চিত্ত যেথা ভয়শূন্য ছেলেবেলায় আমাদের স্কুলে কালিপদ নামে এক দপ্তরি ছিল। নানা কাজের পাশাপাশি তার একটি কাজ ছিল স্কুলে ঘণ্টা বাজানো। একেক সময়ের জন্য একক রকম ঘণ্টা। তাল, লয়, সুর সবকিছুই আলাদা। লাইনে দাঁড়ানোর ঘণ্টা, ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা, টিফিনের ঘণ্টা আর ছুটির ঘণ্টা।
শব্দ শুনেই বুঝতাম। অকস্মাৎ ছুটির ঘণ্টা বাজলেই অনাবিল উচ্ছ্বাসে ভরে যেত মনটা। ছুটির ঘণ্টা বাজানোর পাশাপাশি অন্য একটি আকর্ষণ ছিল কালিপদের; সে ছিল দীর্ঘদেহী, শ্মশ্রুমণ্ডিত এবং কাঁধ ছাড়িয়ে কোঁকড়ানো লম্বা চুলে তাকে কেন যেন ঋষি ঋষি লাগত। এভাবে ঘণ্টা বাজানো শুনতে শুনতে এক সময় স্কুল ছাড়ার ঘণ্টা বাজল। তীব্র কষ্ট পেয়েছিলাম।
বড় হয়ে যাওয়ার কষ্ট। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, কৈশোর পেরিয়ে যৌবন। অলক্ষ্যে কেউ সময়মতোই ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। এখন কষ্ট ফেলে আসার; সেই ঝলমলে তারুণ্য। কষ্ট অতিক্রম করার; দুরন্ত যৌবন।
জীবনের অমোঘ পরিণতি। নির্মম অথচ স্বাভাবিক এই নিয়মটা কিন্তু মানুষ অবচেতনে মেনে নিতে পারেনি। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ কল্পনা করে এসেছে এমন এক অমৃতের, যা দিয়ে চিরযৌবন লাভ করা যায়। এ অমৃতের সন্ধান চলছে সেদিন থেকেই, যেদিন থেকে আদি পুরুষ চার পায়ের বদলে দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে শিখেছিল। অমৃতের সন্ধান মানুষ পায়নি কিন্তু দীর্ঘ জীবন লাভের সূত্রগুলো মানুষ একে একে আবিষকার করে ফেলেছে।
দারুণ চমকপ্রদ সেসব আবিষকার।
দীর্ঘ জীবনের জন্য প্রত্যাশা আর স্বপ্ন যুগে যুগে পালন করলেও মাত্র ১৯৬১ সাল থেকে দীর্ঘ জীবনের জন্য গবেষণার আধুনিক যুগ শুরু হয়। লিওনার্ড হেফ্লিক একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষকার করেছিলেন। ‘কোথায় শুরু হয় বুড়িয়ে যাওয়া। ’ এটা বের করার জন্য হেফ্লিক কিছু ভ্রূণ কোষ একটি পেট্রিডিশে রাখলেন।
বুঝতেই পারছেন, এই ভ্রূণ কোষগুলোর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই ছিল না। যেমন ধরুন একটি জটিল জীবন্ত প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অপরিমেয় যে সমস্ত কাজ দেহকোষগুলোকে করতে হয় সেগুলো। কাজ ছিল শুধু একটিই। জীবন্ত কোষের আদি এবং অকৃত্রিম কাজ। তা হলো অবিরাম বিভাজিত হওয়া।
কোষগুলো বিভাজিত হতে থাকল। দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে আট, আট থেকে ষোল ঠিক এভাবেই একই গতিতে বিভাজন চলল, বেড়ে চলল কোষের সংখ্যা। কিন্তু পঞ্চাশের বিভাজিত হওয়ার পর হঠাৎ থমকে পড়ল। কোষগুলো কেমন যেন বুড়িয়ে যাওয়ার মতো আচরণ করতে লাগল। কম খাবার খেতে লাগল, কোষের প্রাচীরগুলো নষ্ট হয়ে যেতে লাগল।
এরপর হেফ্লিক ঠিক একই ধরনের আরেকটি পরীক্ষা করলেন। তবে পার্থক্য হলো, এবার তিনি নিলেন সত্তর বছর বয়সী বুড়োর দেহকোষ। এবারে অবাক কাণ্ড, কোষগুলো বিশবার কোনোমতে বিভাজিত হওয়ার পরেই বুড়িয়ে যেতে শুরু করল।
ঘটনার অর্থ কিন্তু যুগান্তকারী। অর্থাৎ প্রতিটি কোষেই থাকে একটি অ্যালার্ম দেয়া ঘড়ি।
কালিপদের মতো সময়মতো ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। এরপর আর এক মুহূর্তও নয়। এই কালিপদকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? তাহলে সময় শেষ হলেই আবার নতুন করে অ্যালার্ম সেট করে নেয়া যেত। আজ পর্যন্ত বুড়িয়ে যাওয়ার যত কারণ পাওয়া গেছে সেগুলো সবগুলোর নিদান হয়তো মেলেনি তবে যতগুলোর পাওয়া গেছে সে অনুযায়ী মানবজাতি চললে আগামী দুই হাজার বিশ সাল নাগাদ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু হবে আশির ওপরে আর এখন তা সত্তরের নিচে। এবার দেখা যাক বুড়িয়ে যাওয়ার কারণগুলো কী কী? জীবনের জন্য শক্তি কিছু উৎপাদিত হলে তার কিছু বর্জ্য থাকে।
যেমন থাকে কারখানায়। তেমনি আমরা শরীরে অক্সিজেনের মাধ্যমে বিপাকক্রিয়া সম্পাদন করে শক্তি উৎপাদন করি। এই বিপাকের সময় কিছু কিছু অক্সিজেন অণুর একটি ইলেকট্রন ছিটকে যায়। জন্ম নেয় অতি বিধ্বংসী ফ্রি রেডিকেলের। যেহেতু ফ্রি রেডিকেলের একটি ইলেকট্রন কম থাকে সেহেতু রাসায়নিকভাবে ফ্রি রেডিকেল অতি সক্রিয়।
যেখানে ফ্রি রেডিকেল তৈরি হয় সেখান থেকেই সে খুবলে নেয় ইলেকট্রন; শুরু হয় অপ্রতিরোধ্য ভাঙন। সমস্ত জীবন ধরে ফ্রি রেডিকেলের এই ভাঙন থেকেই জন্ম নেয় প্রাণঘাতী ক্যান্সার, হৃদরোগ, এমনকি বুড়িয়ে যাওয়ার সাধারণ লক্ষণ যেমন-চামড়া কুঁচকে যাওয়া বা বাতব্যথা, চোখের ছানি ইত্যাদি।
তবে খুব বেশি ভয় নেই। এই প্রাণঘাতী ফ্রি রেডিকেলের আক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিনগুলো। যেমন- ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন ই।
কোষীয় বিপাকের আরেকটি ক্ষতিকর বর্জ্য হচ্ছে গ্লাইকোসাইলেশন। কাবাব বানানোর সময় বা পাউরুটি টোস্ট করার সময় আগুনের আঁচে যে বাদামি রঙ তৈরি হয় সেটিই হচ্ছে গ্লাইকোসাইলেশনের মোক্ষম উদাহরণ। তাপে প্রোটিন, শর্করার সঙ্গে মিশে আঠালো, কিঞ্চিত নরম এক যৌগ তৈরি করে। ঠিক এই বিক্রিয়াটিই ঘটে ডায়াবেটিক রোগীদের। যখন প্রোটিন এবং শর্করা মিলে যায় তা অন্যান্য প্রোটিনকেও আকৃষ্ট করে তৈরি হয় আঠালো, মাকড়সার জালের মতো বস্তু-যা হাড়ের জোড়ার মধ্যে জমে বাত সৃষ্টি করতে পারে, রক্তনালি বন্ধ করে দিতে পারে, স্বচ্ছ কোষকলাকে ঘোলা করে দিতে পারে।
যেমন চোখের লেন্স। ঠিক এই ঘটনাগুলোই ঘটে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এর সাথে বুড়িয়ে যাওয়ার সম্পর্ক কী? সম্পর্ক হচ্ছে যারা ডায়াবেটিক নন তাদেরও শর্করা বিপাক করতে হয় এবং এই বিক্রিয়া ঘটে তাদের শরীরে, তবে ধীরগতিতে।
কিছুদিন আগে একটি নতুন ওষুধ আবিষকার হয়েছে যার নাম ‘পিমাজিডিন’। গবেষণা চলছে তুমুল।
দেখা গেছে ‘পিমাজিডিন’ একই সঙ্গে ডায়াবেটিস এবং গ্লাইকোসাইলেশনের বিরুদ্ধে কার্যকর। অর্থাৎ বুড়িয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধেও। কোনো মেদ-চর্বি নয়, কম খেলে বেশিদিন বাঁচা যায়। কোনো আজব কথা নয়, একেবারে গবেষণায় প্রমাণিত। এক গবেষণায় কিছু ইঁদুরকে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০-৪০ ভাগ কম খাবার দেয়া হতো লাগল।
দেখা গেল, অন্যান্য ইঁদুর, যেগুলো স্বাভাবিক খাবার খেয়েছিল তাদের চেয়ে উপোস দেয়া ইঁদুরগুলোর আয়ু ছিল ৪০ ভাগ বেশি। মানুষের ক্ষেত্রেও একই পরীক্ষায় দেখা গেল, দৈনিক ১৫০০ কিলোক্যালরি গ্রহণ করলে আয়ু ৩০ বছর পর্যন্ত বাড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি একজন মানুষের দৈনিক ক্যালরি চাহিদা ২২০০-২৪০০ কিলোক্যালরি। ঠিক কীভাবে এটি ঘটে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও কিছু অনুমান করা গেছে। যদি খাবার কমিয়ে দেয়া যায় বা রোজা বা উপোস রাখা হয় তবে শরীরের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মতো হ্রাস পায়।
কম তাপমাত্রার অর্থ হচ্ছে কম বিপাক। তার অর্থ হচ্ছে কম পরিমাণ খাদ্য শরীরের ভেতরে প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। শরীরী ভারসাম্য তখন বাড়ন্ত অবস্থা থেকে সুইচ-ওভার করে সারভাইভাল মুডে। যেহেতু শরীর কম ক্যালরি পাচ্ছে তাই ক্যালরিও পুড়বে কম। মেরিল্যান্ডের ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এজিং’-এর প্রফেসর জর্জ রথ বলেন, ‘আমরা শুধু উপোস দিয়েই আশি বছরের ওপরে বেঁচে থাকতে পারব।
’ তিনি ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘আপনারা কি কোনো শতায়ুকে দেখেছেন যিনি মোটা। ’
তবে ভোজনরসিক মানুষকে ঠেকাবে কে? ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে বাঁচার আনন্দ অনেকটাই মাটি হয়ে যাবে যদি না খেয়ে আয়ু বাড়াতে হয়। এবারেও দুশ্চিন্তা নেই এমন একটি ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে যা দেহের কোষগুলোর সঙ্গে একটি ছোট প্রতারণা করবে। মানুষটি যতই গিলে থাকুক না কেন কোষের কাছে বার্তা পাঠাবে ‘শরীরে অল্প খাবার আসছে’। প্রতিক্রিয়া একই, বেচারা কোষ ভাববে ‘বেটা উপোস করার সময় পেল না।
’
জুতোর ফিতের মাথায় প্লাস্টিক
হেফ্লিক একটি প্রশ্নের জবাব পরিষকারভাবে বলতে পারেননি তা হচ্ছে, ‘কেন একটি কোষ মারা যায়?’ এর উত্তরে বিজ্ঞানীরা চোখ ফেরালেন জিনের দিকে-যেখানে লেখা থাকে জীবের খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না, একটি জিনিস ছাড়া। তা হচ্ছে ক্রোমোজমের মাথায় ছোট একটু অংশ ঠিক জুতোর ফিতের মাথায় যে প্লাস্টিকের আবরণ থাকে তার মতো। এর কোনো সুনির্দিষ্ট কাজও নেই। বিজ্ঞানীরা নাম দিলেন এর ‘টেলোমেয়ার’।
প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় এই ‘টেলোমেয়ার’ একটু করে কমে যায় এবং সবশেষে সেই যে হেফ্লিক বলেছিলেন, ‘পঞ্চাশ বার বিভাজিত হওয়ার পর শুরু হয় বুড়িয়ে যাওয়া। ’ ঠিক পঞ্চাশ বারের কাছাকাছি সময়ে এসে বিভাজিত কোষে আর দৃশ্যমান ‘টেলোমেয়ার’ থাকে না।
মাত্র কয়েক ধরনের কোষে পর্যাপ্ত ‘টেলোমেয়ার’ থাকে আর তা হচ্ছে ক্যান্সার কোষ এবং পুরুষের শুক্রাণু। এগুলো পঞ্চাশবার কেন হাজার বার বিভাজিত হতে পারে। এরপর বিজ্ঞানীরা বের কররেন সেই এনজাইম যা ‘টেলোমেয়ারকে’ নষ্ট হতে দেয় না।
‘টেলোমেরেজ’। কী আশ্চর্য! এর পাঁচ বছরের মধ্যেই এই একই এনজাইম আবিষকৃত হলো ক্যান্সার কোষের মধ্যে। মৃত্যুর কোলে শাশ্বত জীবনের প্রতিশ্রুতি। ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে। তবু আনন্দ, তবুও শান্তি, তবু অমৃত জাগে।
’
আজব কৃমি
সেজয়েড হেকেমি নিজস্ব জেনেটিকস ল্যাবরেটরিতে এক ধরনের আজব কৃমি তৈরি করেছেন-যা প্রায় পঁচাত্তর দিন বাঁচে। বস্তুত এই কৃমিগুলো স্বাভাবিকভাবে বড়জোর নয় দিন বাঁচে। হেকেমি এই কৃমিগুলোকে তৈরি করেছেন কৃমিগুলোর বংশের দীর্ঘায়ু, কৃমিগুলোর ক্রমাগত প্রজননের মাধ্যমে। এরপর খুঁজেছেন জিনে কোনো অসঙ্গতি আছে কি না। পেয়ে গেলেন।
স্বাভাবিকভাবে নয়দিন বাঁচে যে কৃমিগুলো সেগুলোর জিনে আছে একটি বিকৃত অংশ। এই তো অ্যালার্ম ঘড়ি! মানুষের শরীরে খুঁজলেন হেকেমি। ফলাফল অভূতপূর্ব সেই একই ঘড়ি ‘বিকৃত জিন’।
এ তো গেল একটি ঘড়ি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের মতে এমন ঘড়ি আছে কমসে কম ৭০০০টি।
প্রতিটি ঘড়িকে রিসেট করার মতো প্রযুক্তি এখনো তৈরি হওয়ার অপেক্ষায়।
মানবজাতির পক্ষে অমরত্ব লাভ করা হয়তো সম্ভব হবে না। কেননা এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তবে গবেষণার এই ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত যা প্রাপ্তি তাতে মানবজাতির গড় আয়ু বেড়ে যাবে দশ থেকে বিশ বছর এটা নিশ্চিত। এর পরের পর্ব হচ্ছে দীর্ঘ যৌবন।
কালিপদ ঘণ্টা বাজাবে আরো ধীরে। অনেক বেশি দিন উপভোগ করব অপরূপ পৃথিবীর রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধ। সেই পরশমণির ছোঁয়ায় আমাদের জীবন পুণ্য হোক-ধন্য হোক।
(৯০ এর দশকে আজকের কাগজে প্রকাশিত এই লেখাটি পরবর্তীতে "বালাই ষাট" বইয়ে সংকলিত হয়েছে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।