ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে............... সারা বিচারস্হল একেবারে নীরব হয়ে আছে। দিগম্বর অজস্র মানুষদের মধ্যে থেকে একজন এসে ধীর পায়ে দাঁড়াল খোদ ঈশ্বরের সামনে। ঈশ্বর সেই মানুষটির আমলনামা খুলে হাতে তুলে নিলেন।
ঈশ্বর এরপর শুরু করলেন, 'তোমার সমস্ত জীবন বিস্তর মন্দ দ্বারা পূর্ণ ছিল। যাহারা তোমার দয়ার আশায় বসিয়াছিল, তাহাদের প্রতি তুমি নির্দয় ছিলে জীবনভর।
যে অসহায় মানব সকল তোমার দ্বারে প্রেরিত হইয়াছিল, তুমি তাহাদের পানে অন্তর খুলিয়া কভু তাকাও নাই। যাহাদের সম্বল নাই তাহারা বিপন্ন হইয়া যখন তোমার নাম ধরিয়া ডাকিত, তুমি কর্ণদ্বয়ের কবাট বন্ধ করিয়া বসিয়া ছিলে দ্বিধাহীন। এতিমের সম্পদ তুমি জোরপূর্বক নিজের করিয়া নিয়াছ। তোমার গৃহের নিকটে যেই সমস্ত প্রতিবেশি ফসল ফলাইত, তা বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে ছাগলটি, বলদটি ছাড়িয়া দিতে সকাল-বিকাল। শিশুর মুখের খাবার কাড়িয়া কুকুরকে খাওয়াইয়াছ।
নির্জনে পড়িয়া যেইসকল কুষ্ঠরোগী আমার নাম জপিত, তুমি তাহাদের তাড়াইয়া পথে নিয়া তুলিতে। যেই মাটি হইতে তোমকে সৃজন করিয়াছিলাম, সেইখানে তুমি রক্তের পর রক্ত ঝরাইয়াছ।
মানুষটি সকল অভিযোগ স্বীকার করে নিল।
আমলনামায় চোখ রেখে ঈশ্বর পুনরায়, 'তোমার জীবন মন্দে মন্দে ছাইয়া গিয়াছিল। আমার দানকৃত সৌন্দর্য তুমি এড়াইয়া চলিয়াছ।
তোমার গৃহে দেয়াল জুড়িয়া ছিল বিচিত্র সব ছবি। বাঁশির সুরে তোমার ঘুম ভাঙিত। সে সব পাপকে আমি বিতাড়ন করিতে চাইয়াছিলাম , তাহাদের মন্দির গড়িয়া তুমি নিত্য অর্ঘ্য দিয়াছ। যাহা খাইতে বারণ করিয়াছিলাম, খাইয়াছ। স্বর্ণে নহে, চাঁদিতে নহে, রক্ত আর মাংসের প্রতিমা সাজাইয়াছিলে।
তাহাদের হাত ভরিয়া দিয়াছ ডালিম ফুল। পায়ে আলতা পরাইয়া ঝলমলে গালিচা বিছাইয়া দিয়াছ পায়ের তলায়। চক্ষের কোল ভরিয়াছ রূপালি রঙে আর তাহাদের গায়ে ছিটাইয়াছ চন্দনের বাস। সমস্ত করিয়া তারপর তাহাদের পায়ে লুটাইয়া পড়িয়াছ ভরা রোদের আলোয়। দিনের আলো আর রাতের চন্দ্র তোমার প্রলাপ শুনিয়া বারবার লজ্জা পাইত।
'
মানুষটি এবারও সব কিছু মেনে নিল।
তৃতীয়বারের মতো ঈশ্বর লোকটির আমলনামা সামনে রাখলেন।
'তোমার জীবনের সবটুকুতে মন্দ বৈ আর কিছুই ছিল না। খারাপের জন্যে তুমি ভালোর সঙ্গ ছাড়িয়াছ। যে হাত দু'খানি তোমাকে আহার দিয়াছে, তুমি তাহাতে আঘাত করিয়াছ।
যাহার স্তন পান করিতে, তাহাকে পরে ঘৃণা করিয়াছ। জলের ভরা পাত্র তোমাকে দান করিতে আসিয়া অনেক মানুষ শুকনা মুখে চলিয়া গিয়াছে। রাত্রে যে তোমাকে বিপদ হইতে আশ্রয় দিয়াছে, ভোর না হইতেই তাহার অনিষ্ট করিয়াছ। যে শত্রু তোমাকে হত্যা না করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে, তাহাকে আবারও ফাঁদে ফেলিতে উদ্যত হইয়াছ। যে বন্ধু তোমার হ্ত ধরিয়া হাঁটিত, তাহাকে বিক্রি করিয়া খাইয়াছ।
ভালোবাসার বিনিময়ে তুমি বরাবর কাম আর লালসা দিয়াছ। '
মানুষটি সব দোষ স্বীকার নিল আরও একবার।
ঈশ্বর এবারে আমলনামা বন্ধ করে বজ্রকণ্ঠে বললেন, ' তোমাকে আমি অবশ্যই নরকে প্রেরণ করিব। নরক ভিন্ন তোমার আর কোনখানে ঠাঁই হইবে না। '
মানুষটি জোরগলায় বলল, 'আপনি তা করতে পারবেন না।
'
ঈশ্বর খানিক বিস্মিত হলেন। 'কেন পারিব না? তোমাকে নরক হইতে নিস্তার দিবার কোনই কারণ নাই। '
মানুষটি গলা ছাড়ল। 'কারণ সারা জীবন আমি নরকেই বাস করেছি। '
শেষ বিচারের গৃহে গাঢ় নীরবতা নেমে এল।
খানিক পরে ঈশ্বর স্বয়ং জবান খুললেন। ' যদি আমি তোমাকে নরক নাহি দিতে পারি, তবে স্বর্গই হইবে তোমার চিরকালের ঘর। আমি তোমাকে তাই স্বর্গে পাঠাইব। '
গলায় আরও খানিক জোর এনে লোকটি বলল, 'পারবেন না। '
বিস্ময়ে সবজান্তা ঈশ্বর পুনরায় প্রশ্ণ করে বসলেন।
'পারিব না কেন?'
'কারণ কোন সুখকেই, কোন স্হানকেই আমি স্বর্গ ভাবতে পারি না। '
লোকটির এমন উত্তরে বিস্ময়চাপা গাঢ় নীরবতা ছেয়ে গেল সমস্ত বিচারালয় জুড়ে।
আলোকচিত্র: 'দ্য লাস্ট জাজমেন্ট' (১৯৮৭) বাই জন মার্শভেল্ড
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।