পি এম বাহার আহমেদ ধারাবাহিক সাহসী বীরের গল্প
হেলেনাকে উদ্ধার পর্ব-দুই
অলাম্বস একটা বড় গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর স্রো স্রো শব্দে জেগে উঠে। চার পাশে তাকালে গভীর অন্ধকারে কিছু দেখা গেলো না। আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে। এবার শব্দটা আরো জোরে হয়।
চোখ খুলে দেখতে পায় তার সামনে ভয়ংকর দানব। দানব’টার শরীরের আকৃতি অজগর সাপের মতো।
চোখ দু’টি লাল, নীল ও সবুজ রঙ এর স্ফুলিঙ্গ ছেড়ে তেড়ে আসছে। মনে হচ্ছে কালো মেঘের ছায়ায় দু’টি রংধেনু আকাশ থেকে মাটিতে পড়ছে। ভয়-ভয়ংকর একটা দৃশ্য।
স্ফুলিঙ্গ দু’টি অনেক’টা কাছে চলে এসেছে। এবার বুঝা গেল, অজগরের মুখটা এত বড় যে এক নিঃশ্বাসে অলাম্বসের মতো দু’টা মানুষ খেয়ে সাবাড় করতে পারে। অলাম্বস ভয় পেল। যে ভয় আর কখনো পায়নি।
হঠাৎ করে একটা মেয়েলি কণ্ঠ শুনা গেল।
“ভিতু অলাম্বস”! অজাগর আধাঁরের সাথে মিশে গেল। শব্দ’টা বারবার বাতাসের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে।
‘কে তুমি?’ সম্বিত পেয়ে জানতে চাইল। কিন্তু কোনো শব্দ শোনা গেল না।
অলাম্বস চিন্তিত হলো।
অকারণে কেন এত ভয় পেল! সেতো কখনো এত ভয় পায়নি।
হঠাৎ করে তার পিছনের দিক’টা আলোকিত হয়ে গেল। ফিরে দেখে অনেকটা দূর বড় বড় আগুনের স্ফুলিঙ্গ মাটির দিক খেকে আকাশে উঠে মিলে যাচ্ছে। ব্যাপারটা খুব আশ্চার্য মনে হলো তার কাছে। অলাম্বস জানে ফিগো হেল পাহাড়ের আশ পাশে কোন মানব বসতি নেই।
এত গভীর পাহাড়ের জঙ্গলে আগুনের স্ফুলিঙ্গ কল্পনা করা যায় না। জীব-জানোয়ার আগুনে ভয় পায়। ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানবেরা আগুনের কাছে যেতে চায় না। একমাত্র মানুষ ছাড়া আগুন নিয়ে খেলা করার ক্ষমতা অন্য প্রাণীদের নেই। তাহলে এই ভূতদের আশ্রমে, দানবদের গুহায় আগুন জ্বালাবে কে? নিশ্চয় বণিক দল হতে পারে।
অলাম্বস পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গের দিকে হেঁটে চললো। একটু এগিয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে নিল। কি যেন মনে করে পিস্তল’টা ফের যথাস্থানে রেখে দিল। আগুনের স্ফুলিঙ্গের যতো কাছে যাচ্ছে, একটা ভয়ংকর-অদ্ভুত শব্দ ততো বেড়ে যাচ্ছে। এখন একটা উঁচু টিলায় উঠে দাঁড়ালো।
আতর্কিত ‘কেক-কে! বলে হালকা চিৎকার দেয়। শরীর’টা অবশ হয়ে যেতে লাগলো।
পৃথিবীতে এত ভয়ংকর দানব আছে, চোখে না দেখলে মানুষ বিশ্বাস করার মত নয়।
অলাম্বস স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বিশাল একটা দানব।
হাঁ- করছে আর তার মুখের ভেতর থেকে বিশালাকার অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে। আগুনের গোলাগুলো শূন্যের উপর ভেসে ভেসে আকাশের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। দানবের গলা থেকে সম্পূর্ণ মস্তক’টা দেখা গেল। বিশাল আকারের ভূমিটা যেন দেহ।
যে দানব আগুন নিয়ে খেলা করার ক্ষমতা রাখে, সে নিশ্চয় সাধারণ কিছু না।
অলাম্বস অনুভব করল, একটা অদৃষ্ট শক্তি তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মনে হচ্ছে, সম্পূর্ণ দেহ তার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সামনের দিকে একটু একটু করে এগোচ্ছে। কেন এগোচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে। বুঝতে পারছে না।
দানবের মুখের ভেতর মৃত্যুর গুহায় অলাম্বস যেতে চায় না। জেনে শুনে কোনো মানুষ মৃত্যুর ফাঁদে পা-দিতে চায় না। হোক সে মহা বীর, অথবা ধার্মিক। যে মৃত্যুর স্বার্থকতা নেই; সে মৃত্যু কেউ চায় না। অযথা অলাম্বস মরতে যাবে কেন? মনের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে।
না, আমি যাবো না। এটা মৃত্যুর গুহা। দুষ্ট দানবের কৃত্রিম দোযখ। এ’গুহায় আমার মৃত্যু হতে পারে না।
অলাম্বস মনকে বুঝাচ্ছে।
কিন্তু দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এমূহুর্তে পা-দু’টি তার মাটি থেকে শূন্যে উঠে যায়। বাতাসের সাথে ভেসে ভেসে দানবের ভয়াল অগ্নি স্ফুলিঙ্গের দিকে যাচ্ছে। দানব হাঁ-করে আছে। আগুনের মধ্যে দানবের জিহ্বা নীলের উপর কালো রঙ ধরেছে।
যেন কোটি বছর আগুনে ফুঁড়ে নীলের উপর কালো রঙ ধরেছে। জিহ্বার তুলনায় অলাম্বসের মত একজন বীর একটা শস্যদানার মতো।
ভেসে যাওয়ার গতি অনেক বেড়েছে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার প্রাণোবসান ঘটতে পারে। হঠাৎ করে দানব চোখ দু’টা মেলে ধরলো।
গাঢ় লালের মধ্যে কালো রঙ ঘেরা মনিটা। আবার চোখের মনিতে সাদা মেঘের আভা দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো কতো বড় হিসেব করা যাবে না। সব মিলিয়ে একটা ভয়ংকর দানব।
অলাম্বসের শরীরে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।
যন্ত্রণা ক্রমস বাড়ছে। দেহটা জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বোঝতে পারছে, মুখ দিয়ে নয়, দানবের চোখের গুহায় ঢুকে পড়েছে। চোখের ভেতর’টা ফুটবলের মতো গোলাকার। চোখের বল’টা গুড়ছে।
অলাম্বসও গুড়ছে। মানুয়ের চোখে পোঁকা ঢুকলে যা বুঝা যায়।
অলাম্বস বুঝতে পারে, যন্ত্রণার গতি যতো বাড়ছে, শারীরীক শক্তি ততো বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে। পিঠে একটা ব্যাগ থাকার কথা।
না, সেটা অনুভব হচ্ছে না। আমি যখন অক্ষত; নিশ্চয় কোমরে চাকু’টাও আছে। কোমর থেকে চাকু বাইর করতে খুব চেষ্টা হলো। শেষে বের করে হাতে নেয়।
এটি খুব ধারালো অস্ত্র।
খুব বিষাক্ত আঘাত। এ’মূহুর্তে কাজে আসবে। আর কিছু ভাবা দরকার হলো না। দানবের চোখের মনিতে আঘাত শুরু করে। আঘাত পেয়ে দানবের চোখের মনি তীব্র গতিতে গুড়তে লাগলো।
সে সাথে অলাম্বসও। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে পেললো। জ্ঞান ফিরে দেখে ছোট একটা সমতল ভূমিতে পড়ে আছে। তখনো সমস্ত শরীর শির শির করে কাঁপছে। কিছু দূর এগোলে দেখতে পায়, পিঠে ঝুলানো ব্যাগটা পড়ে আছে।
এখন মনে হচ্ছে না দানবের চোখের অভ্যন্তরে থাকা অবস্থায় ব্যাগটা ছিল কিনা। অথচ আগে ব্যাগ কোথাও রাখা হয়নি। অলাম্বস অবাক হলো। নিজে অক্ষত, কিন্তু পিঠে ঝুলানো ব্যাগ এতদূর এলো কি করে। দানব কোথায় গেল? আশ পাশে ঘটনার কোন চিহ্ন দেখা গেলো না।
এখন সব কিছু একটা রহস্য মনে হচ্ছ। তবে যাই হোক, শারীরীক অবস্থা দেখে মনে হলো- নিশ্চিৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা গেছে। এরপর অলাম্বস আর কিছু ভাবতে চায় না। সামনে অনেক কাজ, অনেক পথ, এমনকি অনেক বিপদ রয়েছে। সব বিপদ ডিঙ্গিয়ে তাকে ভূতের রাঁজা তানস ফিগো’র হাত থেকে রাজ কন্যা হেলেনা’কে উদ্ধার করতে হবে।
অলাম্বস হাঁটতে হাঁটতে এতো দুর্বল হয়- যে কোনো মূহুর্তে শরীর স্টাইক করতে পারে। এখন জিরিয়ে নেয়া দরকার। একটা ঝোপের ভেতর দিকে ঘাস, লতা-পাতায় ঘেরা ছোট্র ঝিল। ঝিল থেকে পরিস্কার পানি খুঁজে পান করল। কিছু পরিচিত ঘাস বা শাক সংরহ করে পেটের খিদা মিটালো।
বেলা শেষ পর্যায়ে চলে আসে।
আজো একটা গাছের নিছে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল। আঁধার নেমে আসার সাথে সাথে চার’দিকে বিক্রিত শব্দের হাক-ডাক শুরু হয়। মনে হচ্ছে, কয়েক হাজার দৈত্য-দানব হৈ হুল্লোর করছে। অলাম্বস নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়।
গত কালের মতো যখন তখন দানবেরা আক্রমন করতে পারে। আগে থেকে প্রস্তুত থাকা ভালো। রাত অনেক হয়েছে। অলাম্বসের চোখে ঘুম আসছে না। ভয়াল দানবদের ভয়ংকর থাবার আশংকায় তার ঘুম নেই।
মনের ভয়’টাও ক্রমে বাড়ছে। এ’সময় অতীতের কথা মনে হলো।
কিছুদিন আগের কথা-
অলাম্বসের প্রথম পরিচয় একজন সাহসী বীর। বিশ্ব জুড়ে তার সাহসের খ্যাতি। সমুদ্র শহরে মেলস্টোন শহরে যাচ্ছে।
প্রথিমধ্যে তার জাহাজ এক বিশাল দানবের খপ্পরে পড়ে।
অলাম্বস একটা সূত্র আবিস্কার করে, বাঁচতে হলে মরতে হবে। মরতে চাইলে বাঁচার পথ সুগম হয়।
জাহাজে অনেক অনেক অপন বন্ধুরা রয়েছে। এদের কেউ বাঁচবে না, যদি সে নিজেকে উৎসর্গ না দেয়।
তাহলে আর দেরি কেন! জাহাজের যাত্রী, নাবিকসহ আর সবাইকে বাঁচাতে অলাম্বস এক বস্তা বিষাক্ত খাবার নিয়ে সমুদ্রে নেমে পড়ে।
দানব ভয়ানক-ভয়ংকর।
বিশাল আকৃতির চোখজোড়া অলাম্বসের দিকে তাক করে আছে। এখন ভয় করে লাভ নেই। নাছতে নেমেছে, উঠোন বাঁকায় কি আসে যায়!
সে এক নির্ভীক যুবক।
এই বয়স মৃত্যু নিয়ে খেলা করার। মৃত্যুকে পরোয়া করা চলে না।
হাতের বস্তাটা ছুড়ে দেয় দানবের দিকে। বিশাল আকৃতির দানবের মুখটা বিশাল। হাঁ করে খাদ্যের বস্তা মুখে নিতে অলাম্বসও মুখের ভিতর চলে গেল।
কি হচ্ছে, কি ঘটছে বুঝতে পারলো না সে। কিছুক্ষণের মধ্যে পিচ্ছিল কিছু অনুভব করলো। ‘চার’দিকে অন্ধকার দুনিয়া। এটা নিশ্চয় মানুষের উপযোগী না। বুঝতে বাকি নেই, দানব বস্তার সাথে তাকেও গিলে খেয়েছে।
অলাম্বস জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে দানবের পেটে বিশক্রিয়া দেখা দেয়। যন্ত্রণা সৈর্য হচ্ছে না দানবের। বিদিশা হয়ে উপকূলে এসে ভুমি করে।
এক জেলে অলাম্বসকে জীবিত অবস্থায় পেল।
জেলের এক কুমারী কন্যা ছিল। নাম জেরিন। জেরিনের সেবা-যত্নে দু’মাসে অলাম্বস দুস্থ হয়। দীর্ঘ ‘এগারো’মাস কেটে যায়। জাহাজের সাথীদের কোন খোঁজ পেলো না।
কিছুদির আগে জানতে পেল, তার জাহাজ বেলুন্তন দ্বীপের ছোট একটা শহরে নোঙ্গর করেছে। হেলেনা’কে উদ্ধার করে বেলুন্তনে যেতে হবে।
অতীতের ঘটনা মনে হলে অলাম্বসের মনের ভয় দূর হয়।
দু’দিন পর দুপরবেলা। দূর থেকে একটা উঁচু প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে।
প্রসাদের আয়তন খুব বড় মনে হয় না। খুব পুরানা। খুব সুন্দর। এ’প্রাসাদে মানুষ বাস করতে পারে। কিন্তু আশে পাশে কাউকে দেখা যায় না।
মনে হচ্ছে, খুব কম মানুষ বাস করে। ভয়ে বাইরে বের হয় না। আতর্কিত একটা বিড়ালের ডাক শুনে ফিরে তাকালো। নাহ, বিড়াল দেখা গেল না। এত বড় গলায় বিড়াল কি করে ডাকতে পারে! বাঘা বিড়াল হতে পারে।
অলাম্বস সতর্কপা’য়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার বিড়ালের ডাক। ফিরে তাকালো, এবারো বিড়াল দেখতে পেলো না। নিশ্চয় মানুষ লালিত বিড়াল। আগন্তুক দেখে লুকোছুরিতে অভ্যস্ত।
মানুষের দয়ায় বড় হওয়া বিড়ালগুলো এমন হয। খুব দুষ্ট।
প্রসাদের প্রথম গেইট অতিক্রম করলো। দ্বিতীয় গেইট অতিক্রমের সাথে সাথে প্রথম গেইট বন্ধ হয়ে যায়। অলাম্বস অবাক হয়।
কাউকে দেখা গেলো না। গেইট কে বন্ধ করল! তৃতীয় গেইট পেরোলে একই ব্যাপার। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গেইট বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ করে একটা বিক্রিত গলার শব্দ শোনা যায়। ‘স্বাগতম, অলাম্বস! স্বাগতম মানব যুবক!’ কন্ঠটা হাওয়ায় ভেসে ভেসে হারিয়ে গেল।
অলাম্বস বলে, ‘ক তুমি?’ আর কোনো শব্দ এলো না। অবশ্য ধারণা করে নিল, এটা শয়তান ফিগোর প্রাসাদ হতে পারে। নিজ কে প্রস্তুত করে নিল। শয়তানের উপর বিশ্বাস নেই। যখন তখন আক্রমন করতে পারে।
চলবে-
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।