সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ ব্লগিং হজমের জন্য ক্ষতিকর। ছোটবেলায় মা গাইতো, “আয় তবে সহচরী, হাতে হাত ধরি ধরি, নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান...। ” চুপচাপ গিয়ে হারমোনিয়ামের সামনে গালে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে শুনতাম সে গান। অবশ্য একদম যে চুপচাপ থাকতাম তাও ঠিক না। অনেক সময় আমার লক্ষ্য থাকতো কিভাবে হারমোনিয়ামের সামনে বাতাস যাওয়ার পথটাতে আঙুল প্রবেশ করিয়ে খেলা করা যায় সেদিকে!!
সময় গড়িয়েছে অনেক, আজো রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি, কখনো গালে হাত রেখে কখনোবা শুয়ে শুয়ে, ছোটবেলায় যেমনটি লাগতো আজো তেমনই লাগে।
একটুও পরিবর্তন হয়নি সেই স্বাদ!! আর হবেই বা কেমনে এ যে রবীন্দ্রসৃষ্টি। সত্যিই বাঙালি হিসেবে আমরা অনেক অনেক ভাগ্যবান যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি।
সাহিত্যের অনেক অংশে তাঁর গুরুসম পদচারণা থাকলেও তিনি সর্বদা পূজিত হন তাঁর অসাধারণ সঙ্গীত সৃষ্টির জন্য। বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাঁর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গানদুটি যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত।
তবে হাজারো সঙ্গীতকর্ম সৃষ্টি করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আশ্রিত হয়েছিলেন অন্যগানের দ্বারে। মূল গানের সুর অপরিবর্তিত রেখে নতুন লিপি সংযোজনে, নতুন ধাঁচে তিনি গানটিকে দিয়েছিলেন নতুন একমাত্রা। আর রবীন্দ্রনাথের এমন সব গান নিয়ে “The Tagore Treasury রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং ভাঙা গান” নামে অন্যধরনের একটি অ্যালবাম তৈরি করেছেন তরুণ শিল্পী স্বপ্নীল সজীব।
সত্যিই অসাধারণ কন্ঠের পাশাপাশি, সৃষ্টিশীল চিন্তার মাধ্যমে তিনি অ্যালবামটিকে দিয়েছেন ব্যতিক্রমী এক ধারা। আর আজকে আমরা আলোচনা করবো সেই অ্যালবামে প্রকাশিত গানগুলো নিয়ে।
উল্লেখ্য; অ্যালবামটি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণের আরো একটি বড় কারণ হল, বাংলাদেশে এই ভাঙা গান নিয়ে এটিই বোধহয় এখনো পর্যন্ত প্রথম এবং একটি সম্পূর্ণ কাজ!!
----------------------------------------------------------
** যদি জিজ্ঞেস করা হয় রবীন্দ্রনাথের কোন গানটি সর্বাধিক শ্রুত হয়েছে আমাকে দিয়ে। তবে নির্দ্বিধায় যে গানটি আমার ঠোঁটে চলে আসবে তা হল -
ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা,
একা একা দিন যে আমার কাটে না রে। ।
তবে মজার ব্যাপার হল রবীন্দ্রনাথ গানটির সুর নিয়েছেন “দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ” নামক একটি লোকগীতি থেকে। যদিও “The Tagore Treasury রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং ভাঙা গান” অ্যালবামটিতে গান দুইটি একসাথেই গাওয়া আছে তবুও লোকগীতিটির দুটি লাইন নিচে দেওয়া হল -
তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলে আর পেলাম না
দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সুনা।
অ্যালবামে গান দুটি এক সাথে গাওয়া, সুর মিলিয়ে নিনঃ ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি
----------------------------------------------------------
** ভাবগাম্ভীর্য ও ভক্তিরসে পুষ্ট একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের নামোল্লেখ করতে বলা হলে যে গানটি প্রথমেই মাথায় উঁকি দেয়, তা হল -
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর। ।
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগন মাঝে,
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে। ।
আর এই গানটির সুর নেওয়া হয়েছে স্বয়ং ঋগবেদের “সং গচ্ছধ্বং” শ্লোক হতে -
সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাং
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাং
অ্যালবামে গান দুটি এক সাথে গাওয়া, সুর মিলিয়ে নিনঃ আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে
----------------------------------------------------------
** আরেকটি অতিপ্রিয় ও সুন্দর ভাষ্যের গান এটি -
বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে।
সব গগন উদ্বেলিয়া—মগন করি অতীত অনাগত
আলোকে-উজ্জ্বল জীবনে-চঞ্চল একি আনন্দ-তরঙ্গ।
আর রবি ঠাকুর এই গানটির সুর নিয়েছেন হরিদাস স্বামীর একটি হিন্দি গান হতে। নিম্নে মূল গানের দুটি লাইন তুলে দেওয়া হল -
নাচত ত্রিভঙ্গ রে নন্দনন্দন বৃন্দাবন যমুনাতট
অমিত মনমথমদবিমর্দন মৃদুল অভিনব জলদ সুন্দর অঙ্গ
অ্যালবামে গান দুটি এক সাথে গাওয়া, সুর মিলিয়ে নিনঃ বিপুল তরঙ্গ রে
----------------------------------------------------------
** প্রায় সময়ই মন ভালো না থাকলে বা বন্ধুবান্ধব দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে উদাস মনে যে গানটি আপনার অজান্তে মাথায় গুনগুনিয়ে উঠে তা হল -
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। ।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে।
শুনে নিন এখান থেকেঃ যদি তোর ডাক শুনে
এবং এই চমৎকার গানটির সুর ধার করা হয়েছে “হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে” নামক অন্য আরেকটি লোকগীতি হতে -
হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই। ।
আমার একলা নিতাই, একলা নিতাই, একলা নিতাই, একলা নিতাই।
এবার পূর্বের গানের সাথে সুর মিলিয়ে নিনঃ হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে
----------------------------------------------------------
** মন ভালো রাখার একটি গান এটি। অন্যের অনুরোধ রক্ষার্থে যদি কোন গান গাইতে বলা হয় তবে আমি সোজাসাপ্টা গেয়ে উঠবো -
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়,
তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়।
শিরোনামহীনের করা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অ্যালবামটিতে এই গানটি শুরুর সাথে সাথে জাপানী কন্ঠে চিঁ চিঁ করে যে অদ্ভুত সুরের গানটি গাওয়া হয়, এতদিন জানতাম না যে আসলে সেটি একটি স্কটিশ ফোক গান “Ye banks and braes”!! তবে স্বপ্নীল সজীব অ্যালবামটিতে দুটি গানই একসাথে গেয়ে সুরের মিলটা ধরিয়ে দিয়েছেন নিপুণভাবে -
Ye banks and braes o’ bonnie Doon
How can ye bloom sae fresh and fair?
How can ye chaunt, ye little birds,
And I sae weary, fu’ o’ care.
অ্যালবামে গান দুটি এক সাথে গাওয়া, সুর মিলিয়ে নিনঃ ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে
----------------------------------------------------------
** রবি ঠাকুরের এই গানটি শুনেছেন কিনা জানি না। তবে আমার কাছে কিছু পুরনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালেকশান আছে বিধায় এটি শুনেছিলাম বারকয়েক -
একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে,
আনন্দ বসন্ত সমাগমে।
বিকশিত প্রীতিকুসুম হে
পুলকিত চিতকাননে।
শুনে নিন এখান থেকেঃ একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ
আর এই সুন্দর গানটির সুরের সাথে সন্তু ত্যাগ রাজার তেলেগু ভাষায় গাওয়া “লাবাণ্য রামা কানু” গানটির সুরের অদ্ভুত মিল ধরিয়ে দিয়েছেন শিল্পী স্বপ্নীল সজীব -
লাবাণ্য রামা কানু লাড়া জুডাবে
অতি লাবাণ্য রামা কানু লাড়া জুডাবে।
শ্রীবান্নিতা চিত্তা কুমুদা
সীতা কারা সাতানানাজা।
এবার পূর্বের গানের সাথে সুর মিলিয়ে নিনঃ লাবাণ্য রামা কানু
----------------------------------------------------------
** এতক্ষণ তো কেবল অন্য সুরের মায়ায় ফুটে উঠা অসাধারণ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনা হল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, অ্যালবামটিতে উপরের গানগুলোর পাশাপাশি রয়েছে এই চমৎকার গানটিও। তবে এই গানটির কথা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ লিখেননি! গানটির কথা লিখেছেন গোবিন্দদাস ও এতে সুরারোপ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গানটির কয়েকটি লাইন -
সুন্দরি রাধে আওয়ে বনি
ব্রজরমণীগণ মুকুটমণি। ।
কুঞ্চিতকেশিনী নিরুপমবেশিনী
রস আবেশিনী ভঙ্গিনী রে।
অধরসুরঙ্গিণী অঙ্গতরঙ্গিণী
সঙ্গিনী নব নব রঙ্গিনী রে।
শুনে নিন এই গানটিঃ সুন্দরি রাধে আওয়ে বনি
----------------------------------------------------------
পরিশেষে এই কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা সাহিত্যে যত কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক এসেছেন, তাদের সকলকে সাধারণভাবে মাপার মাপকাঠি হিসেবে আমরা সর্বদা যে প্রবাদপুরুষটিকে ব্যবহার করি তিনি হলেন আর কেউ নন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। আজ ২২শে শ্রাবণ, কবিগুরুর মৃত্যুবার্ষিকী।
বিশ্বকবির কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন।
এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
আজ কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা রইলো। রবীন্দ্রসাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথও অমর থাকুক বাঙালির চিন্তাচেতনায়।
** পড়ে নিতে পারেন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে রম্যরচনা - “ওহে রবি ঠাকুর, তুমি কেন এত মধুর!!!” – একটি গবেষণাধর্মী রচনা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।