আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আঞ্চলিকতার দোষ

বলা হয়ে থাকে পুরো ভারতবর্ষ চষে বেড়ালে নাকি পৃথিবীর অর্ধকেটা দেখা হয়ে যায়। উক্তিটি তর্ক সাপেক্ষ্য তবে অগ্রহণযোগ্য নয়। সুপ্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস, বৈচিত্র, জীবনরীতি, ধর্ম বিশ্বাস ইত্যাদির দিকে এক নজর তাকালেই ব্যাপারটি অনুমেয়। বহুকাল যাবত একটি বৃহৎ সংস্কৃতি যখন বিক্ষিপ্ত আকারে আপন বৈচিত্র নিয়ে সহাবস্থান করে, তখন তাদের মাঝে ভাষা, আঞ্চলিকতা ও বিশ্বাসের উপর ভিক্তি করে কিছু বিভাজন সৃষ্টি হয়। এই প্রবণতাটি শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই নয় যথাক্রমে আরব উপদ্বীপ, আফ্রিকা, ইউরোপ ইত্যাদি প্রাচীন সভ্যতায় দেখা যায়।

পাশাপাশি সাময়িক স্বার্থের উপর ভিক্তি করে রাজনৈতিক বিভাজন বা সীমারেখা তৈ্রি ঐ নিদিষ্ট স্থানে বসবাসরত মানুষের জীবনকে কীভাবে ওলটপালট করে তার নজির যুগে যুগে ভারতবর্ষের মানুষ দেখেছে। সভ্যতা ও প্রযুক্তির শিখরে থাকা মানুষজনকেও এর তিক্ত আস্বাদন লাভ করতে হয়েছে। উদাহরণ জার্মানি। আর ইতিহাস নয়, আজকের বিবেচ্য বিষয় এক জাতির এক দেশ! বাংলাদেশের আঞ্চলিকতাবাদ। মন খারাপ করার কিছুই নেই।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এই প্রবণতা অনেক কম এবং তা সহনীয় মাত্রায় বিদ্যমান। নিন্মোক্ত বিবরণ গুলো আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধান প্রসূত এবং তা দেশের কিছু নিদিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। কিছুদিন আগে নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর এক মধ্য বয়স্ক মুরুব্বীর কৌতূহলদীপ্ত প্রশ্ন “ভাই আফনের দেশ কিতা, সিলটী নি?” কিছুক্ষন সময় নিয়ে ভাবলাম, আর চিন্তা করলাম সিলেট নামে কোন দেশতো রিসেন্টলি গুগোল ম্যাপে দৃষ্টি গোচর হয়নি! সিলেটের পর চট্টগ্রামের ব্যাপারে আসা যাক। বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে মূলত চট্টগ্রাম ও সিলেটে। অঞ্চলদুটি ঐতিহাসিক ও অর্থনৈ্তিকভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশ সমৃদ্ধ।

যদিও এর নেপথ্যে রয়েছে প্রকৃতিগত সুবিধা, ব্যাবসার প্রসার ও বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর অবদান। তবে সব সাদৃশ্য ও তুলনাকে ছাড়িয়ে গেছে ভাষাগত স্বকীয়তা। প্রমথ চৌধুরী যথার্থই বলেছেন “বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে!” একদা আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত চট্টগ্রাম বৃটিশ কর্তৃক পৃথক হয়ে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হয়। একই ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাস লালন করা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক অধিবাসী চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে কেবল মাত্র নাফ নদের কারনে। আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক পরাধীনতা ও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা কীভাবে মানুষকে একবিংশ শতাব্দীতেও মধ্যযুগীয় বর্বর অভিজ্ঞতা দান করে।

এবার রাজনৈতিক সীমান্তের ভিতরে (নিজ ভূখণ্ডে) কিছু প্রচলিত ধ্যান ধারণার ব্যাপার তুলে ধরছি। শৈশব থেকে শুরু করে যাপিত জীবনের সিংহভাগ কেটেছে চট্টগ্রাম শহরের আলো বাতাসে। তবে শৈশব থেকে শুরু করে আজ অব্দি অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয় আমার প্রিয় চট্টগ্রাম আঞ্চলিকতার দূষণ থেকে মুক্ত নয়। হয়তো এই ধরণের প্রথা দেশের সর্বত্র কমবেশী প্রচলিত। মোটাদাগে ধর্মপ্রান ও অতিথীপরায়ণ চট্টগ্রামের মানুষ মূলত ভাষাগত ভাবে নিজেদেরকে বিভাজিত করার প্রয়াস চালায়।

চট্টগ্রামের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় থানা গুলো ভাষাগত দিক থেকে ভিন্ন হওয়াতে অনেকে রসিকতা করে সিক্সটি ফাইভ- থার্টি ফাইব হিসেবে সম্বোধন করে। রাস্তা ঘাটের রিক্সা চালক ভাই থেকে শুরু করে বিপণী বিতানের ব্যাবসায়ী পর্যন্ত সবাইকে যদি তটস্থ রাখতে চান তবে অবশ্যই চট্টগ্রামের খাঁটি আঞ্চলিক ভাষা ব্যাহার করবেন। ট্রাই করে দেখতে পারেন বিফলে মূল্য ফেরত! সাবধান! সীমিত জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে ইহা ব্যাবহার করতে যাবেন না। এতে আপনার অস্থি মজ্জা স্থানচূত হবার সম্ভবনা রয়েছে। চট্টগ্রামের অধিবাসীরা দেশের অন্যান্য স্থান থেকে আগত মানুষজনকে মূলত “বইংজ্ঞা” বলে সম্ভোধন করে।

আবহমানকাল থেকে আরাকানবাসী তৎকালীন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, আসাম সহ অন্যান্য বাংলা ভাষাভাষী গোষ্ঠীকে “বইংজ্ঞা” বা বঙ্গ দেশের অধিবাসী হিসেবে বিবেচনা করতো। যদিও বর্তমানে প্রচলিত অর্থে বইংজ্ঞা মানে “ভাদাইম্মা” বা “এলিয়েন”, একইভাবে অসমীয়া অপভ্র্রংশ লালিত বৃহত্তর সিলটী ভাষায়ও এইরূপ অবজ্ঞা সূচক শব্দের দেখা মিলে। একদা বাজেট বিষয়ক জরুরী আলোচনার স্বার্থে কিছু আমলা ও শীর্ষস্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা গিয়েছেন আমাদের প্রয়াত এক অর্থমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে। সবার আগ্রহ দেখে তিনি বললেন “সটার ফড়ে আসেন", কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কর্মকর্তারা একে অন্যের দিকে তাকালো, অতপর দ্রুত বঙ্গ বাজারে ছুটে গেলো নতুন সোয়েটার কেনার উদ্দেশ্যে। ঘণ্টাখানেক পর প্রত্যেকে নিজ নিজ সোয়েটার পরিধান করে পুনরায় অর্থমন্ত্রীর অফিসে প্রবেশ করলো।

এবার কিন্তু মন্ত্রী সাহেব বেশ চটেছেন। তিনি আসন ছেড়ে দিয়ে বললেন “আফনাদেরকে না বলছি সটার ফড়ে আসতে?!” সবাইতো হতভম্ব, একে অন্যের দিকে তাকালেন, ও আচ্ছা ছয়টার পর। অবশেষে আসল কাহিনী বুঝতে পেরে মুচকি হেসে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন। আজকাল অনেকে চকুরীর সাক্ষাৎকারে কথা বলার সময় ভাষায় আঞ্চলিকতার টান নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকেন। পাছে চাকুরীটাই না খোয়া যায়।

চাকুরীর বেলায় মেধার চাইতে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেওয়ার নজির ও কিন্তু আমাদের দেশে আছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে বিয়ে নিয়ে আঞ্চলিকতাবাদের সংকীর্ণতা। বিশেষত যখন দেখি কিছু শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, ধর্মপ্রাণ মানুষও একই দোষে দুষ্ট। তখন ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বলে মনে হয়। এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক।

যেইসব বাংলাদেশী ভাইবোনেরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কসমোপলিটন সিটিতে বসবাস করেন, তাদেরকে প্রায়ই একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন দেশ, জাতি, বর্ণ, রুচি ও ভাষার মানুষ এক কাতারে দাড়িয়ে সালাত আদায় করছে। পাশাপাশি বসে ইফতার করছে। মৌলিক বিশ্বাস ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ তাদেরকে আজ একক পরিচয় দান করেছে। ইসলামে আঞ্চলিকতাবাদ বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের কোনো সুযোগ আছে বলে আমার জানা নেই।

যদি থাকতো তাহলে সহস্রাধিক গোত্রে বিভক্ত আরব উপদ্বীপবাসী অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে যেতো। পরিচয় সংকটের এই যুগে একমাত্র মৌলিক বিশ্বাসের জোরে মানুষ সকল প্রকার হীনমন্যতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। পরিশেষে আঞ্চলিকতার বিভাজন আপন অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতাকেই প্রমাণিত করে...... ঈদ মোবারক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।