মনের মহাজন খুঁজে ফিরি.... বর্তমান আ.লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে তেমন কোন কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাস না হলেও শেষ বছরগুলোতে একেরপর এক কেলেঙ্কারির নিত্যনতুন খবর বের হচ্ছে| শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, কুইক রেন্টাল, রেলের কালো বিড়াল, হলমার্ক নিয়ে বিতর্কসহ নানান বিষয় এখন আ.লীগের জন্য কাল হয়ে দাড়াচ্ছে| শেয়ার কেলেঙ্কারির বিতর্ক সামলাতে না সামলাতেই সরকারের দোরগোড়ায় হাজির হয় পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগ। মন্ত্রীর বিদায়, বিশ্বব্যাংকের শর্ত, পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের ঢেউ এখনো চলছে। শেয়ার কেলেঙ্কারিতে ৩২ লাখ বিনিয়োগকারীর আর্তনাদ সরকারবিরোধী সমালোচনাকে উসকে দিয়েছিল। সর্বস্ব হারিয়ে আত্দহননের পথ বেছে নেন অনেক বিনিয়োগকারী। এখনো পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ায়নি।
৪২ হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়া খলনায়কদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ দূরে থাক, তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা যায়নি। দোর্দণ্ড দাপটের সঙ্গে তারা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। কুইক রেন্টালের নামে বিদু্যুৎ খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ মিডিয়া পল্লী থেকে রাজনীতির অঙ্গন মাতিয়ে রাখছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিতর্ক দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও ঠাঁই নিয়েছে। এত সব বিতর্কের মুখে রেলের কালো বিড়াল ধরতে আসা রেলমন্ত্রী (সাবেক) সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও রেল কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মধ্যরাতে পাওয়া টাকার বস্তা সরকারকে বিব্রতই করেনি, বিতর্কের ঝড়ে ফেলে চরম ইমেজ সংকটের দিকেও ঠেলে দিয়েছে।
এই কেলেঙ্কারিতে থলের বিড়াল বেরিয়ে এলেও ধরা হয়নি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগে বাধ্য হলেও দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে বড় গলায় কথা বলে যাচ্ছেন। বিব্রত সরকার এই রহস্য উদঘাটনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এত সব বিতর্কের ঢেউয়ের মধ্যে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি সর্বশেষ দাঁড় করিয়েছে ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বৃহৎ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস নিয়ে এখন সর্বত্র ঝড় বইছে।
অখ্যাত গজিয়ে ওঠা হলমার্ক গ্রুপকে ওই শাখা থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বিনা মর্টগেজে ঋণদানের ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। সরকারের প্রভাবশালী মহল থেকে রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যাংক চেয়ারম্যান, সাবেক এমডি ও পরিচালকদের অনেকের নাম উঠে আসছে। সর্বত্র এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার তুফান বইছে। এর মধ্যেই বিব্রত সরকারের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি বড় ঘটনা নয়। দায়িত্বশীল পদে থেকে অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্য সব মহলকে ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও বিস্মিত করেছে।
ব্যাংকের দুজন ডিএমডিকে ওএসডি করা হয়েছে। দুদক একের পর এক ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি নিয়েও দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কিন্তু কোনো ঘটনারই রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে না। একের পর এক ঘটনা ধামাচাপা পড়ায় তৃষ্ণা যেমন নিবারিত হচ্ছে না, তেমনি সত্য উদঘাটিত হবে বা অপরাধী সাজা পাবে এমন বিশ্বাসও মানুষের মনে জাগছে না।
একদিকে তদন্ত, অন্যদিকে সরকারের প্রভাবশালীদের বক্তব্য দেশবাসীকে বিব্রত করছে। এদিকে দলবাজি ও সরকারের নাম ভাঙানো একটা শ্রেণীর স্বেচ্ছাচারিতা ও নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো। প্রতিবাদে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরাও আন্দোলনে নামছেন। রক্তপাতের মতো ঘটনা ঘটার পরও সরকার দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছে না। নিয়োগবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য, ফলাফল কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভিসি-প্রোভিসির পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষকের আন্দোলনের মুখে দুই মাস ধরে অচল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
বুয়েট পরিস্থিতির আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবীরকে পদত্যাগে বাধ্য করতে ছাত্র-শিক্ষকরা আন্দোলনকে উত্তাল করেছিলেন। সেখানে পানি অনেক গড়ানোর পর সরকার ভূমিকা রাখে। ভিসি এনামুলকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্রাবাস সরকার-সমর্থিত ক্যাডাররা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সেখানে গিয়ে কেঁদেছেন কিন্তু অপরাধীরা আজও ধরা পড়েনি।
এমন প্রতিটি ঘটনা সরকারকে বিতর্কের মুখে ফেলছে। দেশের প্রকৃত ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় মর্টগেজ, কাগজপত্র, প্রজেক্ট প্রোফাইল জমা দিয়ে ব্যাংক ঋণের জন্য দিনের পর দিন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। ঋণ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় মর্টগেজ ছাড়া তিন হাজার কোটি টাকা অখ্যাত নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণদানের ঘটনায় মানুষের মধ্যে সন্দেহ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সরকারের প্রভাবশালী মহলের দিকে সন্দেহের তীর যাচ্ছে প্রতিটি কেলেঙ্কারির ঘটনায়।
দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা জুটছে না। অন্যদিকে রাতারাতি গজিয়ে ওঠা বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, কোন আলাদীনের চেরাগ তাদের হাতে? এখন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক-ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান, দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটকে আটক করে যৌথ সেলে জিজ্ঞাসাবাদে না নেওয়ায় পর্যবেক্ষক মহলের প্রশ্ন, প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার সুবাদে আর দশটা কেলেঙ্কারির নায়কদের মতো এরাও কি পার পেয়ে যাচ্ছে? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি কেলেঙ্কারি, রেলের অর্থ কেলেঙ্কারি, কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট, ব্যাংক-ঋণ কেলেঙ্কারি সরকারের ইমেজের ওপর বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। সরকার যদি মানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে প্রতিটি ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে এর চড়া মাশুল দিতে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এসব প্রতিটি কেলেঙ্কারি নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে যেমন বিএনপি জমানার সার কেলেঙ্কারি, ২০০১ সালের নির্বাচনে তেমনি আওয়ামী লীগ শাসনামলের শেয়ার কেলেঙ্কারির প্রভাব পড়েছিল।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের দুর্নীতি, লুটপাট, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, হত্যা, খুন, গ্রেনেড-বোমা হামলার কেলেঙ্কারি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। জোয়ার-ভাটার রাজনীতির জনমত আদায়ে ভোটযুদ্ধের ময়দানে ভোটারদের মধ্যে কোনো ইস্যুই ভবিষ্যতেও ছোট হয়ে দেখা দেবে না। অভিজ্ঞ মহলের মতে, প্রতিটি কেলেঙ্কারির রহস্য উদঘাটন করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা সরকারের ইমেজ পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখতে পারে। রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের মাত্রা সহনীয় থাকায়, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় ও যোগাযোগব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় মানুষ নির্বিঘ্নে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারায় সরকারের ভাবমূর্তি যতটা উজ্জ্বল হয়েছিল, তা সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। উল্টো দ্রব্যমূল্য, সহনীয় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ও যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার সুফল নিয়ে সরকার কথা বলার আগেই সাম্প্রতিক খুন আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
এ মুহূর্তে সরকার সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছে ব্যাংক-ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায়। প্রশ্ন হচ্ছে কবে আমাদের এই সোনার দেশ কেলেঙ্কারির মত ঘৃণ্য আর জঘন্য অপবাদ থেকে মুক্ত হবে ? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।