আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিশ্চল মেঘ

মেয়ে দেখা হচ্ছে। বয়স কম হলো না। আর বাড়িতে মা-ও সারাদিন একা থাকে। অনেক ভেবে এবার সে আর কোনো আপত্তি জানালো না। ফরহাদের মা-ও বেশ খুশি।

ছেলে ভালো চাকরি করে, ভালো বেতন। এবার ভালো দেখে একটা পুত্রবধূ আনতে পারলেই তার দায়িত্ব শেষ। মনে মনে তিনি সাম্ভাব্য পুত্রবধূর একটা তালিকা তৈরি করে ফেলেন। নিকটাত্মীয় থেকে শুরু করে দূরসম্পর্কের ভাইবোনের মেয়ে, পাড়ার সুদর্শন তরুণী, ভাড়াটিয়ার মেয়েটাও বাদ গেলো না। ইদানিং তিনি এজন্যে বাইরেও বেশ ঘোরাঘুরি করছেন।

তবে ফরহাদ এ ব্যাপারে জানে না। কি জানি তার অতিআগ্রহে কি ভেবে বসে। ফরিদা খাতুন মাঝে মাঝে আবার ভাবেনেও যে ছেলের পছন্দের কেউ আছে নাকি। একদিন ছেলের সামনে একথা পেড়েও বসলেন। বলেন, হ্যাঁ রে বাবা, তোর বন্ধু বান্ধবীদের সব কি খবর? ফরহাদ একটু বিস্মিত হয়।

বান্ধবী? মা, তুমিতো জানোই যে আমার কোনো বান্ধবী নেই। ফরিদা খাতুন একথা ভালোই জানেন, তবু একটু যাচাই করে নেয়া আরকি! এমনিতেই বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে ছেলেটা। অমতে কিছু করতে গিয়ে আবার সে কষ্ট পাক্‌! ছেলের জন্য খুব মায়া হয় তার। ছোটোবেলায় বাবাকে দেখেছে। কিন্তু স্বভাবে ঠিক তার বাবার উল্টো।

নম্র, আস্তে আস্তে কথা বলে, সহজে ক্ষেপে যায় না মানে বদরাগী নয়। এমন ছেলের জন্য একটা বিনয়ী বউ চাই। তিনি যেমনটা ছিলেন। কিন্তু লোকটা তার জিবিওন ধ্বংস করতে বসেছিলো । অহেতুক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্বামীর সংসার ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।

থাক, এসব কথা আর স্মরণ করতে চান না ফরহাদের মা। অনেক কষ্টেসৃষ্টে ছেলেকে মানুষ করেছেন, এখন তার সংসারটা গুছিয়ে দিতে পারলেই স্বস্তি। কাজের বাইরে ফরহাদের বেশিরভাগ সময় শুয়ে বসেই কাটে। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া হয় তবে অতো দীর্ঘ সময় নিয়ে নয়। আজকাল সে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে।

ভালোই লাগে। নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়, নতুন কিছু জানা যায়। তো বেশ ক’দিন ধরে ফেসবুকের ফ্রেন্ড সাজেশনে একটা পরীর ছবি চোখে পড়ছে। নীল পরী ছদ্মনাম। ফরহাদের একটু কৌতূহল হয়।

নীল পরীর দেয়ালে যায়। মেয়েটা পাগলাটে বোধহয়। নইলে নিজের সম্পর্কে কেউ এভাবে লিখে? পৃথিবীর সেরা মিথ্যুক হয়ে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাবে! মিথ্যেবাদী পরী? কৌতূহলী ফরহাদ এই প্রথম কোনো মেয়েকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। একসেপ্ট হতেও বেশি সময় লাগলো না। দু-চার দিন যাবার পর পরিচয়টা যখন মোটামুটি স্থিতিশীল তখন ফরহাদের মধ্যে ভাবের অভ্যুদয় দেখা গেলো।

সময় অসময়ে ফেসবুক আর নীল পরীর সাথে বার্তা বিনিময়। ফরহাদ আসল নাম জানতে চায় কিন্তু নীল পরী কিছুতেই বলে না। ছবি দেখতে চায় কিন্তু এতেও নীল পরীর আপত্তি। অনেক জোরাজুরির পর সেস পর্যন্ত নীল পরী একটা ছবি পাঠায়। অপূর্ব! বনলতা সেন না হয় মোনালিসা! এর বেশি ফরহাদের আর কোনো তুলনা মাথায় আসে না।

না আসুক, নীল পরী একটা মুচকি হাসি দিয়েছে তো! এভাবে ভাব যখন কয়েকদিন ঘনীভূত হওয়া শুরু করলো তখন ফরহাদের কৌতূহল দেখা করার আবদারে গিয়ে ঠেকলো। আজ ওদের দেখা হবে। ফরহাদ একটা রেস্টুরেন্টের কথা বলেছিলো কিন্তু নীল পরী রাজি হয়নি। বিকেলের পরপর যখন সবচেয়ে বেশি মানুষের ভিড় থাকে, ফার্মগেটের ফুটওভারব্রিজে ওদের দেখা হবে। পাগলি আছে! চিনবে কি করে? ফরহাদ ফোন নাম্বার চায়।

কিন্তু নীল পরী স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সে ফরহাদের ছবি দেখেছে তাই তার চিনতে অসুবিধা হবে না। আর এ মেয়ে যখন একবার বলেছে তখন না মেনে নিয়ে আর উপায় নেই। ফরহাদ অফিস থেকে বাসায় ফিরে খুব তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নেয়। নীল সিল্কের পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়েছে এমন সময় মা এলেন। কোথায় যাবি রে বাবা? – এই একটু মিটিং আছে।

মা অবাক দৃষ্টিতে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করেন। বুঝতে পেরে ফরহাদ বলে- না, মানে বন্ধুদের সাথে অনেকদিন পরে দেখা হচ্ছে আর কি। শুনে ফরিদা খাতুন একটু হতাশ হন। আজ তার ছেলেকে নিয়ে এক জায়গায় কনে দেখতে যাবার কথা ছিলো। তিনি ছেলেকে বলেন- আজ না গিয়ে অন্যদিন গেলে হয় না? হঠাৎ এবং অকারণে মায়ের ওপর ফরহাদ রেগে যায়।

-হবে না। জোর গলায় বলে চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে গটগট সে বেরিয়ে যায়। ফরিদা খাতুন স্তব্ধ। একটা রিকশা নিয়ে ফরহাদ ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যখন পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা প্রায় ছ’টা।

দেরি হয়ে গেলো বোধহয়। ফরহাদ দ্রুত গিয়ে ওভারব্রিজের ওপরে ওঠে। । এপার ওপার ঘুরে এলো। অনেক মানুষ, কিন্তু তার অপেক্ষায় কেউ আছে বলে মনে হলো না।

তবে কি নীল পরী এসে ফিরে গেলো? নাকি আসেইনি? ওতো আবার বিশ্বসেরা মিথ্যুক হতে চেয়েছে। ফরহাদের মন খারাপ হয়ে যায়। মায়ের কথা মনে পড়ে। বেরিয়ে আসার সময় মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করে এসেছিলো। মনে পড়ায় আরো বেশি খারাপ লাগছে।

রেলিঙয়ের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের রাস্তায় আটকে থাকা এলোমেলো গাড়িগুলোর দিকে ও তাকায়। কিছুক্ষণ পর বিক্ষিপ্ত চিন্তায় নিমগ্ন ফরহাদের কানে মিহি কণ্ঠে উচ্চারিত দুটো শব্দ কানে আসে- এক্সকিউজ মি! ফরহাদ ফিরে তাকায়। -আপনি কারো জন্য মনে হয় অপেক্ষা করছেন? জ্বি, ফরহাদ বলে। -আমি নীল পরী। মেয়েটা অনেক সুন্দর কিন্তু ছবির সাথে কোনো মিল নেই।

বনলতা বা মোনালিসা কোনোটাই নয়, এ আরো অন্য কিছু্‌। আর কি হতে পারে ফরহাদ ভাবতে শুরু করে। -কি হলো? ফরহাদ এবার বাস্তবে আসে। কিন্তু...। নীল পরী ফিক করে হেসে দেয়।

বলে চলুন কোথাও গিয়ে বসা যাক। আর কোনো কথা হয় না। ওভারব্রিজ থেকে নেমে ওরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ পর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছায়। ফরহাদ যেটার কথা বলেছিলো।

অদ্ভুত! ফরহাদের কেমন ঘোরঘোর লাগছে। রেস্টুরেন্টের আলোআঁধারিতে সেটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। নীল পরী এককোণে একটা টেবিলের দিকে যায়। ফরহাদ নীরবে তাকে অনুসরণ করতে করতে যখন টেবিলের কাছে পৌঁছালো ততক্ষণে নীল পরী বসে পড়েছে। ফরহাদ অবাক হয়ে দেখে তার পাশে আরেকটা মেয়ে বসে আছে।

তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না। প্রজ্ঞা। ভার্সিটিতে একসাথে পড়তো। মেয়েটা ওকে খুব জ্বালাতো। কিন্তু ফরহাদ কখনোই ওকে পাত্তা দেয়নি।

নীল পরী পরিচয় করিয়ে দেয়- আমার বড়বোন। ফরহাদ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়। প্রজ্ঞা বলে- বসো। ফরহাদ চুপচাপ বসে পড়ে। সেদিন আর বেশি কথা হয় না।

ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থায় ফরহাদ একরকম পালিয়ে আসে। বাসায় ফিরে নীল পরীকে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দেয়। কয়েকদিন পর। বিকেলের ম্রিয়মাণ আলোয় মায়ের সাথে রিকশাভ্রমণ বেশ ভালোই লাগছিলো। ওরা যখন একটা বাসার সামনে গিয়ে থামলো তখন সন্ধ্যা।

ফরিদা বেগম ফরহাদকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। লোকটা বেশ ভদ্র। বিনয়ী ভঙ্গিতে কত্থা বলেন। ফরহাদকে এটাওটা জিজ্ঞেস করছিলেন এমন সময় ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রবেশ করলেন। তার পেছনে একটা মেয়ে, বেশ সাজগোজ করা।

ফরহাদ চমকে উঠলো। নীল পরী! ভদ্রলোক বললেন- আমার মেয়ে, পরিচিত হও। নির্বাক ফরহাদ কোনো কথা বলতে পারলো না। শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। ফরিদা বেগম মুচকি হাসলেন।

তিনিই কথা বললেন। কথায় কথায় জানা গেলো বড় মেয়ে প্রজ্ঞা দুদিন এখানেই ছিলো কিন্তু আজ সকালেই আবার শ্বশুর বাড়ি গেছে। রাত তখন এগারোটা হবে। ওরা বাসায় ফিরে এসেছে। ফরহাদ আধশোয়া হয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিলো।

মা তার ঘরে এলেন। পাশে বসে হাসি হাসি মুখে বললেন- কিরে মেয়েটাকে তোর পছন্দ হয়নি? ফরহাদ কোনো কথা বললো না, শুধু শব্দ করে সমরেশের একটা পাতা ওল্টালো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।