আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও ‘গোঘ্ন’ ছোটগল্পের গল্প হয়ে ওঠার গল্প আবু নোমান

পড়তে চাই বেশি বেশি ২০১২ সালটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কথাসাহিত্যিক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলাদেশের নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ এবং তারাশংকরখ্যাত তুখোড় গাল্পিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মৃত্যু হয়েছে এ সালেই। কথাশিল্পী কিংবা কবিরা মারা যান না-এ কথা এ তিনজন লেখকের জন্য অবশ্যই প্রযোজ্য। উপরিউক্ত তিনজন লেখকের লিখার পরিমান বিশাল। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে তাঁদের রচনার এ বিশালতা তাঁদেরকেও ইতিহাসে বিশাল করে রাখবে-এ প্রত্যাশা সকল বাংলাভাষী পাঠকের।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জীবন বর্ণিল সব ঘটনায় বৈচিত্রময়। শৈশবে তিনি তাঁর গ্রাম খোশবাসপুরের দারকা নদীর অববাহিকায় ছুটে বেরিয়েছেন। উলুকাশের জঙ্গলে পাখি ওড়ার দৃশ্য, খাগরি নামক নালায় মাছ ধরার আনন্দ আর স্কুল ফেলে রাখালদের সাথে ঘুরে ঘুরে স্বাধীনতার অর্থ অনুভব করেছেন। বাঢ়ির আবদ্ধ পরিবেশ তাঁকে ভাল লাগেনি। ভাল লাগেনি নিয়ম আর পাঠ্যক্রমের জটিলতায় মুখ গুঁজে আটকে থাকা।

না ! পড়াশোনার প্রতি অনাগ্রহের কারণে নয়, পড়াশোনা তাঁর ভালবাসা। তবে পাঠ্যক্রমের অনিবার্যতা নয়, ইচ্চেমত, খুশিমত বিষয়ই তাঁর আরাধ্য। প্রকৃতির অমোঘ সৌন্দর্য যেমন তাঁকে আহবান করতো-তিনি বেরিয়ে পড়তেন-জঙ্গলে, মাঠে-ঘাটে-বিলে; পারিবারিক লাইব্রেরিতেও তিনি বইয়ের স্তুপে মুখ গুঁজে খুঁজে ফিরতেন-বিচিত্র সব বিষয় ও পরিবেশ। তাঁর জন্ম ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ডামাডোলের ইতিহাস ভাঙচুরের যে দোলা, তা সে সময়ের সমাজ জীবনকেও আলোড়িত করেছে।

তিনি বাড়ি থেকে কোলকাতায় আসেন পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। এ সময়ে বামপন্থী রাজনীতি এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। যাত্রা থিয়েটরে কাজ করতে গিয়ে অনেক সামাজিক কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। এ সময়ে কোলকাতায় যে রায়ট শুরু হয় তাতে তাঁকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁর গ্রামের বাড়ি খোশবাসপুরে। আবার গ্রামের দারকা নদীর অববাহিকার সেই নির্জনতা, খাল-বিল-জঙ্গলের সাথে বসবাস।

বাবা ছিলেন স্বদেশী। সেই অপরাধে বাসায় আসতে পারতেন না। মা সিরাজের নয় বছর বয়সেই মারা যান। ্ কাকীর কাছে বড় হতে থাকেন এই শিল্পী। মা, কাকী দুজনেই লিখালিখি করতেন।

এ সব আবহ তাঁকে নাড়া দিয়েছিল –তিনি প্রথমত কবি হয়ে উঠলেন। তারপর তাঁর বিচরণ উপন্যাস-ছোটগল্পে। চাকুরি করেছেন সাহিত্য পত্রিকায়। ফলে তাঁর মেধাকে সানিয়েছেন সাহিত্যচর্চায়, স্বপ্ন জাগিয়েছেন আর পরিশ্যমী এই লেখক নিত্য রচনা করে ঘেছেন বিখ্যাত বিখ্যাত সব উপন্যাস আর ছোট গল্প। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বহরমপুর শহরের সুপ্রভাত পত্রিকায় প্রথম গল্প লিখেন ‘কাঁচি’।

সেই থেকে শুরু। এরপর মফসসল থেকে শহরের নানা পত্রিকায় তাঁর অনায়াশ প্রবেশাধিকার বাংলা সাহিত্যে তাঁকে অনিবার্য করে তোলে। মাঝে মাঝে তিনি ইবলিশ নামে লিখতেন। কোলকাতার বিখ্যাত ছোট গল্প পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্প ছিল ‘তরঙ্গিনির চোখ’। তারপর কোথায় নয় ? সাহিত্য সৃষ্টিতে তখন তাঁর নেশা ধরার মত অবস্থা।

‘দেশ’ তখনও ভারতবিখ্যাত পত্রিকা। সেখানে তাঁর গল্প না ছাপানোর মনোকষ্টও দূর হয়ে গেল। আর ফিলে তাকাতে হয়নি তাঁকে। লিখেছেন অগণিত উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ। প্রবন্ধ লিখেছেন একান্তই দায় থেকে।

উপন্যাসেও তিনি দ্যুতি ছড়িয়েছেন। তবে তিনি নিজে মনে করেন, ছোট গল্পকার হিসেবে তিনি যতটা সার্থক হয়েছেন, উপন্যাসে তিনি ততটা দিতে পারেননি। গোঘœ তাঁর বিখ্যাত একটি ছোটগল্প। অন্যান্য অনেক বিখ্যাত গল্পের সাথে সাথে গোঘœ গল্পটিকেও তিনি তাঁর মেধা-মনন ও পরিশীলতা দিয়ে সাজিয়ে বাংলা সাহিত্যে অমর আছেন এবং থাকবেন। ছোটগল্প অবশ্যই লেখকের কল্পনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

গল্পের ঘটনার স্থান, কাল ও পাত্রের পরিষ্ফুটনে লেখকের স্বকীয় ধ্যান-ধারণা ও অভিজ্ঞতাই মূখ্য বিষয়। শিল্পে ছোটগল্পের অবস্থান শক্তিশালী-এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গোঘœ গল্পটি শুরু হয়েছে এইভাবে, “চারু মাস্টারের বেহালা শুনে দোলাই বড় কেঁদেছিল। দোলাই ছিল নরম মনের ছেলে। বলেছিল আপনার যন্তরে কী জানি কী যাদু আছে, কলজে টাটায়।

হেই মাস্টারবাবু, আপনার বিটির বিভায় যত কুমড়া লাগবে, হামি দিবো। যত কলাই লাগবে, হামি দিবো। ...দোলাই তার আগেই গাবতলার গোরে ঘুমাতে গেছে। ” গল্পটিতে তিনটি স্তর বা ভাগ লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্তরে গল্পের নায়ক হারাই রাঢ় অঞ্চলে গরুর গাড়িতে করে তার মৃত ভাইয়ের চারু মাস্টারকে দেয়া কথা রাখতে এসেছে।

তার ভাই দোলাই রাঢ়ের এই চারু মাস্টারের বেহালার সূর শুনে মুগ্ধ হয়ে এ কথা দিয়েছিল। কথা রাখতে হারাই দু’ বস্তা কলাই, কুড়িটা বড় বড় কুমড়ো সাথে এনেছে। দোলাই মারা গেছে। কিন্তু চারু মাস্টারকে দেয়া দোলাইয়ের সে কথা পালন করার জন্য তার ভাই হারাইকে এই দূরাতিক্রম্য পথের পথিক হতে হয়েছে। গরুর গাড়ির সঙ্গে ধনা-মনা দুটো গরু।

চারু মাস্টারের বাড়িতে হারাই রাঢ়ি চালের মিষ্টি ভাত খায়। সে বলে, হামারঘে দ্যাশে রাঢ়ি চালের ভাত খায় শুধু আমির-বড়লোকে। চারু মাস্টারের মেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কী খাও চাচা? উত্তরে হারাই বলে, মোটা মাসকলাই, আটার লাহারি, ছাতু, ভুজা, গেঁহু উঠলে আম-কাঁঠালের সঙ্গে গেঁহুর আটার চাপড়ি। আউষের ভাত মাত্র মাসে কয়েকদিন। তাদের রাঢ়ি অঞ্চলের চাল নিতে বছরে সে একবার আসে, সেটিও সে বলে।

হারাই রাঢ়ি অঞ্চলে শুধুমাত্র মাঙতে আসে না। রাঢ়িতে যা নিয়ে আসে তার ঠিক ঠিক ওজন অনুসারে সে এ অঞ্চল থেকে মিষ্টি ধান নিয়ে যায়। এই ধানের অপেক্ষায় লম্ফ হাতে পাটকাঠির বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে তার বৌ আর ঘুম ঘুম চোখে ছেলে মেয়েরা প্রত্যাশার ঝকমকে চোখে প্রত্যাশা করে, বাপ ফিরে এলে রাঢ়ি মিঠা ধানের ভাত খেতে পাবে। এভাবেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তাঁর গল্পের শুরুতে গল্পের স্থান-কাল-পাত্রের বিবরণ দিয়ে দিলেন। একজন শক্তিমান লেখকের জন্য আলাদা করে বলে দেয়ার প্রয়োজন হয় না এটি কোন সময়ের কোন প্রেক্ষাপটে লিখা।

গল্পের ভাষা, পরিভাষা গল্পটিকে আকর্ষণীয় করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গল্পের দ্বিতীয় অংশে দেখা যাচ্ছে, হারাইয়ের দুটো বলদের মধ্যে বামদিকের বলদটি অসুস্থ। চারু মাস্টারের পরামর্শক্রমে সানকিডাঙায় পিরিমল বদ্যিকে দিয়ে হারাই রাঢ়ি থেকে ফিরে আসার পথে বামদিকের বলদ ধনাকে দেখাতে নিয়ে এসেছে। পিরিমল বদ্যি গরুর কী অসুখ হয়েছে, জানতে চায়। হারাই বলে, বাঁওয়ালি বলদের ছ্যারানি।

পিরিমল বদ্যির ওষুধ খরচস্বরূপ পাঁচসিকে চায়। হারাইয়ের কাছে বারো আনা আছে। সে সেটা দিতে পারে, জানায়। অনিচ্ছাস্বত্তেবও পিরিমল রাজি হয় ওষুধ দিতে। হারাই অর্জুন তলায় গরু দুটোকে বেঁধে রেখেছিল।

পিরিমল তা দেখে বলে উঠলো, হায় হায় হায়! আবাগীর বেটা করিছে কীগো! হারাই ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, এখানে কালু দিয়াড়ের ইসমিল আত্মহত্যা করেছিল। হারাই শিউরে ওঠে। মনের মধ্যে খালি কু গায়। পিরিমল বদ্যি ধনা গরুকে ওষুধ দেয়। কিছু পরামর্শ দিয়ে পয়সা নিয়ে চলে যায়।

রাত নামছে পথে। হারাই ধনাকে ওষুধ খাওয়াতে চেষ্টা করে। ওষুধ মুখ থেকে গড়িয়ে যায়। আবার চেষ্টা করে। নির্জন এলাকা অন্ধকার ভয়ংকর হয়ে আসে।

অন্ধকার নেমেছে চারদিকে। দূরে শেয়াল ডেকে ওঠে। আচমকা অর্জুনের ডালে প্যাঁচা ডেকে ওঠে। হারাইয়ের শরীর ভয়ে ভারী হয়। বিড়বিড় করে দোয়া আওড়ায়।

হারাই শীতে এবং ভয়ে কাঁপতে থাকে। দু বেলা নামাজ পড়া হয়নি তার। অর্জুনের ডালে কারা যেন চাপাস্বরে কী বলাবলি করে। সামনে ওই ভয়ের রাতের মুখের হাঁ বড় হতে থাকে। মাকড়সার জালে আটকে পড়া পোকার মত নি:সাড় হয়ে জ্বলজ্বলে চোখে বাঘরি দেশের গাড়োয়ান।

রাতের অন্ধকার, শীতের কামড় এবং ধনার অসুখের চিন্তা হারাইকে এক অস্বাভাবিক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে। এদিকে অর্জুন গাছে ইসমিলের আত্মহত্যার কথাটি হারাই মন থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে ইসমিলের শুকনো ডালটা দেখে। বিভিন্ন চিন্তা মাথায় আসে হারাইয়ের। নিজ পরিবারের কথা মনে হয় হারাইয়ের।

গাড়িতে রয়েছে তিন বস্তা ধান। সাদা ঝকমকে স্বাদু সুগন্ধময় ধান দেখে বৌ-ছেলে-মেয়েরা খিলখিল করে হেসে উঠবে। পরক্ষণেই রুগ্ন গরুর কষ্ট অনুভব করে হারাই। গরুর গায়ে হাত রাখে স্েস্নহে। ধনার পিঠের কাঁপন টের পায়।

বলে, বাপ, ধনারে, ...কষ্ট করে এট্টু গা তোল বাছা ! বদ্যির ওষুধ খেয়েছিস আর ভয় কিসের? ওরে ব্যাটা ! না না ! ভাবছিস তোকে গাড়ি টানাবো ফির (ফের) ? হামি কি লিদয়া মানুষ? সোনার হামা, ওঠ্ দিকিনি ! হারাই নিজ মনে কথা বলতে থাকে। “বুঝিরে বুঝি ! সেই ছুটো থেকে মাগ-মরদে পেলেছি, তু হামারঘে বেটা। হামারঘে কলিমদ্দি, ছলিমদ্দি, অসিরদ্দি যেমন ব্যাটা, তোরা ধনা-মনাও হামারঘে ব্যাটা। ওঠ্ বাপ। হুই মোদিপুর ! হুই দ্যাখ।

” কখনো কখনো রেগে ওঠে বলে, ‘জেভিয়ে’ -সেও অন্য এক আদরের ডাক। গরুর কষ্ট নিজে অনুভব করে। বলে, ‘গো-জন্মের কী কষ্ট? হুঁ গো-জন্মে বড় কষ্ট বাপ। ’ অবোধ, অসুস্থ গরুকে গাড়ির পেছনে বেঁধে হারাই নিজে তার বদলে নিজ ঘাড়ে জোয়াল তুলে নিয়েছে। সানকিডাঙা থেকে দুক্রোসের পথ মেদিপুর শেষ হতে চায় না।

অন্ধকারের পথে পথে কত কী ঘটে যায়। অন্ধকারের ছায়ায় হঠাৎ এক মূর্তি ভেসে উঠে। হারাই চমকে ওঠে। লোকটির সালাম শুনে হারাই আশ্বস্ত হয়। লোকটি নিজের পরিচয় দেয়, নাম দিলজান।

গরুর অসুস্থতা নিয়ে কথা হয়। হারাইও নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, তার নাম হারুন। অভিজ্ঞ গরুর কশাই দিলজান। গরুটিকে ভাল করে লক্ষ্য করে বলে, গরুটির গতিক ভালো না। রাত পেরোয় কিনা।

শুনে হারাই আঁতকে বোবা ধরা গলায় চিৎকার করে বলে, বাঁচবে না ? দিলজান গরুটিকে কিনে নিতে চায়। নিজে নিজেই দাম হাঁকে, ত্রিশ-চল্লিশ, পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত। ধনা নামক এ গরুটির প্রতি হারাইয়ের ভালবাসার ব্যাকুলতা এ সময়েই ফুটে ওঠে প্রবলভাবে। বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের পশুর প্রতি বিশেষ করে গরুর প্রতি ভালবাসার গল্পের উদাহরণ পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্রের মহেশ এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে।

হাসান আজিজুল হকের আমৃত্যু আজীবন কিংবা নাজিব ওয়াদুদের কসাই গল্পেরও উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিটি গল্পের ক্ষেত্র, পরিস্থিতি ও আঙ্গিকতা ভিন্ন ভিন্ন। শরৎচন্দ্রের মহেষকে বিক্রি করতে হচ্ছিল দুর্ভিক্ষপিড়িত বাংলার নিম্নবৃত্তীয় মানুষের ক্ষুধা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে। শরৎচন্দ্রের গফুরও তার গরুকে বিক্রি করতে চায়নি। সে তার গরুকে নিজ ভঙ্গুর ঘরের চাল থেকে খড় খুলে কিংবা নিজ খাবার থেকে গরুকে দিতে গিয়ে মেয়ের তিরস্কারকেও প্রাপ্য বিবেচনা করেছে।

নাজিব ওয়াদদের কসাই গল্পটিতেও হারেজুদ্দীন তার প্রিয় মৃত সন্তান মাহাজানের হাতের ছোঁয়ালাগা গরুকে বিক্রি করতে চায় না। গরুকে সে শাহাজানই মনে করে। মনে করেএটিই তার শাহাজান পুত্র। তথাপি সমাজের বিভিন্নরূপী কসাইয়ের কাছে তাকেও নতি স্বীকার করতে হয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গরু বিক্রি করতে হচ্ছে গরুটি হঠাৎ অসুস্থ হয়েছে বলে, কসাইয়ের চাপে।

এক্ষেত্রেও হারাইয়ের অভাব ছিল না বলা চলে না। কিন্তু এমন অসুস্থ গরুর প্রতি শুধুমাত্র পুত্রবৎ স্নেহই তাকে কষ্ট দিচ্ছে। একজন চাষী কতটা দরদী হলে সে তার পুত্রের চেয়েও গরুকে ভালবাসতে পারে গোঘœ একটি উদাহরণ। গরুর প্রতি স্নেহ-ভালবাসা গল্পটির ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে দিয়েছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। গল্পে দেখা যাচ্ছে, কোনো অবস্থায়ই হারাই ধনাকে বিক্রি করতে চায় না।

কসাই দিলজান রেগে ওঠে, একসময় পরাস্ত হয়। সে ফিরে যায়। হারাই ধনার গায়ে হাত দেয়। দোয়া গঞ্জল আরশ পড়তে থাকে। অসুস্থ ধনার হাঁটতেও কষ্ট হয়।

হারাই ধনাকে সাহস দিচ্ছে, ডর কী ? হামি তো আছি। চারদিকে ফজরের আজান হয়। হারাই তার গাড়ি থামিয়ে পাশের পুকুর থেকে অজু করে নেয়। আল্লাহকে মুহুর্মুহু ডাকতে থাকে। হুহু করে কেঁদে বলে, হামার বেটার জান মাঙি হুজুর।

আর কিছু মাঙি না সংসারে। ...হেই পরোয়ার দিগার ! হামরা মাগ-মরদে বাঁজা লই তুমার মেহেরবানিতে। তুমি এক ব্যাটার জানের বদলে হামারঘে আরেক ব্যাটার হায়াত দাও। এখানেও হারাইয়ের গরুর প্রতি ভালবাসার গভীরতা অনুভব করার মত। নিজ পুত্রের জীবনের বদৌলতে গৃহপালিত পশুর জীবন ভিক্ষা করে হারাই পশুর প্রতি প্রেমের এক বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে।

গৃহপালিত পশুর জীবনের বিনিময়ে নিজপুত্রের জীবন হারাতে প্রস্তুত-এমন আরেকটি দৃশ্য আমরা পাই হাসান আজিজুল হকের আমৃত্যু আজীবন নামক গল্পে। সেখানে দেখা যায়, করমালির একটি বলদকে সাপে কেটেছে। করমালির স্ত্রী জোরে জোরে বিলাপ করে। ‘কি কাল সাপে খাইছেরে- ওরে আমারে ক্যান নেলে না। ’ গরুটির মৃত্যুচিন্তায় কমরমালি বিভোর হয়ে বারবার নিজপুত্র রহমালির জীবনের বিনিময়ে হলেও বলদটির জীবন বাঁচাতে চায়।

ক্ষেত্র, পরিস্থিতি, আঙ্গিকতা আলাদা হলেও নিকটতম অতি আপন মানুষের জীবনের বিনিময়ে পশুর জীবন বাঁচাতে চাওয়ার মধ্যে সমাজের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, প্রাণীর প্রতি অন্য এক মানবতাবোধ নিঙড়ে বের করার কৃতিত্ব সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তাঁর গোঘœ গল্পে সার্থকতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। হারাই পরিস্থিতির চাপে পড়ে এক সময় ধনাকে আরো কমদামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। সেই দিলজান কসাই গরুটিকে ত্রিশ টাকায় কিনে নেয়। টাকা হারাইয়ের হাতের আঙুলের ফাঁকে জোর করে গুঁজে দেয়। হারাইয়ের চোখে তখন শব্দহীন জল।

গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়টি এখানেই শেষ করা যায়। গল্পের তৃতীয় অধ্যায়ে একটি নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। গল্পটি মোড় নেয় নতুন এক আঙ্গিকে, নতুন সমস্যায়। ধনা গরুর বদলে হারাই যখন বাঁওয়ালি জোয়াল কাঁধে পথে চলছিল, সে সময় বদর হাজি নামক একজন সজ্জন মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। হারাইকে জোঁয়াল কাঁধে বলদের মত চলতে দেখে বদর হাজি তাকে বিভিন্ন ধরনের তিরস্কার করে তার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে।

হারাই উত্তরে পদ্মার ধার শিমুলেকেষ্টপুর বলে। এ জায়গাটি তাদের সে সময়ের অবস্থান অর্থাৎ মেদিপুর থেকে প্রায় বিশ ক্রোশ বা চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্বে। বদর হাজি হারাইকে কারো গাড়ির সঙ্গে তার গাড়ি বেঁধে নেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ আপ্যায়নের ব্যবস্থাও করেন। বদরহাজিকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ও অমায়িক স্বভাববিশিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

তিনি মেহমানকে অত্যন্ত খাতির যতœ করে থাকেন। সে বেলা তিনি মৌলবি সায়েব এবং হারাইকে দাওয়াত দিয়ে যতœ আত্তি করে খাওয়াতে বসালেন। বদর হাজি নিজেই প্রথমে মৌলবি সায়েবকে তারপর হারাইকে তরকারি তুলে দিচ্ছেন। হারাই ভাত এবং মাংশের টুকরো মুখে নিয়েছে। বদর হাজি গল্প জুড়ে দিয়েছেন, “আমার ভাগ্নেব্যাটা একেবারে গো-খাদ (খাদক) আজ হাটবার ছিল।

দিলজান একটা হালাল করেছে শুনে নিয়ে এসেছিল। ” শুনে হারাই আচমকা হতচকিত হয়ে থুথু করে ফেলে দেয়। বমি করে। হারাই তারই পুত্রবৎ স্নেহে লালিত পুত্রের চেয়েও অধিক প্রিয় পশুর মাংস খেতে পারে না। ধর্মে যা-ই বলুক সে কি পুত্রের মাংস খেতে পারে ? তাই সকলের আবেদন-তিরস্কারকে উপেক্ষা করে সে বলে ওঠে, হেই হাজি সাব! হামাকে হারাম খাওয়ালেন ! জবাই করা পশুর মত হারাই ছটফট করতে থাকে।

হারাই ফিরে যায় পেছনে। মনে পড়ে তার মৃত ভাই দোলাইয়ের কথা। মনে পড়ে দোলাই চারু মাস্টারের মেয়ের বিয়েতে যে কুমড়া-কলাই দিতে চেয়েছিল-তার কথা। চারু মাস্টারের বাঁশির সূর ভেসে আসে। মনে হয় তার বৌ ধনা-মনা এবং তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে প্রহর গুণছে।

ধনা-মনার পাঁ ধুয়ে দেবে বলে তার এই অপেক্ষা। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গোঘœ গল্পটি এভাবেই গল্প হয়ে উঠেছে। আমি মনে করি বাংলার এই চাষাভুষা, গ্রামীণ নিম্নবৃত্তীয় মানুষের বুকের কষ্ট, ভালবাসা, তাদের বেঁচে থাকার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাগুলোকে তিনি এভাবেই কালি ও কলমের আঁচড়ে এঁকেছেন। তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পেই তিনি এমন এক একটি বিশেষ গ্রামীণ পরিবেশ ও আবহ তৈরিতে সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। এভাবে উচ্চতাসম্পন্ন মানুষের লাইব্রেরীতে, পড়ার টেবিলে, শহুরে পরিবেশে, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ উপস্থাপন করে দিলেন গ্রাম্য সেই অভাবী-অভদ্র মানুষগুলোকে সাজিয়ে, বর্ণিল রঙে-ঢঙে, আয়োজনে।

একটানা গোস্ত-মাছের আয়োজনে ক্লান্ত খাদকের কাছে ভিন্নতার মতই তিনি গ্রাম্য সহজ-সরলতাকে নিয়ে এসেছেন আপন সৃষ্টিতে। তাই তো সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ নিজেও গল্প হয়ে গেছেন। তাঁর জীবন-গল্পের শেষও তিনি রচনা করলেন এই ২০১২ সালেই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.