বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ আজীজ চাচা বললেন, বাড়ির পিছনে কবরখানা আছে সালমা। ঐ দিকে তর যাওনের দরকার নাই । জায়গাটা ভালো না।
বুঝলি? কী দেখতে কী দেখবি। শ্যাষে ভয় পাবি।
আইচ্ছা। বলে সালমা চুপ করে থাকে।
আজ সকাল থেকেই চারিদিকে ঝরঝরে রোদ ছড়িয়ে আছে।
শ্রাবণ মাসে হঠাৎ হঠাৎ এমন ঝলমলে রোদের দিনের দেখা মেলে। আজীজ চাচা একতলার বারান্দায় বসে গায়ে সর্ষের তেল মালিশ করছিলেন। মাঝারি উচ্চতার থলথলে শরীর। গায়ের রং ধবধবে ফরসা। বয়স ষাটের কাছাকাছিই হবে ।
মাথায় টাক নাকি মাথা মসৃণভাবে কামানো-ঠিক বোঝা যায় না। ভরাট গাল মসৃণভাবে কামানো। চোখ দুটির কোণে ঘন কালির ছোপ। গাঢ় অনিদ্রার চিহ্ন।
আজীজ চাচা দূর্গাবাড়ির বনেদি সিকদার বংশের সন্তান।
এক সময় নাকি সিকদারবাড়ির অবস্থা ভালোই ছিল। আজীজ চাচা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। দীর্ঘদিন হল চাকরি ছেড়ে কবিরাজী চিকিৎসা করছেন। হোমিওপ্যাথি ট্রিটমেন্টও করেন। দূরদূরান্তে যান রোগী দেখতে।
তেল মাখতে মাখতে আজীজ চাচা বললেন, তর নাকি লেখাপড়ায় মাথা ভালো?
সালমা চুপ করে থাকে। কথাটা সত্য। সালমা এসএসসি-তে ভালো রেজাল্ট করেছে। তবে এই কথাটা ও বলতে পারে না।
আজীজ চাচা বললেন, ঠিক আছি।
তরে আমি কলেজে ভর্তি করায়া দিমু । খালি বাড়িত থাইকা করবি কী। আমি সারাদিন বাড়িত থাকি না।
কথাটা শুনে সালমা ভারি খুশি হয়ে ওঠে। বাবা মারা যাওয়ার পর পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার আশংকায় দিশেহারা ।
অজ পাড়াগাঁর গরিব ঘরের মেয়ে সালমা। বাবা মারা যাওয়ার পর চোখেমুখে অন্ধকার দেখছিল। ছোট থাকতেই মা মারা গিয়েছিল । ভাইবোনও নেই। আজীজ চাচা সালমার বাবার দূরসর্ম্পকের চাচাতো ভাই।
গ্রামের হেকিম নুরু মিঞা আজীজ চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করে দিন কয়েক আগে সালমাকে সিকদারবাড়িতে রেখে গেছে। সিকদার বাড়িতে কাজের লোকজন নেই বলে সালমা অবাক হয়েছিল। আজীজ চাচা বললেন, আমি একা মানুষ । রান্নাবান্না আমিই করি।
সালমা দোতলায় ওর ঘরে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়ায়।
তারপর ভাঙাচোরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সিকদার বাড়ির ভগ্নদশা। বেশ পুরনো দোতলা দালান। বাড়ির পিছনে গাছপালার ঘন জঙ্গল। দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায়-বড় একটি কড়ুই গাছ।
পিছনে বাঁশঝাড়। সিকদার পরিবারের পারিবারিক গোরস্থান ওদিকেই । গোরস্থানে আজীজ চাচার স্ত্রী রাবেয়া চাচীর কবর। সালমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাবেয়া চাচী ভীষণ সুন্দরী ছিলেন।
ফরসা। আর বড় ভালো মানুষ ছিলেন রাবেয়া চাচী; সালমাকে ভীষণ আদর করতেন। একবার বললেন, ভালো করে পড় মা। তুই ভালো করে মেট্রিক পাস করলে তোরে আমি দূর্গাবাড়ি নিয়া কলেজে ভর্তি করায়া দিব।
আজীজ সিকদার দূর্গাবাড়ি ইব্রাহীম কাদের কলেজে সালমা কে ভর্তি করিয়ে দিলেন ।
বড় একটা মাঠের চারপাশে হলুদ রঙের দোতলা দালান। পিছনে নারকেল গাছ ঘেরা টলটলে জলের পুকুর। কলেজটা সিকদারবাড়ির কাছে না হলেও, অনেক দূরেও না অবশ্যি। হেঁটেই আসা যায়।
প্রথম দিন কলেজে পৌঁছতেই শুরু হল ধুম বৃষ্টি।
ক্লাসরুমে অল্প পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছিল। ছাত্রছাত্রী সবাই গম্ভীর ভাবে বসেছিল । আকাশ ভীষণ মেঘলা হয়ে ছিল। শ্যামলা চেহারার একটি মেয়ে আর ফরসা চেহারা একটি মেয়েলি ধাঁচের ছেলের সঙ্গে পরিচিত হল সালমা। ইংরেজির অধ্যাপক নৃপেন চন্দ্র বসাক ক্লাসে ঢুকলেন।
ঢুকেই রোল কল করতে শুরু করলেন। তারপর পড়াতে আরম্ভ করলেন । যেন এটি প্রথম ক্লাস নয়!
স্যারের লেকচার শুনতে শুনতে আড়চোখে পাশের বেঞ্চের ওপর বসা একটি ছেলের দিকে চোখ গেল সালমার। ও কেঁপে ওঠে। শ্যামলা রঙের মিষ্টি চেহারার চশমা পরা ছেলেটির মাথায় কোঁকড়া চুল।
পরনে সবুজ রঙের হাফ হাতা শার্ট । কি নাম ওর? বড় জানতে ইচ্ছে করছে। সালমা অস্থির বোধ করে । নৃপেন স্যার কী বলছেন- কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
সেদিনই কলেজ ছুটির পর রেললাইনের কাছে ছেলেটিকে দেখতে পেল সালমা।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেলেও রাস্তায় পানি জমে ছিল। ছেলেটি সিগারেট খাচ্ছে না দেখে সালমা স্বস্তি পায়। ওর কল্পনার রাজপুত্র সিগারেট খায় না। সালমাকে দেখে হাসল ছেলেটি। তারপর এগিয়ে আসে ।
বেশ সপ্রতিভ ভাবে বলল, আমার নাম শ্যামল। আপনি?
আমি সালমা।
ও। আপনাকে এর আগে কখনও দেখিনি। আপনি কি এই শহরেই থাকেন?
হ্যাঁ।
কোন্ বাড়ি?
সিকদার বাড়ি।
কথাটা শুনে শ্যামলের মুখের ভাব কেমন বদলে গেল। ভয় পেয়েছে বলে মনে হল। দ্রুত পা ফেলে শ্যামল চলে যায়। কি হল? সালমা অবাক।
সিকদার বাড়ি নাম শুনে শ্যামল ভয় পেল কেন। সালমা লক্ষ্য করেছে সিকদারবাড়িতে লোকজন তেমন আসে না। পায়রার বদলে দালানের কার্নিসে বসে থাকে কাক । মাঝেমধ্যেই উঠানে কোত্থেকে একটা কালো কুকুর চলে আসে। কুকুরটা মনে হয় পিছনে জঙ্গল থেকে আসে।
আজীজ চাচাকেও মাঝেমধ্যে পিছনের জঙ্গলে যেতে দেখেছে সালমা।
কলেজে সালমা লক্ষ্য করল শ্যামল ওকে এড়িয়ে চলে। অথচ শ্যামল ওর সঙ্গোপন কল্পনায় আসে ...
দিন কয়েক পর সিঁড়িতে দোতলায় ওঠার পর বাংলার অধ্যাপক মোশাররফ সালমাকে ডাকলেন, এই মেয়ে, শোন।
অধ্যাপক মোশাররফ-এর মাথায় ধবধবে পাকা চুল। গায়ের রং কিছুটা তামাটে।
পরনে সাদা পায়জামা; সিলকের পাঞ্জাবি। কাঁধে একটি ঝোলা। সারাক্ষণ পান চিবান অধ্যাপক মোশাররফ।
সালমা বলল, জ্বী স্যার।
তুমি কি সিকদার বাড়ির মেয়ে?
জ্বী স্যার।
কথাটা শুনে অধ্যাপক মোশাররফ অবাক হয়ে সালমার কপালে কী যেন দেখলেন। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন, হুমম। তা আজীজ সিকদার তোমার কে হয়?
আমার বাবার চাচতো ভাই। অবশ্য দূর সর্ম্পকের। আমি আগে গ্রামে ছিলাম স্যার।
আমার বাবা- মা বেঁচে নেই। এখন আজীজ চাচার বাড়ি থেকে পড়ছি।
ও। এবার বুঝেছি। বলে অধ্যাপক মোশাররফ চলে যান।
ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় অধ্যাপক মোশাররফ । তার কারণ আছে। অধ্যাপক ক্লাসে পাঠ্যবই তেমন পড়ান না। তার বদলে আধিভৌতিক বিষয়ে আলোচনা করেন। অধ্যাপক মোশাররফ- এর ছেলেবেলা থেকেই অতিপ্রাকৃত বিষয়ে গভীর আকর্ষন ছিল।
রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার আশায় পরিত্যক্ত পুরনো বাড়িতে, শ্মশানে-কবরে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
হয়তো কোনও ছাত্র জিজ্ঞেস করল, আপনার কি কখনও ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে স্যার?
হুমম। হয়েছে।
হয়তো আদুরে কন্ঠে কোনও ছাত্রী বলল, বলুন না স্যার শুনি।
অধ্যাপক মোশাররফ বলেন, বললে তোমরা ভয় পাবে।
তোমাদের ভয় পাওয়ানো আমার উদ্দেশ্য হতে পারে না। শোন। আমি কিশোর বয়েসে আসামের কামরূপ কামাখ্যায় গিয়েছি। তারপর তরুণ বয়েসে কালীগঞ্জের জামশেদ পীর-এর শিষ্যত্ব বরণ করেছি। জামশেদ পীর-এর চিল্লাবাড়ি তে নানা রঙের বেড়াল।
আসলে ওগুলি জিন।
অধ্যাপক মোশাররফ ছাত্রছাত্রীদের ভৌতিক অভিজ্ঞতা শোনেন। অনেক সময় লিখেও রাখেন।
অধ্যাপক মোশাররফ একদিন ক্লাসে সালমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই মেয়ে, তোমার ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বল।
আমার তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি।
সালমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
আচ্ছা। বোস । বলে অদ্ভূত দৃষ্টিতে সালমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অধ্যাপক মোশাররফ।
সেদিন রাতেই সালমার ভৌতিক অভিজ্ঞতা হল ...
পরদিন টিফিন পিরিয়ডে অধ্যাপক মোশাররফ কে দেখল টির্চাসরুমের দিকে যাচ্ছেন।
দ্রুত পায়ে সালমা এগিয়ে গিয়ে বলল, স্যার।
ও তুমি? তুমি সিকদার বাড়ির মেয়ে না?
জ্বী, স্যার।
বল কী বলবে?
আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল স্যার।
বল শুনি। কী বলবে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে সালমা চাপাকন্ঠে বলল, গতরাত্রে আমি স্যার রাবেয়া চাচী কে দেখলাম। কিন্তু, স্যার, রাবেয়া চাচী তো বেঁচে নেই।
হুমম। জানি। তিনি গত বছর এপ্রিল মাসে মারা গিয়েছেন।
আচ্ছা। আজ ছুটির পর তুমি আমার বাড়িতে একবার এসো। আমি থাকি ঘোষপাড়া। রেললাইন পেরিয়ে পশ্চিম দিকে। লোকজনকে বললেই দেখিয়ে দেবে।
একটা মুদী দোকানে অধ্যাপক মোশাররফ-এর কথা বলতেই বুড়ো দোকানি বাড়িটা দেখিয়ে দিল। আস্তরহীন দেওয়ালের মাঝখানে সবুজ রং করা সদর কাঠের দরজাটি ভেজানোই ছিল। সালমা ভিতরে ঢুকে দেখল পরিচ্ছন্ন বাগান। নারকেল, আতা, জামরুল আর কলার ঝোপের ওপাশে সাদা রঙের পুরনো একটি একতলা দালান । সালমা শুনেছে ঘোষপাড়ার বাড়িতে চিরকুমার অধ্যাপক মোশাররফ একাই থাকেন।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে বারান্দায় উঠে এল সালমা। দরজা ভেরানো ছিল। দরজার পাল্লা ঠেলে সালমা যে ঘরটিতে ঢুকল সে ঘরে আগরবাতির তীব্র গন্ধ। অবশ্য এ ঘরে অধ্যাপক মোশাররফ নেই। মোশাররফ স্যার কোথায়? ঘরটিকে তিন-চারটি বইয়ের আলমারী আর বেতের সোফা।
সোফার ওপর সাদা, কালো ও নীল রঙের তিনটে বেড়াল ঘুমাচ্ছে। । নীলরঙের বেড়াল? আশ্চর্য!
লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে অধ্যাপক মোশাররফ পিছনে বারান্দায় মোড়ার ওপর বসে ছিলেন। মেঝের ওপর একটি পিকদানী আর কয়েকটি কৌটো। কৌটোর পাশে সাতটা বেড়াল পাশাপাশি বসেছিল।
একটা বেড়ালের রং সাদা তো পাশের বেড়ালের রং কালো, পরেরটার রং সাদা, আবার পরেরটার কালো-এভাবে। সালমা অবাক হল। বেড়ালগুলির পাশে কয়েকটা ছোট আকাশের বর্শা। বর্শার মাথায় তীক্ষ্ম ইস্পাতের ফলা; কালো রঙের মজবুত কাঠ আর ফলার মাঝখানে তামা র রিং বসানো।
অধ্যাপক মোশাররফ মোড়া দেখিয়ে বললেন, বোস ।
সালমা বসল। এদিক ওদিক তাকাল । ওপাশে ছোট একটি উঠান ঘিরে ঘন গাছপালার জঙ্গলের ওপর অপরাহ্ণের আলো ছড়িয়ে আছে।
অধ্যাপক মোশাররফ ঝুঁকে একটি রূপার কৌটো তুলে নিলেন। তারপর কৌটো খুলে পান বের করে মুখে ফেলে চিবাতে চিবাতে বললেন, বলত তো শুনি।
ঠিক কী হয়েছিল গতরাত্রে।
সালমা বলল, ইয়ে ... মানে-গত রাতে রাত দশটার দিকে আমি রান্নাবান্না সেরে ভাত-তরকারি টেবিলে বেড়ে ঘরে আসতেই কারেন্ট চলে যায়। মোম জ্বেলে পড়তে ইচ্ছে করছিল না। বিছানায় শুয়ে পড়ি। ঘরে অন্ধকার।
হঠাৎ মিষ্টি গন্ধ পেলাম।
কেমন গন্ধ?
বেলি ফুলের গন্ধ স্যার ।
তারপর?
তারপর পাশের ঘরে দেখি আবছা আলো। ওই ঘরটাই খাবার ঘর। কি ব্যাপার? আজীজ চাচা তখনও ফেরেননি।
কারণ কোনও শব্দ হয়নি । চোর-টোর এল না তো। এই ভেবে উঠে দরজার কাছে দেখি রাবেয়া চাচী ...
অধ্যাপক মোশাররফ কী বলতে যাবেন - বারান্দায় শ্যামল এল । সালমাকে দেখে অবাক। সালমার বুক ধক করে ওঠে।
ও কি আমাকে কলেজ থেকে ফলো করেছে? শ্যামলের পরনে কালো টিশার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট। ভ্যাপসা গররে শ্যামল ঘেমে গেছে।
মোড়া দেখিয়ে অধ্যাপক মোশাররফ বললেন, বোস, শ্যামল।
শ্যামল বসল।
অধ্যাপক মোশাররফ বললেন, সালমা, এ শহরে আমার একজনই শিষ্য রয়েছে।
সে হল এই শ্যামল। মনে রাখবে- দুনিয়ায় শুভ আর অশুভের মধ্যে লড়াই চলছে। আমার উস্তাদ জামশেদ পীর সারাজীবন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। লড়াই আমিও করেছি। আমি আমার উস্তাদ জামশেদ পীরের কাছে যা শিখেছি তাই শ্যামলকে শিখাচ্ছি।
শ্যামল?
জ্বী স্যার, বলেন।
আমি সালমার একটি ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা শুনছি। হ্যাঁ। এবার বল সালমা। বলে পিকদানীতে পানের পিক ফেললেন অধ্যাপক মোশাররফ।
সালমা একবার শ্যামলের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার,আমি কি প্রথম থেকে বলব?
না, না। যেখানে শেষ করেছিলে সেখান থেকে বল।
স্যার, আমি দেখলাম, রাবেয়া চাচী টেবিলের ওপর ঝুঁকে ঢাকনা তুলে ভাত-তরকারি দেখছেন। পরনে সাদা শাড়ি। শাদা ব্লাউজ।
আর ওই গন্ধটাও তীব্র হয়ে উঠেছে।
ঠিক কিসের গন্ধ বল তো?
বেলিফুলের গন্ধ স্যার।
তারপর?
তারপর রাবেয়া চাচী মিলিয়ে গেলেন। ভয়ে আমার হাত-পা হিম হয়ে আসছিল। আমি তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়ি।
তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ি। স্যার?
বল।
রাবেয়া চাচী একবার আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়তাম। রাবেয়া চাচীর খোঁপায় বেলিফুলের মালা দেখেছি।
বেলিফুল রাবেয়া চাচীর প্রিয়। আর রাবেয়া চাচী সব সময় সাদা শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ পরতেন।
হুমম।
স্যার, সিকদারবাড়িতে আমার ভয় হয়। সালমা বলল।
হুমম। কাল রাতে তুমি যা দেখেছো তাতে ভয় তো পাবেই । বলে অধ্যাপক মোশাররফ ঝুঁকে একটা কৌটো তুলে নিয়ে ঢাকনা খুলে ভিতর থেকে কী একটা বের করে সালমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা রাখ। আজই কাইতন দিয়ে বেঁধে কোমরে পড়বে। বলে সালমাকে ছোট্ট একটি রুপার তাবিজ দিলেন।
তাবিজটা নিতে নিতে সালমা জিজ্ঞেস করে, স্যার, রাবেয়াচাচী সত্যি কি এসেছিলেন?
মনে তো হয়। তবে এরপর ভয় পেলে তুমি সোজা আমার এখানে চলে এসো কেমন।
আচ্ছা, স্যার।
বাড়ি ফিরে সালমা দেখল আজীজ চাচা বাড়ি নেই। ও বাথরুমে যায়।
(কাইতন কিনে এনেছিল ও) কালো কাইতনে বেঁধে কোমরে তাবিজটা পড়ল। মুহূর্তেই কোমর থেকে সারা শরীরে একটা উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে যায়। আর শরীরটা অবশ লাগে। এর পর ওর সারা শরীর ঘামতে থাকে। সালমা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে বাথরুমের পলেস্তরা খসে খসে পড়ছে।
ভূমিকম্প? তখনও দিনের আলো ছিল। বাথরুমের ঘুলঘুলিতে হলুদ আলো। নীচে কবরখানার গাছপালায় চিৎকার করে কাক ডাকছে। সেই সঙ্গে একটা কুকুরের ভয়ঙ্কর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল ...
আজীজ চাচা সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাড়ি ফিরলেন । আজীজ চাচার চোখ লাল দেখে সালমা ভয় পেল।
ফরসা মুখটি কেমন আগুনের মতন গনগনে হয়ে আছে। কর্কস কন্ঠে আজীচ চাচা জিগ্যেস করলেন, তুই কখন বাড়ি ফিরছোস? সত্যি কইরা ক।
কলেজ ছুটির পর চাচা।
তাইলে এত কাক ডাকে ক্যান?
কেমনে কই।
সত্য কইরা ক, কই গেছিলি? সত্য কথা না কইলে রক্ত বমন কইরা মরবি কইলাম।
আমি কোথাও যাই নাই চাচা।
তাইলে সিকদার বাড়িত কে আইছিল ক? কালা কুত্তায় এত ডাক পারে ক্যান?
কেউ আসে নাই চাচা।
সত্য কইরা ক। নাইলে রক্ত বমন কইরা মরবি।
সত্য কথা বলতেছি চাচা।
বুঝছি। যা। অখন ঘরে যা।
সালমা দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরে আসে। ভয়ে কাঁপতে থাকে।
কী করবে বুঝতে পারছে না। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। ঘরে অন্ধকার জমে উঠছিল। শরীর তখনও ঘামছিল। শরীর জুড়ে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি।
ঘরে আতরে গন্ধ টের পেল ও। মনে হল ঘরে ও একা না। আরও কেউ আছে। যাকে সালমা দেখতে পাচ্ছে না। সালমা টের পায়-আজীজ চাচা কই বেড়িয়ে গেলেন।
অন্ধকারে বসে ছিল সালমা । অবশ্য তেমন ভয় লাগছিল না ওর।
তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে ও।
তারপর ঘুমটা যখন ভাঙল- জানালায় জ্যোস্নার ধবধবে আলো দেখতে পেল ও। জ্যোস্নার রাতটা নির্জন আর শুনশান করছিল ।
ঠিক তখনই নীচের কবরখানার গাছপালায় একসঙ্গে অনেক কাক ডেকে ওঠাল। সালমা বিছানা থেকে ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে দ্রুত পায়ে বারান্দায় চলে আসে। কবরখানা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। নীচে একটা কড়ুই গাছের দিকে চোখ যেতেই সালমার সারা শরীর হিম হয়ে যায়। কড়ুই গাছের নীচে রাবেয়া চাচী দাঁড়িয়ে আছেন।
পরনে সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। খোঁপায় বেলিফুলের মালা। রাবেয়া চাচীর পাশে আজীজ চাচা দাঁড়িয়ে। আর সামনে একটা কালো কুকুর বসে। হঠাৎ রাবেয়া চাচী মুখ তুলে বারান্দার দিকে তাকায়।
তারপর হাত তুলে আজীজ চাচাকে দেখায়।
আজীজ চাচা বারান্দার দিকে তাকালেন।
সালমাকে কে যেন বলল, এখুনি এখান থেকে পালাও।
সালমা ঘুরে এক ছুটে পরপর দুটো ঘর পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে যায়।
তারপর কখন ঘোরের মধ্যে নীচের উঠানে নেমে সদর দরজা খুলে রাস্তায়।
দৌড়াতে দৌড়াতে পিছনে কুকুরের হিংস্র চিৎকার শুনতে পেল সালমা । ও পিছন দিকে না তাকিয়ে প্রাণপন দৌড়াতে থাকে । বুকের ওপর থেকে কখন ওড়না খসে গেছে। ও টের পায় পিছনে একপাল কুকুর ওকে তাড়া করছে। উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে কখন ও রেললাইন পেরিয়ে ঘোষপাড়ায় পৌঁছে যায়।
অধ্যাপক মোশাররফের বাড়ির সদর দরজা খোলা ছিল।
বাগানে দাঁড়িয়েছিল শ্যামল। বলল, জলদি এসো। বলে শ্যামল দ্রুত সদর দরজা লাগিয়ে দিল।
সদর দরজার ওপাশে কুকুরগুলি ডাকছিল।
অধ্যাপক মোশাররফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, এসো, সালমা।
সালমা ভীষণ হাঁপাচ্ছিল। বলল, স্যার।
অধ্যাপক মোশাররফ হাত তুলে বললেন, জানি।
এসো। বলে ঘুরে দাঁড়ালেন।
প্রাচীরের ওপাশে কুকুরগুলি তখনও ভয়ঙ্কর ভাবে ডাকছিল। একটু পর দেয়ালের ওপর কী যেন ভয়ানক শব্দে আছড়ে পড়ল। মাটির কেঁপে উঠল।
বাগানের গাছপালা ভীষণ কাঁপছে। যেন ঝড় উঠেছে।
অধ্যাপক মোশাররফ বললেন, ওটা ভিতরে ঢুকতে পারবে না। তোমার সঙ্গে তাবিজ থাকায় পিশাচটা তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারে নি।
সালমা স্বস্তি বোধ করে।
তবে আতঙ্কে হিম হয়ে ছিল।
পিছনে বারান্দায় বসে অধ্যাপক মোশাররফ বললেন, বোস, সালমা।
সালমা বসল। তখনও হাঁপাচ্ছিল।
শ্যামল ওকে এক গ্লাস পানি এনে দিয়ে পাশে বসল।
সালমা ঢকঢক করে পানি খেল।
অধ্যাপক মোশাররফ বললেন, শোন সালমা। তোমার এখন সব জানা দরকার। সেদিন তোমায় বলিনি তুমি ভয় পাবে বলে। আজীজ সিকদার- এর বাবা হানিফ সিকদার শবসাধনা করতেন।
কি সাধনা করতেন স্যার?
শবসাধনা। তার কারণও ছিল। হানিফ সিকদার- এর স্ত্রী-অর্থাৎ আজীজ সিকদার-এর মা রওশন ছিল ভীষণ সুন্দরী। আজীজ সিকদার- এর বয়স যখন বারো বছর সে সময় তার মা রওশন মারা যায়। স্ত্রীর শোকে হানিফ সিকদার যাকে বলে একেবারে উন্মাদের মতন অবস্থা ।
রওশনকে বাড়ির পিছনে কবর দেওয়া হয়। কবরখানাটি তো তুমি দেখেছো না?
সালমা বলল, জ্বী , স্যার। আমি গ্রাম থেকে দূর্গাবাড়ি আসার পরই সিকদার চাচা বললেন, বাড়ির পিছনে কবরখানা আছে ঐদিকে যাওনের দরকার নাই। জায়গাটা ভালো না।
শ্যামল বলল, হুমম।
সাবধান করে দিয়েছে।
অধ্যাপক মোশাররফ বললেন, তো, হানিফ সিকদার তার স্ত্রীর কবরের কাছে বসে থাকত। হানিফ সিকদার তন্ত্রমন্ত্র জানত। সেসব তার ছেলেকেও সে শিখিয়েছিল। যাই হোক।
হানিফ সিকদার একটা মারাত্মক ভুল করে বসে ।
কী স্যার?
বলছি। আমার উস্তাদ জামশেদ পীর বলতেন- মৃত আত্মাকে জীবিত করতে নেই, তাদের মোকাম আলাদা। আল্লাহতালা যে নিয়ম করেছেন- সে নিয়ম ভাঙতে নাই। আল্লাহতালার নিয়ম ভেঙে হানিফ সিকদার তাঁর স্ত্রীকে জীবিত করে।
ওহ্ ।
এবং সে আরেকটা ভয়ানক ভুল করে।
কী স্যার ?
ইয়ে মানে, হানিফ সিকদার তার স্ত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চায়, সে রকম করতে গেলেই হানিফ সিকদার-এর স্ত্রী রওশন অদৃশ্য হয়ে যায় এবং হানিফ সিকদার একটা কালো কুকুরে রূপান্তরিত হয়। ওই কুকুরই সিকদারবাড়ির পিশাচ!
ওহ্ ।
গতবছর তোমার রাবেয়া চাচী মারা গেলে আজীজ সিকদারও তার স্ত্রী কে জীবিত করে।
তবে সে তার বাবার পরিনতি দেখে সাবধান ছিল। সে তার স্ত্রীকে স্পর্শ করে না। এবার বুঝেছ?
জ্বী, স্যার।
ওই কালো কুকুরটাকে এত দিন আমি কিছু বলিনি। পিশাচটা আজ আমার বাড়ি আক্রমন করল।
কত বড় স্পর্ধা! বলে অধ্যাপক মোশাররফ ঝুঁকে তিনটে বর্শা তুলে নিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এখন চল, পিশাচটাকে কবরে ফেরৎ দিয়া আসি।
কোথায় যাবেন স্যার? সালমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
শ্যামল বলল, সিকদারবাড়ি।
সালমা কেঁপে উঠল।
ওরা তিনজন যখন রাস্তায় নামল ততক্ষণে চারিদিকে ভোরের নরম আলো ফুটে উঠেছে ।
সিকদারবাড়ি নির্জন হয়েছিল। কবরখানায় গাছপালায় নর, আলো ছড়িয়েছিল। কাকপাখি ডাকাডাকি শুরু করেছে।
অধ্যাপক মোশাররফ হাত তুলে বাঁশঝাড়ের ফাঁকে দুটি কবর বললেন, ওই যে দেখছ, কবরের মাটি তোলা।
দৃশ্যটা দেখে সালমা কেঁপে ওঠে। ঠিক তখনই একটা বহেরা গাছের ওপাশ থেকে সেই কালো কুকুরটা বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এল।
অধ্যাপক মোশাররফ বর্শা ছুড়ে মারলেন।
বর্শা বিদ্ধ কুকুরটি ভয়ানক আর্তনাদ করে উঠে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর মৃতদেহ থেকে কুন্ডলী পাকিয়ে সাদা ধোঁওয়া ওঠে।
দেখতে দেখতে মৃতদেহটা কুঁচকে ছাই হয়ে যায়।
কাঠবাদাম গাছের ওপাশ থেকে কী একটা শূন্যে ভেসে আসছে। রাবেয়া চাচী! পরনে সাদা শাড়ি। খোঁপায় বেলিফুলের মালা। চুল ঝুলছে মাটির ওপর।
অধ্যাপক মোশাররফ বর্শা ছুড়ে মারলেন।
বর্শাটা রাবেয়া চাচীর মাথায় গেথে যায়। রাবেয়া চাচী ভয়ানক আর্তনাদ করে উঠে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর মৃতদেহ থেকে কুন্ডলী পাকিয়ে সাদা ধোঁওয়া ওঠে। দেখতে দেখতে মৃতদেহটা কুঁচকে ছাই হয়ে যায়।
সালমা অবাক হয়ে দেখে কবর দুটির দুপাশ থেকে মাটি ঝরে কবরের গর্ত দুটি ঢেকে যাচ্ছে ।
সালমা চারপাশে তাকায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, আজীজ চাচা কোথায় স্যার?
অধ্যাপক মোশাররফ আশেপাশে তাকিয়ে বললেন, হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে। তার সঙ্গে আমার পরে মোকাবেল হবে। এখন চল।
আপাতত কাজ শেষ।
ওরা ঘাস আর শুকনো পাতা মাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। সালমা আড়চোখে শ্যামলের মুখের দিকে তাকায়। শ্যামলের মিষ্টি শ্যামলা মুখে ভোরের আলো এসেছে পড়েছে। ওর হাত ধরতে ইচ্ছে করছিল সালমার।
ওরা যখন কবরখানা থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় উঠে এল ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।