আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: প্রোফেসর আশরাফির নেতৃত্বে এবারের অভিযান বঙ্গপোসাগরের সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ তানিয়া তাবাসসুম ল্যাবে ঢুকেই বলল- সং থেকে ঘুরে এলাম!উফ! দারুন যায়গা। সং থেকে মানে? প্রফেসর আশরাফিকে ছোট্ট একটি স্টার স্ক্র ডাইভার এগিয়ে দিতে দিতে শান্ত জিজ্ঞেস করল । ল্যাবের পনেরো ফুট টেবিলের ওপর একটা দশ ফুট একটা পি.এস বা পোর্টেবল সাবমেরিন ।

পুরোটাই ট্রান্সপারেন্ট। প্রফেসর আশরাফি সেটির ওপর ঝুঁকে কাজ করছেন। তানিয়া বলল, হ্যাঁ সং। SONG-এর মানে-Swatch of No Ground. জায়গাটা বঙ্গপোসাগরে ১৪ কিলোমিটার ওয়াইড একটা ডিপ সি ক্যানিয়ন। পানির রং উফ কী বলব! সবজে নীল! অসাম।

আর সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ ডলফিনও আছে। ডলফিন! প্রোফেসর আশরাফি বললেন, শান্ত, আসলে সং বা সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড হল আন্ডার ওয়াটার ডেলটা। ওটা এই ধর ১৩৪০ মিটার গভীর। আন্ডার ওয়াটার ডেল্টাকে সাবমেরিন ফ্যানও বলে। সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড -এর অবস্থান বেঙল ফ্যানে।

হ্যাঁ। ওখানে ডলফিন আছে। বিশেষ করে বটলনোজ ডলফিন আর প্যানট্রোপিকাল স্পটেড ডলফিন। আশ্চর্য! এসব আমরা জানি না! তানিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, বাংলাদেশে অনেকেই জানে না। অথচ সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার।

আমরা মাছধরার ট্রলারে গেলাম। ইস! আমরা মিস করলাম! তোমরা তো চাঁদপুর গেলে। নইলে যেতে পারতে। জান, সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এ তিমিমাছ দেখেছি। তিমি? মানে? শান্ত আর ফারহান এর মুখ রীতিমতো হা হয়ে গেল।

হ্যাঁ। এনট্যাঙ্গলড হোয়েল। ডক্টর সিরাজি তো তাই বললেন। ডক্টর সিরাজি হলেন একজন জুলজিস্ট। আমার বাবার বন্ধু।

তিমি? সত্যি? সত্যি না তো মিথ্যা। তানিয়া ঠোঁট ফোলালো। প্রোফেসর আশরাফি বললেন, হ্যাঁ। সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ তিমিও আছে। আপাতত আমার কাজ শেষ।

এবার চল। ও ঘরে বসে কথা । তানিয়া, তুমি আমাদের জন্য কফি করে নিয়ে আস। ফারহান, তুমি ওভেনে প্যাটিস গরম কর। প্যাটিসে কামড় দিয়ে শান্ত বলল, স্যার।

চাঁদপুরে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখলাম। জেলের পল্লিতে রীতিমতো হাহাকার পড়ে গেছে। মেঘনায় ইলিশ নেই। স্যার, এত শীঘ্রি ইলিশশূন্য হওয়ার কী কারণ? কফিতে চুমুক দিয়ে প্রোফেসর আশরাফি বললেন, হুমম। কারণ নিশ্চয়ই আছে, সেটা ভেবে বার করতে হবে।

এবার শোন। মাস কয়েক আগে বিসিডিপি- এর একজন মেম্বার ডক্টর গোলাম মোর্তোজা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কে স্যার? ডক্টর গোলাম মোর্তোজা। বিশিষ্ট প্রানিবিজ্ঞানী। আমার বন্ধু।

বিসিডিপি হল বাংলাদেশ সিটেসান ডাইভারসিটি প্রজেক্ট । সিটেসান হল বড় সামুদিক স্তন্যপায়ী প্রাণি। যেমন ডলফিন, তিমি এসব। তো, বিসিডিপি ২০০০ সাল থেকে মোর্তোজার নেতৃত্বে বঙ্গোপসাগরে বিশেষ করে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ডে ‘সিটেসান ডাইভারসিটি’ নিয়ে গবেষনা করছে। মোর্তোজা এজন্যে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড- এর ম্যাপ তৈরি করছে।

এ জন্যে সে ইকো সাউন্ডডারর্স ইউজ করে। আসলে ... মোস্ট ম্যাপস অভ দ্য ওশেন আর বেজড অন মেজারমেন্টস মেড বাই ইকো সাউন্ডারস। দি ইন্সট্রমেন্ট ট্রান্সমিটস আ ব্রাস্ট অভ টেন টু থার্টি কিলোহার্জ সাউন্ড অ্যান্ড লিসনস ফর দ্য ইকো ফ্রম দি সি ফ্লোর। এনি ওয়ে, মোর্তোজা সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ডে একটি ডুবেজাহাজের ধ্বংসাবশেষ ট্রেস । কি ট্রেস করছেন বললেন? ডুবোজাহাজের ধ্বংসাবশেষ।

ও আমাকে খোঁজ খবর নিতে বলল। আমি খোঁজখবর নিলাম। ১৮৬৩ সালে গ্যাডফ্লাই নামে একটা ২১২ টনি ব্রিটিশ গানবোট ঝড়ের কবলে পড়ে বঙ্গোপসাগর ডুবে গিয়েছিল। সময়টা শেষ মুগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর মৃত্যুর এক বছর পর। পরে নথিপত্রে দেখা যায় ওই জাহাজে করে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে বিপুল পরিমান ধনরত্ন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ।

হিস্টোরিয়ানরা গ্যাডফ্লাই জাহাজের ধনরতত্ন নাম দেয় ‘গ্যাডফ্লাই ওয়েলথ’। তো দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও মায়ানমার সরকার ‘গ্যাডফ্লাই ওয়েলথ’ অনুসন্ধান করছে। বাংলাদেশ সরকারও এ বিষয়ে সচেতন। মোর্তোজা ওর ইকো সাউন্ডডারর্স এ সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ডে যে ডুবোজাহাজের ধ্বংসাবশেষ ট্রেস করতে পেরেছে সেটা ‘গ্যাডফ্লাই ওয়েলথ’ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। অনেক দিন ধরে একটা পোর্টেবল সাবমেরিন নিয়ে কাজ করছি।

ওটা ১৩৪০ মিটার গভীরে যেতে পারবে। ভাবলাম কাজটা শেষ করে ‘গ্যাডফ্লাই ওয়েলথ’ এর খোঁজে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ডের তল থেকে ঘুরে আসব । ওহ! কবে যাচ্ছেন স্যার? আজ রাতেই রওনা দেবে। আমি প্রাইমিনিস্টার কে সব জানিয়েছি। আর্মির একটা ট্রাক পোর্টেবল সাবমেরিন পৌঁছে দেবে কুয়াকাটা।

ওখান থেকে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড একশ কিলো মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। কয়েকদিন পর সকাল দশটায় শান্তর মোবাইলটা বাজল। তানিয়া তাবাসসুম। বলল, প্রফেসর আশরাফি ফোন করেছিলেন। আমরা সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ যাচ্ছি।

মংলায় ডক্টর গোলাম মোর্তোজা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। তোমরা তৈরি থেকো। আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসছি। ওকে। শান্তর বুক দুলে উঠল।

এখন শোন। নোট করে নাও- কী কী নিতে হবে। বাইনুকুলার, বড় সানহ্যাট, সানস্ক্রিন, সানগ্লাস, ফুলহাতা সুতির শার্ট, টর্চলাইট, ফ্ল্যাশ লাইট, তোয়ালে টুথব্রাশ, পেস্ট, স্লিপিংব্যাগ। ক্যামেরা তো নেবেই, এছাড়া নেবে ব্যাটারি চার্জার । শুকনো খাবার আর ওষুধপত্র- এই যেমন, স্যালাইন, এন্টাসিড প্লাস, প্যারাসিটামল।

ওকে? ওকে? শান্ত ফোন অফ করে ‘ওহ’ বলে লাফিয়ে উঠে ফারহানকে জড়িয়ে ধরে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই কিয়া স্পোরটেজটা নিয়ে এল তানিয়া । গাড়িতে ফারহান আর শান্ত ধরাধরি করে একটা বড় বাক্স তুলল। তানিয়া বলল, যা যা বলেছি। নিয়েছো? হ্যাঁ।

তানিয়া মনিপুরী পাড়া থেকে সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব কে তুলে নিতে নিতে বারোটা বাজল। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব বললেন,এবারের অভিযানের নাম কী? তানিয়া বলল, এক্সডিশন ‘গ্যাডফ্লাই ওয়েলথ’ । মানে? মানেটা সবাই মিলে বুঝিয়ে দিল। প্রবীণ সাংবাদিকের চেহারা দেখার মত হল। এই নিন।

এবার এটা পড়ুন। বলেন প্রিন্টেড কাগজ দিল তানিয়া। কি এটা? এটা ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ, দি ওশ্যান কনসারভেন্সির কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর মুসতাসির মামুন ইমরান-এর লেখা এনট্যাঙ্গলড হোয়েল হোয়েল হ্যাভ বিন সিন ইন সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড ... ওহ! তানিয়া যখন মংলা পর্যটন মোটেলে গাড়ি ঢোকাল তখন সন্ধ্যা। মোটেলের নাম: ‘পশুর’। পুরনো ধাঁচের দোতলা ছিমছাম দালান।

সামনের প্রশস্ত রাস্তায় ধূসর সাফারি সুট পরে এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোক পায়চারি করছিলেন। মুখে পাকা দাড়িগোঁফ। চোখে বাইফোকাল চশমা। তানিয়া তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ডক্টর গোলাম মোর্তোজা? হ্যাঁ। আমরা ...মানে বুঝেছি।

এসো। আমি তোমাদের জন্য রুম বুক করে রেখেছি। তানিয়া সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব কে বলল, ইনি ডক্টর গোলাম মোর্তোজা । প্রফেসর আশরাফির বন্ধু। সামুদ্রিক বড় স্তন্যপায়ী প্রাণি নিয়ে গবেষনা করেন।

ও। তবে ডুবে যাওয়া ‘গ্যাডফ্লাই ওয়েলথ’ এর সঙ্গে একজন প্রাণিবিজ্ঞানীর সম্পর্ক খুঁজে পেলেন না এই প্রবীণ সাংবাদিক। কথা বলে বোঝা গেল ডক্টর গোলাম মোর্তোজা বেশ অমায়িক। রাতে ডিনারের পর সবাই বারান্দায় বসল । তানিয়া বলল, স্যার এই নিয়ে আমি সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ দ্বিতীয়বার যাচ্ছি।

ফাইন। গতবার আমি সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ এনট্যাঙ্গলড হোয়েল দেখেছি। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা মাথা নাড়লেন। তারপর ইংরেজিতে বললেন, দো রিভার সিসটেম অভ বাংলাদেশ হ্যাজ বিন আ সোর্স অভ দ্য গ্যানগেজ ডলফিনস সিন্স লং টাইম, বাট হোয়েল ইজ স্টিল আ ফেয়ারলি নিউ মামাল টু এনরিচ টেরোটোরিয়াল ফাউনাল বিউটি। তবে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ তিমি চোখে পড়ে।

এদের মধ্যে ব্রায়ডেস তিমিই বেশি। একে ফিন হোয়েল বা বালিন হোয়েলও বলে । ওরা মেরু অঞ্চলের চেয়ে ট্রপিকাল এবং নাতিশীতোষ্ণ উপকূলীয় পানি পছন্দ করে বেশি । লম্বায় ৪০ থেকে ৫৫ ফুট। ওজন? ওজন? তা এই ধর ৯০,০০০ হাজার পাউন্ড।

৯০,০০০ হাজার পাউন্ড! হ্যাঁ। ৯০,০০০ হাজার পাউন্ড। পুরুষ ফিন তিমি সাধারণত কিছু ছোট হয় মেয়ে ফিন তিমির চেয়ে। ইন্টারেষ্টিং। হ্যাঁ।

ভাগ্য ভালো হলে কাল দুপুরের পরে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ তিমি দেখতে পাবে। প্রথমে দেখবে সারফেসের ওপর ঝিরঝির পানি ছুড়ে মারবে। তারপর লেজ উচিঁয়ে সাগরের গভীরে ডাইভ দেবে। ইটস আ ইমপোজিং সাইট টু রিমেমবার। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব জিজ্ঞেস করলেন, কাল দুপুরের আগেই সোয়াচ এ পৌঁছে যাব বলছেন? ডক্টর গোলাম মোর্তোজা বললেন, হ্যাঁ।

মংলা থেকে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড ১২০ কিলোমিটারের মতন দক্ষিণ । দুবলার থেকে অবশ্য - কথা শেষ হল না তানিয়া বলল, ফিফটি ফাইভ কিলোমিটার। স্যার আমি গতবার দুবলার চর থেকে গিয়েছি । ও আচ্ছা। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব জিজ্ঞেস করলেন, তা জার্নির হ্যাজার্ড কেমন? প্রথম যাচ্ছি।

ডক্টর গোলাম মোর্তোজা হাসলেন। বললেন, একটু গরম লাগবে। মোবাইল কি ডিসকানেক্ট হয়ে যাবে? না, না। বোটে জেনারেটর আছে। মোবাইল চার্জ করতে পারবেন।

তবে বোটের টয়লেটটি বেশ ছোটই। বলে তিনি হাসলেন। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তানিয়া মুখ চাপা দিল। শান্ত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমরা তো আর প্লেজার ট্রিপে বের হইনি স্যার।

প্রেফেসর আশরাফি যখন এ অভিযান অ্যারেঞ্জ করেছেন। তখন রহস্য একটা আছেই । আলবৎ আছে। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব বললেন। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা বললেন, যাক।

এবার শুয়ে পড়া যাক। কাল ভোর ৫টায় মধ্যেই উঠে তৈরি থাকতে হবে। আর মংলাপোর্টে একটা সারপ্রাইজ আছে। সারপ্রাইজ? হ্যাঁ। প্রফেসর আশরাফি? না।

তাহলে? তাহলে কাল পোর্টেই দেখতে পাবে। এখন ঘুমানো যাক। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা উঠে চলে গেলেন। পরদিন ভোরে মংলা বন্দরে পৌঁছেই সারপ্রাইসটা যে কী- সেটা বোঝা গেল। কয়েক জন ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের স্বাস্থবান লোক ‘মুরশিদ মিঞা’ নামে একটি ফিশিং বোটের পাটাতনে বোটে বড় বড় কয়েকটি হলদে বক্স তুলছিল।

মেজর ইফতেখার হায়দার তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। মেজর ইফতেখার হায়দার-এর পরনে সিভিল ড্রেস। তিনি ফারহানদের দেখে হাত নাড়লেন। হাসলেন। শান্তরা ফিশিং বোট বোটে উঠে এল।

কাঠের তৈরি ৫৬ ফুট লম্বা মোটরাইজড ফিশিং বোট বোট। পিছনের দিকে ছোট কেবিন। এই বোট নিয়ে যাবে গভীর সমুদ্রে? শান্ত ফারহানের দিকে তাকাল। ফারহান ততক্ষণে তরতর করে কেবিনের ছাদে উঠে গেছে। ছাদটা কাঠের, তবে তার ওপর বাঁশের বেড়া পাতা।

ডক্টর গোলাম মোর্তোজা সারেংয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এর নাম খুরশিদ মিঞা। সে স্থানীয় লোক। সারেং ছাড়াও এই বোটে তিনচার জন ক্রু আছে। এদের নাম আলম জাহাঙ্গীর আর লতিফ। এরা অবশ্য খুরশীদ মিঞার ছেলে।

মেজর ইফতেখার হায়দার তানিয়াকে একটা বক্স দিয়ে বললেন, ব্রেকফাস্ট, ম্যাডাম। থ্যাঙ্কইউ মেজর। মেজর ইফতেখার হায়দার বোট থেকে নেমে গেলেন। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের বলিষ্ট চেহারার লোকগুলি অবশ্য আগেই নেমে গেছে। খুরশিদ মিঞা ‘মুরশিদ মিঞা’ ছাড়ল।

ভটভট শব্দ ভোরের নির্জনতা খান খান করে ভেঙে দিল। মেজর ইফতেখার হায়দার জেটি থেকে হাত নামলেন। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা কেবিনে ঢুকলেন। পিছন পিছন ফারহান। ফারহান পড়ছে বুয়েটের এন এ এম ই ডিপার্টমেন্টে।

(ডিপার্টমেন্ট অভ নাভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং) ওর চোখে বাংলাদেশ নেভির জন্য নিউক্লিায়ার সাবমেরিন বানানোর স্বপ্ন। ও ডক্টর গোলাম মোর্তোজার কাজ বুঝতে চায়। কেবিনটা মনে হল: ল্যবরেটরি কাম স্লিপিং বার্থ কাম কিটরুম। কেবিনে তাকের ওপর একটা ছোট্ট ডিসপ্লে। অনেকটা ওভেন এর মতন দেখতে ।

নীচের দিকে অনেকগুলি নব। ফারহান জিজ্ঞেস করে, এটাই কি ইকো সাউন্ডারর্স স্যার ? হ্যাঁ। এটা ডুয়েল ফ্রিকোয়েন্সির । টেলিডাইন ব্র্যান্ডের। মডেল হল: ওডোম এম কে থ্রি।

ও। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা আরও বললেন, রিসাচের সময় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। শান্ত থাকে। আর রিসার্চের ইকুইপমেন্ট হল মূলত ফটো -আইডেন্টিফিকেশন, লেন্থি ডিসটেন্স স্কোপ। ফিসিং বোটটা চলছে।

ঝরঝরে রোদ উঠছে। রোদে পশুর নদীর পানি চিকচিক। ডক্টর গোলাম বললেন, নদীটা ৮৫০ মিটার চওড়া। ফিসিং বোট অবশ্য সুন্দরবনের খুব কাছ দিয়ে যাবে না । তবে ভাগ্য ভালো থাকলে দূর থেকে কেওড়া গাছের আড়ালে হরিণ দেখা যেতে পারে।

এনি ওয়ে, চল ব্রেকফাস্ট করে নিই। ব্রেকফাস্ট বক্সে নানরুটি আর রসগোল্লা ছিল। শান্ত নানরুটি ছিঁড়ে মুখে ফেলে দেখল ফিরোজা রঙের আকাশে গাঙচিল। বাতাসে লোনা গন্ধ। গতকালও ঢাকায় ছিল।

ভাবলে কেমন লাগে। মুখে তাত লাগছিল। আর ফিশিং বোটের শব্দ বাড়ছিল। নাশতা শেষ করে হ্যাট পরে নিল সবাই। মুখে সানস্ক্রিন ঘষে সানগ্লাস পরে নিল ।

সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব এর মনে হল তাত সইছে না। তিনি একটা তোয়ালে ভিজিয়ে মাথায় রাখলেন। তার পরনে ফুলহাতা সুতির শার্ট। তার পাশে সারেং খুরশিদ মিঞা। সে ব্যাজারকন্ঠে বলল, দিনকাল খারাপ স্যার।

ইলিশ মাছ পাই না। এক রকম বেকার কইতে পারেন। মোর্তোজা স্যারে কাজ না দিলে যে কী হইত। হুমম। ইদানীং কী কারণে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব এর কন্ঠে আক্ষেপ। সময় মন্থর গতিতে কাটছে । সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব এর চোখে বাইনুকুলার। শান্ত ওর ক্যামেরার প্যারামিটার ঠিক করছে, ব্যাটারি চার্জ করে নিচ্ছে। তানিয়া ব্যাগ থেকে শুকনো খাবার বের করে গুছিয়ে রাখল।

টয়লেট থেকে বেরিয়ে ফারহান বলল, টয়লেটটা জোস। দুপুরে খাবারের আইটেম অতি সাধারণ। ভাত ডাল আর সবজি। তানিয়া বলল, আহ! কি টেস্টি! কে রেঁধেছে। খুরশিদ মিঞা মিঞা বলল, আমার ছোট ছেলে।

ওর নাম জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর এর বয়স আঠারো উনিশের বেশি না। তানিয়া বলল, আচ্ছা, রাত্রে আমি রাঁধব। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা বললেন, একটু পর সমুদ্র।

সবাইকে এখন লাইফ-জ্যাকেট পড়ে নিতে হবে। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব লাইফ জ্যাকেট পরতে পরতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি বিশাল বিস্তার দেখেছেন। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা বাইনেকুলার দিয়ে দূরে কী দেখছিলেন। কথাটা শুনে মাথা নাড়লেন। বললেন, দ্য লারজেস্ট সাবমেরিন ফ্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড দ্য বেঙ্গল ফ্যান ইজ দ্য ক্যারেক্টারিস্টিক ফিচার অভ দ্য বে অভ বেঙল ।

বলেন কী? হ্যাঁ। উইদইন আ উইডথ অভ অ্যাবাউট ওয়ান থাউজেন্ড কিলোমিটার, ইট এক্সটেন্ডস টু আ লেন্থ অভ থ্রি থাউজেন্ড কিলোমিটার, অ্যাকোমোডেটিং সেডিমেন্টস হুজ থিকনেস রিচেস মোর দেন সিক্সটিন কিলোমিটার অ্যাট দ্য প্রক্সিম্যাল রিজিওন অভ দ্য বেঙ্গল ডেলটা। এসব কথা শুনে সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব কী বলবেন ভেবে পেলেন না। ধূসর আকাশে গাঙচিল উড়ছিল। ঢেউয়ের দোলায় বোট এতই দুলছে যে পাটাতনের ওপর দাঁড়ানোই কঠিন।

তাছাড়া সূর্যের প্রখর রশ্মি। পানির রং বদলে যাচ্ছিল। উপকূলের দিকের পানি কাদা মেশানো। বোঝা গেল এটা অগভীর দিক । আর দক্ষিণের পানির রং সবজে নীল ।

বোঝা গেল জায়গাটা গভীর। তিনটার মতো বাজে। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা বললেন, আমরা সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ প্রবেশ করছি। ফারহান চেঁচিয়ে বলল, অসাম। ওর গলায় একটা ক্যানন ইওস ফাইভ ডি মার্ক টু ঝুলছে।

শট নিতে শুরু করে দিয়েছে। শান্ত চেঁচিয়ে ওঠে, কুল। বাংলাদেশে এমন জায়গা আছে! ষ্ট্রেঞ্জ! ডক্টর গোলাম মোর্তোজা বললেন, আসলে এখানেই গঙ্গার শেষ পরিনতি। এই জায়গাটা স্যাটেলইট থেকেও দেখা যায়। সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড নীচে উপত্যকা আছে।

তানিয়া বলল, হ্যাঁ। গতবারই শুনছি। ভাবলেই গা কেমন ছমছম করে। উপত্যকাটি আজ থেকে ১২৫,০০০ বছর আগে তৈরি হয়েছে। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব প্রথম ডলফিন দেখলেন ।

তিনি হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলে, ডলফিন! ডলফিন! ওই যে দেখ, ওই যে দেখ। শান্ত দেখল অনেকটা দূরে সবজে নীল জল ফুঁড়ে একটা কালচে ডলফিন অর্ধবৃত্তাকারে শূন্যে লাফিয়ে উঠল। অসাম! কুল! এবার সবজে নীল জল থেকে সাদা ঝিরঝির পানি শূন্যে উড়ল । তিমি!সবাই দেখল সবজে জলের তলা থেকে একটা টান্সপারেন্ট পোর্টেবল সাবমেরিন ভেসে ওঠে। প্রফেসর আশরাফি! পোর্টেবল সাবমেরিনটা ধীরে ধীরে ফিশিং বোটে ঠেকল।

একটু পর ওপরের হ্যাচটা খুলে গেল। একটা সচ্ছ কাঁচের হেলমেট দেখা গেল। প্রফেসর আশরাফি হাত বাড়ালেন। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব টেনে তুলতেই প্রফেসর বোটে উঠে এলেন । প্রফেসর আশরাফির পরনে এক ধরনের হলুদ প্লাস্টিকের ইউনির্ফম।

প্রফেসর সচ্ছ কাঁচের হেলমেট খুললেন। ডক্টর গোলাম মোর্তোজা জিজ্ঞেস করলেন, কি স্যার, ব্রিটিশ গানবোটটার দেখা মিলল? পরনের হলুদ প্লাস্টিকের ইউনিফর্মটা চেইন টেনে খুলতে খুলতে প্রফেসর বললেন, হ্যাঁ। দেখলাম। হোয়াট! তবে গানবোটটা ফাঁকা। ভিতরে কিছু নেই।

তার মানে গ্যাডফ্লাই ওয়েলথ কেউ সরিয়েছে? ডেফিনেটলি। বলে পাটাতনের ওপর রাখা হলদে বক্স দিকে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর আশরাফি । খুরশিদ মিঞা বলল, কন তো খুইলা দেই স্যার। না, না। আমিই খুলছি।

ভিতরে সেনসেটিভ পার্টস আছে। বলে নিয়েই কাজে লেগে গেলেন। বাক্সের ভিতরে প্লাসটিক। ইলেকট্রনিক পার্টস। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব বললেন, কিরে শ্যামল? এগুলি দিয়ে কি করবি? ইলিশ মাছ বানাব।

ইলিশ মাছ? হ্যাঁ। ইলিশ মাছ। রোবট ইলিশ। রোবট ইলিশ? হ্যাঁ। রোবট ইলিশ।

তারপর রোবট ইলিশ যাবে একটা রোবট হোয়েল এর পেটে। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব বললেন, তোর কথার মাথা মুন্ডু তো কিছুই বুঝলাম না। বলছি। বলে প্রফেসর আশরাফি এবার শান্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, শান্ত, সেদিন তুমি বলছিলে না- চাঁদপুরে জেলে পল্লিতে হাহাকার। নদীতে একেবারে ইলিশ নেই।

তুমি বললে এত শীঘ্রি মেঘনা নদী ইলিশশূন্য হওয়ার কী কারণ? জ্বী স্যার। বলেছিলাম। পাশ্ববর্তী একটি দেশ রোবট হোয়েল তৈরি করে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ডে পাঠিয়েছে। যেন সন্দেহের উদ্রেক না হয়। তানিয়া বলল, স্যার আমি গতবার এনট্যাঙ্গলড হোয়েল দেখেছিলাম।

ওটা? হতে পারে। রোবট হোয়েলটা দেখলাম এনট্যাঙ্গলড হোয়েল- এর মতোই। আসলে ওটা একটা স্পাই রোবট। ওটাই পাশ্ববর্তী দেশ কে গ্যাডফ্লাই ওয়েলথ -এর খোঁজ দেয়। রোবটটা বে অভ বেঙলে সার্ভে করে।

টনটন ইলিশ মাছ গিলে খায়। তারপর পাশ্ববর্তী দেশের সৈকতে উগড়ে দেয়। বলেন কী! হ্যাঁ। এত শীঘ্রি ইলিশশূন্য হওয়ার এটাই কারণ। এখন তাহলে আপনার প্ল্যান কী? এখন আমার প্ল্যান হল একঝাঁক প্যাকড উইথ এক্সপ্লোসিভস রোবট ইলিশ তৈরি করব ।

তারপর মাছগুলি রোবট হোয়েট গিলে খাবে। দ্যান ... ওয়াও। বলে তানিয়া হাততালি দিল। মারহাবা,মারহাবা। বলে সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব চেঁচিয়ে উঠলেন।

অসাম আইডিয়া। ফারহান বলল। কুল, রিয়েলি কুল। শান্ত বলল। হরেন্ডাস।

বলে ডক্টর গোলাম মোর্তোজা তাঁর বিস্ময় প্রকাশ করলেন। এমন কী খুরশিদ মিঞা দাঁত বার করে হাসল। রাতটা কাটল রোবট ইলিশ তৈরি করতে করতে । কেউই ঘুমালো না। সবাই প্রফেসরকে হেল্প করল।

ফারহান ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে দিয়েছে। যদিও আকাশে তুমুল জ্যোস্না। পাটাতনের ওপর রোবট ইলিশগুলি চিকচিক করছিল । তানিয়া রান্না করল। টাকি মাছের ভর্তা, কাচকি মাছের চচ্চরি আর লাউ ডাল।

কাজ শেষ হতে হতে ভোর হল। প্রফেসর আশরাফি খুরশিদ মিঞা কে বললেন, শোন খুরশিদ মিঞা । আমি বোট থেকে নেমে যাওয়ার পরই তুমি যতটা পার ফুল স্পিডে বোট চালিয়ে উপকূলের কাছাকাছি চলে যাবে। কি পারবে না? জ্বে স্যার। পারুম।

এমন জোরতে টান দিমু। এইহান হইতে দু’বলার চর ৪০ মাইল। বেশি সময় লাগব না। প্রফেসর আশরাফি পোর্টেবল সাবমেরিনে নেমে গেলেন। খুরশিদ মিঞা বক্স ভর্তি রোবট ইলিশ পোর্টেবল সাবমেরিনে তুলে দিল।

পোর্টেবল সাবমেরিন ধীরে ধীরে পানিতে বুদবুদ তলিয়ে গেল। খুরশিদ মিঞা দ্রুত কেবিনে যায়। ধীরে ধীরে বোট ঘুরিয়ে নেয় সে। তারপর ফুল স্পিডে উপকূলের দিকে যেতে থাকে। সবাই প্রচন্ড টেনশন টের পাচ্ছিল।

সূর্য উঠল। সবাই খিদা তৃষ্ণা ভুলে গেছে। ঘন্টা দুয়েক পর উপকূল রেখা দেখা গেল। সবাই ফেলে আসা সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড- এর দিকে চেয়ে আছে। হঠাৎই সমুদ্রের স্তর ফুঁসে উঠল।

বড় ঢেউয়ের ফণা এগিয়ে আসে। তাতে ফিশিং বোট দুলে উঠল। তবে কাত হয়ে যায় না। উপকূলের কাছে পৌঁছে যাওয়ার আগেই প্রফেসর আশরাফির পোর্টেবল সাবমেরিন ভেসে উঠল। সবই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

তথ্যসূত্র: http://www.flickr.com/photos/jexca/4364265679/ Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.