আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: খুলনার বধ্যভূমি, গল্লামারী নদী যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো দুই ট্রাক মাথার খুলি!

সফল ব্লগার নয়, সত্যবাদী ব্লগার হওয়াই হোক আমাদের লক্ষ্য। একাধিক লাশ পড়ে আছে। সেদিকে একটি কুকুর খাচ্ছে আর অপর একটি লাশের পাশে আরেকটি কুকুর বসে হাপাচ্ছে। মনে হয়, মানুষ খেয়ে তার উদর অতিমাত্রায় পরিপূর্ণ। ছবি: গল্লামারী স্মৃতিসৌধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গত ৪২ বছর ধরে অনেক লুকোচুরি চলেছে! মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহচরদের নারকীয় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুঠতরাজ ও অন্যান্য ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ খুব কমই প্রকাশিত হয়েছে।

আর এর সুযোগ নিয়ে অনেকেই এই ইতিহাসকে বিকৃত করার সাহস পেয়েছে। তাই বর্তমানে একাত্তরের পরাজিত শক্তি স্বাধীণতা বিরোধীদের তৎপরতা লক্ষ্য করে মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছি। এই পোস্ট তারই একটি প্রয়াস। আজ আপনাদেরকে জানাবো খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমির ইতিহাস: খুলনা জেলার বধ্যভূমিতে গুলি করে, জবাই করে পাকিস্থানি সেনারা একাত্তরে হত্যা করেছিলো বাঙালীদের। হত্যা করার পূর্বে পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে তাদের উপর চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন।

বিভিন্ন নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া লাশের বহরে লাল হয়ে গিয়েছিল পানির রং। বধ্যভূমিতে পড়ে থাকা অনেক বাঙালীর দেহ পরিণত হয়েছিলো শিয়াল-কুকুরের খাবারে। খুলনায় একাত্তরের কয়েকটি বধ্যভূমির ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে বাঙালীদের উপর পাকিস্থানিদের পরিচালিত এই নারকীয় তান্ডবের বর্ণনা করেছেন সাংবাদক গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি বধ্যভূমিগুলো পরিদর্শনকালে এসব ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এবং ১৯৭২ সালের সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। গল্লামারী নদী, খুলনা শহরের তিন কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ-পশ্চিমকোণ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বয়ে চলেছে।

আজ এই নদীটির ওপর ব্রীজ। ব্রীজের ওপারে খুলনা-সাতক্ষীরা রোডের ডান পাশে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়; বাম পাশে স্মৃতিসৌধ। শহীদ স্মৃতিসৌধ। হাজার হাজার সন্তানের শহীদী আত্মত্যাগকে ধরে রাখতে এই স্মৃতির মিনার। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে খুলনা শহরে এখনকার মতো ঘন জনবসতি ছিল না।

ছিল না গল্লামারী নদীর ওপর ব্রীজ। ছিল না খুলনা-সাতক্ষীরা রোড। শহর থেকে অদূরবর্তী এই গল্লামারী জায়গাটি ছিল বেশ নির্জন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনিক ভবনটি ছিল তখন একতলা। এই ভবন থেকে বেতার কার্যক্রম সম্প্রচার করা হতো।

বেতার কেন্দ্র দখলের নামে শুরুতেই পাকিস্থানি সৈন্যরা এ ভবনটি দখল করে নেয়। ভবনের অবস্থান ও আশেপাশে নির্জন এলাকা হয়ে ওঠে বধ্যভূমি। ধর্ম, লিঙ্গ, বয়স নির্বিশেষে বাঙালিদের ধরে এনে এখানেই গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, জবাই করে হত্যা করা হতো। শেষে নিথর দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হতো গল্লামারীর স্রোতে। ১৯৭২ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী এ প্রসঙ্গে দৈনিক বাংলায় (অধুনালুপ্ত) লেখা হয়েছে- "সারাদিন ধরে শহর ও গ্রাম থেকে বাঙালিদের ধরে এনে হেলিপোর্ট ও ইউএফডি ক্লাবে জমা করা হতো।

তারপর মধ্যরাত হলেই সেই সব হতভাগ্য নিরস্ত্র বাঙালিদের পেছনে হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা ব্রাশফায়ার করা হতো। রক্তাপ্লুত দেহে লুটিয়ে পড়তো হতভাগ্যরা। হত্যার আগে ট্রাক ভরে যখন সেইসব নিরুপায় মানুষদের নিয়ে যাওয়া হতো তখন তাদের আর্তনাদ রাস্তার আশেপাশের মানুষ শুনতো। কিন্তু কারো কিছু করার ছিল না। কারণ বাইরে কারফিউ।

সেই আর্তনাদ সইতে না পেরে একদিন শেরেবাংলা রোডের এক ব্যাক্তি জানালা খুলে মুখ বাড়িয়েছিল মাত্র। ব্যস, অমনি তাকে লক্ষ্য করে হানাদার বাহিনি গুলি ছুড়লো আর বুলেটবিদ্ধ হয়ে সে লুটিয়ে পড়লো। হানাদার বাহিনি প্রতি রাতে কম করেও শতাধিক ব্যাক্তিকে হত্যা করতো। দিনের বেলায় তাদের লাশ জোয়ারের পানিতে ভেসে আসতো। কিন্তু কারো সাহস হতো না তাদের দাফন করার।

অনেকে তাদের আপনজনের লাশ শনাক্ত করেও সেখান থেকে তাকে উঠিয়ে নিতে পারেনি। কেননা এ খবর জানাজানি হলে তারও নিশ্চিত মৃত্যু। কিছুদিন পর জল্লাদরা ঠিক করে, গুলি করে আর হত্যা নয়। অন্য পন্থা। শুরু হলো জবাই করে হত্যা।

তবে সংখ্যা সেই শতাধিক। আগে এইসব হত্যাকান্ড গুলো রাতে ঘটানো হতো। পরে ঘটে আরো নিষ্ঠুর ঘটনা। রাতের বদলে দিনেই হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সকলের সামনে দিয়ে পিঠমোড়া দেওয়া ট্রাক ভর্তি বাঙালি সন্তানদের নিয়ে যাওয়া হতো।

আর ঘন্টাখানেক পরে শূণ্য ট্রাক ফিরে আসতো। গল্লামারীতে পড়ে রইতো কিছুক্ষণ আগে নিয়ে যাওয়া সেই সব বঙ্গ সন্তানের নিথর দেহ গুলো। খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী নদী থেকে দুই ট্রাক খুলি পাওয়া গিয়েছিলো। " দৈনিক বাংলার প্রতিবেদক ঐ প্রতিবেদনে আরো লেখেন- "ছবি তোলার জন্য গল্লামারীর অভ্যন্তরীণ ধানক্ষেতে ঢুকে দেখলাম এক নৃশংস দৃশ্য। একাধিক লাশ পড়ে আছে।

সেদিকে একটি কুকুর খাচ্ছে আর অপর একটি লাশের পাশে আরেকটি কুকুর বসে হাপাচ্ছে। মনে হয়, মানুষ খেয়ে তার উদর অতিমাত্রায় পরিপূর্ণ। " বঙ্গ সন্তানের অসংখ্য লাশ ও রক্তে সিক্ত ভূমিকে জাজ্জ্বল্যমান রাখতে আজ সেখানে স্মৃতির মিনার গড়ে উঠেছে। স্মৃতিসৌধ দেখাশোনা করেন মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার। দেশ মাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ে শামিল হওয়া এই যোদ্ধা আজ বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে।

সূর্য্য উদয় ও সূর্য্য অস্তের সময় স্মৃতি বেদীমূলে তিনি জাতীয় পতাকা ওঠানো এ নামানোর কাজ করেন। থাকেন বধ্যভূমি সংলগ্ন বাড়িতে। গলা ভারী হয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার বলেন- "দেশ হানাদারমুক্ত করার জন্য যে হাতে একদিন অস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিলাম; আজ সেই হাতে বধ্যভূমিতে গড়ে ওঠা এ স্মৃতিসৌধ পরিচর্যা করছি। প্রতিদিন চোখে ভাসে সেই নারকীয় তান্ডব। মানুষের গগণবিদারী আর্তচিৎকার, গুলির শব্দ, রক্তাক্ত হয়ে ওঠা গল্লামারীর ঘোলা জল।

" সেই স্মৃতি বর্ণনা করতে যেয়ে আজো মুক্তিযোদ্ধা সাত্তারের সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে ওঠে, শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। তিনি বলেন, "১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ এখানে এসে লাশের পঁচা দুর্গন্ধ, কঙ্কাল, হাড়-গোড় ও মাথার খুলিতে পা রাখা দায় হয়েছিলো। যা আজ কল্পনাকেও হার মানায়। যেখানে আজ বধ্যভূমি, সেটি ছিলো ধানক্ষেত। গল্লামারী নদী।

নদী তীরবর্তী এলাকা, আশ-পাশের ধানক্ষেত, সামান্য দূরের বেতার সম্প্রচার ভবন প্রভৃতি গোটা এলকায় ছিল হাজার হাজার মানুষের নিথর দেহ। অনেকে ছুটে গেছেন সেদিন স্বজনকে খুঁজতে। দুর্গন্ধ বাতাসে ভারী হয়ে ওঠা এলাকায় নাক-মুখ চেপে মানুষ সেই অবশেষ লাশ, হাড়-গোড়, কঙ্কালের মধ্যে প্রিয়জনের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে ফিরেছে। কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি। " স্বজন হারানোর স্মৃতি চিহ্ন খোঁজা ছাড়াও নির্মমতা দেখতেও অনেকে ছুটে গিয়েছিলেন বধ্যভূমি গল্লামারীতে।

কবি মোল্লা ফজলুর রহমান এমনি একজন ব্যাক্তি। পাক-হানাদারদের নয়মাসের বর্বরতার চিহ্ন দেখে তিনি লিখেছেন- "১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর খুলনা বাদে সারা বাংলাদেশ মুক্ত হয়। খুলনা মুক্ত হয় ১৭ই ডিসেম্বর, শুক্রবার। বাংলার ভাগ্যাকাশে পতাকা উড়ল। যুগ যুগান্তরের শৃঙ্খল বেড়ী ছিড়ে নতুন সূর্য্য উদয় হলো।

আমি সেবার বধ্যভূমি গল্লামারী দেখতে হেঁটে যায়। রাস্তার ওপরে দু’ধারে পুলের (আজকের ব্রীজ) পার্শে হোগলাবনে ও কচুরীপানার ভিতর নরকঙ্কাল মাথার খুলি হাড় ভর্তি দেখলাম। যুবক-যবতী, ছেলে-মেয়ের শাড়ী, লুঙ্গি জামা কাপড় দেখলাম। শিয়াল কুকুর মানুষের তাজা তাজা দেহের অংশ কুরে কুরে খাচ্ছে আর ঘেউ ঘেউ করছে। বধ্যভূমি খালের (নদী) কাদায় সদ্যকাটা যুবক ও যুবতীদের দেহ দেখলাম।

" গল্লামারী বধ্যভূমির ভয়াবহতা আর নিষ্ঠুরতা দেখে পাক-বাহিনী ও তাদের দোসরদের মনোভাব টের পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো খুলনার মানুষের আত্মত্যাগের কথাও অনস্বীকার্য। গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি সে্ সব শহীদদের যারা প্রাণ দিয়ে এনেছেন আমাদের এই স্বাধীণতা, আমাদের বাংলাদেশ। কারা এই হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী সেটা নিয়ে নিশ্চয় কারো মনে কোন প্রশ্ন নেই? এখন সবার মনে প্রশ্ন একটাই, কবে হবে যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসি? কবে?? রাজাকারদের নিয়ে কোন রাজনীতি চলবে না। সরকারের উচিত দ্রুত এদের ফাঁসি কার্যকর করা আর বিএনপির উচিত এদের পাছায় কষে লাথ্থি দিয়ে বগলের তলা থেকে বের করে সঙ্গ ত্যাগ করা।

আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক, ধর্ম রক্ষার নামে ধর্ম ব্যবসা, রাজাকার তোষন, বিদেশী কুটনীতিক দিয়ে চাপ প্রয়োগ, মিথ্যাচার, হত্যা, হামলা কোন কিছু করেই জনগণের এ দাবিকে দাবানো যাবে না এটা বুঝে নিন হে মহান(!) রাজনীতিকরা এই সিরিজের অন্যান্য পোস্ট: * সফল ব্লগার নয়, সত্যবাদী ব্লগার হ্ওয়াই হোক আমাদের লক্ষ্য। (বোনাস: পাকবাহিনীর নির্যাতনের সহযোগী রাজাকাররাও যেসব নির্যাতনের ভাগ বাধ্যতামূলকভাবেই পেয়েছিলো!) * মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: বাঙালী নারীদের উপর পাকবাহিনীর নির্যাতন (ধারাবাহিক পোস্ট) * মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: রাজশাহীর বধ্যভূমি (১ম পর্ব), একশটি গণকবর থেকে দশ হাজার মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়! * মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: রাজশাহীর বধ্যভূমি (২য় পর্ব), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটাই যেন বধ্যভূমি! [পোস্টের বিষয়বস্তুর বাইরে কেউ কোন মন্তব্য করবেন না। তর্কের খাতিরে, সম্পূর্ণ পোস্ট না পড়ে বা অহেতুক তেনা পেচানোর জন্য মন্তব্য করলে কঠোর ভাবে প্রতি উত্তর দেওয়া হবে। অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য মুছে ফেলতেও আপত্তি নাই] ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.