বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ তারপর প্রোফেসর আশরাফি সত্যি সত্যি উধাও হয়ে গেলেন। স্পেস গার্ডেন- এর ল্যাবে নাসিরউল্লাহ আজকাল একাই থাকে। শাহীনূরও অবশ্য আছে ল্যাবে।
প্রোফেসর আশরাফির ভক্তেরা রোজই খাবার-দাবার পাঠাচ্ছে। চাকরিটা বাঁচাতে একটানা খেয়েই যাচ্ছে শাহীনূর। মাঝে মধ্যে আমার আর ফারহান-এর সঙ্গে সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব এবং তানিয়া তাবাসসুম- এর কথাবার্ত হয় ফোনে । তারাও প্রোফেসর আশরাফির হদিশ জানে না। ওদিকে এলিয়েনরা লসএঞ্জেলেস শহরে ধ্বংসলীলা চালিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর পুবে এসে নিউইর্য়ক শহরেও একই ধরনের তান্ডব চালিয়েছিল।
সসারটা তারপর মহাকাশে উধাও হয়ে গেছে। এই বিষয়ে তানিয়া তাবাসসুম-এর মত হল: হলিউড যেন আর এলিয়েনদের হেনস্থা করে মুভি না-বানায় সেই জন্যই এই ডোজ!
কিন্তু, প্রোফেসর আশরাফি কোথায় লুকিয়ে আছেন? আমি আর ফারহান ঢাকা শহরে বড় বিষন্ন বোধ করছি। এদিকে বুয়েটও বন্ধ। কী করব বুঝতে পারছি না। বাবা-মাকে রাজি করিয়ে আমি আর ফারহান একরাতে ট্রেনে চেপে সিলেট চলে এলাম ।
ফারহানের সাজেদা খালার বাড়ি উঠে দিন কয়েক সিলেট ঘুরে বেড়ালাম। তারপর ঢাকায় ফেরার পথে সিলেট থেকে এলাম শ্রীমঙ্গল । লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান দেখার ইচ্ছে ছিল । এর আগে ওই বিখ্যাত বৃষ্টিবনটি দেখা হয়নি।
শ্রীমঙ্গল পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।
উঠলাম এক হোটেলে। বেশ নিরিবিলি ছিমছাম হোটেল। নাম: নীলিমা। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ফারহান ওর দশ ইঞ্চি লেনেভো আইডিয়া প্যাডটা নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি পাশের বিছানায় আবদুল্লাহ আল-মুতী -র ‘মহাকাশে কী ঘটছে’ বইটা পড়তে লাগলাম মন দিয়ে।
মহাকাশে কী ঘটছে তা জানা দরকার। ফারহান বলল, এই শান্ত। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ভারি মিস্টিরিয়াস এক ঘটনা ঘটেছে।
কি রে? আমি বই মুড়ে ওর দিকে তাকালাম।
অনলাইন পত্রিকা সিলেট নিউজ ২৪. নেট কী লিখেছে পড়ছি শোন।
কিছুদিন ধরে দানবীয় এক উল্লুকের উৎপাতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। একদা পর্যটকমূখর লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক আজ পরিত্যক্ত। বিরান। অতিকায় উল্লুকের উৎপাতে দেশিবিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ২০০৮ সালে লাউয়াছড়া উদ্যানে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৬৩ হাজার।
এখন কমে প্রায় প্রায় শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে। দানব আকৃতির এই উল্লুক হঠাৎ আক্রমন করে লোকজনকে আহত করে। গতবছর একটা মার্কিন তেল কোম্পানি তেলগ্যাস অনুসন্ধানের জন্য লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ করে আসছিল। তারাও কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে।
স্ট্রেঞ্জ! আমার মুখ থেকে বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে আসল।
বললাম, অতিকায় উল্লুক লিখেছে। কত বড়?
ফারহান বলল, এক সুইডিশ পর্যটক নাকি ভোরবেলা দেখেছে। তার বর্ণনা অনুযায়ী পত্রিকাটি লিখেছে অতিকায় উল্লুকটির উচ্চতা প্রায় বারো ফুট।
বারো ফুট?
হ্যাঁ। বারো ফুট ।
ধ্যাত! অত বড় উল্লুক কি হয়?
না, মনে হয়। দাঁড়া দেখি। ... না। উল্লুক ৯০ সেন্টিমিটারের বড় হয় না। তার মানে এই ধর- আড়াই ফুট।
আমি বললাম, তাহলে অন্য কোনও রহস্য থাকতে পারে। চল, কাল তো আমরা লাউয়াছড়া যাচ্ছিই । যদি সম্ভব হয় ওখানে কোথাও থেকে উল্লুক-রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করি।
ফারহান বলল, চল। উল্লুকের ইংরেজি হল ‘হুলোক গিবন’।
বড় বিরল এবং বিপন্ন প্রজাতির প্রাণি। এরা আসলে বনমানুষ বা এপ। উল্লুক দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বনমানুষ। লাউয়াছড়া বিখ্যাত উল্লুকের জন্য। রসিক লোকেরা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের নাম দিয়েছে ‘উল্লুকের মুল্লুক’ বলে।
এখন লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে একশোর মতন উল্লুক আছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় উল্লুক আছে ভারতে আর শ্রীলঙ্কায়। এদের প্রিয় হল চাপালিশ ফল ...
ফারহান আরও কী সব বলছিল। বই পড়তে পড়তে আমি ঘুমিয়ে পড়লেও ফারহান অনেক রাত্রি অবধি জেগে রইল।
পরদিন সকালে শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জের বাসে উঠলাম।
বাসে ফারহান বলল, ১৯২৫ সালে ব্রিটিশরা লাউয়াছড়া কে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষনা করে নানাজাতের গাছগাছালি লাগিয়েছিল। সেই গাছই আজ ঘন অরণ্যে পরিনত হয়েছে। লাউয়াছড়া উদ্যানের আয়তন ১২৫০ হেক্টর। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে লাউয়াছড়া অরণ্যকে ‘জাতীয় উদ্যান’ ঘোষনা করে। শ্রীমঙ্গল থেকে লাউয়াছড়া ৬-৭ কিলোমিটার পথ।
পথটুকু চোখের পলকে কেটে গেল। অশ্বিনের রোদ ঝলমলে দিন । ন’টার মতো বাজে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান প্রবেশ পথের কাছে টিকেট কাউন্টার। তবে ফাঁকা।
পার্কের ভিতরে ঢুকতেই অজস্র পাখির কিচিরমিচির শুনতে পেলাম। বিশাল বিশাল গুল্মলতা ঝুলছে এমন সব গাছ চোখে পড়ল। গেটের ওপাশে একটা সাইনবোর্ডে গাইডের ফোন নম্বর আর চার্জ টাঙানো । ওখানেই একজন বেঁটে মতন লোক বসে ছিল। দেখে খাসিয়া বলে মনে হল।
ফারহান তখন বলছিল, লাউয়াছড়ায় খাসিয়াই নাকি বেশি। লোকটার পরনে লাল হাফপ্যান্ট আর কালো গেঞ্জি; গায়ের রং কালো। মুখ ঠিক পুরোপুরি মঙ্গোলয়েড না। অনেকটা বাঙালিদের মতোই। তবে বয়স ঠিক বোঝা গেলনা।
তবে তিরিশের কোঠায় বলে মনে হচ্ছে।
আমাদের দেখে লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলল, খ্যুবলাই। বুঝলাম খ্যুবলাই মানে ‘হ্যালো’ বা ‘সালাম’ জাতীয় কিছু হবে। আমরাও হেসে প্রতি উত্তর দিলাম। এরপর সে পরিস্কার বাংলায় বলল, আমার নাম থ্রোক খাসিয়া বাবু।
থাকি সূখিয়া ছড়ার কাছে খাসিয়াপঞ্জীতে। আগে গাইড-এর কাজ করতাম। অখন লোকজন ইদিকে আসে কম। এখন বেকার আছি বাবু।
ফারহান ওর স্যামসং এস থ্রি দিয়ে থ্রোক খাসিয়ার একটি ছবি তুলে নিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের খাসিয়া পঞ্জীতে দু-একদিন থাকা যাবে?
থ্রোক খাসিয়া বলল, তা যাবে বাবু। তবে মন্ত্রীর (হেডম্যানের ) অনুমতি লাগিবে। আমাগো মন্ত্রীর নাম হৈল ডিবারম্যান পতাম। তবে আমি কইলে সে অনুমতি দিবেক।
চল, তাহলে।
আমরা হাঁটছি। পিচ রাস্তা বেঁকে গেছে কুয়াশায়। দু’ পাশে বিশাল বিশাল সব গাছ। পরিচিত গাছের মধ্যে আছে কড়ুই রেনট্রি; তবে এদের গায়ে যেভাবে লতাগুল্ম জড়ানো তাতে আদিম আর অচেনা বলে মনে হয়। অনেক উঁচু থেকে গাছগুলির মাথা চুইয়ে আলোর রেখা নিচে নেমে আসছে।
মনে পড়ল তখন বাসে ফারহান বলেছিল: লাউয়াছড়া চিরহরিৎ বৃষ্টিবন। সারাবছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। গাছ এত উঁচু হওয়ার কারণ সূর্যের আলোর জন্য গাছের কম্পিটিশন। রাস্তার ওপর গভীর ছায়া পড়েছে। ঝিঁঝি পোকারা ডাকছিল বিরামহীন।
সেই সঙ্গে বিচিত্র সব কীটপতঙ্গের শব্দও ছিল। পথের দু’পাশে বাঁশের ঝাড়, বেত গাছ, বিচিত্র বর্ণের সব ফুল ও নানা রঙের অর্কিড। কোনও কোনও গাছের গুঁড়িতে নাম লেখা। একটি গাছের গুঁড়িতে লেখা ‘রক্তন গাছ। ’ রাস্তার পাশে কয়েক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া।
রাস্তার পাশে পাখির পরিচিতিমূলক বোর্ড, ম্যাপ ও টিপ্স লেখা সাইনবোর্ড। জলপাই গাছে বসে আছে একটি মায়াবী পাহাড়ি ময়না। আমার গলায় একটা প্যানাসনিক লুমিক্স টি জেড থারর্টি ঝুলছে । ঝটপট ছবি তুলছিলাম। পরে ফেসবুকে আপলোড করব।
পিচরাস্তার পাশে একটা বনবিভাগের সবুজ জিপ থেমে আছে। এই ন্যাশনাল পার্কটি যে একেবারে বিরান তা কিন্তু নয়। পিচ রাস্তায় কিছু লোক হাঁটছে। এদের মধ্যে দু’একজন ফরেনারও আছে দেখলাম । দুটো সাইকেল চলে যায়।
তার একটায় একটা মেয়ে। অন্যটায় একজন মাঝবয়েসি পুরুষ। দু’জনই ফরেনার। মেয়েটার চোখে সানগ্লাস। বেনি করা সোনালি চুল ।
কাঁধে খাকি রুকসেক। পরনে কালো ট্রাউজার আর লাল রঙের টিশার্ট। মধ্যবয়েসি পুরুষের চুল সোনালি; চোখ নীল। মুখে খোঁচা খোঁচা সোনালি দাড়ি। পরনে সাদা গেঞ্জি।
তাতে জাগুয়ার- এর একটি ছবি। এর পিঠেও ধূসর রঙের ব্যাকপ্যাক।
বাঁ পাশে মাটির একটি রাস্তা গভীর বনের মধ্যে ঢুকে গেছে । থ্রোক খাসিয়া সে পথে নেমে গেল। চোখের সামনেই একটা কালো কাঠ বেড়ালী লাফ দিয়েই অদৃশ্য।
একঝাঁক প্রজাপতি উড়ছিল। বিরল চশমা পরা বানর দেখলাম অর্জুন গাছে বসে আছে। কোন জগতে এলাম? একটা মায়া হরিণ চকিতে পালাল। আচমকা ডানা ঝাপটে উড়ে দূরের কুয়াশায় মিলিয়ে গেল একটি সবুজ ঘুঘু। একটা বনমোরগ উড়াল দিল রঙ্গনের ঝাড়ে।
গাছের ফাঁকফোকড়ে পড়ে আছে সদ্য কাটা গাছের ছাল-বাকল। বনদস্যুদের কাজ! কাল রাতে ফারহান বলেছিল: দানব আকৃতির ওই উল্লুক এর আতঙ্কে অবশ্য ছিনতাইকারী উৎপাত এবং সংঘবদ্ধ বনদস্যুর গাছকাটা বন্ধ হয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে থ্রোক খাসিয়া বলল, তার বউয়ের নাম মনভা পলং । বউ পান চাষ করে। তার দুটি ছেলে মেয়ে ।
বড় ছেলে প্রেয়ার্ড খাসিয়া পড়ছে ক্লাস সিক্সে এবং মেয়ে এ্যামি খাসিয়া ক্লাস টু। বৃষ্টি কম হওয়ায় এবার পান চাষের অবস্থাও ভালো না।
হঠাৎ চোখে পড়ল লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি পরা একজন স্থানীয় লোক বুনোপথ ধরে এদিকেই আসছে। সে আমাদের দেখে দাঁড়াল। থ্রোক খাসিয়া তাকে খাসিয়া ভাষায় কী যেন বলল ।
লোকটি মাথা নেড়ে চলে যায়। থ্রোক খাসিয়া বলল, এর নাম হৈল সাজু মারসিয়াং বাবু। এ আমার বন্ধু হয়। আনারস চাষ করে। টিলার ওপর টংঘরে একা থাকে।
মাথার ঠিক নাই অর বাবু, সাজু মারসিয়াং পাগল আছে বটেক।
সামনে রেললাইন। দুটি স্থানীয় মেয়ে রেললাইনের ওপর হাত ধরে হাঁটছে কুয়াশায়। ফারহান বলল, সিলেট-আখাউড়া রেলপথ। এই রেললাইনটাই দেখিয়েছিল জুলভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ ছবিতে ।
১৯৫৬ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল।
তাই নাকি! বলিস কী!
রেললাইন পেরিয়ে হাঁটছি। ফারহান বিশাল এক গাছ দেখিয়ে বলল, ওই যে আফ্রিকান টিকওক গাছ। বেশ রহস্যময় গাছ। এর পাতা শুঁকলে নাকি মানুষ জ্ঞান হারায়।
বললাম, এমন কি হতে পারে না যে ওই পাতা খেয়ে উল্লুকদের দ্রুত মিউটেশন হয়েছে?
ভাবছি। ফারহার সংক্ষেপে বলল।
চারিদিকে ছোটবড় টিলা। আর অনুচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে সবুজ রঙের বাঁশ ঝাড়।
তারপর ছড়া। ছড়ায় স্নান করছে খাসিয়া মেয়েরা। টিলার চূড়ায় পানের বরজ। ফারহান বলল, খাসিয়াদের মূল জীবিকাই পান। খাসিয়া-পানের জুড়ি নেই।
তবে এরা পান ছাড়াও আনারস আর লেবুও চাষ করে।
পান দেখলাম গাছে জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে।
থ্রোক খাসিয়া একটা টিলায় উঠছে। মাটি কেটে মাটির ওপর বাঁশ কেটে সিঁড়ির মতো ধাপ তৈরি করেছে। সিঁড়িতে অনেক শুকনো পাতা।
এক পাশে লাল জবা ফুটে রয়েছে।
টিলার ওপরে ওঠার পর খাসিয়াপঞ্জী চোখে পড়ল। বেশির ভাগ বাড়িই টিনসেডের। দু -একটা অবশ্য বেড়ার। অনেক বাড়িতে আবার সোলার প্যানেল ।
খাসিয়াপঞ্জীর ঘরে ঘরে নাকি টিভি। (থ্রোক খাসিয়ার বউ মনভা পলং কথাটা পরে বলেছিল)। বাড়ির আঙ্গিনায় ফুলের গাছ। অনেক বাড়ি দেয়ালে কালো বর্ডার। লাল রং করা।
পরিস্কার উঠান। যদিও এখানে ওখানে বাঁশ পড়ে আছে । উঠানে এবং বারান্দায় পান এর স্তূপ। মহিলারা দেখলাম পানি দিয়ে পান ধুয়ে আঁটি বাঁধছে। পরে জেনেছি একে কান্তাই বাঁধা বলে ।
খাসিয়া মহিলারা দেখলাম শাড়িও পরে!
থ্রোক খাসিয়ার বাড়িটা ছিমছাম। টিনসেডের। বারান্দার পিলার ঘন বেগুনি রং করা। বারান্দায় মোড়ায় বসে বাচ্চারা ক্যারাম খেলছিল। এখন অবাক বিস্ময় ভরা দৃষিটতে দেখছে আমাদের।
আমরা বারান্দায় বসলাম। থ্রোক খাসিয়া গেল মন্ত্রীর পারমিশন আনতে। মনভা পলং উঠানে কান্তাই বাঁধছিল। উঠে এল মহিলা। শাড়ি পরা।
কিছুটা মঙ্গোলয়েড চেহারা। কথাবার্তায় বুঝলাম ভারি অমায়িক। আনারস কেটে এনে খেতে দিল । মোড়ায় বসে কাটা সুপারি মুখে ফেলে বলল, এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় পান পাতা হলুদ হয়ে গেছে। গত বছর এক কান্তা পান ছিল ২০০টাকা।
এ বছর ১৩০ টাকা। বারোটি পানে এক গুছা। এরকম বারো গুছায় এক কান্তা। ছেলে প্রেয়ার্ড খাসিয়া আর এ্যামি খাসিয়া কে ডাকল। প্রেয়ার্ড খাসিয়া দেখতে কিছুটা মঙ্গোলয়েড তবে এ্যামি খাসিয়ার চেহারা বাঙালিদের মতোই।
মনভা পলং দুপুরে আনারস দিয়ে মোরগ রান্না করে খাওয়াল। ফারহান বলল, এরা খাওয়ার পর পান খাওয়াবেই। না করিস না। খাওয়ার পর বেরুলাম। অতিকায় উল্লুকের যদি দেখা পাই।
ফারহান বলল, কাল শ্রীমঙ্গলের নীলকন্ঠের বিখ্যাত ছয় রঙ্গা চা খাওয়া হয়নি। চল। আজ খেয়ে আসি।
লাউয়া ছড়া থেকে শ্রীমঙ্গল হেঁটে যেতে ২ ঘন্টা লাগবে। আর মাত্র দেড়াটা বাজে।
বললাম চল।
নীলকন্ঠ কেবিন এর বাইরে অনেকগুলি প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস। সামনে খোলা স্পেসে অনেক চেয়ার। বেশ ভিড়। ভিতরে ঢুকে বসলাম।
তোমরা? তাকিয়ে দেখি-তানিয়া তাবাসসুম। জিন্স আর টপস পরা। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব একটা টেবিলে বসে। আমাদের দেখে হাত নাড়লেন। তাঁর পাশে পাশে গরদের শাড়ি পরা চশমা পরা গম্ভীর চেহারার ফরসা এক মহিলা।
পরে জেনেছি ইনি সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব- এর স্ত্রী। মিসেস লায়লা মোশতাক একটা এনজিওতে আছেন।
বললাম, আমরা এখানে গতকাল এসেছি।
তানিয়া তাবাসসুম বলল, আমরা সিলেট যাচ্ছি। বাবা আছেন।
এসো, পরিচয় করিয়ে দিই।
সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব বললেন, আরে তোমরা এখানে? আমার পাগলা ফ্রেন্ডের সন্ধানে বুঝি?
আমরা কিছু বললাম না। উনি ফান করতে পারেন। আমরা কি সেই অধিকার রাখি?
পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোককে দেখিয়ে তানিয়া তাবাসসুম বলল, আমারা বাবা। অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক।
পরে জেনেছি ইনি তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি মধুরকন্ঠে বললেন, আমাদের সঙ্গে সিলেটে চল। বেড়িয়ে আসবে।
আমি টেবিলে বসতে বললাম, আমরা আজ রাতে লাউয়াছড়ার খাসিয়াপঞ্জী তে থাকব। তানিয়া তাবাসসুম লাফিয়ে উঠে বলল, লাউয়াছড়া? আমরা যাব! আমরা যাব! আমরা যাব! অগত্যা থ্রোক খাসিয়া কে ফোন করলাম।
এখানকার নেট ওয়ার্ক ভালো না। পরে অবশ্য পেলাম । থ্রোক খাসিয়া বলল, সবাইকে নিয়ে যেতে। সে হেডম্যা নডিবারম্যান পতাম -এর সঙ্গে কথা বলবে। কোনও সমস্যা হবে না।
ছয় রঙের চা খেয়ে মাইক্রোবাসে চাপলাম। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব বললেন, সেদিন পত্রিকায় পড়লাম, অতিকায় উল্লুকের উৎপাতে নাকি পর্যটক আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে?
হ্যাঁ।
তানিয়া তাবাসসুম বলল, জন্তুটাকে তোমরা দেখেছ নাকি?
না। এখনও সেই সৌভাগ্য হয়নি।
অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক বললেন, একটি মার্কিন কোম্পানী লাউয়াছড়ায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করছে।
মার্কিন কোম্পানি জঙ্গলের ভিতরে ইলেকট্রিক লাইন বসিয়ে ডায়ানামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভুকম্পন সৃষ্টি করে গ্যাস অনুসন্ধান করে। একটি বিরল প্রজাতির চশমা বানর বোমার শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ইলেকট্রিক তারের সঙ্গে জড়িয়ে মারা যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বানরটি ছটফট করছিল। মার্কিন কোম্পানীর অনুসন্ধান কাজ শুরু হওয়ার পর নাকি অরণ্য কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে।
মাইক্রোটা লাউড়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গেটের কাছে থামল।
পার্কের ভিতরে ঢুকে তানিয়া তাবাসসুম বলল, অমাঃ কী সুন্দর!
বন। আমি ভয় দেখাবার জন্য বললাম, এই বনে জিনভূত ছাড়াও আছে মেছোবাঘ, পাগলা কুকুর আর বুনো শুকোর । বলে লাভ হল না। ওমাঃ কী সুন্দর পাখি। ওই পাখিটার কী নাম? সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব বলেন, সবুজ সুইচোরা।
হলুদ আলো ছড়ানো অপরাহ্নের অরণ্যে ভারি অদ্ভূত এক পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। শব্দটা ভারি অদ্ভূত তো। হ্যাঁ। ট্যুরিস্টরা বলে ‘ফরেস্ট মিউজিক’। রেললাইন পেরিয়ে ফারহান বলল, আর ঐ যে ওইটা, ওইটা হল আফ্রিকান ওকট্রি।
ওই গাছের পাতার গন্ধ শুঁকলে নাকি মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। কেন? সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব শ্রাগ করলেন।
পানের বরজ দেখে তানিয়া তাবাসসুম মুগ্ধ। টিলার ওপর খাসিয়া পঞ্জী। এই পঞ্জীর কি আলাদ মিনিং আছে? ফারহান বলল, পঞ্জী মানে পল্লী।
মনভা পলং -এর আতিথেয়তায় সবাই চমৎকৃত। ফুটফুটে এ্যামি খাসিয়া কে দেখে তানিয়া তাবাসসুম মুগ্ধ। অনেক ছবি তুলল। প্রেয়ার্ড খাসিয়া আর এ্যামি খাসিয়ার চোখে বিমুগ্ধ বিস্ময়। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব থ্রোক খাসিয়াকে বাজারের টাকা দিলেন।
মিসেস লায়লা মোশতাক বসলেন উঠানে। মহিলাদর সমস্যা শুনছেন । বললেন, পান চাষের অবস্থা যখন খারাপ তখন তাঁত বসানো যায় কিনা। দূরে তখন কাঠ ঠোকরার কাঠ ঠোকরানোর শব্দ ভেসে আসছিল।
পরদিন যখন আমার ঘুম ভাঙল।
টের পেলাম ভোর। আলো ফোটেনি। উহ উহ উহু শব্দ শুনতে পেলাম। আরে এতো উল্লুকের ডাক ! উঠে বসলাম। কালরাতেই ফারহানের নেটবুকে শুনেছি।
ও ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করছিল। ফারহান ঘুমাচ্ছে। সর্ন্তপনে ঘরের বাইরে চলে এলাম। বেশ শীত। উঠানে কুয়াশা।
সারা পঞ্জী নিথর। নির্জন । উঠানে নেমে এসে উল্লুকের ডাক যেখানে শোনা যাচ্ছিল। যেতে থাকি। একটা বেজী উঠানে পেরিয়ে পালাল ওদিকার বাঁশঝাড়ের দিকে।
ডুমুর গাছে একটা ধনেশ পাখি বসে । সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। উহ উহ উহু। অনেক ওপর থেকে ভেসে এল উল্লুকের ডাক। মানুষের কন্ঠের প্রায় কাছাকাছি।
মুখ তুলে দেখি একটা চাপালিশ গাছের মগডালে বসে ডাকছে উল্লুকটা। শাদা রঙের পশম। দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবার ডাকল ঠিক আমা পিছন থেকে। চমকে উঠে দেখি বিরাট এক উল্লুক।
বারো ফুট তো হবেই। সারা শরীরে সাদা রোম। কালো গোল চোখ। চোখের চারপাশে সাদা ভুরু। মুখের চারপাশে সাদা দাগ।
বিশ্রি গন্ধ। উহ উহ উহু চিৎকার করে উঠল। আমাকে ধাক্কা মারল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। চিৎকার যে করব।
গলায় স্বর ফুটল না। উল্লুকটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে- হঠাৎ ক্রর ররর করে একটা যান্ত্রিক শব্দ হল। উল্লুকটা স্থির হয়ে এল। কি ব্যাপার।
উঠে এসো শান্ত।
এ কি! প্রোফেসর আশরাফির কন্ঠস্বর! দ্রুত উঠে বসলাম। ধূসর কুয়াশায় প্রোফেসর আশরাফি দাঁড়িয়ে । পরনে ফরেস্ট গার্ডদের খাকি ইউনিফর্ম, মাথায় খাকি ক্যাপ । তার পাশে থ্রোক খাসিয়ার বন্ধু টিলার ওপর টংঘরে একা বাস-করা পাগলাটে স্বভাবের আনারস চাষী সাজু মারসিয়াং।
আমার প্যান্টে শিশির লেগেছিল।
ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম, আপনি! আপনি! এখানে! আমার বুক তখনও ভীষণ ধরাস ধরাস করছিল। প্রোফেসর আশরাফি অবিকল উল্লুকের স্বরে ডেকে উঠলেন উহ উহ উহু। তারপর বললেন, হুমম । রাষ্ট্রের কর্ণধারের পরামর্শে আমার বনবাস পর্ব চলছে এখন।
বললাম, ও।
ওদিকে এলিয়েনরা লসএঞ্জেলেস শহর ধ্বংসলীলা নিউইর্য়ক শহলে আতঙ্ক ছড়িয়ে মহাকাশে উধাও হয়ে গেছে।
জানি হে জানি। পৃথিবীতে কোথায়কী ঘটছে এখানে বসেই টের পাচ্ছি। স্পেস গার্ডেনের ল্যাবে নাসিরউল্লাহ রোজ বাগানে পানি দিচ্ছে। শাহীনূর একটানা খেয়েই যাচ্ছে।
নাসিরউল্লাহর সঙ্গে আমার রোজ কথা হয়। বলে এলজি অপটিমাসটা দেখালেন।
আপনি তাহলে এখানেই থাকেন?
ঠিক এখানে না। আমার ফরেস্ট ল্যাবটি কাছেই। চলো যাই।
ওহো। এ হল, সাজু মারসিয়াং । আমার ডানহাত বলতে পার। বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলেন প্রোফেসর আশরাফি। আমি তার পিছন পিছন হাঁটছি।
বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে সরু পথ। বাঁশঝাড়ের মাকড়শাল জাল। ভোরের আলো লেগেছে। পাখিরা তারস্বরে ডাকতে শুরু করেছে। বাতাসে বেশ হিম।
মাটির ওপর ভাঙা ডাল, সাপের খোলশ। ট্রেনের আওয়াজ শুনলাম। পরে বুঝলাম পাখির ডাক । পথের ওপর বাঁশ হেলে পড়েছে। কী একটা ডোরাকাটা।
মেছোবাঘ? এদিকে সবুজ ঘাস।
প্রোফেসর আশরাফি বললেন, সাবধানে এসো শান্ত । জোঁক কামড়াতে পারে। ছিনে জোক। ঘাসের সঙ্গে মিশে থাকে।
রংও সবুজ।
আমাকে জোঁক-টোক কামড়ালো না অবশ্য । তবে আমরা একটি ছড়া পেরুলাম। প্রোফেসর আশরাফি বললেন, এটা চিগাছড়া। একটা বনবিড়াল পানি খাচ্ছে।
ছড়া পেরুলেই টিলা। বাঁশ কেটে ধাপ তৈরি করা মাটির সিঁড়ি-পথটা ওপরে উঠে গেছে। চূড়ায় বাঁশ আর বেতের ঘন জঙ্গল। প্রোফেসর আশরাফি বললেন, এটাই খাসিয়া কবরস্থান। বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে সরু পথ।
একটা সজারু বুনো ঝোপে লুকিয়ে পড়ল। বাতাসে বুনোলতাপাতার অদ্ভূত গন্ধ। বিশাল বিশাল গাছের ছায়ায় ঢাকা একটি বেশ পুরনো টংঘর চোখে পড়ল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি। ছোট বারান্দা।
ভিতরে ঢুকে ধাক্কা খেলাম। বেশ বড় একটি ঘর। বাঁশের দেয়ালে গোলাপি রঙের ওয়ালপেপার লাগানো । মেঝেতে ম্যাট্রেস। তার ওপর বই, একটি তোশিবা ল্যাপটপ, বায়নুকুলার।
ওপাশে দরজা। প্রোফেসর আশরাফি বললেন, এসো এসো। বারান্দায় বসি।
দরজার ওপাশে সরু করিডোর। দু’পাশে দরজা।
টয়লেট, বেডরুশ আর কিচেন মনে হল। করিডোরের শেষ মাথায় একটি দরজা। দরজার ওপরে স্টিফেন হকিংয়ের একটি ছবি। তার নীচে লেখা: আই অ্যাম লিও।
এই তাহলে প্রফেসরের ফরেস্ট ল্যাব? দরজার ওপাশে কাঠের রেলিং দেওয়া বারান্দাটি বেশ বড় ।
রোদ পড়েছে। মাঝখানে কাঁচ বসানো সুন্দর একটি বেতের টেবিলের চারপাশে ছয়-সাতটা পাহাড়ি বেতের তৈরি সোফা। ঠিক তার ওপরে একটি খাঁচা ঝুলছে। খাঁচায় একটি নীল সুইচরা পাখি। আমি অবাক হলাম।
রেলিংয়ের কাছে সরু হলদে টিউবে একটি টেলিস্কোপ। ভোরের বনের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যতদূর চোখ যায়- সবুজ আর সবুজ। যেন সবুজের সমুদ্র। যেন সবুজের হ্রদ।
ওপরে অক্টোবরের আকাশও নীল। বনময় ভোরের রোদমেশানো হালকা কুয়াশা ছড়ানো। বনময় কী এক রহস্য ছড়ানো । আর পাখিদের সিম্পোফি। আর ঝিঁঝির ডাক।
প্রোফেসর আশরাফি সোফায় বসতে বসতে বললেন, বসে বসে সময় কাটাচ্ছিল না। তাই রোবট-উল্লুক বানালাম।
আমি বসতে বসতে বললাম, বিদেশি তেল কোম্পনীকে ভয় দেখাতে?
হুমম। শালারা ভারি বজ্জাত। বনের উল্লূকদের শান্তিতে থাকতে দেয় না।
বলে হা হা হা করে হেসে উঠলেন।
সাজু মারসিয়াং এল। হাতে বেতের ট্রেতে লেবুচা। চা মনে হয় ফ্লাক্সে ছিল। প্রোফেসর আশরাফি বললেন, মারসিয়াং আমার কয়েকজন গেস্ট আসবেন।
ওদের তুমি পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসো। বলে এলজি অপটিমাস তুলে নিলেন। সাজু মারসিয়াং চলে গেল। প্রোফেসর আশরাফি বললেন, ফারহানকে বলি ওদের নিয়ে আসতে কেমন ? আমি মাথা নাড়লাম। প্রোফেসর আশরাফি ফারহানের সঙ্গে কথা বললেন।
তারপর টেবিলের ওপর থেকে বড় একটি ডিসপ্লে বসানো রিমোট তুলে বললেন, এখন আরএফটি টা ওখান থেকে সরিয়ে ফেলি। নৈলে মেয়েরা ভয় পাবে।
আরএফটি মানে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
প্রোফেসর আশরাফি হেসে বললেন, আরএফটি মানে রেইন-ফরেস্ট-টেরর। তার মানে বারো ফুটি অতিকায় দানবীয় উল্লুক।
ওহ। কী ভাবে বানালেন? বাংলাদেশে তো এফবি আই আর সি আই এ আপনাকে কিডন্যাপ করার জন্য ঘুরঘুর করার কথা।
প্রোফেসর আশরাফি বললেন, জানি হে জানি। পার্টস-টারস সব মেজর মেজর ইফতেখার হায়দার পৌঁছে দিয়েছেন। ওরা এসে গেছে মনে হয়।
যাও ওদের নিয়ে এসো।
আমি ফারহানদের ফরেস্ট ল্যাবের সামনে রিসিভ করার জন্য চলে এলাম। তানিয়া তাবাসসুম দৌড়ে বারান্দায় এসে বলল, স্যার, আপনি এখানে? আর আমরা সারা বাংলাদেশ খুঁজে মরছি। সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিব বললেন, পলাইবার জন্য তোফা জায়গা শ্যামল।
প্রোফেসর আশরাফি পাত্তা না দিয়ে মিসেস লায়লা মোশতাক কে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ লায়লা?
মিসেস লায়লা মোশতাক বললেন, জ্বী,ভাই।
আমি ভালো।
বসো, তোমরা।
তানিয়া তাবাসসুম খাঁচার পাখি দেখে বলল, ওয়াও। অসাম। কালই তো ... কোথায় যেন দেখলাম এটা? বলে, বেতের চেয়ার বসল।
আবার দাঁড়িয়ে বলল, ওহ। স্যার, আমার বাবা অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওনাকে চিনি চিনি । রেগুলার ওনার কলাম পড়ি নিউ এজ-এ ।
অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক বললেন, শুনেছি কীসের আতংকে লাউয়াছড়ায় মার্কিন কোম্পানীর কাজ বন্ধ। সি আই এ নাকি ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেশন চালাচ্ছে।
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রোফেসর আশরাফি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সাজু মারসিয়াং কে গম্ভীর টোনে বললেন, সাজু। এখন বাজারে যাও, দেখ, হরিণের মাংস পাও কিনা। আর বালিহাঁস পেলে এনো।
বলে আমার দিকে তাকিয়ে প্রোফেসর আশরাফি বললেন, তুমি আর ফারহান কিচেনে গিয়ে আমাদের জন্য লেবুচা তৈরি করে আন। যাও।
আমি আর ফারহান রান্নাঘরে চলে এলাম । মনে পড়ল কাল পার্কে দু’ জন ফরেনার দেখেছি। তারা সাইকেল চালাচ্ছিল।
একটা মেয়ে আর একজন মাঝবয়েসি পুরুষ। এরা কারা? সিআইএ-র এজেন্ট নয়তো? বেতের ট্রেতে চা নিয়ে ফিরলাম । আমার ঠিক পিছনেই ফারহান। তানিয়া তাবাসসুম দাঁড়িয়ে সুইচরা পাখি দেখছিল। আর বলছিল, কি কিউটি।
ছোনা আমার। যাদু আমার। দূরের জঙ্গলে কি যেন ঝিকিয়ে উঠল। চোখের পলকে বিশাদেহী প্রফেসর আশরাফি বাঘের মতন তানিয়া তাবাসসুম- এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ওমাঃ ছি! তানিয়া তাবাসসুম সাংবাদিক মোশতাক আন্দালিবসহ পড়ল আমার ওপর।
আমি ট্রে শুদ্ধ উলটে পড়লাম ফারহানের ওপর। একটা ভোঁতা শব্দ শুনেছি। ওপরে পাখির খাঁচা দুলছে। আমার মুখে গরম চটচটে কি য়েন। রক্ত! অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক ততক্ষনে মিসেস লায়লা মোশতাক কে টেনে মেঝের ওপর শুয়ে পড়েছেন।
পিছনে ফারহান এর কী অবস্থা বুঝতে পারছি না। তবে প্রফেসর আশরাফি গড়িয়ে মেঝেতে পরে থাকা সনি ট্যাবলেট এসটা তুলে নিয়েছেন । অন্য হাতে এল জি অপটিমাস। কার সঙ্গে কথা বললেন। তারপর উঠে বললেন,কুইক।
ওঠে সবাই, ল্যাবের বাইরে এসো। আমরা ফরেস্টল্যাব- এর বাইরে বেরিয়ে এলাম। একটা চাপালিশ গাছের নীচে সাজু মারসিয়াং আর থ্রোক খাসিয়া দাঁড়িয়ে। ওদের সঙ্গে আরও দুজন খাসিয়া যুবক। আমি এদের চিনি না।
তারা প্রফেসর আশরাফি কে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সালাম করল। মাটির ওপর একটা মেয়ে আর একজন মাঝবয়েসি ফরেনার পুরুষ পিছমোড়া করে বাধা। চোখে কালো কাপড়ের ফেট্টি। মেয়েটার চুল সোনালি। কাঁধের সেই র্যাকসেকটা একটু দূরে।
নীল চোখের মাঝবয়েসি পুরুষের সোনালি দাড়ি। সাদা গেঞ্জিতে জাগুয়ার- এর ছবি। চাপালিশ গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রাখা একটা টেলিস্কোপিক সাইট রাইফেল। বুনো পথে দূর্দান্ত স্মার্ট ৫-৬ জন যুবক উদয় হল। ফরেনারদের নির্দয়ভাবে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেল।
কারা ওরা? আমি জিজ্ঞেস করি। প্রফেসর আশরাফি বললেন, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টিলিজেন্স। জিজ্ঞেস করলাম, আর ওরা সিআইএর এজেন্ট। মিশন জাগুয়ারে এসেছে?
হুমম। যাক।
এবার ওরা টের পেয়ে যাবে আমার অবস্থান। এখান থেকে আমার আস্তানা গোটাতে হবে।
আমি চারদিকের রোদ লাগা গাছপালার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উল্লুক-অধ্যুষিত এই বিখ্যাত বৃষ্টিবনে যে এত গা ছমছমে রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছিল তা কে জানত ... চাপালিশ গাছের ওপর একটি উল্লুক ডেকে উঠল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।