নি, নতুন করে গতি সঞ্চার করে চাবুকের আঘাত ভুলে এগিয়ে যাচ্ছে সিরাজ হাইদারের ছেলে ভুলুর অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে মরিয়মের স্বপ্ন পুরণ করতে। মরিয়ম মেয়ে নয় মানুষ হয়ে আকাশ ছুয়েই আসবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।