কাজই খালি জানতে চাওয়া.তাই অনেকে বিরক্ত হয় এই সিরিজের অন্য পোস্ট গুলো পড়তে চাইলে [১ ,২ ,৩]
ফার্মিয়ান কণাদের সাথে মনে হয় প্রাথমিক পরিচয়টা আমাদের হয়েছে , আপনারা কি বলেন ? তবে এটা সত্যি যে যৌগিক ফার্মিয়ান কণাদের( বেরিয়নদের ) সম্পর্কে খূব বেশি কিছু বলা হয়নি , পরে বলার ইচ্ছা আছে । তার আগে বোসনদের সাথে প্রাথমিক পরিচয়ের পালাটা শেষ করি । আচ্ছা আপনাদের অবশ্যই মনে মনে প্রশ্ন আসছে এদের বোসন বলা হয় কেন ? উত্তর তো আপনারা জানেন (বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে) । তবে কি এটা জানেন এই বোস যে একজন বাঙালী বিজ্ঞানী ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু হচ্ছেন সেই মহান বিজ্ঞানী আর তাঁর নামানুসারেই এই কণাদের নাম বোসন বলা হয় । এই মহান বিজ্ঞানী সম্পর্কে কিছু না বললেই নয় ।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯২১ সালের মে মাসের কোন এক সময় ঢাকায় আসেন এবং একই বছরের জুনের ১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার পদে যোগদান করেন । ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ম্যাক্স-প্ল্যাঙ্ক যে সমীকরণ দিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন কিন্তু এই তত্ত্বের মধ্যে একটি ত্রুটি ছিল । আর এই ত্রুটি সম্পর্কে অনেকেই সচেতন ছিলেন এদের মধ্যে কে কে ছিলেন জানেন ? আইনস্টাইন , ডিরাক এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের আর বড় বড় বিজ্ঞানীরা । কিন্তু এই ত্রুটি দূর করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ( কার্জন হলের কোন একটি কক্ষে বসে ) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক থাকা অবস্থায় । ম্যাক্স-প্ল্যাঙ্কের সমীকরণের জন্য প্রয়োজন ছিল কোয়ান্টাম অবস্থার তাপবলবিদ্যাগত সম্ভাবনা ( Probability ) নির্ধারণ করা ।
আর এই কাজটি সমাহারতত্ত্ব ব্যবহার করে সত্যেন্দ্রনাথ বসু করেছিলেন । বসু তাঁর এই কাজের প্রবন্ধটি আইনস্টাইনের কাছে পাঠান , আইনস্টাইন এ প্রবন্ধের গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং তা নিজেই জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে সাইট শ্রিফট ফ্যুর ফিজিক পত্রিকায় ১৯২৪ সালে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন । অধ্যাপক বসুকে কোয়ান্টাম সংখ্যাতত্ত্বের জনক বলা হয় । তাঁর এই অবদানের জন্য কণাদের নাম দেয়া হয়েছে বোসন কণা । ‘বোসন’ এবং ‘ফার্মিয়ান’ শব্দ দুইটি প্রথম ব্যবহার করেন নোবেল বিজয়ী এবং কণা পদার্থ বিজ্ঞানে প্রতিসাম্যের প্রবক্তা ইউজিন উইগনার ।
যাইহোক আমরা আবার মূল কথায় ফিরে আসি । বোসন কনাদের পরিচয়! বোসন কনাদের কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে ( রাজার সৈন্যদের কথা মনে আছে? সৈন্যসামন্তদের মধ্যে যেমন ভাগ আছে, একেক বাহিনীর উপর একেক রকম দায়িত্ব ঠিক এমনভাবে একেক মৌলিক বোসন কণা একেক রকম মৌলিক বলের জন্য দায়ী ) । আর ভালভাবে বলতে হয় বোসন কণার বলের (সৈন্যবাহিনীর দায়িত্বের ) উপর ভিত্তি করে এদের ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে । তবে ফার্মিয়ান কণাদের মত বোসন কণারাও প্রাথমিকভাবে দুই ধরনের –
ক) মৌলিক বোসন কণা এবং
খ ) যৌগিক বোসন কণা বা মেসন ।
মেসন সম্পর্কে আগেই বলেছিলাম এরা হ্যাড্রন পরিবারের একটি সদস্য ।
একটি কোয়ার্ক ও একটি প্রতি-কোয়ার্ক মিলে মেসন হয় । যদিও এদের বোসন বলা হয় তবে এরা কিন্তু মৌলিক বোসন(গ্লুয়েন) এবং ফার্মিয়ান (যেহেতু কোয়ার্ক ও প্রতি-কোয়ার্ক হচ্ছে ফার্মিয়ান কণা ) দিয়ে তৈরি । তাহলে নিশ্চয়ই প্রশ্ন আসবে “তাহলে এদের বোসন বলা হয় কেন ?” উত্তরতো আপনাদের জানা এরা (কোয়ার্ক ও প্রতি-কোয়ার্ক দিয়ে সৃষ্টি হলেও ) বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে ( কিছু কিছু যৌগিক বোসন কণা বা মেসন আছে যারা বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে না , তাই সত্যিকার অর্থে এদের বোসন বলা যায় না যাইহোক সেই প্রসঙ্গটা অন্য আরেকদিনের জন্য তুলে রাখলাম) । প্রথমে মৌলিক বোসন কণাদের সাথে পরিচয় হই । যদিও বেশির ভাগ বোসন কণারা হচ্ছে যৌগিক তবে প্রমিত মডেল বা Standard Model অনুযায়ী মৌলিক বোসন কণা হচ্ছে ৫ ধরনের -
• ৩ ধরনের গেজ বোসন (Gauge Bosons)
• ১ টি হিগস্ বোসন (Higgs Boson)
• ১ টি গ্রাভিটন (Graviton) (যদিও গ্রাভিটন কে প্রমিত মডেলে স্থান দেওয়া হয় না)
চিত্র-১ : প্রমিত মডেল বা Standard Model
গেজ বোসন গুলো ছাড়া হিগস্ বোসন (৪ জুলাই ২০১২ এ যদিও বলা হয়েছে ৯৯.৯৯% নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে হিগস্ বোসন আবিষ্কার হয়েছে এবং এই সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অনেক লিখা আপনারা পড়েছেন) এবং গ্রাভিটন এই ২ টি বোসন কণার অস্তিত্ব এখনো প্রমাণ করা যায়নি ।
নিউটনের বা ক্লাসিক্যাল পদার্থ বিজ্ঞানের তত্ত্ব মতে বল সঞ্চারিত হয় ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে । কিন্তু কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বে ( Quantum Field Theory) বলক্ষেত্র সমূহ বিভিন্ন ধরনের মৌলিক কণার দ্বারা গঠিত মনে করা হয় আর এই মৌলিক কণা গুলো হচ্ছে বোসন । যেহেতু আমরা বোসন কণা নিয়ে আলোচনা করবো তাই এদের দ্বারা সৃষ্ট বলগুলোর সাথেও পরিচয় পর্বটা সেরে নিব । যাইহোক আমার মনে হয় আগে মৌলিক বোসন কণাদের সাথে পরিচয়ের পালাটা শেষ করি ।
কণা পদার্থ বিজ্ঞানে গেজ বোসন মহাকর্ষ বল (ধারনা করা হয় যে গ্রাভিটন কণার জন্য মহাকর্ষ বলের উৎপত্তি ) ছাড়া অন্য ৩টি মৌলিক বলের বাহক হিসেবে কাজ করে আরো ভালভাবে বলতে গেলে গেজ তত্ত্ব ( Gauge Theory হচ্ছে এক ধরনের পরিমাপ তত্ত্ব ) অনুযায়ী এই কণাগুলোর আদান-প্রদানের মাধ্যমেই মৌলিক বলগুলোর উৎপত্তি ।
যদিও বিজ্ঞানীরা বল কে বূঝার জন্য ৪টি ভাগে ভাগ করেছেন । ৪ টি মৌলিক বল এবং মৌলিক এই ৪ ধরনের বল কে যে ৪ টি তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় তা হচ্ছে নিম্নরুপ –
১) সবল নিউক্লিয় বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Quantum Chromodynamics (QCD)
২) তড়িচ্চুম্বকীয় বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Quantum Electrodynamics (QED)
৩) দূর্বল নিউক্লিয় বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Flavordynamics
৪) মহাকর্ষ বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Geometrodynamics
চিত্র-২ : মৌলিক বল ও বল পরিবাহী কণা ।
এই ৪ টি বলের মধ্যে একমাত্র মহাকর্ষ বল ছাড়া বাকি ৩টি বলকে কোয়ান্টাম গতিবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় । যেহেতু মহাকর্ষ বলের জন্য এখন পর্যন্ত কোন কোয়ান্টাম গতিবিজ্ঞান আবিস্কার করা যায়নি , তাই একে Geometrodynamics দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় । দূর্বল নিউক্লিয় বলের ক্ষেত্রে এর তত্ত্ব কে The theory of weak interaction বলা হয় তবে অনেক সময় একে Flavordynamics ও বলে ।
আমরা বোসন কণাদের সাথে সাথে এদের দ্বারা সৃষ্ট বলগুলো এবং তত্ত্বগুলোর সাথেও প্রাথমিক পরিচয় হব । প্রাথমিক কথাটা বললাম এই জন্য কারণ এই তত্ত্বগুলো জটিল গণিতে পূর্ণ তাই বিশদভাবে আলোচনা করা হবেনা শুধু বলা যায় এই তত্ত্ব গুলোর ইতিহাস এবং খানিকটা ধারণা দেওয়া হবে ।
চিত্র-৩ : মৌলিক বল
প্রথমে গেজ বোসন দের সাথে পরিচিত হই । প্রমিত মডেল বা Standard Model অনুযায়ী গেজ বোসন ৩ ধরনের -
ক ) ফোটন
খ ) W ± এবং Z বোসন
গ ) গ্লুয়েন ( Gluons )
এই তিন ধরনের গেজ কণার মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বেশি পরিচিত হচ্ছে ফোটন কণা । আমরা আমাদের চারপাশে যত আলো (আমরা নিশ্চয় জানি যে আলোও এক প্রকার তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ ) বা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ দেখি সবই ফোটন ।
যেমন আমরা বাসা- বাড়িতে বাল্ব জ্বালাই , বাল্বের এই আলো আসলে ফোটন কণার বন্যা বলা যায় । আমরা মোবাইলে কথা বলি , মোবাইল মূলত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে আর তাই এখানেও ফোটন কণার ব্যাপারটা চলে আসছে । শুধু কি তাই! আধুনিককালে যোগাযোগের জন্য তারবিহীন যত ডিভাইস ব্যবহার করা হয় তার সবই তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে । আমরা ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সাথে পরিচিত , আর এই ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মধ্য দিয়ে ফোটন কণার চলার মধ্য দিয়েই কিন্তু যোগাযোগ হয় ।
ফোটন কণা কিভাবে উৎপন্ন হয় তা একটি উদাহরনের মাধ্যমে পরিস্কার করা যাক ।
আমরা আমাদের বাড়িতে বাল্ব জ্বালাই তা কিভাবে জ্বলে তা একবারও চিন্তা করেছি ? চিন্তা না করে থাকলে কোন সমস্যা নাই আমরা এখন চিন্তা করব । পরমাণুর ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের কথা মনে আছে ? আমরা জানি যে ১ম শক্তিস্তরে যে ইলেকট্রন দুটি থাকে এদের থেকে ২য় শক্তিস্তরের ইলেকট্রন গুলোর শক্তি বেশি থাকে তাই না ? এভাবে ৩য় শক্তিস্তরে আরো বেশি । বাল্বের সুইচ ON করার মাধ্যমে বাইরে হতে শক্তি প্রদান করা হয় , তখন ধরি ১ম শক্তিস্তরের ইলেকট্রন এই বাইরের শক্তি পেয়ে ২য় শক্তিস্তরের ইলেকট্রন গুলোর শক্তির সমান হয়ে গেল এবং ২য় শক্তিস্তরে লাফ দিয়ে চলে আসে কিন্তু এটাতো ২য় শক্তিস্তরের ইলেকট্রনরা মেনে নেয়না এরা একে আবার ১ম শক্তিস্তরে পাঠিয়ে দেয় (যদিও কথাটা মজা করার জন্য বললাম)তাই ইলেকট্রনটি অতিরিক্ত শক্তিটুকু ছেড়ে দিয়ে (মনের দুঃখে) আবার ১ম শক্তিস্তরে ফিরে আসে আর এই শক্তিটুকু ফোটন হিসেবে নির্গত হয় । আসলে ফোটন-ই একমাত্র গেজ বোসন যাদের আমরা দেখতে পাই । বাকি বোসনদের দেখতে পাই না শুধু এদের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় আর তাই অনেক সময় বোসনদের ভার্চুয়াল কণা বলে ।
যাইহোক এছাড়া আরো অনেক ক্ষেত্রে আমারা ফোটনের দেখা পাই , যেমন কণা ও প্রতিকণা সংস্পর্শে আসলে গামা রশ্মি আকারে শক্তি নির্গত হয় আর গামা রশ্মি হচ্ছে ফোটন ।
ফোটন গ্রিক শব্দ যার অর্থ হল আলো । ফোটন কে গ্রিক অক্ষর γ (গামা) দিয়ে প্রকাশ করা হয় এবং এই কণার স্পিন হচ্ছে ১ । আমরা উপরের আলোচনা হতে এতোটুকু বুঝতে পারি যে ফোটন হচ্ছে আলোকের মৌলিক একক আর তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ হচ্ছে তার আরেকটি রূপ । তড়িচ্চুম্বকীয় বলের পরিবাহক হচ্ছে ফোটন কণা ।
আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বড় ও ক্ষুদ্র বস্তুর মধ্যে ফোটনের প্রভাব দেখতে পাই । ফোটনের কোন ভর নেই তাই এটা অনেক দূর পর্যন্ত (অসীম) মিথস্ক্রিয়া করে । আমি আগেই বলেছি যে ফোটন , কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্ম প্রদর্শন করে যাকে Duality বলে । ফোটনের আধুনিক ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন । ফোটন সম্পর্কে আপাতত এতটুকুই জানি ।
এখন ফোটন দ্বারা সৃষ্ট বল ও তত্ত্ব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক ।
৪টি মৌলিক বলের মধ্যে ফোটন দ্বারা সৃষ্ট হয় তড়িচ্চুম্বকীয় বল যা আমি আগেই বলেছি । আর এই তড়িচ্চুম্বকীয় বলকে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা (Quantum Mechanics) দিয়ে সবচেয়ে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায় । কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার যে তত্ত্ব দিয়ে ফোটনের গতিবিধি বা এর দ্বারা সৃষ্ট তড়িচ্চুম্বকীয় বল ব্যাখ্যা করা হয় তার নাম হচ্ছে কোয়ান্টাম তড়িৎগতিবিদ্যা বা Quantum Electrodynamics (QED) । মৌলিক যে ৪টি বল আছে তার মধ্যে সর্ব প্রথম যে বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব হয় সেটা হচ্ছে তড়িচ্চুম্বকীয় বলের ।
এই তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আমাদের তড়িচ্চুম্বকীয় বল সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা উচিত । এই বল অনেক দূর বা অসীম পর্যন্ত কাজ করতে পারে (কারণ ফোটনের ভর নেই বলে ) কিন্তু এই বল কাজ করে শুধু মাত্র চার্জধারী কণার উপর । এই বলের ইলেকট্রন এবং কোয়ার্কের মতো বৈদ্যুতিক চার্জ বিশিষ্ট কণার সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়া হয় তবে চার্জ বিহীন কণার সঙ্গে কখনো ক্রিয়া হয় না । তড়িচ্চুম্বকীয় বল মহাকর্ষ বল হতে ১০২৪ গুন বেশি শক্তিশালী তাহলে প্রশ্ন আসবে আমরা এই বলের অস্তিত্ব অনুভব করি না কেন ? আমরা স্কুলের মাধ্যমিক স্তর হতেই জানি যে একই রকম চার্জ পরষ্পরকে বিকর্ষণ করে অপর দিকে বিপরীত ধর্মী চার্জ পরষ্পরকে আকর্ষণ করে । ফলে বৃহৎ বস্তুর ধ্বনাত্বক চার্জ (প্রোটন) এবং ঋণাত্বক চার্জের (ইলেকট্রনের) প্রভাব পরষ্পরকে নিঃশেষ করে ফেলে তাই আমরা এই বলের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারিনা তবে অণু-পরমাণু স্তরে এ বলের প্রভাব পরিলক্ষীত হয় ।
কোয়ান্টাম তড়িৎগতিবিদ্যা বা Quantum Electrodynamics (QED):
তড়িচ্চুম্বকীয় বলের পদার্থবিদ্যাগত তত্ত্ব হচ্ছে Electrodynamics যা ১০০শত বছর পূর্বে Maxwell ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন । আর একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে Maxwell এর তত্ত্বটি আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল । Maxwell এর এই তত্ত্ব কে আবেলীয় ক্ষেত্রতত্ত্ব বলে । এই ধরনের ( আবেলীয় ক্ষেত্রতত্ত্ব ) তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য এই যে , এখানে যে কোন কোয়ান্টাম সংখ্যা বা চার্জ যুক্ত কণা একটি সুদূর প্রসারী ক্ষেত্র সৃষ্টি করে এবং সেই ক্ষেত্রের শক্তি ঐ কোয়ান্টাম সংখ্যার সমানুপাতিক । Maxwell এর তত্ত্বে এই কোয়ান্টাম সংখ্যা হচ্ছে বৈদ্যুতিক চার্জ ।
১৯৪০ সালে Feynman , Tomonaga , Schwinger এর হাত ধরে কোয়ান্টাম তড়িৎগতিবিদ্যা বা Quantum Electrodynamics (QED) পূর্ণটা লাভ করে । QED কে বলা হয় কোয়ান্টাম জগতের সবচেয়ে পুরাতন , সহজ এবং সফল গতিবিদ্যা বিষায়ক তত্ত্ব । QED তত্ত্বটি পরবর্তীতে অন্যসব কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের জন্য এই রূপায়ণ একটা মডেল হিসাবে কাজ করেছে । আমি ফোটন কিভাবে উৎপন্ন হয় তা একটা সহজ উদাহরণ দিয়েছিলাম এইবার কোয়ান্টাম জগতের পরিপেক্ষিতে আরেকটি উদাহরণ দেই । কোনো পদার্থ কণা যেমন ইলেকট্রন একটা ফোটন বা বলকণা নিক্ষেপ করে, এবং এর ফলে পিছনের দিকে একটা ধাক্কা খায় ।
এই বলকণা পরে দ্বিতীয় কোনো পদার্থকণার সাথে ধাক্কা খেয়ে একীভূত হয়ে যায়, ফলে এই দ্বিতীয় কণাটির গতিপথও বদলে যায় । আসলে QED তত্ত্বে চার্জযুক্ত কণাদের সকল পারস্পারিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই ফোটনের আদান প্রদান হিসাবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে । নিচে চিত্রের সাহায্যে তড়িচ্চুম্বকীয় বলের প্রাথমিক পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হল -
চিত্র-৪ : ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়া
উপরের চিত্র হতে আমরা দেখতে পাই , একটি ইলেকট্রন অগ্রসর হচ্ছিলো এবং পরে একটি ফোটন বিনিময় করে আবার নিজ পথে চলে যেতে থাকে । চিত্রে সরল রেখাগুলো ইলেকট্রন (যে কোন চার্জযুক্ত কণা হতে পারে ) এবং বক্ররেখাটা ফোটন নির্দেশ করছে আর যেসব অংশে দাগগুলো এসে মিলেছে সেসব অংশে একটি ফোটন নির্গত বা গৃহীত হয়েছে বোঝায় । সময়ের প্রবাহ প্রকাশ করা হয় নিচ থেকে উপরের দিকে ।
যুক্তির খাতিরে কণাটিকে আমি ইলেকট্রন ধরেছি ; এটা কোয়ার্ক অথবা নিউট্রিনো বাদে (কারণ নিউট্রিনো হচ্ছে চার্জবিহীন কণা তাই এরা তড়িচ্চুম্বকীয় বল দ্বারা প্রভাবিত হবে না ) যে কোন লেপ্টন হতে পারে । এইবার আরেকটু জটিল পদ্ধতিতে চিন্তা করা যাক ।
চিত্র-৫ : দুইটি ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়া
উপরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে দুইটি ইলেকট্রন একে অপরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, একসময় তারা একটি ফোটন বিনিময় করে এবং এর পরে আবার নিজ পথে চলে যেতে থাকে (আমাদের এটা বলার দরকার নাই যে কোনটি ইলেকট্রন নির্গত করছে আর কোনটি ইলেকট্রন শোষণ করছে ; কারণ চিত্রে দুইদিক হতেই দেখান হয়েছে ) । এই চিত্রে দুইটি ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়া দেখান হয়েছে । উপরের চিত্র দুইটিকে ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম বলা হয় কারণ ফাইনম্যান শুধু QED সংশোধনই করেন নাই একটি চমৎকার সচিত্র পদ্ধতিও আবিস্কার করেছিলেন আর তাই তাঁর নামানুসারে এই চিত্র গুলোকে ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম বলা হয় ।
তাঁর এই ডায়াগ্রাম এখন শুধু QED তেই নয় বরং সকল ধরনের কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বে ব্যবহার করা হয় । ক্লাসিক্যাল পদার্থ বিজ্ঞানের তত্ত্ব মতে দুইটি ইলেকট্রনের এই মিথস্ক্রিয়া কে আমরা চার্জের মত কুলম্বের বিকর্ষণ বলতে পারি । QED তে এই পদ্ধতিকে Mόller Scattering বলে । আমরা বলতে পারি “ফোটন আদান-প্রদানের মাধ্যমে” এই মিথস্ক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় । এমনভাবে যখন ইলেকট্রন ও প্রতিইলেকট্রনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া হয় তখন একে Bhabha Scattering বলে ।
চিত্র-৬ : Bhabha Scattering
উপরের তিনটি ডায়াগ্রামের মত অসীম সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন ডায়াগ্রাম সম্ভব এবং এই অসীম সংখ্যক ডায়াগ্রামগুলোকে গাণিতিক ভাবে হিসাবে আনতে হয় । ডায়াগ্রামগুলো কিন্তু নিজের ইচ্ছা মত আঁকা হয়না এসব ডায়াগ্রাম গঠিত হয় নির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়ম মেনে, যার ফলে একটা ডায়াগ্রাম দেখে বিজ্ঞানীরা তার প্রকাশকারী গাণিতিক সূত্র সম্পর্কে ধারণা করতে পারে । ধরা যাক একটা ইলেকট্রনের আদি ভরবেগ আমরা জানি , তাহলে বিক্ষেপনের পরে এই ইলেকট্রন কত শেষ ভরবেগ নিয়ে ছুটে যাবে সেটা আমরা হিসাব করতে পারবো প্রতিটা ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের সূত্র থেকে পাওয়া মানসমূহ যোগ করে । যেহেতু ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম হয় অসীম সংখ্যক তাই হিসাব টা একটু জটিল হয় । ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম যদিও QED তত্ত্বে অনেক জটিলতা দূর করেছে তবে এই ডায়াগ্রামের যাহায্যে QED তত্ত্বের একটা খুবই গূরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা দূর হয় না ।
আর এই প্রতিবন্ধকতাটি হচ্ছে আমরা যখন অসীম সংখ্যক ডায়াগ্রাম থেকে প্রাপ্ত ফলাফলসমূহ যোগ করবো তখন আমরা একটা অসীম ফলাফল পাবো । যেমন আমরা যদি ইলেকট্রনের ভর এবং আধান ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম হতে বের করার চেষ্টা করি তাহলে দেখব এই মান দুটি হচ্ছে অসীম । কিন্তু আমরা জানি যে ইলেক্ট্রনের ভর ও আধান সসীম । এই অসীম মান দূর করার জন্য পদার্থবিদরা একটা পদ্ধতি বের করেন এর নাম হচ্ছে পুনঃসাধারণীকরণ (Renormalization) । এই পুনঃসাধারণীকরণ প্রক্রিয়ায় ঋণাত্বক অসীম মানগুলোকে এমন ভাবে বিয়োগ করা হয় যেন তত্ত্ব থেকে প্রাপ্ত ঋণাত্বক ও ধনাত্বক অসীম মানসমূহ পরস্পরকে কাটাকাটি করে এবং সর্বশেষে একটি সসীম মান অবশিষ্ট থাকে ।
আর অবশিষ্ট এই সসীম মানই হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষীত ইলেকট্রনের ভর ও আধানের মান । গাণিতিকভাবে যদি আমরা এই পুনঃসাধারণীকরণ প্রক্রিয়াটি দেখি তাহলে কিছুটা অসস্তিতে পরতে হয় কারণ ইলেকট্রনের ভর ও আধানের যেকোনো সসীম মানই এ প্রক্রিয়ায় পাওয়া যম্ভব তবে একটা সুবিধা হল ঋণাত্বক অসীম মানগুলো এমন ভাবে নেওয়া যায় যাতে করে ইলেকট্রনের ভর ও আধান ঠিক মত পাওয়া যায় । হয়তো ইলেক্ট্রনের ভর ও আধান পুরোপুরি সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব না ।
তাহলে প্রশ্ন আসে কেন আমরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করি ? কারণ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে যদি আমরা একবার ইলেক্ট্রনের ভর ও আধান নির্ণয় করতে পারি তাহলে QED প্রয়োগ করে ইলেক্ট্রনের ভর ও আধান সম্পর্কে অনেক রকম ভবিষ্যৎবাণী করতে পারি যারা সবই পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে যায়।
আজ এই পর্যন্ত পরের পর্বে অন্য আরেকটি বোসন কণা ও এর দ্বারা সৃষ্ট বল সম্পর্কে আলোচনা করবো ।
চলবে......
সূত্র:
১. উইকি
২. A Briefer History of Time by Stephen Hawking
৩. The Grand Design by Stephen Hawking & Leonard Mlodinow
৪. Lectures on Quantum Field Theory ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।