আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিষচক্র ২ মাসুদ রানা

৪২ মনোযোগ দিয়ে শুনছে রানা, গড়গড় করে নিজের কথা বলে যাচ্ছে মিলি। রানার চোখ ডিভান হোটেলের ছাদে। অ্যানেক্স বিল্ডিং আর হোটেলের জানালাগুলোর কাঁচ সূর্যের আলোয় সোনালী দেখাচ্ছে। ওখানে ছাল্ডে সুইমিং পুলে উঁচু বোর্ড থেকে ডাইভ দিচ্ছে অনেকে। বাচ্চারা খেলায় ব্যস্ত।

ট্র্যামপোলিনে লাফাচ্ছে। বিদ্যুৎ-চমকের মতো চিন্তাটা খেলে গেল রানার মাথায়। ডাইভিং বোর্ড! ট্র্যামপোলিন! কাজ হতে পারে! হয়তো কাজ হবে! ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এখন সম্ভব বলেই মনে হচ্ছে! ‘রানা?’ ডাকল মিলি। ‘কোথায় হারালে?’ ঘুরে তাকাল রানা, মিলির চোখে চোখ রাখল। ‘আজ রাতে আমি কাজে বের হবো।

’ হাত ধরাধরি করে লিভিং রুমে ফিরে এলো রানা আর মিলি। মিলি যেন কী বলতে চায়, মুখ ফুটে বলতে পারছে না। লাঞ্চ আনিয়ে সুইটেই খাওয়া সারল ওরা। বয়কে দিয়ে পেপার আনাল রানা। প্রত্যেকটা পেপারে এসেছে চিকা মোস্তাকের মৃত্যুসংবাদ, তবে একটাতে আছে অটোপসি রিপোর্ট।

তাতে বলা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে কোকেনে আসক্ত ছিল সে। ওর সন্দেহই সঠিক জেনে মনটা আরও বিষণœ হয়ে গেল রানার। দুপুরের পর শুলো রানা। কিছুক্ষণ পর ওর মাথার পাশে এসে বসল মিলি, চুলে বিলি কেটে দিতে শুরু করল। টুকটাক কথা হলো ওল্ডে মাঝে, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল রানা।

বিকেলে কপালে নরম ঠোঁটের স্পর্শে চোখ মেলল রানা। তখনও মিলি ওর মাথার পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ‘ব্যাপারটা কী হলো, মিলি?’ ‘আমি আমার ভূমিকা পালন করছি মাত্র,’ মুচকি হেসে বলল মিলি। ‘সেটা তো করবে লোকের সামনে। ’ ‘তুমি না বললে, ঘরে-বাইরে সব সময় নিজের ভূমিকা পালন করতে হবে, তবেই সার্থক অভিনেত্রী হতে পারব!’ চোখে চোখে কথা হলো দুজনের।

হাসল রানা, আর কিছু বলল না। আগুনে পুড়তে চায় যে মেয়ে, তাকে বুঝিয়ে কী লাভ? সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য হোটেল থেকে বের হলো রানা। এক দোকান থেকে দড়ি আর অন্য দোকান থেকে হুক কিনে ফিরল। সুইটে ঢুকেই শুনল নাচের বাজনা বাজছে। নীল জামা পরা মিলি পরীর মতো নাচছে বাজনার সঙ্গে।

রানাকে দেখে ওর মুখটা আরক্ত হলো। নাচতে নাচতেই রানার সামনে এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরল ওকে। ভূমিকা পালন করছে। ভেজা ভেজা ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হলো। পায়ের পাতার সামনের অংশে ভর দিয়ে আলতো করে রানার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল মিলি।

অল্প অল্প কাঁপছে ওর দেহ। রক্তে কীসের এক অজানা শিহরন অনুভব করল রানা। ওর নিষ্ঠুর ঠোঁট চেপে বসল মিলির কোমল অধরে। নীরব সমঝোতায় অন্ধকার বেডরুমের দিকে চলল ওরা একটু একটু করে। ‘পরে পস্তাবে না তো, মিলি?’ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল রানা।

‘কেন? আমি তো তোমার কথামত অভিনয় করছি,’ দুষ্টামি হাসি মিলির ঠোঁটে। ‘প্রেমিকার আচরণ করতে হবে না?’ ‘না করলেও চলে কিন্তু। ’ খাটের উপর বসল রানা। ‘তা ছাড়া ভাবছি, আমাকে যেভাবে পরীক্ষা করে দেখেছ ড্রাগ নিচ্ছি কি না, তোমাকেও আমার সেই একই ভাবে পরীক্ষা করে জেনে নেয়া ল্ডকার তুমিও নিচ্ছ কি না। ’ একটা পেন্সিল টর্চ রানার দিকে তাক করে, শান্ত গলায় বলল মিলি, ‘ভয় পেয়ো না, আমি ৪৩ তোমার কোনও ক্ষতি করব না।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাজটা করতে হচ্ছে। তোমার পোশাক খুলে ফেলো। ’ ‘কীহ্!’ ‘একবারই মাত্র ব্যাখ্যা করব আমি, রানা,’ বলল মিলি। ‘তারপর যদি তুমি কথা না শোনো তা হলে জোর করে তোমার কাপড় খুলতে হবে আমাকে! নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, তোমার কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে পারি না আমি? এবার পোশাক খুলে ফেলো। আমি দেখতে চাই তোমার শরীরে সিরিঞ্জের নতুন কোনও দাগ আছে কি না।

ভেবো না আনন্দ পাবার জন্য কাজটা করছি আমি, করতে হচ্ছে এটা আমার দায়িত্ব বলে। ’ ‘ইয়োক!’ বলল রানা। ‘করতেই হবে, রানা, দেরি কোরো না। আমি তা হলে বাধ্য হবো কাজটা নিজ হাতে করতে। ’ ‘ঠিক আছে, লজ্জা-শরম বলে কিছু যদি না থাকে, তা হলে নিজ হাতেই করো।

আমি পারব না। ’ রানার কাপড় আর প্যাডিং খুলে ফেলল মিলি দক্ষ হাতে। ‘গুড!’ এক পা পিছিয়ে টর্চের আলো রানার দেহে ফেলল মিলি। আপাদমস্তক পরীক্ষার ভান করছে। ভ্রƒ কুঁচকে রেখেছে রানা।

‘সারাজীবন এজন্যে তোমাকে ঘৃণা করব আমি, মিলি,’ হিসহিস করে বলল ও। ‘সারাজীবন! যজ্ঝিনেক বছর বাঁচি তো অনেক বছর ধরে তোমাকে আমি...’ ‘চুপ!’ ধমক দিল মিলি। দু’চোখ ভরা ঘৃণা নিয়ে মিলিকে দেখল রানা। ‘নোংরা মনের মেয়েমানুষ তুমি, মিলি গঞ্জালেস! তুমি ছেলেল্ডে উলঙ্গ দেখে বিকৃত আনন্দ পাও। ’ জবাব না দিয়ে ব্যস্ত হাতে এবার নিজের ব−াউজের বোতাম খুলল মিলি, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব−াউজটা খুলে ফেলল।

ধীর পায়ে এগিয়ে এলো রানার দিকে। ‘ইয়োক!’ রানা আপত্তি জানাল। কিন্তু কথা শুনল না মেয়েটা। দু’হাত পিঠের পিছনে নিয়ে ব্রেসিয়ারের হুক খুলল ও, তারপর ওটা খুলে মাটিতে ফেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রানার বুকে। গ্রীষ্মের প্রখর খরতাপ শেষে এক সময় নামল বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, কেঁপে কেঁপে উঠল মিলি, তারপর রানার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল বেখবর।

ওর ঠোঁট ছুঁয়ে থাকল অদ্ভুত মিষ্টি, সরল একটা পরিতৃপ্তির হাসি। পাশে শুয়ে দ্বিধায় ভুগছে রানা। বুঝতে পারছে না কাজটা ঠিক হলো কি না। মিলিকে ফিরিয়ে ত্থেয়াই কি ওর উচিত ছিল? মিলির ঘুম যাতে না ভাঙে তাই সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠল ও, গোসল সেরে তৈরি হতে শুরু করল। রাতের খাবারটা সুইটে আনিয়ে ডেকে তুলবে মিলিকে, খাওয়া সেরেই বেরিয়ে পড়তে হবে কাজে।

সাত আধখানা ঘোলাটে চাঁল্ডে আলোয় ডিভান হোটেলের ছাদে নানা আকৃতির ছায়া সৃষ্টি হয়েছে। অর্ধেক তৈরি একটা ঘরের ছায়াটাই ৪৪ সবচেয়ে বড়। এছাড়াও রয়েছে ওয়াটার টাওয়ার, এলিভেটর মেশিনারি হাউসিং আর বাচ্চাল্ডে খেলবার নানান সরঞ্জামের ছায়া। আরেকটা ছায়া অন্যান্যগুলোর মতোই নিথর হয়ে আছে। দীর্ঘ সুঠাম দেহটা যেন পাথরে তৈরি।

আধঘণ্টা হলো ঠায় স্ফাড়িয়ে আছে সে, একদৃষ্টিতে লক্ষ করছে ডিবার্গ অ্যান্ড কোম্পানির আলোকিত সোনালী জানালাগুলো। এখন মাত্র তিনটে জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে। ওগুলো বোধহয় ডিবার্গের প্রাইভেট সুইটের জানালা, আন্দাজ করল লক্ষকারী। এরইমধ্যে সে দেখেছে একজন সশস্ত্র গার্ড বন্ধ অফিসের সামনে দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর ঘুরে যাচ্ছে। কাজে কোনও ত্র“টি নেই তার, তবে নির্দিষ্ট একটা ল্ডজা সে খুলছে না।

ওটার ওপাশেই সম্ভবত আছে ডিবার্গ ম্যাকেঞ্জি নামের অসুস্থ এক বুড়ো মাকড়সা, বিছানায় শুয়ে শুয়ে বুনে চলেছে তার নোংরা জাল। আজ রাতে তার জাল বোনায় বাধা আসবে। শেষ পর্যন্ত ছায়া থেকে চাঁল্ডে আবছা আলোয় বেরিয়ে এলো রানা। চিতার মতো নিঃশব্দে হালকা পায়ে হাঁটছে ও, কালো ট্রাউজার্স, কালো সোয়েট শার্ট আর কালো জুতো-মোজা পরেছে। ছাল্ডে কিনারায় এসে স্ফাড়াল ও, অ্যানেক্স বিল্ডিঙের দিকে চেয়ে আছে।

আরেকবার ভ্রƒ কুঁচকে আর্কিটেক্টের কথা ভাবল। মাঝখানের দূরত্বটা পার হওয়া অসম্ভব নয়। কাছ থেকে দেখে এখন মনে হচ্ছে বারো ফুটের বেশি হবে না। পেন্টহাউস তৈরির কাজে বল্টহৃত একটা তক্তা মাঝখানে রেখে পার হওয়া যেত, কিন্তু বাধ সেধেছে উচ্চতা। অ্যানেক্সটা অন্তত দশফুট উঁচু।

সমস্যা সেখানেই। দুই বিল্ডিঙের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে নীচে তাকাল রানা। দশতলা নীচে নিরেট কংক্রিটের মেঝে। যদি পড়ে যায় তা হলে নিশ্চিত মৃত্যু। কাজ শুরু করল ও।

রাবার মোড়া হুক সহ দড়ি ছুঁড়ল অ্যানেক্সের কোপিঙের দিকে। প্রথম চেষ্টায় অসফল হলো। পরপর আরও কয়েকবার চেষ্টা করল ও। কোপিংটা পিছলা আর ঢালু, হুক আটকাচ্ছে না, হড়কে যাচ্ছে। একটু পরেই ও বুঝে গেল এভাবে হবে না।

বাধ্য হয়ে একটা তক্তা বেছে নিয়ে ফিরে এলো কিনারায়। নামিয়ে রাখল তক্তা। দুটো বাড়ির ছাদ সমান হলে নাচতে নাচতে ওটার উপর দিয়ে পার হয়ে যেতে পারত ও। গভীর শ্বাস পড়ল ওর। এই পেশায় ঝুঁকির কোনও শেষ নেই।

এবার অর্ধসমাপ্ত পেন্টহাউসের ওপাশ থেকে সিমেন্টের ব্যাগ আনল ও একেকবারে দুটো করে। প্রতিটার ওজন একশো পাউন্ড। হাত টনটন করে উঠল ওর। রাতটা শীতল, কিন্তু কায়িক পরিশ্রমে ঘামতে শুরু করল ও। তক্তার প্রান্তে সিমেন্টের ব্যাগগুলো নামাল ও, তারপর তক্তাটা ঠেলে দিল বাইরের দিকে।

আরও সিমেন্টের ব্যাগ এনে রাখল। পাঁচ মিনিট পর ওর পছন্দ মতো ওজন রাখা হলো তক্তার উপর। মোট ছয়টা ব্যাগ। তৈরি হয়ে গেল ওর ডাইভিং বোর্ড। তবে নীচের বদলে উপরে ডাইভ দেবে ও।

আরেকবার নীচে তাকিয়ে মনে মনে নিজেকে সাবধান করল, যদি পড়ো তো মরলে! কাজ সেরে আবার ছায়ায় ফিরে গেল ও, অপেক্ষার ফাঁকে মনোযোগ দিল অফিসটার দিকে। ওকে কেউ দেখে ফেলে থাকলে তৎপরতা শুরু হয়ে যাবে। অস্ত্র পরীক্ষা করল রানা। বেল্টে গোঁজা আছে ওয়ালথার। বাহুর খাপে স্টিলেটো তৈরি।

সঙ্গে করে সায়ানাইড গ্যাস বোমাটাও নিয়ে এসেছে। ডিবার্গের মুখ খোলাতে এসবের মধ্যে স্টিলেটো কাজে লাগানোর ইচ্ছে আছে ওর। অবশ্য সঙ্গে ট্রুথ সিরামও রেখেছে ও। কিন্তু লোকটার হার্টের যা অবস্থা তাতে ট্রুথ সিরাম দিলে মারাও যেতে পারে। সিগনেট আংটির ৪৫ ড্রাগটা কাজে লাগিয়ে হয়তো লোকটাকে গুহা থেকে বের করা সম্ভব।

সবকিছু ঠিক আছে বলেই মনে হচ্ছে ওর। মন থেকে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তক্তার কাছে চলে এলো রানা। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, একবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দ্বিধায় ভুগলে বিপল্ডে সম্ভাবনা বাড়ে। তার চেয়ে সবরকম সতর্কতা শেষে সম্পূর্ণ মনোযোগ একত্রিত করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া ভালো। তক্তার বাইরের শেষ প্রান্তে এসে স্ফাড়াল রানা।

বুঝতে পারছে ও যদি পড়ে যায় তা হলে মেঝে থেকে কোদাল দিয়ে ওকে চেঁছে তুলবে পুলিশের লোক। পিঠের কাছটা শিরশির করে উঠল ওর। বার কয়েক হালকা লাফ দিল ও তক্তার উপর। ¯িপ্রঙের মতো লাফাল তক্তাটা ওর নীচে। মনে হলো ওটা যেন জীবন্ত।

উপর দিকে তাকাল রানা। দশফুট উঁচুতে পৌঁছুতে হবে ওকে। পার হতে হবে প্রায় ছয় ফুট। একবারই সুযোগ পাবে ও। সফল হলে ভালো, নইলে গুড বাই এভরিবডি! এখন! লাফিয়ে উঠে তক্তার উপর নামল রানা, পা দুটো শক্ত করে রেখেছে।

নিজের পুরো দক্ষতা কাজে লাগিয়ে শূন্যে শরীরটাকে ভাসিয়ে দিল ও। দু’হাত মাথার উপর তুলে রেখেছে। চাঁল্ডে ফ্যাকাসে আলোয় কালো একটা তীরের মতো ছিটকে উঠল ও। ভুল হয়ে গেল! ওর বাড়ানো দু’হাতের আঙুল ছাল্ডে টাইলের তৈরি কোপিং স্পর্শ করল। সাঁড়াশির মতো আঙুল দিয়ে টাইল আঁকড়ে ধরতে চাইল রানা, পারল না।

পিছলে যাচ্ছে আঙুলগুলো! অন্তত একটা হাতও কোপিঙের ওপাশে নিতে পারলে উঠে যাওয়া সম্ভব ছিল। শূন্যে ঝুলছে রানা, ক্রমেই পিছলে যাচ্ছে ওর আঙুল। কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগে এক তুর্কি রাজমিস্ত্রী কাজে অবহেলা করেছিল, ফাটা একটা টাইল লাগায় সে, চারপাশের ফাঁকগুলোতে সিমেন্টের আস্তরও দেয়নি। শুধু সে-কারণেই বেঁচে গেল রানা। ওর ডান হাতের আঙুলগুলো ফাটা টাইলের ফাঁকে আটকে গেল।

রানার স্টিলের মতো শক্ত আঙুলগুলো ধরবার জায়গা পেয়ে গেছে। ঝুলে থাকল রানা। জীবন-মৃতুশু মাঝে তফাৎ এনে দিচ্ছে শুধু ওর চারটা আঙুল। নীচে অপেক্ষা করছে শক্ত সিমেন্টের মেঝে। বামহাতটা কোপিঙের উপর দিয়ে ওপাশে নিয়ে গেল রানা, বাম হাতের জোরে শরীরটাকে কোপিঙের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ছাদে তুলে ফেলল।

সামান্য সরে দুই বিল্ডিঙের মাঝখানের ফাঁকটা দিয়ে তাকাল ও, পড়ে যাওয়ার চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে পরবর্তী কাজে মন দিল। একটা চিমনির আড়ালে সরে এসে অপেক্ষা করল। অ্যালার্ম বেজে উঠবে ওকে কেউ দেখে থাকলে। পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল, অ্যালার্ম বাজল না। আবার ছাল্ডে কিনারায় চলে এলো রানা, ডিভান হোটেলের নিচু ছাদ্মা দেখল।

উপর থেকে লাফ দিয়ে পুরু তক্তায় পড়ে মাঝখানের দূরত্ব পেরিয়ে ওই ছাদে পৌঁছে যাওয়া কঠিন হবে না। ওর ফিরবার পথ উন্মুক্ত। আরেকবার অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখল রানা। সন্তুষ্ট হয়ে চলে এলো এলিভেটরের মেশিনারি ঘরের সামনে। যা ভেবেছিল, ল্ডজাটায় তালা ঝুলছে।

সস্তা তালা। সেলুলয়েডের টুকরো দিয়ে ওটা খুলতে তিরিশ সেকেন্ড লাগল ওর। ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আরেকটা ল্ডজার কাছে চলে এলো রানা। এটা খোলা। একটা ল্যান্ডিঙে আছে এখন ও।

পাঁচ ধাপ সিঁড়ির পরই ওপাশে একটা ফ্রস্টেড কাঁচের ল্ডজা দেখতে পেল। বিনকিউলার দিয়ে আগে যখন দেখেছে তখন লক্ষ করেছে এরপর আছে সংক্ষিপ্ত একটা করিডর। করিডরটা চলে গেছে ডিবার্গ লিমিটেডের ৪৬ অফিসগুলোয়। ওই অফিসগুলোর পর আছে ডিবার্গের প্রাইভেট সুইট। ওখানে পৌঁছুতে হলে গার্ডের একটা বল্টস্থা করতে হবে ওকে।

করিডর এবং অফিসের কোথাও আছে এখন সশস্ত্র লোকটা। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ল্যান্ডিং পার হলো রানা, সতর্ক হয়ে আছে যেন ওর ছায়া ফ্রস্টেড গ−াসে না পড়ে। ল্ডজার ফাঁকটা দিয়ে মিউজিকের আওয়াজ শুনতে পেল ও। আন্দাজ করল, একাকী বিরক্ত হয়ে মিউজিক শুনছে গার্ড। নিশ্চয়ই সঙ্গে করে একটা ট্র্যানজিস্টর রেডিও নিয়ে এসেছে।

ভালো, মনে মনে বলল রানা। ওই মিউজিক অনুসরণ করে লোকটার কাছে পৌঁছে যেতে পারবে ও। কাঁচের ল্ডজাটা সামান্য ফাঁক করল রানা। ফাঁকে চোখ রেখে দেখল করিডরের মাঝখানে একটা টেবিলের পিছনে বসে আছে গার্ড। লোকটার পিঠ ওর দিকে ফেরানো।

টিনের তৈরি একটা টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খাবার তুলে তুলে খাচ্ছে সে, সেই সঙ্গে বাজনা শুনছে। যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে রানা জানে, কেউ যদি কোনও প্রাণী বা মানুষকে আড়াল থেকে অনেকক্ষণ লক্ষ করে তা হলে সেটা সেই প্রাণী বা মানুষটা টের পেয়ে যায়। সময় নষ্ট করল না রানা, নিশ্চিত পদক্ষেপে এগোল। ও আর এক ফুট দূরে থাকতে ইন্দ্রিয় সতর্ক করল লোকটাকে, ঘাড় ফেরাল সে।

গার্ডের ঘাড়ে সজোরে এক কারাতে চপ বসাল রানা। ঘাড় ভেঙে খুন করবার জন্য মারেনি, লোকটা অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ে যেতে শুরু করতেই ধরে ফেলল। দ্রুত হাতে কাজ করছে রানা। পকেট থেকে এক রোল টেপ বের হলো ওর। গার্ডের কব্জি আর গোড়ালি বাঁধল ও টেপ দিয়ে।

মুখে রুমাল গুঁজে দিয়ে তার উপর টেপ লাগিয়ে দিল। এবার গার্ডের রিভলভারটা হোলস্টার থেকে তুলে নিল ও, গুলিগুলো বের করে পকেটে রেখে রিভলভারটা রেখে দিল আগের জায়গায়। লোকটাকে ডেস্কের পা রাখবার জায়গায় ভরে ডিবার্গের প্রাইভেট সুইটে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে এগোল ও। ল্ডজাটা চামড়া মোড়া। নবে মোচড় দিয়ে ঠেলা দিতেই খুলে গেল।

ঢুকল রানা। খাটো একটা হলওয়ে এটা। মেঝেতে পুরু কার্পেট। বেডরুমও কার্পেটে মোড়া। দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।

ভিতরে বিরাজ করছে থমথমে নীরবতা। পিছনে ল্ডজাটা লক করে দিল রানা। এখন ওরা দু’জনই শুধু আছে এই সুইটে। ইয়া মোটকা ডিবার্গ বিছানায় শুয়ে কী যেন পড়ছে। নিজের উপস্থিতি জানান দিল না রানা।

ছায়ায় স্ফাড়িয়ে ঘরটা ভালো করে দেখল ও। বাতাসে হালকা সৌরভ ভাসছে, সেই সঙ্গে ওষুধের গন্ধ। বিছানার পাশের ছোট টেবিলে পনেরো-বিশ রকমের ওষুধ দেখতে পেল ও। বেশ কয়েকটা বোতল, একটা গ−াস, চামচ আর একবাক্স বড়ি। রানার মনে পড়ল, ডিবার্গের হার্টের অবস্থা ভালো নয়।

ওটার অবস্থা আজ আরও খারাপ হতে পারে। তবে সামান্যতম করুণা বোধ করছে না রানা। ম্যাজেন্টা রঙের ঢোলা পাজামা পরেছে ডিবার্গ। খালি গা। চারটে থুতনি গোনার পর গুনতিতে ক্ষান্ত দিল রানা।

চর্বিতে ভরপুর একটা দেহ। গোটা শরীরটা ঘিরে রেখেছে চর্বির স্তর। এক মাথা রুপালী চুল ছোট করে ছাঁটা। থলথলে চেহারাতে চাতুরির ছাপ। নাকটা যেন ঠিক টিয়া পাখির বাঁকানো ঠোঁট।

তার নীচেই একজোড়া লালচে ঠোঁট। বানরের লালচে নিত¤েল্ফ কথা মনে হয়ে গেল ওটা দেখে রানার। মুখটা আকৃতি হারিয়েছে স্ফাতের অভাবে। বেডসাইড টেবিলে কাঁচের গ−াসে স্ফাতগুলো দেখতে পেল ও, পানিতে চুবিয়ে রাখা হয়েছে। ‘গুড ইভনিং!’ বেডরুমে পা রাখল রানা, চলে এলো বিছানার ৪৭ পাশে।

‘আমাল্ডে প্রথম মিটিং বলে গোপনেই দেখা করলাম। ’ বিস্ময়ে ডিবার্গের হাত থেকে বইটা পড়ে গেল। বালিশের তলায় ডানহাত ভরতে গেল সে। ভাসা ভাসা চোখে সতর্কতা নিয়ে রানাকে দেখছে লোকটা। ‘কে...কে আপনি? কী চান?’ জবাব দিল না রানা।

‘হাতটা বালিশের কাছ থেকে সরান। ’ ভ্রƒ কুঁচকে গেল ডিবার্গের। ‘গার্ড আপনাকে বাধা দেয়নি?’ ‘না। ’ ‘দেখেছেন ওকে?’ ‘দেখেছি। ’ অবাক হলো ডিবার্গ।

‘কী চান? আমি অসুস্থ মানুষ। ’ ‘আমি মাওলানা আব্দুল হামিল্ডে লোক,’ নির্বিকার চিত্তে মিথেল্টলল রানা। ‘সে জানতে চেয়েছে আপনাল্ডে পরবর্তী মিটিং কবে এবং কোথায় হবে। ’ ডিবার্গের চোখে সন্দেহের ছায়া খেলে গেল। ‘মিথ্যে কথা! মিস্টার হামিদ জানেন।

’ রানার হাতে স্টিলেটো বেরিয়ে এলো। ওটার তীক্ষè ডগা দিয়ে ডিবার্গের গলায় সামান্য খোঁচা দিল ও। এক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে। ‘কোথায়?’ ‘না!’ ডিবার্গের গলা কেঁপে গেল। বালিশের কাছ থেকে হাত সরিয়ে ফেলেছে সে।

রানা বলল, ‘আপনি কিন্তু সময় নষ্ট করছেন। মিটিং কবে এবং কোথায় হবে?’ ‘এখনও ঠিক হয়নি। মিস্টার হামিদকে জানানো হবে সেটা তিনি জানেন। ’ রানার মনে হলো সত্যি কথাই বলছে মোটকু। স্টিলেটো সরাল না ও।

‘এবারের কোকেন আর হেরোইনের চালানটা কোথা দিয়ে যাবে সেটা বলুন। ’ ‘কে আপনি? কার হয়ে কাজ করছেন?’ স্টিলেটোর খোঁচায় আরেক ফোঁটা রক্ত বের হলো ডিবার্গের গলার ফুটো দিয়ে। ‘স্ফাড়ান! কতো টাকা চাই আপনার?’ ‘তোমার নোংরা পয়সা আমার চাই না, ডিবার্গ। যা জানতে চাইছি জবাব দাও তার। আমার কাছে ট্রুথ সিরাম আছে।

জিনিসটা তোমার হার্টের জন্য ক্ষতির কারণও হতে পারে। ’ স্টিলেটো সরিয়ে নিল ও, শার্টের পকেট থেকে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ আর ছোট্ট স্বচ্ছ বোতলটা বের করে দেখাল। ‘পাঁচ মিনিট সময় নেবে কাজ করতে। ’ অনেক কসরৎ করে বিছানায় উঠে বসল ডিবার্গ। মুখটা টকটকে লাল দেখাচ্ছে।

রেগে গিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বিছানার চাল্ড খামচে ধরল। শুয়ে পড়ল কাত হয়ে। বিদঘুটে মুখটা হাঁ হলো। ‘ওহ্! আ! ওহ্গ্গ্গ্! হার্ট অ্যাটাক! মেডিসিন! আমার মেডিসিন! সবুজ বোতল!’ সবুজ বোতলটা তুলে নিল রানা। ডিজিটালিস।

ওটা বাড়িয়ে দিতেই কাঁপা হাতে নিতে চাইল ডিবার্গ, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই। এবার আমি...ঠিক হয়ে যাব। ’ বোতলটা তার হাতে দিল না রানা। ‘আগে কোকেন আর হেরোইনের চালান কোথা দিয়ে যাবে বলো, তার আগে ওষুধ পাবে না। মিথ্যে বোলো না।

বললে আমি টের পাব। এই অবস্থায় ট্রুথ সিরাম তোমাকে খুন করবে। ’ বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে দিল ডিবার্গ, দেখে মনে হলো ডাঙায় তোলা তিমি মাছ। প্রতিবার শ্বাস নিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। মুখটা আরও কুঁচকে গেছে তীব্র ব্যথায়।

বিস্ফারিত চোখ দুটো যেন ৪৮ পিংপং বল, মাটিতে পড়ে লাফিয়ে উঠবে। ‘টা-টাইম নেই! আমি মরে যাচ্ছি!’ ‘তা হলে তাড়াতাড়ি বলো, ওষুধটা দিয়ে èে। ’ প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় চাল্ড খামচাতে শুরু করল ডিবার্গ। ‘উর্ফা!’ ককিয়ে উঠল সে। ‘উর্ফা! এডেসা পাস! তিন দিন পর।

এবার ওষুধটা...ওটা...আমি মারা যাচ্ছি!’ বোতলটা বাড়িয়ে ধরল রানা। ওটা নিতে হাত বাড়াল ডিবার্গ, তারপরেই হাতটা নেতিয়ে পড়ল। পরক্ষণে দু’হাতে গলা চেপে ধরল সে। ঝটকা খেল গোটা শরীর। ঢেউ উঠল পেটে।

কাতর একটা আওয়াজ বের হলো গলা দিয়ে। মাথাটা কাত হলো। মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা স্বচ্ছ বুদ্বুদ, ঠোঁটে এসে স্থির হলো, তারপর ফাটল ওটা। রানার দিকে তাকাল লোকটা, দৃষ্টিতে কোনও অভিব্যক্তি নেই। এক মুহূর্ত পর রানা বুঝতে পারল ডিবার্গ ম্যাকেঞ্জি মারা গেছে।

সিগনেট আঙটিটা একবার দেখল রানা। ওটা কাজে লাগিয়ে ডিবার্গকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া আর হলো না। এখন কিছু করার নেই আর। পরবর্তী পনেরো মিনিট ব্যয় করল ও সুইটে জরুরি কিছু আছে কি না খুঁজতে। নেই।

থাকবে আশাও করেনি ও, রুটিন চেক করতে হয় তাই করল। এরা অত্যন্ত চতুর একটা দল। প্রমাণ হাতের কাছে রাখে না কখনও। এখানেও তাল্ডে গোপন কর্মকাণ্ডের কোনও প্রমাণ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। বাল্ডইল বাথরুমটা।

ওখানে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু খোঁজা ওর কর্তব্য। উর্ফা, মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে রানার। তিনদিন পর এডেসা পাস দিয়ে যাবে মাওলানা আব্দুল হামিল্ডে কোকেন আর হেরোইনের চালানটা। মৃত্যুপথযাত্রী ডিবার্গ বোধহয় সত্যি কথাই বলেছে।

শেষ সময়ে মিথ্যে তৈরির কথা চিন্তায় আসবার কথা নয়। মাথা খাটাবার উপায় থাকে না। ডিবার্গের কথা সত্যি হলে এখন ও জানে ওকে কোথায় যেতে হবে। টয়লেটে ঢুকেই গন্ধটা পেল রানা। এবার চিনতে দেরি হলো না।

এসটোন। নেইলপলিশ রিমুভার। লা সিনেমা বি−উতে লেডি স্টানার অফিস আর বাথরুমে ঠিক এই গন্ধই পেয়েছিল ও। হাতির মতো লাশটার দিকে তাকাল ও, বিছানায় পড়ে আছে ওটা। লোকটা হার্টের কন্ডিশন ভালো না হলেও হয়তো মেয়েল্ডে নিয়ে ফুর্তি করত।

কিন্তু তার সম্ভাবনা কম। এসটোনের গন্ধ ওকে ভাবাচ্ছে। কিছু একটা বিশেষ মানে আছে এর। ওর মন বলছে গন্ধটা ওকে যেন কিছু স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কী? মেডিসিন ক্যাবিনেট খুলল রানা।

জানে কী দেখতে পাবে। ছোট একটা বোতল। ফাস্টঅ্যাক্ট। শিকাগোতে তৈরি। লা সিনেমাতেও এরকমই একটা পেয়েছিল ও বাথরুমে।

বোতলটা পকেটে পুরল ও, বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। এখানে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। চারপাশে আরেকবার দেখে নিয়ে সুইট থেকে বেরোনোর ল্ডজার দিকে পা বাড়াল রানা। ল্ডজাটা খুলতেই সোনালী চুলওয়ালা মেরিলিন হিউলেটকে দেখতে পেল ও। ডিবার্গের প্রাইভেট সেক্রেটারি।

মেয়েটার হাতে এখন ছোট্ট একটা অটোমেটিক পিস্তল। ঠিক রানার পেটে তাক করল সে। তার পিছনে স্ফাড়িয়ে আছে ইউনিফর্ম পরা গার্ড। তার হাতে শোভা পাচ্ছে রিভলভার। চিন্তা করো, রানা! নিজেকে তাগাদা দিল রানা।

একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর শরীরে। মেয়েটাকে নিরস্ত্র করে কিছু প্রশ্ন ৪৯ করতে পারলে হতো, কিন্তু গার্ড সে সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। লোকটার পকেটে হয়তো বাড়তি গুলি ছিল। নিজেকে হাঁদারাম মনে হলো রানার। সার্চ করে দেখা ল্ডকার ছিল লোকটাকে।

লাথি দিয়ে মেয়েটার হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে সরিয়ে দিল রানা, একই সঙ্গে সামনে বেড়ে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে, নিজের সামনে ধরে থাকল তাকে। গার্ড আর ওর মাঝে মেয়েটা এখন একটা বাধা। দু’পা পিছাল গার্ড। গুলি করবার সুযোগ খুঁজছে। হিসহিস আওয়াজ বের হচ্ছে সেক্রেটারির নাক দিয়ে, নীরবে লড়ছে মেয়েটা।

রানার মুখে খামচি মারতে চেষ্টা করল। এক ঝটকায় মেয়েটাকে তুলে নিল রানা, পরক্ষণেই ছুঁড়ে মারল গার্ডের গায়ে। মেয়েটার দেহের ধাক্কা খেয়ে একটা টেবিলে হোঁচট খেল গার্ড। ওটা পার হয়ে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ল। তার উপর পড়েছে মেয়েটা।

তার পিংক আন্ডারওয়্যার আর সুগঠিত ফর্সা ঊরু দেখতে পেল রানা। পাকা চোরের মতো ঝেড়ে দৌড় দিল রানা। গার্ড আর মেয়েটা সামলে নিয়ে উঠে বসবার আগেই করিডর পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাদে বেরিয়ে এলো ও। রানা মনে মনে নিশ্চিত, গার্ড গুলি করবে না ওকে। মেয়েটাই করতে দেবে না।

চিকা মোস্তাক যা-ই বলুক, মেয়েটা এই ড্রাগ কার্টেলের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জড়িত। সে চাইবে না পুলিশি ঝামেলা হোক। দৌড় শুরু করল রানা, নির্দিষ্ট জায়গায় টাইল কোপিং ডিঙিয়ে ঝাঁপ দিল শূন্যে। দুই বাড়ির ফাঁকের মাঝখানে এসে নিজেকে ও ঘুরিয়ে নিল নিখুঁত ফায়ারম্যান’স ফল-এর জন্য। পিঠ দিয়ে ও তক্তায় পড়বে, দু’হাতে ধরে থাকবে হাঁটুÑপেশি আর হাড়ের তৈরি একটা নিরেট বল।

পড়েই ডিগবাজি খেয়ে উঠে স্ফাড়াবে, পৌঁছে যাবে হোটেলের ছাদে। যদি না কেউ তক্তাটা সরিয়ে থাকে! সরায়নি কেউ। যেমন ছিল তেমনই আছে তক্তা। তক্তার ঠিক মাঝখানে পড়ল রানা, ডিগবাজি খেয়ে সিধে হলো, তারপর দৌড়ে পৌঁছে গেল হোটেলের ছাদে। দৌড় থামাল না, সোজা ছুটল সিঁড়ির দিকে।

গার্ড আর মেয়েটা যখন অ্যানেক্স অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে পৌঁছুল ততোক্ষণে হোটেলের ছাদে নীরব-নিথর ছায়াগুলো আর ডিভানের ছাদ থেকে বেড়ে থাকা তক্তাটা ছাড়া দেখবার আর কিছু নেই। আট আত্মগোপন করে থাকা রানার ত্থেয়া গোপন তথ্য কানেই তুলল না পুলিশ। কর্মকর্তারা হয় প্রচুর ঘুষ খেয়েছে, নয়তো তারা ব−্যাকমেইলিঙের শিকার। পে-ফোন থেকে ফোন করেছিল রানা, ওকে জানিয়ে দিল, অনির্ভরযোগ্য কোনও সোর্সের কথায় সীমান্ত এলাকায় বড় ধরনের কোনও রেইড করা তাল্ডে পক্ষে সম্ভব নয়। তাল্ডে কাছে এমন কোনও খবর নেই যে ড্রাগের চালান যাবে এডেসা পাস দিয়ে।

বাধ্য হয়েই একা এডেসা পাসে যাবে ঠিক করল রানা। মিলি জোর দিয়ে বলল, একা রানা ব্যর্থ হতে পারে। সেক্ষেত্রে ড্রাগের চালান নষ্ট করতে আরেকটা প্রচেষ্টা করতে পারবে ও উপযুক্ত ৫০ ইকুইপমেন্ট থাকলে। কথাটায় যুক্তি আছে বুঝে আর আপত্তি করেনি রানা, মিলিকেও সঙ্গে নিয়েছে। শেষ রাতের খানিক আগে ইয়েসিলকয় এয়ারপোর্ট থেকে চার্টার করা কার্গো বিমানে রওনা হলো ওরা।

পাইলট ওল্ডে পরিচিত, আগেও রানা এজেন্সির কাজ করেছে, ফলে কোনও প্রশ্ন করে ওল্ডে বিব্রত করেনি। পাইলটের কাছ থেকে কেনা সেকেন্ডেহ্যান্ড একটা ছোট জিপও তুলে নিয়েছে ওরা পে−নে। প্যারাশুট করে নামানো হবে ওটা নির্দিষ্ট জায়গায়। এখন চুপ করে বসে ঝিমাচ্ছে রানা। মিলি ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।

বুশ জ্যাকেট, ট্রেঞ্চকোট আর ¯−্যাক্স পরে থাকায় ওকে দেখতে বাচ্চা মেয়েল্ডে মতো লাগছে। ঘুমের মধেদ্দ রানার একটা হাত ধরে আছে ও। একটানা গুঞ্জন তুলে ছুটে চলেছে ওল্ডে বিমান। হাতে বেশি সময় নেই ওল্ডে। ভোরের আগেই জাম্প করতে হবে।

সূর্য উঠবার আগেই লুকিয়ে পড়তে হবে নিরাপদ কোনও আশ্রয় খুঁজে নিয়ে। যজ্ঝিবশ্য সূর্য ওঠে। আবহাওয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে ঘন মেঘে আচ্ছন্ন থাকবে আকাশ। ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা আছে। ওয়েদার রিপোর্টটা শুনে রানা এখন নিশ্চিত, আবহাওয়াবিল্ডা যখন বলেছে বৃষ্টি হবে তা হলে সারাদিন কড়া রোদ না থেকেই যায় না।

একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তার রাজ্যে ডুবে গেল ও। ইস্তাম্বুলের পুবে পুব-দক্ষিণে ছয়শো মাইল গেলে পৃথিবীর রুক্ষতম জায়গাগুলোর একটা পড়ে। পাহাড়, মরু, জঙ্গল আর গভীর সব খাদ পরস্পরকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে ওখানে। দুর্গম একটা এলাকা। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেতিস নদীর খামখেয়ালীপনায় সৃষ্টি হয়েছে ত্রিকোণ অঞ্চলটা।

দেখলে মনে হয় দানবের দল জমিতে চাষ দিয়েছিল, কিন্তু ফসল বুনতে ভুলে গেছে। এই বুনো প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী বলতে কিছু উপজাতীয় কুর্দি। প্রকৃতির মতোই রুক্ষ তারা, প্রকৃতির চেয়েও নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর। ঘড়ি দেখল রানা। সময় হয়ে এলো।

মিলিকে ঘুম থেকে জাগাল ও। কো-পাইলট গেল প্রস্তুতির বল্টস্থা করতে। ভোরের সামানঞ্জাগে পে−ন থেকে প্যারাশুট জাম্প করল ওরা দু’জন। তখনও আকাশ থেকে সামানঞ্জালো ছড়াচ্ছে চাঁদ্মা। হালকা বাতাস আছে।

সেটা কোনও সমস্যার কারণ হলো না। হাত-পা না ভেঙেই মিলিকে নিয়ে সমতল একটা জায়গায় নামতে পারল রানা। ছোটখাটো জিপটা সাপ−াইসহ আগেই নামিয়ে ত্থেয়া হয়েছে চারটে প্যারাশুট বেঁধে। ওল্ডে মাথার উপর একবার চক্কর মেরে ফিরে গেল কার্গো পে−ন। সভ্যতার সঙ্গে ওল্ডে শেষ সম্পর্কটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

আবহাওয়া বিভাগ সম্পর্কে রানার ধারণা পাল্টাতে হলো। মেঘ ভেদ করে সূর্যটা মাঝে মাঝে মুখ বের করছে বটে, কিন্তু বৃষ্টিতে ঝাপসা দেখাচ্ছে ওটাকে। ওরা একটা পাহাড়ী গুহার ভিতর আশ্রয় নিয়েছে। গুহা থেকে সামান্য দূরেই একটা গভীর খাদ, ওটা চলে গেছে এডেসা পাসের দিকে। ওল্ডে উত্তর আর পুবে আকাশ ছোঁয়া পর্বত চূড়া।

অস্পষ্ট দেখায় ওগুলো। বছরের কোনও সময়ই ওগুলোর মাথার বরফ গলে না। কাছেই আরেকটা গুহার ভিতর জিপটা লুকিয়ে রেখেছে ওরা। জায়গাটা পাহাড়ী ছাগলের উপযোগী, এখানে আসবার সময় জিপ চালাতে চালাতে ভেবেছে রানা। জিপের সামনের চাকায় পিছলে গিয়ে একটা পাথর খাল্ডে ভিতর হাজার হাজার ফুট নীচে পড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে সতর্ক হয়েছে ও।

জিপ এখানে তেমন ৫১ একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। খাল্ডে পাশ দিয়ে আসবার সময় মিলি এতো ভয় পেয়েছে যে একটা কথাও বলেনি। বেশিরভাগ সময় চোখ বন্ধ করে থেকেছে। মাঝে মাঝে ভরসা পাওয়ার জনশুানাকে স্পর্শ করেছে। গুহাটা খুঁজে পাবার পর থেমেছে ওরা।

ঠিক করেছে কাজে নামবার আগে এখানেই বিশ্রাম নেবে। কম্বল পেতে শুয়েছে ওরা। বাইরে ঝমাঝম বৃষ্টি হচ্ছে। তাকালে মনে হয় গুহার বাইরে ধূসর একটা দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। শীত-শীত করছে সবারই, কিন্তু আগুন জ্বালানো যাবে না গুহার ভিতর।

শুকনো কাঠ থাকলেও জ্বালানো যেত না, ধোঁয়ায় শ্বাস আটকে আসত। বাতাসটা বাইরে থেকে আসছে। গুহার সামনে উপর দিকে চওড়া কার্নিশ মতো আছে। ওটার তলায় আগুন জ্বালানো যায়, কিন্তু ঝুঁকিটা রানা নিতে চায়নি। মিলি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।

উঠল রানা। গুহামুখের কাছে রাখা রাইফেলটা আরেকবার পরখ করে দেখল। এটা কাজে লাগতে পারে মিলির। মিলিই এই অ্যাসাইনমেন্টে ওর ব্যাকআপ। রানা যè্যর্থি হয় তা হলে দূর থেকে অনুসরণ করবে সে ড্রাগের চালানটাকে।

কুর্দিল্ডে সহ ড্রাগের চালানটা ধ্বংস করে দেবে টিএনটি-২৫ বল্টহার করে। রাইফেলের চেম্বারে একটা গুলি ঢুকিয়ে রাখল রানা। এদিকে নেকড়ে আর বুনো হয়ে যাওয়া বিরাটাকৃতির অ্যানাতোলিয়ান শিপডগের অভাব নেই। তাল্ডে আক্রমণ হলেও রাইফেলটা কাজে দেবে। জিনিসটা একটা স্যাভেজ ৯৯।

হাই ভোলোসিটি বল বুলেট বল্টহার করা হয়। সঙ্গে ওয়াদারবাই স্কোপ আছে। হাত ভালো হলে তিনশো গজ দূর থেকেও নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব। ওটা নিয়ে গুহার বাইরে এসে খাল্ডে কিনারায় স্ফাড়াল রানা। মিলি চলে এলো ওর পাশে।

‘চলো, একটু ঘুরে দেখা যাক,’ বলল রানা। ভেড়ার চামড়ার তৈরি জ্যাকেটের কলার টেনে দিল ও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। ‘আশপাশটা দেখে রাখো। ’ ‘চলো। ’ কিছুক্ষণ চারপাশ দেখে যে-গুহায় জিপটা লুকানো আছে সেটায় চলে এলো ওরা।

কী কী এনেছে আরেকবার পরীক্ষা করে দেখল দু’জন। ক্যাম্প করবার মতো সবকিছুই আছে। রানার সুটকেসে ঠাঁই পেয়েছে ছয়টা টিএনটি-২৫। তার থেকে তিনটে মিলিকে দিল ও। ‘রাখো।

বাধ্য হলেই শুধু বল্টহার করবে। ’ ড্রাগের চালানটা নষ্ট করলেই চলবে না, সেই সঙ্গে সিন্ডিকেটকেও পঙ্গু করে দিতে হবে। সেজন্য ল্ডকার তথ্য। রানা আন্দাজ করতে পারছে তথ্য কোথায় পাওয়া যাবে। বুল হাডসন মাঠ পর্যায়ে কাজ দেখাশোনা করে।

সব খবরই তার নখদর্পণে থাকতে হয়। নিশ্চয়ই তার কাছে সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যল্ডে নাম থাকবে। ওই নামগুলো পেলে সিন্ডিকেটকে বিকল করে ত্থেয়া সম্ভব। অন্তত কয়েক বছর কোমর সোজা করে আর স্ফাড়াতে পারবে না তারা। সেটা পুলিশের সাহায্য না পেলে।

আর পুলিশের সাহায্য যদি পাওয়া যায় তা হলে এই ড্রাগ সিন্ডিকেটকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ত্থেয়া সম্ভব। রানা এবং মিলি, দু’জনই জানে, ওপিয়াম বল্টসা কখনোই বন্ধ করা যাবে না। এতে এতো বেশি লাভ যে একদল লোক সবসময় আগ্রহী হবে পপি চাষে। তুরস্কের ছোট ছোট খামারগুলোর উৎপাদিত পপি সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছে যাবে প্রসেসিং ফ্যাক্টরিতে। ওখানে তৈরি হবে হেরোইন, এক সময় ঢুকে যাবে সারা দুনিয়ার অসহায় অ্যাডিক্টল্ডে রক্তে, অনেক তরুণ-তরুণীর মৃত্যু ডেকে আনবে।

যারা মরবে না তারাও বেঁচে থাকবে জীবন্মৃতের মতো। ৫২ এসব কথা ভাবতে গিয়ে মিলির কথা মনে হলো রানার। অজান্তেই চেহারার কঠোর রেখাগুলো কোমল হলো ওর। ভালো হবার জনঞ্জনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছে মিলি। ওর সাহসকে প্রশংসা না করে উপায় নেই।

কিন্তু এটাও ঠিক যে ও লাখে একজন। ভাগ্য খুব ভালো না হলে হেরোইন বা কোকেনের মতো ড্রাগ ছাড়তে পারে না কেউ। ডিবার্গের কথা ভাবল রানা। ল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.