আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এরশাদের হাইপ্রোফাইল ভিজিট, নানা কৌতূহল

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আনপ্রেডিক্টেবল প্লেয়ার বলে পরিচিত এরশাদ আবারও আলোচনায়। নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে এরশাদের হাইপ্রোফাইল দিল্লি ভিজিট নিয়েই এই আলোচনা। কি এমন ঘটনা ঘটলো যে এরশাদকে মনমোহন সরকার ডেকে পাঠালেন দিল্লিতে। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা। হাজারো কাজের ভিড়ে সাউথ ব্লক কেন হঠাৎ এরশাদকেই প্রয়োজনীয় মনে করলো।

বলা হচ্ছে, আগামী বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তখন ঢাকায় নতুন একটি জোট ক্ষমতায় আসতে পারে। আর আগের নির্বাচনগুলোর মতোই ওই সময়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান শরিক দল জাতীয় পার্টির এরশাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এ বিষয়ে দিল্লিতে সচেতনতা বাড়ছে। টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত নিউজ ইয়াহু’র ‘দিল্লি রিচেস আউট টু ঢাকা পার্টিস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একেবারে অনুগত নয়- বাংলাদেশের এমন প্রায় সকল অতিথিই ভারতকে সতর্ক করেছে।

বলেছে, সব সমর্থন এক পক্ষকে দেবেন না। এই বার্তা দৃশ্যত কাজে এসেছে। তাই দিল্লি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এইচ. এম এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ৩৫ মিনিটের এই বৈঠকে বাংলাদেশের সবশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনায় এসেছে।

বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু, স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়েও কথা হয়েছে দু’-নেতার মধ্যে। ছয়দিনের দিল্লি সফরে এরশাদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে। ইতিমধ্যেই তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন, বিদেশ সচিব রঞ্জন মাথাই ও রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং (র)-এর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ভারতের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায় ও জোটনেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গেও বৈঠকের কথা রয়েছে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে হাসিনার দূত হিসেবে এরশাদের এই দিল্লি সফর- এমন কথা বলা হলেও জাতীয় পার্টির সূত্রগুলো বলছে ভিন্ন কথা।

গত চার বছরে মহাজোট সরকার এরশাদকে দেয়া কোন প্রতিশ্রুতিই রাখেনি। শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তাকে প্রেসিডেন্ট বানানোর কথা পর্যন্ত বলা হলেও সে ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ দূত করা হবে, তা-ও করা হয়নি। জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা টেলিফোনে বলেছেন, মনমোহন সরকারের অনুরোধে একসময় জাতীয় পার্টি মহাজোট সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিল। আগামী নির্বাচনে পার্টি কি ভূমিকা পালন করবে এবং মহাজোট সরকার প্রতিশ্রুতি পালন না করায় মনমোহন সরকারকে নালিশ জানাবেন।

তবে নানা সূত্র বলছে, দিল্লি আর যা-ই হোক বাংলাদেশে কোন জঙ্গিবাদের সূচনা হোক তা দেখতে চায় না। আর এ নিয়েই নতুন কোন কৌশল এরশাদকে বাতলাতে পারে সাউথ ব্লক। বৈঠক সূত্র বলছে, মনমোহন-এরশাদের বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও তিস্তা এবং স্থল-সীমান্ত চুক্তি নিয়ে দিল্লির ‘টালবাহানা’য় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট। এরশাদের এই সফর নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের চলতি কূটনৈতিক বিনিময়েরই অঙ্গ এরশাদের এই সফর। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের সামপ্রতিক উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে মহাজোট সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদ বিশদ আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের সঙ্গে।

তিস্তা চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে সরকার যে আশাবাদী, সে কথা এরশাদকে জানিয়েছেন মনমোহন। দু’-দেশের মধ্যে স্থল-সীমান্ত চুক্তি রূপায়ণের জন্য সংবিধান সংশোধন এবং এর জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন, সে কথাও এরশাদকে বুঝিয়ে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, এরশাদকে যথেষ্ট রাজনৈতিক গুরুত্ব দিচ্ছে দিল্লি। নিরাপত্তা ও কৌশলগত ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পরে ঢাকার পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে।

পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট ভারতবিরোধী জঙ্গিদের মোকাবিলার প্রশ্নে এই সহযোগিতা দিল্লির কাছে অত্যন্ত জরুরি। হাসিনার সঙ্গে এরশাদের সামপ্রতিক মতবিরোধের কথা নয়া দিল্লির অজানা নয়। তাই বাংলাদেশে সুস্থিতির স্বার্থে এরশাদের সঙ্গে কথা বলে তার ক্ষোভ প্রশমিত রাখাটাও নয়া দিল্লির পক্ষে মঙ্গলজনক হবে। ইসলামী কট্টরপন্থিরা যাতে বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিতে না পারে, বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে সেজন্য উদ্যোগী হতে অনুরোধ করেছেন মনমোহন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় করতে চায় ভারত ও এর জনগণ।

এ বার্তাটি এরশাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন মনমোহন সিং। এর আগে এরশাদ ভারত সফরে গিয়েছিলেন ২০১০ সালে ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তীতে। দু’টি তাৎপর্য রয়েছে মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দিল্লি সফরের দু’টি তাৎপর্য । অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এর প্রচণ্ড প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- আমাদের রাজনীতিতে এই সঙ্কেতই দিচ্ছে ভারত বুঝতে পারছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে যে সংঘাত রয়েছে এই সংঘাত থেকে দেশ বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি- তৃতীয় শক্তির কথা বলা হচ্ছে। এখন তৃতীয় শক্তিটা কি হবে। এর দু’টি বিকল্প আমাদের সামনে আছে। একটা হতে পারে সামরিক বাহিনী। আরেকটি হতে পারে বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তি।

সামরিক বাহিনীর আসাটা আমাদের কারও কাম্য নয়। আমাদের রাজনীতি-সংস্কৃতি পাকিস্তান থেকে আলাদা। সেখানে আমরা সামরিক বাহিনীকে সেভাবে গ্রহণ করে নিই না। আমাদের সামনে গণতান্ত্রিক শক্তি কি আছে? বাম মোর্চার সেভাবে উত্থান ঘটছে না। এখানে কিন্তু এরশাদ একটি বিকল্প শক্তি।

আমেনা মহসীন বলেন, এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা নন। তিনি একজন এমপি মাত্র। তিনি মহাজোটে আছেন। উনি যে হাইপ্রটোকল পাচ্ছেন দিল্লিতে, সেটা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ভারত আগ্রহী বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর কোন কোন অপশন রয়েছে যেগুলো তারা কাজে লাগাতে পারে। ভারত আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চাইছে।

আমার মনে হয়, ভারতের এটা ‘প্র্যাগমেটিক পলিসি’। ভারতও বুঝতে পারছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকগুলো দরজা খোলার সম্ভাবনা আছে। এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, এইচএম এরশাদ সামরিক শাসক ছিলেন। ভারত বরাবরই সামরিক শাসনের বিরোধী। এখানে আমরা দেখছি যে, যার বিরুদ্ধে এত বড় আন্দোলন হলো সে ধরনের একজন নেতার সঙ্গে যখন ভারতের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, ‘র’-এর চিফ বৈঠক করেছেন- তা আমাদের ওই ইঙ্গিতই দেয় যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটা পরিবর্তন আসছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।