সামনে নির্বাচন, সাবধানে পথ চলুন
ফকির ইলিয়াস
=========================================
এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন গোটা বাংলাদেশ ব্যস্ত থাকবে সিটি মেয়র নির্বাচনের ফাইনাল রেসে। সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল নির্বাচনের ফলাফল জানিয়ে দেবে- কেমন হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট। আর তা হচ্ছে, কিছু কিছু ইস্যু নিয়ে তাৎক্ষণিক বড় বড় কথা বললেও ‘মেয়র’ প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে তা ভুলে যান। অথবা তাদের কাজ ফলপ্রসূ করার উপায় থাকে না।
যেমন ধরা যাক, সিলেটে জলাবদ্ধতার কথা। মেয়র কামরান এই ইস্যুতে ভালো ফল দেখাতে পারেননি। কেন পারেননি? তিনি প্রায় দুই দশক এই নগরের ‘নগরপিতা’ ছিলেন। অনেক কিছুই পারেননি। এখন আরিফুল হক চৌধুরী বলছেন, তিনি জলাবদ্ধতার মুশকিল আসান করবেন।
তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের দোসর ছিলেন। অনেক উন্নয়ন কাজের দাবিদার নিজেও। তিনিও পারেননি অনেক কিছুই। দেশ নির্বাচনমুখী। কিন্তু কিভাবে হবে সেই নির্বাচন? তা নিয়ে অনেক জল্পনা।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা লাগামহীন কথা বলে বেড়াচ্ছেন। যা মূলত আওয়ামী লীগের পায়েই কুড়াল মারা হচ্ছে। দপ্তরবিহীন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি বলেছেন, জামাত-বিএনপি-হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরে ৫ মে সরকার উৎখাতের যে ষড়যন্ত্র করেছিল, মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পিটুনি খেয়ে ‘সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ’ বলে পালিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মিলনায়তনে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। এটা কেমন কথা হলো? একটি মানবগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে তিনি এমন কথাবার্তা বলবেন কেন? আমরা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে একজন মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে জানি।
‘কালো বিড়াল’ ধরতে গিয়ে তার নৈতিক স্খলন ঘটেছে, কিংবা তিনি ‘পরিবর্তনবাদী’ হিসেবে শেখ হাসিনার গুডবুক থেকে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছেন, এমন অনেক কথাই বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু তিনি একটি ধর্মের শব্দাবলী উচ্চারণ করে ফাউল কথা বলবেন কেন? বিষয়টি খুবই দুঃখজনক এবং প্রতিবাদযোগ্য। তার এমন কথা প্রত্যাহার করে দুঃখপ্রকাশ সময়ের দাবি। যে প্রশ্নটি আসে, তা হচ্ছে শাল্লা-দিরাই এলাকার ভোটাররা, যারা মুসলমান তারা যদি এই প্রশ্ন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে করেন, তবে তিনি কী জবাব দেবেন?
আরেকটি খবর আমাদের নজর কেড়েছে। আইন প্রতিমন্ত্রী ‘অসাবধানতাবশত কিছু কথা উচ্চারণ করেছেন’ উল্লেখ করে এর একটি সংশোধনী দিয়েছে পিআইডি।
তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এড. কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অসাবধানতাবশত কিছু কথা উচ্চারণ করেছেন। ‘অসাবধানতাবশত তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামাতের তিন নেতাকে জরিমানা এবং এর মধ্যে দুজনকে কারাদ- দেয়ার আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে তারা অযোগ্য হবেন এবং যারা সংসদ সদস্য তাদের সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। ’ ‘তার একথা সঠিক নয়’ উল্লেখ করে তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, ‘প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য হলো- তাদের দ- বাতিল করতে হলে ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে হবে। ’ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করায় এর আগে কয়েকজন মন্ত্রী ও মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তিকে নিয়ে নালিশ সামলাতে হয় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে। মন্ত্রীরা এমন গাফিলতি কেন করছেন? তারা কি জানেন না, কথা বলার আগে সরকার-রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থটি রক্ষা করে এগোতে হয়।
দেশের মন্ত্রীরা যতোই উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলছেন, ততোই বেপরোয়া হয়ে উঠছে অপরাধীচক্র। রাজধানীর দারুস সালাম এলাকায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বাড়ি লক্ষ করে পর পর কয়েকটি হাতবোমা ফাটানো হয়েছে। এর আগে ১৮ দলীয় জোটের ডাকা হরতালের আগের দিন গত ২৮ মে রমনা এলাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বাড়ির ভেতরে দুটি হাতবোমা বিস্ফোরিত হয়। এসব কিসের আলামত? সরকারের মন্ত্রীরা উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরতে সচেষ্ট হতে পারতেন। তা না করে তারা বিভিন্ন আত্মঘাতী কথা বলে বেড়াচ্ছেন।
যা মূলত নির্বাচন থেকে তাদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে। দেশ এখন নির্বাচনমুখী। এই নির্বাচনে কাদের জেতা উচিত? কারা জিতলে জনগণ জিতবে? এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ একটি জাতি এমন পরিকল্পিত আঁধারে নিমজ্জিত থাকতে পারে না। এর থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
বেরিয়ে আসতেই হবে। আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি তৃতীয় মোর্চা তৈরির প্রয়াস চলছে। এদের অনেকেই সৎ এবং নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক বলেও পরিচিত। যোগ্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কথা যদি বলা হয়, তবে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে, সৎ ব্যক্তিত্বদের নির্বাচিত করা উচিত। কিন্তু মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. কামাল হোসেন এমন নেতারা সেই চাহিদা পূরণে কতোটা সক্ষম?
বাংলাদেশ গেলো ৪১ বছরে ইজমের রাজনীতি কম দেখেনি।
এই ইজমের প্রতিপত্তি বিস্তারের লক্ষ্যেই দেশে বিভিন্ন ‘ভবন রাজনীতির’ তালুক সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেসব লুটেরা তালুকদার চক্র সাময়িকভাবে এখন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও তারা সময়মতো এসে রাজনীতিতে জেঁকে বসতে পারে। তাই এসব লুটেরা ফড়িয়া শ্রেণী সম্পর্কে জনগণের সব সময় সতর্ক থাকা দরকার। যে রাজনৈতিক নিষ্পেষণ সাড়ে পনেরো কোটি মানুষের ভাগ্যকে নির্মমভাবে বিড়ম্বিত করেছে, তা থেকে মুক্তি খুঁজতে হবে মানুষকেই। এ জন্য ঐক্য এবং সাহসের কোনো বিকল্প নেই।
সাধারণ মানুষ জঙ্গিবাদমুক্ত শান্তির বাংলাদেশ চান। তারা চান ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটিতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার চিরঅবসান হবে। আর সে জন্যই গুণী, ত্যাগী, নিঃস্বার্থ এবং সৎ সাংসদ নির্বাচিত করতে হবে। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের মেরুদ-ের প্রধান শক্তি, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাই যুদ্ধাপরাধীমুক্ত, রাজাকার-হায়েনামুক্ত, একটি সংসদ গঠনে জনতাকে প্রত্যয়ী হতে হবে।
গণতন্ত্রের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি সুশিক্ষিত ভোটারেরও বিকল্প নেই। প্রতিবেশীকে সচেতন করে তোলা অন্য প্রতিবেশীরই নৈতিক এবং জরুরি দায়িত্ব।
আগামী নির্বাচনে এরশাদ একটা ফ্যাক্টর, তা অনেকে মনে করেন। মহাজোটের থিওরি ছিল রাজাকারের চেয়ে স্বৈরাচার ভালো। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাবেক স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের জাতীয় পার্টির ঐক্য আদৌ হওয়া উচিত ছিল কিনা তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল।
কারণ এই এরশাদশাহীর অবৈধ ক্ষমতায় থাকার নয় বছরে দেশে গণতন্ত্রকে হত্যার ব্যাপক তৎপরতা লক্ষণীয় ছিল। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য আদালতে মামলা হয়েছিল এরশাদের বিরুদ্ধে। সেলিম, দেলওয়ার, ডা. মিলন, বসুনিয়া, নূর হোসেন প্রমুখ শহীদদের বুক ঝাঁঝরা করা হয়েছিল এই স্বৈরশাসকের মসনদ বাঁচাবার জন্যই। ব্যাপক রক্তপাতের মাধ্যমে সৃষ্ট নব্বইয়ের গণআন্দোলন এরশাদের পতনের সূত্রপাত করে। তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান।
এটা জানা বিষয়, শেখ হাসিনা, এরশাদকে মহাজোটে না নিলে বিএনপি তাকে কাছে টানতো। আওয়ামী লীগ ব্রুট মেজরিটি পাওয়ায় জাতীয় পার্টির গুরুত্ব কমে যায়। এই অবস্থার মাশুল আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দিতে হতে পারে। সব মিলিয়ে যে কথাটি জরুরি তা হলো বর্তমান সরকারের সাবধানতা। একটা কথা আছে- ‘সামনে খাদ, সাবধানে চলুন’।
একথা ঘুরিয়ে বললে, বলতে হবে- সামনে নির্বাচন, সাবধানে পথ অতিক্রম করুন। দেশে রক্তপাত ঘটিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা যায় না। যাবেও না। তবে আবার যদি দেশে বাংলাভাই-শায়খ রহমানের মুনিবরা রাষ্ট্রক্ষমতা পায় তাহলে কী গতি হবে, তা ভাবতে হবে। মহাজোট সরকারের ব্যর্থতা আছে।
আছে সাফল্যও। এই সাফল্যের ইশতেহার নিয়ে গণমানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। ব্যর্থ এমপিদের সরিয়ে দিতে হবে প্রার্থিতা থেকে। কাজগুলো সহজ নয়।
কিন্তু এই কাজটি করতে হবে আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেই।
-------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা // : শনিবার, ১৫ জুন ২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।