একটা ভাল গান সৃষ্টির পর, নিজের ভেতর যে আনন্দের স্রোত বয়, তা লিখে বোঝাতে পারবোনা। বাবা থাকলে বলতাম তোমার বুকের চেয়ে শান্তির জমি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই; মাকে বলতাম তোমার কোলে শুয়ে হারানো সুখ এবং একটা শান্তির সবুজ জমি খুঁজে পাই, একটা ভাল গান সুর করার পর। ---- প্রিন্স মাহমুদ/২১.১২.২০০০ (পিয়ানো অ্যালবাম থেকে উদৃত)
প্রতিটি মানুষের বেড়ে উঠায় কারো না কারো ছায়া পড়ে। মানুষ মাত্রই প্রিয় মানুষগুলোর যেসব বৈশিষ্ট তার নিজের কাছে ভাল লাগে তা নিজের ভিতরে লালন করার একটা প্রবল আকাংখা তৈরী হয়; সেই প্রিয় মানুষগুলো হোক কাছের অথবা দূরের। জীবনে চলার পথে যখনই সুযোগ আসে সেই ভাললাগাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে তার নিজের মাধ্যমে।
কেউ আকৃষ্ট হয় কথা-বার্তায়, কেউবা চলাফেরায়, কেউবা বুদ্ধিমত্তায়, কেউবা আবার নান্দনিকতায়। অন্যদিকে কখনো কখনো কেউ কেউ ত্রুটিপূর্ণ বৈশিষ্টে আকৃষ্ট হয়; হতে পারে সেটা সচেতন ভাবে আবার কখনোবা সেটা অচেতনতায়।
আমার বেড়ে উঠায় ছায়া পড়েছে আমার বড় ভাইয়া, আমার ছোট মামা এবং আমার মায়ের। যখন খুব ছোট তখন দেখতাম ছোট মামাকে গান শুনতে। AIWA নামে একটা ডেস্কপ্লেয়ার ছিল ছোট মামার।
শুনতেন প্রচুর গান এবং প্রচুর ক্যাসেটও ছিল ছোট মামার সংগ্রহে। কয়েকটি গানের কথা আজও আমার কানে বাজেঃ 'পৃথিবীর মত হৃদয়টাকে কখনোতো ভাগ করিনি আমি/পৃথিবীর তিনভাগ জল, একভাগ স্থল/আর আমার হৃদয় জুড়ে শুধু তুমি' কিংবা 'যদি সব সাগরের জল কালি হত/যদি পৃথিবীর সব গাছ লেখনি হত/আর সারাটা জীবন যদি লিখে যেতাম/তবু তোমার আমার প্রেমের কথা লেখা শেষ হত না'। ঐ সময়ে শিল্পীকে চেনা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। শুধু গানের কিছু কথা ও সুর গুলো মনে ছিল। তারও অনেক অনেক বছর পর জেনেছি শিল্পীদের নামঃ একজন তপন চৌধুরী আর অন্যজন জহির আহমেদ।
মামার সেই AIWA দিয়েই বড় ভাইয়ার গান শুনত। আবার অন্যদিকে মামার সেই AIWA টা অনেকটা জরাজীর্ণ। ঠিক সেই সময়ই আমাদের নানুর বাড়ির গ্রামের সদ্য বিদেশ ফেরত এক মামা বিদেশ থেকে আনা একটা সিডি প্লেয়ার বিক্রি করবেন বলে জানা গেল। বড় ভাইয়া ছোট মামা ও আম্মুকে রাজি করালেন সেই সিডি প্লেয়ার কিনে দেবার জন্য। বড় ভাইয়ার আর তর সইছিল না, সেই সাথে আমাদের ভেতরও উকি দিতে থাকলো নানাবিধ উত্তেজনা।
সেই সিড়ি প্লেয়ার দ্রুতই নিয়ে আসা হল আমাদের নানুর বাসায়। আমিতো দেখে অবাক ! ! ! শুধু মাত্র গান শোনার জন্য এমন জাকালো ব্যবস্থা ! ! ! সেই সিডি প্লেয়ারটাও ছিল দেখার মত। বিশাল একটা টেবিলের অর্ধেকটা জায়গা জুড়ে স্থান করে নিল অতি দানবাকৃতির সেই কাংখিত সিডি প্লেয়ারটি। সিডি প্লেয়ারটি Installation শেষে শুরু হল গান শোনার পালা। পাশের বাড়ির এক মামা নিয়ে এল নতুন কেনা একটি অ্যালবাম এবং স্থির হল সেই অ্যালবাম দিয়েই শুরু হবে গান শোনা।
ক্যাসেট চালু করা মাত্রই ঝন-ঝনিয়ে বেজে উঠল সিডি প্লেয়ারটি। কিছুক্ষণ মিউজিকের পর শুরু হল এক অবাক কন্ঠ "দশ মাস দশ দিন ধরে গর্ভে ধারণ/কষ্টের তীব্রতায় করেছে আমায় লালন/হঠাৎ কোথায় না বলে হারিয়ে গেল/জন্মান্তরের বাধন কোথা হারাল/সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে/খুজেঁ দেখো পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে/রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস/কোথায় আছে কেমন আছে মা/ওরে তারা রাতের তারা মাকে জানিয়ে দিস/অনেক কেদেঁছি আর কাদঁতে পারিনা"। অন্যদের কথা তেমন মনে নেই; শুধু এইটুকু জানি আমি থমকে গিয়েছিলাম গানের প্রতিটি কথায়। আর শিল্পী যেই ভাবে গানটা গায়ছিল মনে হচ্ছিলঃ সত্যিই যেন মা নেই সেই গায়কের। সেই শুরু প্রিন্স মাহমুদের গানের সাথে পরিচয়।
যেই মামা ক্যাসেটটি এনেছিলেনঃ তিনি ক্যাসেটের ফিতা ঘুড়িয়ে রেখেছিলেন যেন এই গানটিই চলে। অসাধারণ সাউন্ড কোয়ালিটি ছিল সেই সিডি প্লেয়ারটির। একে বারে অন্যরকম যা এর আগে কখনোই অনুভব করিনি। যেন এক মধুর সঙ্গীত সারা ঘর জুড়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে আমাদের। সে এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনা।
আর বাংলাদেশে সেই মূর্ছনার শুরু যুদ্ধকালীন সময় থেকে . . .
যুদ্ধকালীন সময়ে গুরু আজম খান অস্ত্র হাতে সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করতেন। সেই অর্থে তারুণ্যদীপ্ত গানের প্রথম যোদ্ধা একমাত্র তিনিই এবং বর্তমান বাংলা ব্যান্ড ও পপ ঘরানার গানের পথিকৃত আমাদের গুরু আজম খান (গুরু তোমায় সালাম)। বাংলা ব্যান্ড মিউজিক --- বাংলার দামাল ছেলেদের তারুণ্যের হৃদপিন্ডের স্পন্দন'কে প্রতিনিধিত্ব করে আসছে সেই যুদ্ধকালীন সময়ে থেকে বর্তমান ২০১১ পর্যন্ত। দীর্ঘ চার যুগ ধরে এই বাংলাদেশে তারুণ্যের প্রাণের সবটুকু উচ্ছাস-উল্লাস জুড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই ব্যান্ড সঙ্গীত এবং এটি সঙ্গীতের এমনই এক শাখা যেখানের তারুণের নিত্য বসবাস। তরুণ হৃদয়ের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-হতাশা, উল্লাস-উচ্ছাস প্রকাশের সর্বাধিক জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক মাধ্যম যা তরুণ হৃদয়ের মন ও আত্মার ক্ষুধা মেটায় খুব সহজেই।
যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ --- চারিদিকে শুধুই বিভৎস লাশপচাঁ গন্ধ আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে ঠায় দাড়িয়ে গড়ে উঠে ব্যান্ডদল উচ্চারণ। উচ্চারণই বাংলাদেশের মিউজিকের ইতিহাসে প্রথম ব্যান্ড। এরপর একে একে আসে সোলস, ফিডব্যাক, মাইলস, রেঁনেসা, এল.আর.বি, ওয়ারফেইজ, রকস্টারটা, ফিলিংস, চাইম, অবসকিউর, উইনিং, আর্ক, নোভা, অরবিট, ডিফরেন্ট টাচ ও প্রমিথিউস সহ অনেক ব্যান্ড। প্রতিটি ব্যান্ড তৈরী করতে থাকে নিজেদের অ্যালবাম। প্রকাশ পেতে থাকে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের চমৎকার সব অ্যালবাম।
ঐ সময়ে অ্যালবাম মানেই ব্যান্ড কিংবা সলো অ্যালবাম। ব্যান্ড মিক্সড বা মিশ্র অ্যালবামের প্রচলন শুরু হয়নি তখনো।
নব্বইয়ের শুরুর দিকে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে ব্যান্ড মিক্সড বা মিশ্র অ্যালবামের প্রচলন শুরু করেন আর্কের দলনেতা আশিকুজ্জামান টুলু (জনপ্রিয় ব্যান্ড চাইমেরও প্রতিষ্ঠাতা দলনেতা ছিলেন। পরবর্তীতে চাইম ছেড়ে দিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ড "আর্ক" এবং পরবর্তীতে "আর্ক" চরম শ্রোতাপ্রিয়তা পায়)। আশিকুজ্জামান টুলুর সুরবিন্যাস, সঙ্গীতায়োজন ও পরিকল্পনায় প্রকাশিত হয় বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসে প্রথম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম "Stars"।
"Stars" এর সফল ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আশিকুজ্জামান টুলুর সুরবিন্যাস ও সঙ্গিতায়োজনে প্রকাশিত হয় "Stars 2"। সে-ই শুরু ব্যান্ড ও সলো অ্যালবামের পাশাপাশি জনপ্রিয় আরেক ধারার যার নাম "ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম"। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। এরপরের সময়টুকু ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের জন্য শুধুই ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্র যুবরাজ মাহমুদ ঠিকাদার।
যুবরাজ মাহমুদ ঠিকাদার --- সঙ্গীতাঙ্গনে যার একমাত্র পরিচয় তিনি "প্রিন্স মাহমুদ"। সঙ্গীতে যার পদার্পন বন্ধুদের নিয়ে গড়া ব্যান্ড "দ্যা ব্লুজ" দিয়ে। এরপর যুক্ত হন মূলধারার জনপ্রিয় ব্যান্ড অবসকিউর এর সাথে। অবসকিউর থেকে বেরিয়ে গড়ে তোলেন নিজের ব্যান্ড "ফ্রম ওয়েষ্ট"। ফ্রম ওয়েষ্ট এর পরিবেশনায় প্রকাশিত হয় আবেগ নামে একটি অ্যালবাম যেখানে আরও পারফর্ম করে অবসকিউর ও ডিফরেন্ট টাচ।
আবেগ অ্যালবামে আছে প্রিন্স মাহমুদ এর চারটি চমৎকার গান।
গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদঃ ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম "শক্তি" দিয়ে যার শুরু। ঐ অ্যালবামের ১২ টি গানের ভেতর ৮ টি গানের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজন ছিল প্রিন্স মাহমুদের। তারুণ্যের উন্মাদনাকে পুঁজি করে প্রকাশ পাওয়া "শক্তি"র শিল্পীরা ছিলেনঃ গুরু আজম খান(উচ্চারণ), এবি(এল.আর.বি), জেমস(ফিলিংস/বর্তমান নগরবাউল), পার্থ(সোলস), বাবনা(ওয়ারফেইজ), ফজল(নোভা) ও নকীব খান(রেঁনেসা)। চমৎকার সব পরিবেশনা সমস্ত অ্যালবাম জুড়ে।
প্রতিটি গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজনে নান্দনিকতার ছোয়া স্পষ্ট। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। সেই প্রথম অ্যালবাম থেকেই করেছেন নিজের মনের মত গান। গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজন ছিল বরাবরই নান্দনিকতায় ভরপুর। সেই নান্দনিকতার প্রমাণ স্বরুপ শুধুই একটি গানের কথা উল্লেখ করলাম আর সেটা এবি'র করা 'পালাতে চাই'।
(বর্তমান সময়ের অনেকেই হয়ত অসাধারণ ও চমৎকার সব গানে ভরপুর এই সংকলনটি শোনেন নি। অনুরোধ রইল অন্তত একবার শুনে দেখবেন। প্রিন্স মাহমুদ এমনই এক নাম, আমার কাছে সেই নামের প্রতিশব্দ হল 'বিশ্বস্ত সৃষ্টিশীল ও নান্দনিকতার প্রতীক'। )
'শক্তি' এই একটি মাত্র অ্যালবাম দিয়েই বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন। সেই সাথে তৈরী করে নিলেন এক বিশাল নান্দনিক শ্রোতা গোষ্ঠীর।
যারা প্রিন্স মাহমুদের প্রথম অ্যালবাম 'শক্তি' শুনে নান্দনিকতায় মেতে উঠেছিলেন, সেই সব শ্রোতাদের উচ্ছাস ও আস্থাকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে প্রকাশ পায় দ্বিতীয় অ্যালবাম 'ক্ষমা'। 'ক্ষমা' অ্যালবামের মাধ্যমেই প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে প্রথম বারের মত গান করেন মাকসুদুল হক (মাকসুদ ও ঢাকা), খালিদ(চাইম), চন্দন(উইনিং) ও টিপু(অবসকিউর)। এছাড়াও এই অ্যালবামে আরো ছিলেন গুরু আজম খান(উচ্চারণ), বাবনা(ওয়ারফেইজ), ফজল(নোভা), পলাশ(অরবিট), বগি(রেঁনেসা), পার্থ(সোলস) ও ইকবাল আসিফ। বেশ কিছু গান তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পায় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ 'অশ্রু মুছে তুমি তাকাবে/মনকে আলোকিত করবে/তোমার অশ্রু আমায় দুর্বল করে দেয়/আবার দেখা হবে/এখনি শেষ দেখা নয়/আবার কথা হবে/এখনি শেষ কথা নয়'--- আবার দেখা হবে/খালিদ(চাইম), 'কেন মন নিয়ে এত দাও যন্ত্রনা/কেন ক্ষমা দিয়ে ভুল তুমি ঢাকলে না/কেন আধাঁরে এই জীবনে কাছে আসবে না' --- ক্ষমা(মন নিয়ে যন্ত্রনা)/মাকসুদুল হক এবং টিপুর 'চাঁদ জাগা এই রাতে/দুচোখের বরষায় ভিজে/ভাবছি তোমায়/জেগে জেগে রাত/তুমিও কি ভাবছো আমায়' গানগুলো তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। এছাড়া চন্দনের 'ছোটো ছোটো কিছু কিছু ভুল', বাবনার 'কোথায় হারালে', ইকবাল আসিফের 'ভাঙ্গা হৃদয়' যেকোন শ্রোতা হৃদয় বিমোহিত করবে খুব সহজেই।
প্রতিটি গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজনে নান্দনিক সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়া পাবেন অজান্তে নিভৃতেই।
'ক্ষমা'র পরপরই প্রকাশ করেন তৃতীয় অ্যালবাম 'ঘৃণা'। আর্কের সাথে কাজ করার সুযোগ তৈরী হয় মূলত এই অ্যালবামের মাধ্যমেই। আর্কের মেইন ভোকাল হাসান ও আর্কের দলনেতা শক্তিমান গীতিকার ও সুরকার আশিকুজ্জামান টুলু এই প্রথম বারের মত কন্ঠ দেয় প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে এবং সেই সাথে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে সংযোজিত হয় আরেক অনবদ্য সঙ্গীতের। চমৎকার সব পরিবেশনার মধ্যে যে কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়ঃ 'শুণ্য'-মাকসুদ, 'ভালবাসতে হবেই'-হাসান, 'নীরা'-খালিদ, 'অভিমানিনী'-টুলু, 'একা হয়ে যাই'-বাবনা, 'তুমি আর কারো নও'-চন্দন, 'অভিমানে'-পার্থ সহ সবকটি গান (অনেক চেয়েছি গানের শিরোনাম গুলো উল্লেখ না করার জন্য।
কিন্তু উল্লেখ না করে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। লোভ এই যে, যারা অসম্ভব সুন্দর এই গানগুলো শোনেনি তাদেরকে বলাঃ যদি এই গানগুলো অন্তত একবার না শোনেন তবে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের নান্দনিক ও চরম আবেদনময়ী একটা দিগন্ত অন্ধকারেই থেকে যাবে আপনার কাছে)
এর পরপরই প্রিন্স মাহমুদের সুরে বের হয় আধুনিক গানের শিল্পীদের নিয়ে অ্যালবাম 'ব্যবধান'। প্রিন্স মাহমুদ হেরে গলার ড্রামস গিটারের কিছু ব্যান্ড গানই করতে পারে --- আধুনিক গান প্রিন্স মাহমুদ'কে দিয়ে সম্ভব নয় বলে যারা প্রিন্স মাহমুদের সমালোচনায় মুখর ছিলেন, তাদের মুখ বন্ধ করতেই আসে 'ব্যবধান'। উদ্দীপ্ত প্রতিভার সৃষ্টিশীল নান্দনিকতায় প্রিন্স মাহমুদ বরাবরই ছিলেন অন্য সবার শীর্ষে। ব্যান্ড শিল্পীদের ছাড়াও করেছেন আধুনিক ও সলো শিল্পীদের গান।
'এক মুঠো জ্যোছনা' নামে পুরো একটা অ্যালবাম করেছেন জনপ্রিয় শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ-এর। আধুনিক গানের আরেক দিকপাল এন্ড্রু কিশোরের জন্য করেছেন 'গাঁয়েন' নামে একক অ্যালবাম। এছাড়াও করেছেন এন্ড্রু কিশোর ও আতিক হাসানকে নিয়ে ডুয়েট অ্যালবাম 'পদ্ম পাতার জল' ও 'দুই দিনের মেলা' নামে দুটি অ্যালবাম সহ আরো অনেক সলো ও মিক্সড অ্যালবাম। শুধুই ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকেন নি তিনি। মেধা ও নান্দনিক মননশীলতার জ্যোতি ছড়িয়ে দিয়েছেন ব্যান্ড, পপ ও আধুনিক গানে।
এবং প্রিন্স মাহমুদের সেই জ্যোতি শুধুই ছড়িয়ে পড়েনি চারপাশ জুড়ে, উপরন্তু সেই সাথেও আলোকিত করেছেন প্রতিটি শাখা।
ব্যবধানের পরপর প্রকাশিত হয় প্রিন্স মাহমুদের সর্বাধিক জনপ্রিয় ধারার অ্যালবাম 'শেষ দেখা'। আগের সমস্ত অ্যালবাম দিয়ে যাদের গ্রহণযোগ্যতা মিলেনি তারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে এই অ্যালবাম নিয়ে। শুধুই তাই নয় --- যারা বাংলা ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে দোটানায় ছিলেনঃ ব্যান্ড সঙ্গীত শুনবেন কি শুনবেন না তারা সমস্ত দ্বিধা ছুড়ে ফেলে লুফে নেয় ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম 'শেষ দেখা'। 'শেষ দেখা'-ই প্রিন্স মাহমুদের প্রথম অ্যালবামে যেখানে এবি, জেমস, হাসান, শাফিন আহমেদ, পার্থ, টুলু, খালিদ, গুরু আজম খান, ফজল, টিপু ও বিপ্লব এক সাথে একই অ্যালবামে উঠে আসে।
এর আগে আর কোন অ্যালবামে এমনটি ঘটে নি। ততকালীন সময়ের মূলধারার সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোর শিল্পীরা এক সাথে একই অ্যালবামে গান করার সুযোগ পায়। ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের শক্তি এখানেই নিহিত। সব ঘরানার শ্রোতা-ভক্তের জন্য এর চেয়ে ভাল আর কোন প্লাটফর্ম নেই একমাত্র ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম ছাড়া। আর প্রিন্স মাহমুদও ঢেলে দিয়েছে দীপ্তপ্রতিভার সবটুকু নান্দনিক ছাঁপ।
প্রতিটি শিল্পীর কন্ঠোপযোগী শ্রেষ্ঠ গানগুলো তৈরী করেছেন সব শ্রেণীর শ্রোতা-ভক্তকুলের জন্য। এই অ্যালবাম প্রিন্স মাহমুদের অতিতের সমস্ত অর্জন'কে ছাপিয়ে জ্যোতির দ্যুতি আরো বেশী ছড়িয়েছে আপন মহিমায়। এই অ্যালবামে ছিল তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া জনপ্রিয় গানঃ শেষ দেখা-এবি, হতেও পারে এই গান শেষ গান-জেমস, এত কষ্ট কেন ভালবাসায়-হাসান, প্রতিরাতই নির্ঘুম রাত-শাফিন, আকাশনীলা-খালিদ, জীবনের শেষ কটা দিন-গুরু আজম খান, সময় আর কাটে না-পার্থ (কথাঃ আশরাফ বাবু, সুরঃ পার্থ) সহ আরো বেশ কিছু গান। বাংলা ব্যান্ড মিউজিক --- দাগ থেকে যায় পোষ্টে এই অ্যালবাম সস্পর্কে বলেছি। তবুও আবারও বলি এই অ্যালবামের আগে শাফিন আহমেদ অন্য কোন মিক্সড অ্যালবামে গান করেছেন বলে আমার জানা নেই।
অন্যদিকে আর্কের বাইরে হাসান'কে জনপ্রিয় করতে প্রিন্স মাহমুদের অবদান অনস্বীকার্য। হাসানের করা 'এত কষ্ট কেন ভালবাসায়' ঐ সময়ের মানুষের মুখে মুখে বেড়াতো, জেমসের 'বন্ধু ভেঙ্গে ফেলো এই কারাগার/খুলে দাও সে হৃদয়ে প্রণয়ের দ্বার/হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা/হতেও পারে এই গান শেষ গান' কিংবা পার্থর 'সময় আর কাটে না' এখনও গান পাগল মানুষগুলো নিয়মিত শোনেন।
(ব্যক্তিগত প্রসংগঃ এই অ্যালবাম যখন রিলিজ হয় আমি তখন ছোট। আমার মনে পড়েঃ পাশের বাড়ির এক মামা প্রচুর ব্যান্ড মিউজিক শুনতেন। উনার ওইখানেই জেমস/ফিলিংস-এর লেইস ফিতা লেইস, এবি'র কষ্ট, প্রিন্স মাহমুদের শেষ দেখা, এবি-এল.আর.বি-র ফেরারী মন অ্যালবামের গান গুলো শুনতাম।
এখনো মনে পড়ে প্রায় রাতেই চারিদিকের নিশ্চুপ ঘনকালো শীতল আঁধারের চাদরে ঢেকে যখন সবাই ঘুমে বিভোর, তখন প্রায়শই ঘুম ভেঙ্গে গেলে শুনতাম বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে গান-- 'ঐ রাত ঘুমালো ঐ চাঁদ ঘুমালো/নিভে গেছে একে সব আলো/আমি জেগে আছি একা/ঘুম নেই চোখে/এ জীবন আমার এলোমেলো' কিংবা কোন এক রাতে 'পথের বাপই বাপরে মনা/পথের মাঝেই খুজে পাবি আপন ঠিকানা'। আবার কোন কোন রাতে অবাক কন্ঠ ভেসে আসতো 'নিরবেই অভিমানে নিভৃতে/তুমি করছ তিলে তিলে নিজেকে শেষ/কেন বল পৃথিবীতে কেউ কারো নয়/হয়ে গেছে ভালবাসা নিঃশেষ' সহ আরো অনেক গান। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো সম্ভব না। এই অনুভূতি স্বর্গীয় অনুভূতি থেকে পাওয়া যার উৎস এই পৃথিবীতে হলেও উপলব্ধিটুকু দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ খোলা মাঠ পেরিয়ে দূরের নাম না জানা নদীটির স্বচ্ছ জল ছুয়ে কাশফুল ঘেষে ঘেষে সাদা মেঘের মাঝে মিলিয়ে যাওয়ার মত।
)
শেষ দেখা'র পরপরই প্রকাশ পায় প্রিন্স মাহমুদের পরবর্তী অ্যালবাম 'এখনও দু'চোখে বন্যা'। এবি'র 'কতদিন দেখেনি দুচোখ', জেমস-এর 'মা', হাসানের 'প্রশ্ন' ও 'চলে যাও বন্ধু', শাফিন আহমেদের 'কোন এক সাঁঝে', খালিদের 'কোন কারণেই'। এই গানগুলো ঐ সময়ে শ্রোতাকুলকে কিভাবেই না আন্দোলিত করেছিল প্রতিটি গানের প্রতিটি কথা ও সুরে !!!! এই গানগুলির কথা নতুন করে বলতে চাইনা শুধুই এইটুকু ছাড়াঃ কিছু গান হয়ত শুধুই শিল্পীর কারণে অনেক বিখ্যাত। আবার কিছু কিছু গানের গীতিকারের খোজও রাখিনি অথবা জানিনা তবে এই গানগুলি যখন কোন শিল্পীর কন্ঠে Amplification এর সুযোগ পাবে তখন ঐ শিল্পীর পাশাপাশি আরও একটি নাম উচ্চারিত হবে, আর সেই নামটি হল 'প্রিন্স মাহমুদ'। এই গানগুলোর যারা শ্রোতা ছিলেন তাদের বলিঃ প্রতিটি গান শ্রোতা-হৃদয়কে এখনও আন্দোলিত করে সেই আগের মতই।
আর যেই সব গানপাগল মানুষগুলো বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এই কালজয়ী নান্দনিক গানগুলো শুনে দেখেন নি, আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে নান্দনিক সৃষ্টিশীলতায় ভরপুর এই গানগুলি একটি বারের জন্য শুনে দেখুন --- আপনার নিজের ভেতরে কেউ একজন হয়ত বহুকাল ধরেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে এই গানগুলোর জন্য। যেন কত আপন, কত চেনা, কত প্রিয় এই গানগুলো অভিমানে এতদিন আপনার থেকে অনেক অনেক দূরে ছিল। আর আজ কাছে পাওয়াতেই অশ্রুর বাধ ভেঙ্গে গেছে . . .
'এখনও দু'চোখে বন্যা'র পর শতাব্দী পরিবর্তনের আগে ১৯৯৯ এ প্রিন্স মাহমুদের দুটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। একটি হল 'দাগ থেকে যায়/৯৯ এর শুরুর দিকে' আর অন্যটি হল 'স্রোত/৯৯ এর শেষের দিকে'। শেষ দেখা এবং এখনও দু'চোখে বন্যার সফল ধারাবাহিকতার সরব উপস্থিতি মেলে 'দাগ থেকে যায়' অ্যালবামে।
সেই সৃষ্টিশীল নান্দনিকতার পুরোটায় উঠে আসে এই অ্যালবাম জুড়ে। শাফিন আহমেদের গাওয়া 'আজ জন্মদিন তোমার' গানটি অ্যালবাম প্রকাশের সাথে সাথেই সারা বাংলাদেশ কাঁপায়। যেখানেই যাই সেখানেই বাজে শাফিন আহমদের 'আজ জন্মদিন তোমার', জেমসের 'কিছু ভুল ছিল তোমার', এবি'র 'বেলা শেষ ফিরে এসে', জুয়েলের তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া 'তুমি বোঝনি বন্ধুত্ব কি',খালিদের 'হয়নি যাবার বেলা' সহ এই অ্যালবামের বাকী গানগুলো। বাংলা মিউজিকে জন্মদিন উৎসব নিয়ে এর চেয়ে কোন ভাল গান নেই, আসবে সেই আশা ক্ষীণ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্মদিনের উৎসব পালনে এই গানটি জন্মদিন-সঙ্গীত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
এই অ্যালবামের রেশ কাটতে না কাটতেই আসে ৯০ দশকের প্রিন্স মাহমুদের শেষ অ্যালবাম 'স্রোত'। সবকটি গানই শ্রুতিমধুর। স্পষ্ট এবং নান্দনিক কথামালায় গাঁথা গানগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটিঃ এবি'র 'অভিমান নিয়ে', জেমসের 'পাপী', জুয়েলের তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া 'যদি কখনো অসহায়', টিপুর 'একদি কাদঁবে', পিয়াসের 'মন শত পাহারায়', মিজানের 'কাল যে আপন ছিল আজ হল পর' এবং শাফিন আহমেদের 'দুঃখ স্রোত'।
ফিরে যাই এক অবাক কন্ঠে --- জেমস। এখনও দু'চোখে বন্যা অ্যালবামের সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় ও বিখ্যাত গান হল জেমস-এর 'মা'।
এই গানটি প্রথমবার শুনেছিলাম দানাবাকৃতির একটি সিডি প্লেয়ারে (শুরুতেই যেই সিডি প্লেয়ারের গল্প করলাম)। তাও আজ ১ যুগেরও কিছু বেশী সময় পেরিয়ে গেছে। কালের স্রোতে যতদিন বাংলা ব্যান্ড মিউজিক টিকে থাকবে ঠিক ততদিন ঠিক আগের মতই আবেদন থাকবে প্রিন্স মাহমুদের কিছু গানের যেই গানগুলোতে কন্ঠ দিয়েছেন বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের শক্তিমান শিল্পীরা। তবে এখনও দু'চোখে বন্যা অ্যালবামে করা জেমসের 'মা' তার অন্যতম। একটি গানই যথেষ্ঠ জেমস-কে এই বাংলা মিউজিকে অনন্তকাল শ্রোতাকুলের অন্তরে গেঁথে রাখার জন্য।
এই একটি গান শ্রোতা শ্রেণীর সমস্ত প্রাচীর ভেঙ্গে পৌছে গেছে সর্বস্তরে এবং সেই সাথে পৌছে দিয়েছে তারুণ্যদীপ্ত ব্যান্ড সঙ্গীতের বারতা। যে গান শুধুই কানে কানে বলে যায়নি; কাঁদিয়েছে অজস্র শ্রোতা হৃদয়কে, সৃষ্টি করেছে বড় ধরণের দাগ। শত চেষ্টাতেও সেই দাগ মুছে ফেলা যায়। বরং থেকে যায়। যিনি একটি বারের জন্য জেমসের 'মা' গানটা শুনেছেন তার যে অনুভূতি শত শত শ্রোতা হৃদয়েরও অনুভূতিও তেমন-ই এক ও অভিন্ন।
প্রিন্স মাহমুদ এমন অভিন্ন অনুভূতির জন্ম দিয়েছেন অসংখ্যবার। হয়ত তিনি নিজেও জানেন না। আমার মনে আছে আমি যখন মা গানটা হাই-ভলিউমে শুনতাম তখন লক্ষ্য করতাম আশেপাশে যতদূর পর্যন্ত গানের শব্দ স্পষ্ট শোনা যেত তার ভেতরের সমস্ত মানুষ যখন জেমসের কন্ঠে 'দশ-মাস দশ-দিন ধরে গর্ভে ধারণ/কষ্টের তীব্রতায় করেছে আমায় লালন' বাক্যটা শুনত তখন পুরো গানটা শোনার জন্য উদ্গ্রীব থাকত। হোক সে আবাল, বৃদ্ধ কিংবা বনিতা।
তবে সেই সব দিনের সাথে মিল খুজে পাওয়া যায় বর্তমানেও।
এখনো কিছু কিছু গানের প্রথম বাক্যটা শোনার পর কিছু শ্রোতা-মাত্রই কান-খাড়া করে দিয়ে উদ্গ্রীব থাকেন পুরো গানটা শোনার জন্য। তেমনি কিছু গান হলঃ 'রাহাত?/হ্যা,কি?/শুনছো ফুয়াদ যে নতুন সিডি বের করছে?/কে?/নতুন সিডির মধ্যে যে গান করছে ,ওই যে কি,দেহ দোলা দেয় যৌবন দোলা দেয়...', 'দে দোস্ত নাম্বার...', আরেকটা শুরু হয় এভাবে 'ফুয়াদ লুজ মি ...', আরেকটা গান দেখলাম এভাবে শুরু হয় 'আমরা ফুয়াদের কথা বলতে এসেছি/কোন ফুয়াদ? হিংস্র ফুয়াদ?/এই হল সেই জংলি ফুয়াদ/বন্য ফুয়াদ...', আরেকটা গান সিলোঠি টাইপের অনেকটা এইরকম 'দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড লইয়া পড়ছি আমি ফান্দে...। ' আরেকটা গান দেখলাম অদ্ভুত গাঁজাখুড়ি; একবার ইংরেজী কয়,আবার কিসব হাবিজাবি ভাষা, চিৎকার চেচাঁমেচিঁ --- এইটাও ফুয়াদের একটা গান (আধুনিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট না করে 'গাঁজাখুড়ি হাবিজাবি ভাষা ইনস্টিটিউট' করলে অনেকেই এই গানগুলোর অর্থ উদ্ধারে সক্ষম হত এবং সেই সাথে নতুন কিছু বাংলাগাঞ্জিস ভাষার হয়ত উৎপত্তির সুযোগ সৃষ্টি হত!!!
রাস্তার পাশে ছোট-খাটো চায়ের দোকান, যেখানে টিভি-ডিভিডি দেখার ব্যবস্থা আছে সেসব স্থানে প্রায়ই দেখা যায়ঃ ডিভিডি'তে হয়ত মিউজিক ভিডিও চলছে। মিলা'র যাত্রাবালা, বাবুরাম সাপুড়ে, ডিসকো বান্দর, দোলা, যাদু, পাপের পুজারী সহ এইরকম নানাবিধ রকমারী সচিত্র প্রদর্শনীর মিউজিক ভিডিও। কেউবা সিগারেট ফুকে ধোয়া ছাড়ে আর বড় বড় চোখে (সম্ভব হলে চোখ বের করে দিয়ে) ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে সেই সুদৃশ্য মিউজিক ভিডিও দেখতে থাকে, কেউবা চায়ের কাপ হাতে বসে বসে ভিডিও দেখে এবং চায়ের কাপ ঠোটে লাগিয়ে চুমুক দিতেই হয়ত নিভৃতেই মুখের লালা চায়ে মিশে একাকার হয়ে যায়।
যাত্রাবালা, বাবুরাম সাপুড়ে, ডিসকো বান্দর, দোলা, দে দোস্ত নাম্বার, দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড সহ এইরকম আরও রকমারী গান আছে ফুয়াদ আল-মুক্তাদিরের। আমি যতটুকু জানি, ফুয়াদের এই গানগুলো সারা বাংলাদেশে প্রচুর ব্যাবসা করে। তারই পথ ধরে সেই সব শ্রোতা কিংবা ভক্তের কিছু নমুনা দেবার চেষ্টা করেছি চায়ের দোকান দিয়ে। অবশ্য চায়ের দোকান ছাড়াও যত্র-তত্র এইগুলি চোখে পড়ে। কেউ কি বলতে পারেন এই গানগুলি একজন শ্রোতার অনুভূতি'তে কিসের উপলব্ধি জাগাতে পারে ? ? ? !
এবার একটু অন্যদিকে দৃষ্টিগোচর করিঃ এল.আর.বি'র ফার্স্ট ডাবল অ্যালবামের একটি হল 'ঘুম ভাঙ্গা শহরে'।
'ঘুম ভাঙ্গা শহরে' অ্যালবামের একটি গানের শিরোনাম 'মাধবী'। যারা শুনেছেন বোধকরি আপনারা জানেন যে মাধবী নামের নারীটি ছিল একজন পতিতা (Prostitue!)!! পতিতাবৃত্তির সাথে যেকোন কারণেই আমাদের এই বাংলা মায়ের সন্তানদের কেউ জড়িয়ে যেতে পারে যেকোন ভাবে (জড়াচ্ছে তো !!!)। পতিতাবৃত্তি --- এটি এমন একটি পেশা যার মাধ্যমে একটি নারী টাকার বিনিময়ে তার দেহ বিক্রি করে। এল.আর.বি-র মাধবী তেমনি একজন নারী। হয়ত দারিদ্যের কষাঘাতে শোষিত হয়ে প্রতারক-লম্পট-দালালদের ফাঁদে পা দিয়ে এই বাংলার অনেক অনেক কিশোরী, তরুণী, নারীদের মত 'মাধবী'-ও অজ্ঞাতভাবেই জড়িয়ে পড়েছিল এই পেশাবৃত্তিতে।
আর সেই নষ্ট নারী 'মাধবী'কে নিয়েই এল.আর.বি-র প্রয়াস। পাঠক-শ্রোতাদের গানটি শোনার অনুরোধ রইল। যদি অতিতে সহস্রবার শুনে থাকেন তবুও আজ লিরিকের সাথে মিলিয়ে গানটি আরো একবার শুনুন। আমি নিশ্চিত আপনি যদি সৃজনশীল ও নান্দনিক একজন শ্রোতা-পাঠক হয়ে থাকেন তবে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেওয়া মাধবী'র জন্য আপনার মানবিক শুভবোধ গুলো জাগ্রত হবে অপরিসীম সহানুভূতি নিয়ে। আপনি যদি সতেচন পাঠক-শ্রোতা ও সমাজকর্মী হয়ে থাকেন হয়ত কোন একদিন কলম ধরবেন বাংলার এমন অজস্র মাধবীদের নিয়ে।
কোন শ্রোতা-পাঠক হয়ত নিজের অজান্তের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন মাধবী'র জন্য --- হয়ত সেই দীর্ঘশ্বাসের পরতে পরতে জমে আছে আপনার আমার এক একটি লুকানো ক্ষত।
মাধবী ---এল.আর.বি
সুরবিন্যাস ও সঙ্গীতায়োজনঃ এল.আর.বি
অ্যালবামঃ ঘুম ভাঙ্গা শহরে/১৯৯২
চোখে সানগ্লাস ঠোঁটে হাসি
বাঁকা হাসি
তার সব কিছুতেই বড় বেশী
বাড়াবাড়ি
যে চায় সে পায় মাধবী
নয় ফুল নয় লতা মাধবী
সে নষ্ট নারী
রাতের আঁধারে তাকে শুধু দেখা যায়
লাল নীল নানান রঙের গাড়িতে
দিনের আলোতে তাকে মিশে যেতে দেকা যায়
সবার সাথে সবার সাথে
কখন কোথায় সে যে কার
সে নিজেও তা জানে না
সে শুধু জানে দেহের বিনিময়ে
খাদ্য চাই খাদ্য চাই
যে চায় সে পায় মাধবী
নয় ফুল নয় লতা মাধবী
সে নষ্ট নারী
তাকে সমাজ সভ্যতা এড়িয়ে চলে
আইনের শেকল তার পেছনে চলে
ধরা পরে ছাড়া পায় ফিরে আসে আবার
মানুষের কাছে , মানুষের কাছে
নষ্ট নারী কেন তারে বলে
সে নিজেও তা জানে না
সে শুধু জানে দেহের বিনিময়ে
খাদ্য চাই খাদ্য চাই
যে চায় সে পায় মাধবী
নয় ফুল নয় লতা মাধবী
সে নষ্ট নারী
নষ্ট সে হয়েছে কাদের ইশারায়
দুঃখ অভাব আর ক্ষুধারই জ্বালায়
নষ্ট পুরুষ সব কাছে চলে আসে
তাদের দুচোখে লোভী দৃষ্টি ভাসে
মাধবী জানে না কেমন করে
বদলে গেছে সে নষ্ট নারীতে
সংসার শান্তি এসব কিছু আর
নিলো না মাধবীকে আপন করে
যে চায় সে পায় মাধবী
নয় ফুল নয় লতা মাধবী
সে নষ্ট নারী
সময়ের আগে তাকে চলে যেতে হয়
প্রানহীন দেহখানি পৃথিবীতে রয়
নষ্ট পুরুষ সব তাকে ভুলে যায়
নতুন নষ্টা নারী পাবারই আশায়
মাধবীর মরনে কারো ব্যথা নেই
মরনের কষ্ট মাধবী জানে
মাধবীর দেহখানি জঞ্জাল হয়ে
চলে যায় কোন এক অজানায়
আজ বলি একসাথে মাধবী
নয় ফুল নয় লতা মাধবী
সে নষ্ট নারী
দুঃখ কষ্ট যার ছিলো সারি সারি
মাধবী
প্রিন্স মাহমুদ মানেই তুমুল শ্রোতা নন্দিত সারা বাংলাদেশ কাপাঁনো চমৎকার চমৎকার সব অ্যালবাম। প্রতিটি অ্যালবামের সর্বাধিক গানই নান্দনিক, তারুণ্যদীপ্ত কথামালায় গাঁথা ও অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় গড়া অনন্যসব সংকলন। শক্তি, ক্ষমা, ঘৃণা, শেষ দেখা, এখনও দু'চোখে বন্যা, দাগ থেকে যায়, স্রোত এই অ্যালবামগুলি ব্যান্ড সঙ্গীতে অনন্য সংযোজন হিসেবে টিকে থাকবে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসের পাতায়। সেই ইতিহাস প্রিন্স মাহমুদের ইতিহাস।
সেই ইতিহাস বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এক যুবরাজের ইতিহাস।
** দুই খন্ডে প্রিন্স মাহমুদ'কে নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। প্রথম খন্ডে পুরো ৯০ দশক তুলে এনেছি। তবে প্রিন্স মাহমুদ'কে মূল্যয়ল করতে আমি এই পোষ্ট লিখিনি। প্রিন্স মাহমুদ আমার অসম্ভব প্রিয় এক গানের মানুষ।
যার প্রতিটি অ্যালবাম কিনে শুনে শুনে বড় হয়েছি। সেই গান গুলো নিজের অস্তিত্বে ধারণ করেছি। আর তাই আমার এই প্রিয় গানের মানুষটির করা চমৎকার কিছু গানের তথ্য দিয়েই সাজালাম এই পোষ্টটি। উদ্দেশ্য দুটিঃ এক. আপনারা যারা এই পুরোনো চমৎকার গানগুলো শুনেছেন কিন্তু কালের স্রোতে হয়ত ভুলতে বসেছেন কিংবা একসময়ের আপনার প্রিয় সেই গানটি আপনার সংগ্রহে নেই। দুই. নতুন প্রজন্মের সুস্থধারার কিছু গানপাগল মানুষ, যারা বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের সেই সব চমৎকার গানগুলো শোনার সুযোগ পাননি; হতে পারে সেটা তথ্যগত ঘাটতির কারণে কিংবা চমৎকার গান আছে পুরোনো সেই সব গানে জেনেও শুধুমাত্র সংগ্রহে না থাকার কারণে সেই সব অতি চমৎকার গানগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আপনাদের জন্য রেডিও বিজি২৪ নামে ফেসবুকে একটি পেইজ পরিচালনা করছেন কবি ও কাব্য। এবং একাধারে তিনি সংগ্রহ করেছেন ও করছেন হাজার হাজার পুরোনো শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া গান। বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের যেকোন পুরোনো গান পেতে ঘুরে আসুন রেডিও বিজি২৪, যেখানে দুর্লভ বলে কিছুই নেই।
রেডিও বিজি২৪ লিংকঃ http://www.facebook.com/kokbd24
*** প্রিন্স মাহমুদের প্রকাশিত অ্যালবামসমূহ।
০১. শক্তি
০২. ওরা এগার জন
০৩. ক্ষমা
০৪. ঘৃণা
০৫. ব্যবধান
০৬. দূর থেকে ভালবেসে যাব - কামাল আহমেদ (ঠিক মনে নেই)
০৭. শেষ দেখা
০৮. এখনও দু'চোখে বন্যা
০৯. দাগ থেকে যায়
১০. স্রোত
১১. দেয়াল দুই হৃদয়ের মাঝে
১২. প্রিয় বন্ধুকে - ভেলেন্টাইন স্পেশাল
১৩. হারজিৎ
১৪. পিয়ানো
১৫. চিঠির উত্তর দিও
১৬. তাল - হাসান
১৭. মেহেদী রাঙ্গা হাত
১৮. ছুটি - এবি, হাসান, জেমস
১৯. হীরা চুনি পান্না - আসিফ, সুমন, আতাহার টিটু
২০. এক মুঠো জোছনা - কুমার বিশ্বজিৎ
২১. কিশোর কিশোরী - বাপ্পা, কানিজ সুবর্না
২২. দুই দিনের মেলা -এন্ড্রু কিশোর (আর কে যে ছিল ঠিক মনে নেই)
২৩. ১২ মাস - এবি, হাসান, জেমস, মাকসুদ
২৪. এক টুকরো চাঁদ - খালিদ
২৫. গায়েঁন – এন্ড্রো কিশোর
২৬. ও পুতুল আমার পুতুল - আরিফ
২৭. দহন শুধু তোমার জন্য - এবি, হাসান, জেমস, বিল্পব
২৮. সারেগামা - হাসান, জেমস
২৯. পদ্ম পাতার জল - এন্ড্রু কিশোর, আতিক হাসান
৩০. দেশে ভালবাসা নাই - এবি, জেমস
৩১. যন্ত্রনা - এবি, জেমস
৩২. হ্যালো কষ্ট - হাসান
৩৩. প্রতারণা - এবি, জেমস
৩৪. মাটি - এবি, জেমস
৩৫. দেনা পাওনা - এবি, জেমস, হাসান
৩৬. বাজনা - এবি, জেমস, বিল্পব
৩৭. ভালবাসা মানে দুঃখ - হাসান
৩৮. আড্ডা - মেহরাব, রুমী
৩৯. দেবী
৪০. বন্দনা - মাহাদী
৪১. হাটি - কুমার বিশ্বজিৎ, ফাহমিদা নবী
৪২. ঘুমাও - খালিদ
৪৩. বোকা - ক্লোজাআপ ওয়ান তারাকাদের নিয়ে
৪৪. প্রিন্স মাহমুদের গান - প্রিন্স মাহমুদ, পলাশ, মেহরাব, ফাহমিদা নবী
৪৫. নির্বাচিতা (প্রিন্স মাহমুদের সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যালবাম)
৪৬. জয় পরাজয় - তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, খালিদ হাসান মিলু, আগুন (তথ্যঃ সোহাস আল-আমিন)
কারেকশানঃ ওরা এগার জন অ্যালবামটি শক্তি অ্যালবামের পর প্রকাশিত হয় (তথ্যঃ পাপ্পু ভাই)।
আমার এই পোষ্টে অসচেতনতার কারণে এই অ্যালবামের কোন তথ্য সংযোজন করতে পারিনি।
প্রিন্স মাহমুদ এর কণ্ঠের কিছু দুর্লভ গান -
১ সে কেমন মেয়ে- (Click This Link)
কণ্ঠ- প্রিন্স মাহমুদ
ব্যান্ড - ফ্রম ওয়েস্ট (১৯৯১)
২ মন যারে চায়- (Click This Link)
কণ্ঠ - প্রিন্স মাহমুদ
ব্যান্ড- ফ্রম ওয়েস্ট
অ্যালবাম- আবেগ ( ব্যান্ড মিক্সড ১৯৯২)
৩ তোমাকে ছাড়া জীবন আমার - (Click This Link)
কণ্ঠ- প্রিন্স মাহমুদ
ব্যান্ড- ফ্রম ওয়েস্ট
অ্যালবাম- আবেগ (ব্যান্ড মিক্সড)
৪ চলে গেছো - (Click This Link)
কণ্ঠ- প্রিন্স মাহমুদ
ব্যান্ড- ফ্রম ওয়েস্ট
অ্যালবাম- আবেগ (ব্যান্ড মিক্সড ১৯৯২)
৫ চাঁদ জাগা রাত্রি - (Click This Link)
কণ্ঠ- প্রিন্স মাহমুদ
ব্যান্ড- ফ্রম ওয়েস্ট
অ্যালবাম- আবেগ (ব্যান্ড মিক্সড ১৯৯২)
লেখকঃ মোখলেছুর রহমান সজল
২১.১১.২০১১
প্রকাশ এ সহযোগিতায় -" RaDiO bg24"
দুর্লভ কে করেছে সুলভ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।