বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ সকালবেলায় জেসমিন-এর ফোন। চাপা স্বরে বলল, মামা, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে । আমার কাজের মেয়েটা না পেত্নী!
সাত সকালে এমন ফোন পেয়ে থ হয়ে গেলাম।
তবে জেসমিন- এর বিবেচনাবোধ সম্বন্ধে আমার ভালো ধারণা আছে। সুতরাং শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে বুঝলে যে তোমার কাজের মেয়েটা পেত্নী!
জেসমিন বলল, কাজের মেয়েটা নতুন এসেছে। আপনি এখনও দেখেননি। নাম হাজেরা । ভারবেলা উঠেছি।
তো কিছুক্ষণ আগে বাথরুম থেকে ফিরছি। এমন সময় কী মনে করে রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। দেখি হাজেরা রান্নাঘরের মেঝের ওপর বসে কচকচ করে কাঁচা মাছ খাচ্ছে। কই মাছ। দেখে আমা গা কেমন গুলিয়ে উঠল।
হাজেরা পেত্নী না তে কী।
আমি খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বল কী। মাছ কি কাঁচাই খাচ্ছিল?
হ্যাঁ, মামা। কাঁচা। লবনও নেয়নি।
ওহ্ । তা, মেয়েটার বয়স কত?
এই তিরিশের কাছাকাছি হবে। বিধবা। ৬/৭ বছরে একট মেয়ে আছে। গ্রামে মায়ের কাছে রেখে এসেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটা নতুন বললে। কে ঠিক করে দিয়েছে, সোলেমান?
হ্যাঁ।
সোলেমান এ পাড়ায় কাজের মেয়ে সাপলাই দেয়। বললাম, আচ্ছা দেখছি কী করা যায়। তুমি এ নিয়ে ভেব না।
ফোন অফ করে ভাবতে বসলাম। জেসমিনকে সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। তার কারণ আছে। আমি বৃদ্ধ এবং বিপত্নীক মানুষ। আমার একটিই মেয়ে।
তামান্নার বিয়ে হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া থাকে। ছ'তলার এই ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি। নিজেই রান্নাবান্না করি, বাজার করি। এই বহুতলের আট তলায় থাকে।
জেসমিন আমার ভাগ্নে বুলবুল-এর বউ। বুলবুল একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে উঁচু পদে আছে। অফিস থেকে লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনল। আমিও রায়ের বাজারে দু'কাঠা জমি বেচে ফ্ল্যাট কিনলাম। জেসমিন অবশ্য রাতে খাবারটা পাঠায়।
গেস্ট এলে জেসমিন ওর কাজের মেয়েকে পাঠায়। ঘর ঝাঁট দিতে আসে। বড় ভালো মেয়ে জেসমিন। আমি ওকে মেয়ের মতই দেখি। তাই জেসমিনকে সান্ত্বনা দেওয়া দরকার।
ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে একটা সিগারে ধরিয়ে হাজেরার ব্যাপরটা নিয়ে ভাবতে বসলাম। গত বছর আমি রিটায়ার করেছি। পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করতাম। যৌক্তিক কারণ খোঁজার বাতিক আছে আমার। তাই ভাবলাম কাঁচামাছ খাওয়ার ব্যাপারটা কি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক।
এটি কোনও মানসিক সমস্যা? না একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা? কাজের মেয়ে রান্নাঘরে বসে কচকচ করে কাঁচা মাছ খাচ্ছে এ রকম একটি দৃশ্য ডিসগাস্টিং সন্দেহ নেই। জেসমিন পেত্নী বলল। কাঁচা মাছ জাপানিরা খায়। জাপানিরা ওই জাতে পড়ে না। পৃথিবীতে আরও অনেক জাতি কাঁচা মাছ খায়।
তারাও ভূত কি পেত্নীবর্গের নয়। তবে কাঁচা মাছ-মাংস খাওয়া সেইফ কিনা ইদানীং তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুনেছি কাঁচা মাছ খেলে গলব্লাডারের সমস্যা হয়।
টেবিলের ওপর তামান্নার পাঠানো ১৩ ইঞ্চি ডেল আলট্রাবুক। ‘ইটিং র ফিস- দ্য জেঞ্জারস’ লিখে সার্চ দিলাম গুগলে ।
পেইজগুলি এলে পড়তে শুরু করলাম। একটা পেজে লিখেছে: দ্য রিপোটের্ড ডেঞ্জার’স অভ ইলনেস বট অন বাই ইটিং র ফিস অ্যান্ড মিট অফন কজ ফিয়ার অ্যান্ড কনফিউঝন ইন দ্য মাইন্ডস অভ দোজ হু ইনজয় সাচ ফুডস, আইদার ফর দেয়ার এসথেটিক অর নিউট্রিশন্যাল বেনিফিটস।
মনে পড়ে গেল আদিত্যর কথা। আদিত্য আমার ছোট বোন শবনম এর ছেলে। খুব ঘুরে বেড়ায় আদিত্য।
ওই একবার বলেছিল খুলনার সুতারখালীর এক জেলেপাড়ার লোকজন নাকি কাঁচামাছ খায়।
জেসমিনকে ফোন করলাম।
জ্বী মামা, বলেন।
বললাম, কাঁচামাছ খাওয়ার ব্যাপারটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয় জেসমিন।
মামা কী বলছেন আপনি? হাজেরা কাঁটাশুদ্ধ কই গিলে খেল।
খেল ঠিক আছে। কাঁচা মাছ পৃথিবীতে অনেকেই খায়। তাই তোমার নতুন কাজের মেয়েটা পেত্নী না!
পেত্নী না!
না।
ও। আচ্ছা ঠিক আছে।
শোন জেসমিন। নেদারল্যান্ডের অধিবাসীরা বছরের একটা সময়ে কাঁচা মাছ খায়। যখন হেরিং মাছ বিক্রি করার মৌসুম শুরু হয়, তখন খায়। তারা নিশ্চয়ই জিন-ভূত না।
অ।
ফোন রেখে দিলাম।
কলিংবেল বাজল।
কে এল আবার। উঠে দরজা খুলে দেখি- জামাল। এ বহুতলের গার্ড ।
কথায় অত্যধিক স্যার ব্যবহার করে। বললাম, কি ব্যাপার জামাল?
স্যার, আপনার ইন্টারকম কি নষ্ট, স্যার?
হ্যাঁ।
ফোন করছিলাম স্যার কেউ ধরল না স্যার । স্যার আপনার কাছে এক বেটা আইছে স্যার ।
বেটা? কি নাম? আমি অবাক।
স্যার নাম কইলন স্যার সাদেক মিঞা স্যার। চিনেন স্যার?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনি চিনি। যাও ওকে নিয়ে এসো। আর সাইফুল কে পাঠাও। ইন্টারকম ঠিক করে দিয়ে যাবে।
আইচছা স্যার । বলে জামাল চলে গেল।
আশ্চর্য! সাদেক মিঞা ঢাকায়? সাদেক মিঞার মোবাইল আছে। আমার নাম্বারও সে জানে। তাহলে সে আমাকে ফোন করল না কেন।
আসলে সাদেক মিঞা ভারি অদ্ভূত এক মানুষ। নিজেকে তান্ত্রিক বলে পরিচয় দেয়। অশুভ যাদুটোনা বন করে। তবে আমার এসব ব্ল্যাকআর্টে বিশ্বাস হয় না। দাড়ি-টুপি পরা মুসল্লী চেহারা একজন লোক তান্ত্রিক হয় কী ভাবে।
গতবছর জুন মাসে দিনাজপুরে সাদেক মিঞার সঙ্গে আমার পরিচয়। সদ্য স্ত্রী মারা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে উদভ্রান্তের মতন এখানে-ওখানে ঘুরছি। বিরল রেলস্টেশনে এক বেঞ্চির ওপর মাঝরাতে বসে আছি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি ।
সাদেক মিঞাও বসেছিল। বয়স ঠিক বোঝা গেলনা। তবে পঞ্চাশ পেরিয়েছে। সেই যেচে আলাপ করল। বিষয়: সাপের মাথার মনি, লালমাই পাহাড়ের গোপন সুড়ঙ আর কামরূপ কামাখ্যা মন্দির।
এসব রূপকথা শুনতে শুনতে স্টেশনেই কেঁপে জ্বর এল । বৃষ্টি থামলে সাদেক মিঞা ধরাধরি করে এক পুরনো পরিত্যক্ত মাজারের পিছনে একটা টিনসেডের ঘরে নিয়ে তুলল। তারপর মন্ত্রপূত কালিজিরার তেল খাইয়ে জ্বর সারিয়ে তুলল। তার ওখানে দিন সাতেক ছিলাম। সাদেক মিঞা ভারি যত্ন নিয়েছিল আমার ।
কত রহস্যময় সব গল্প শোনালো। একবার জিন নামাতে চেয়েছিল । আমার শরীর কাহিল ছিল তাই জিন দেখতে ইচ্ছা হয়নি। দিনাজপুর থেকে আসার সময় সাদেক মিঞাকে ঢাকার ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। সাদেক মিঞা এর আগে কখনও আমার ফ্ল্যাটে আসেনি ।
আজই প্রথম এল।
লিফটের কাছে তাঁকে রিসীভ করে বললাম, এসো সাদেক মিঞা। কেমন আছ?
আল্লায় তার বান্দারে রাখছে। আপনার শরীর ভালো নি?
আমি ভালো।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতে করতে বললাম।
বস। আরাম করে।
সাদেক মিঞা সোফায় বসল। এদিক-ওদিক দেখছে। ড্রইংরুমটা তেমন সাজাগো গোছানো না।
বইপত্র ছড়ানো।
সাদেক মিঞার হাতে একটা পাটের ব্যাগ। অতি গ্রাম্য চেহারা । পরনে পুরনো হলেও পরিস্কার সাদা লুঙ্গি আর খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় কাপড়ের টুপি।
গোলপানা হলদে মঙ্গোলয়েড চেহারা। ভুঁরু কম। তবে ভরাট মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি।
জিজ্ঞেস করলাম, ঢাকা কবে এলে?
গতকাল নরসিংদী আইছিলাম । শিবপুর।
হারুন চেয়ারম্যান ছারের ভিটায় একটা জিনিস ভর করছিল। সেইটারে ভোররাইতে পাটের বস্তায় বাইন্দা আইজ ভোর ভোর টাইমে যাত্রা করছি।
ও। সাদেক মিঞার জগৎ ভিন্ন। সেই জগতে ঘটনার কার্যকারণ অন্য রকম।
যা আমাদের নিত্য দিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে মেলে না। জিনিস বলতে সে জগতে জিনভূত বোঝায়।
সাদেক মিঞা কী বলতে যাবে -অমনি ঝনঝন করে টিএনটি ফোনটা বাজল । শবনম।
বললাম, হ্যালো।
শবনম। বল।
ভাইজান আদিত্য কে ফোনে পাচ্ছি না।
ওনা কয়েক দিন আগে খুলনা গেল। সুতারখালী না কই-
হ্যাঁ।
আদিত্যর ফোন বন্ধ। কাল রাত থেকে ফোনে পাচ্ছি না। আজ সকালেও পাচ্ছি না।
সে কী! আচ্ছা আমি খোঁজ নিচ্ছি। তুই অত ভাবিস না।
বলে অফ করে দিই। পাত্তা দিলাম না। শবনম- এর টেনশন করার বাতিক আছে। আদিত্য আমার অতি আদরের ভাগ্নে। আমার মতোই স্বভাবচরিত্র ওর ।
কী এক নেশায় বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে ওর মায়ের টেনশন আর টেনশন।
সামান্য তেজারতি স্যার। বলে পাটের ব্যাগটা দেখলো সাদেক মিঞা ।
কি দরকার ছিল বলে ব্যাগটা রান্না ঘরে নিয়ে গেলাম।
টের পেলাম আমার মন কিছুটা বিষন্ন হয়ে রয়েছে । আসলে আমারও আদিত্যর জন্য টেনশন হচ্ছিল। বড় ছন্নছাড়া ছেলে-কখন কোন্ বিপদে জড়ায় কে জানে । আদিত্য বুয়েটে পড়ছে। ওর মা-বাবা চাইছে ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে।
আদিত্য বাইরে যাবে না। এমন ত্যাঁদোড় ছেলে।
পাটের ব্যাগের ভিতর কাঁচা কলা, কাকরোল, দুটো কাঁচা পেঁপে দেখলাম। আখের গুড় আর এক শিশি কালিজিরার তেলও আছে । ওগুলো বের করে ব্যাগটা রান্নাঘরে রাখলাম।
ড্রইংরুমে ফিরে এসে সাদেক মিঞাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কিছু খাবে কিনা?
না। হারুন চেয়ারম্যান ছারে খাসীর গোশতের বিরানি পাকায়ছিল। খাইছি পেট ভইরা।
ও। তাহলে পরে খেও।
আমি রান্নাবান্না করে রাখব। বলে একটা কাপে সাদেক মিঞাকে চা দিলাম। চা খেয়ে সাদেক মিঞা বলল, স্যার আমার একটুখানি ঘুমান দরকার। জিনিসটা ধরতে সারা রাইত হারুন চেয়ারম্যান ছারের পুকুরের পাড়ে জাম্বুরা গাছে বইসা ছিলাম। মশায় কামড়াইছে।
আচ্ছা, তুমি তাহলে রেস্ট নাও। গোছল করবে?
হইলে ভালো হয়।
সাদেক মিঞা কে গেস্টরূমের লাগোয়া বাথরুমটা দেখিয়ে দিলাম। তারপর সর্ষের তেলের শিশি আর নতুন একটা লাক্স সাবান দিলাম। নতুন তোয়ালে বাথরুমেই আছে।
সাদেক মিঞা গোছল সেরে শুয়ে পড়ল।
ইলেকট্রিশিয়ান সাইফুল এল। বললাম, দেখ তো বাবা ইন্টারকমটা কি হয়েছে । সাইফুল দুমিনিটেই ঠিক করে ফেলল । ওকে ৫০টাকা দিয়ে বিদায় করলাম।
তারপর জেসমিন কে ইন্টারকমে ফোন করলাম। বললাম, আমার একজন গেস্ট এসেছে। রান্নাবান্না করা দরকার। তুমি কি হাজেরাকে পাঠাতে পারবে? অসুবিধে হবে?
না না, অসুবিধে হবে না মামা। নাসরীন এসেছে।
আমি ওকে এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বললাম, আচ্ছা মেয়েটির কোথায় বাড়ি কোথায় বলেছে?
খুলনা।
খুলনা কোথায়?
দাকোপ। সুতারখালি।
সুতারখালি শব্দটা শুনে আদিত্যর কথা মনে পড়ল।
কী হল ছেলেটার?
রিসিভার রাখতেই কলিংবেল বাজল। হাজেরা? এত তাড়াতাড়ি। দরজা খুললাম। বছর তিরিশের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো শীর্ণ শরীর।
পরনে সবজে শাড়ি ।
বললাম, তুমি হাজেরা?
হ।
চুলা ধরাতে পার?
পারি।
যাও তাহলে ভাত আর ডাল বসিয়ে দাও। আমি এখন বাজারে যাচ্ছি।
হাজেরা নিঃশব্দে রান্নঘরে চলে গেল।
বাজার কাজেই । আলুপটল ছাড়াও পঁচিশটা কই মাছ কিনলাম। মাছওয়ালার নাম মুসলিম। আমার পরিচিত।
তরতাজা মাছই দিল। সেবার সাদেক মিঞা বলেছিল তার নাকি কইভাজা আর কইমাছের তরকারি খেতে ভালো লাগে । গতবছর আমার বিপদের সময় সে অনেক সেবাযত্ন করেছে। তাকে সামান্য আপ্যায়ন না করলে কেমন দেখায়। আমার আবার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আছে।
দু ডজন কলা আর ইসুফগুলের ভূষি কিনে বাড়ি ফিরলাম।
ফিরতে ফিরতে প্রায় ১১টা বাজল।
লিফটের কাছে আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম । ভাঙাচোরা চেহারা। চুল উশখোখুশকো।
চোখ লাল। পরনের টি-শার্টটা মলিন। শ্যামলা মুখে ক্লান্তির ছাপ।
কি হয়েছে রে তোর? এ কি চেহারা করেছিস?
আদিত্য ফিসফিস করে বলল, ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম মামা।
আহা।
সে তো বুঝলাম । তাই বলে মাকে ফোন করে জানাবি না কই আছিস।
ফোন তো ফেলে এসেছি। পরে আর সময় পাইনি। একটু আগে বাস থেকে নামলাম।
লিফট এসে গেছে। বললাম, আচ্ছা সব শুনছি। আগে ওপরে চল।
ওকে নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। পকেটে চাবি ছিল।
কলিংবেল বাজাতে হল না। নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে আদিত্যকে আমার ঘরে বসতে বললাম। তারপর বাজার নিয়ে রান্না ঘরে গেলাম। দেখলাম ডাল চুলায়। হাজেরা কিচেনের বারান্দায় ভাতের মাড় গালছিল।
আমাকে দেখে উঠে এল।
ইচ্ছেই করেই কইগুলো মেঝেতে ফেললাম। ওগুলি তড়পাড়ে লাগল। বললাম, দশটা কই ভাজ আর দশটা আলুপটল পটল দিয়ে রান্না কর।
আইচ্ছা।
আর আমার ঘরে দুকাপ চা দিয়ে যাও।
আইচ্ছা।
ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি বের করে বেডরূমে এলাম। আদিত্য বাথরুম গিয়েছিল একটু পর বেরিয়ে এল। ওকে পানির বোতল দিয়ে চোয়ারে বসলাম।
আদিত্য আমার মুখোমুখি বিছানার ওপর বসল। ঢকঢক করে পানি খেল।
আমি বললাম, দাঁড়া আদিত্য তোর মাকে আগে একটা ফোন দিই। তোর মা একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছে।
শবনম ফোন ধরল।
বললাম, আদিত্য আমার কাছে আছে। ও একটু পরে বাড়ি যাবে।
শবনম চেঁচিয়ে উঠল, সে কী ভাইজান! ওর ভিসার কাগজপত্র সব রেডি। কাল অ্যামবাসিতে দাঁড়াতে হবে।
আমি ঝাঁঝ দেখিয়ে বললাম, আদিত্য লন্ডন যেতে চাচ্ছে না।
তোরাই ওকে জোর করে পাঠাচ্ছিস।
শবনম শান্তস্বরে বলল, ওকে ফোনটা দাও তো।
আদিত্য গোছল করছে।
শবনম ভীষণ মেজাজি । ফোন রেখে দিল।
আদরের ছোটবোন। ফোন অফ করে বললাম, এবার বল তো শুনি কী হয়েছে তোর।
আদিত্য কি বলতে যাবে- হাজেরা চা নিয়ে এল। এত শীঘ্র চা বানাল কীভাবে। আমি অবাক হলাম।
দেখলাম আদিত্য অবাক হয়ে হাজেরার মুখের দিকে চেয়ে আছে।
চা দিয়ে হাজেরা চলে যেতেই আদিত্য বলল, মামা আমি এই মেয়েটাকে এর আগে দেখেছি।
সে কী রে। কোথায় দেখেছিস?
তোমাকে বলেছিলাম না- গতবছর আমি সুতারখালী গিয়েছিলাম?
হ্যাঁ। মনে আছে।
মেয়েটাকে ওখানে দেখেছি।
বলিস কী। তুই বলছিলি ওখানকার জেলেরা নাকি কাঁচামাছ খায়?
হ্যাঁ, খায়। তবে আরও অনেক কিছুই তারা করে।
আমি দর্শনের অধ্যাপনা করেছি।
কুসংস্কার প্রশ্রয় দিইনি। আমি বিশ্বাস করি সব কিছুর ব্যাখ্যা রয়েছে। আজহোক কাল হোক বোঝা যাবে ... আমার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। বললাম, খুলে বল ।
আদিত্য বলল, গত বছর যখন সুতারখালী যাই- আমার সঙ্গে আমার বন্ধু আদনান ছিল।
আমরা ঠিক করেছিলাম খুব কাছ থেকে আমরা জেলেদের জীবন দেখব এবং জেলেপাড়ায় আগে থেকে খোঁজ খবর করে যাব না। কোনও উপজেলায় নেমে লোকাল বাসে চেপে কোনও নদীর ধারে নেমে পড়ব। এভাবে দাকোপ উপজেলায় নেমে লোকাল বাসে চেপে নিশিকাটি বলে একটা গ্রামে পৌঁছে গেলাম। গ্রামটা ভদ্র্রা নদীর পাড় ঘেঁষে । ছোট গ্রাম।
আমি আর আদদান এক জেলে পরিবারে উঠেছিলাম। তো, পরদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙল। আদনান ঘুমিয়ে ছিল। আমি উঠে ভদ্রা নদীর পাড়ে গেলাম। নির্জন পাড়।
বাতাসে কেমন আশটে গন্ধ। দেখি যে নদীর ধারে কয়েকজন লোক বসে আছে। গতকাল এদের জেলেপাড়ায় দেখেছি। তারা কাঁচা মাছ খাচ্ছে।
কাঁচা মাছ? কি মাছ?
এই ধর, খলিসা, মেনি, চাপিলা।
কাঁচাই খাচ্ছে?
হ্যাঁ, কাঁচা। চিবিয়ে।
কথাটা শুনে আমার মুখটা মনে হয় এখন সিরিয়াস দেখাল।
আদিত্য বলল, আমার বমি বমি লাগছিল। ফিরে এলাম।
রোদ উঠতে দেখি আদনান- এর খুব জ্বর । দুপুরে ওর জ্বর সারল। ও আর ওখানে থাকতে চাইল না। অগত্যা ফিরে এলাম। এই ক’দিন আগে আবার গেলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, একা?
হ্যাঁ। একা। আদনান সিলেট। অন্যদেরও পেলাম না।
গেলি কি কাঁচামাছ খাওয়ার রহস্যভেদ করতে?
ঠিক তা না মামা।
নিশিকাটি গ্রামটা কেমন টানছিল। গতবছর ভোরের ভদ্রা নদীর ছবি তুলেছিলাম। ভদ্রার ওইপাড়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। এত বড় মাঠ এর আগে দেখিনি। ঠিক যেন তেপান্তরের মাঠ।
গাছপালা নেই। আকাশের রংও যেন কেমন। গভীর ফিরোজা। কোনও চেঞ্জ নেই। তাই ভাবলাম পূর্ণিমায় নদী-মাঠের ছবি তুলব।
এবার পূর্ণিমা হিসেব করে রওনা হলাম। এবারও সেই জেলেপরিবারেই উঠেছি। রাতে ঘুমালাম না । মাঝরাতে ভদ্রার পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। চারিদিকে দিনের মত অলো।
পাড়ে উলটানো নৌকা। একটা নৌকায় হেলান দিয়ে বসে রইলাম। হাতে তোমার দেওয়া ১৮ মেগার ক্যানন ইওএস এমটা। মাঝে মাঝে ছবি তুলছিলাম । ওপারে তেপান্তরের মাঠ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল।
এমন সময় বড় একটা মাছ ভেসে উঠেই আবার আবার ডুবে গেল। অনেক বড় মাছ, এই ধর একটা নৌকার সমান। মাছটা রুই মাছে মতন দেখতে। আমি তো অবাক। তবে ছবি তুলে নিলাম।
তখনই অদ্ভূত এক আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখলাম জেলেপাড়ার সবাই অদ্ভূত আওয়াজ করতে করতে ছুটে আসছে। এই ধর দু-তিনশ জন হবে। দলটায় ছেলেবুড়ো সবাই আছে। তারা পানির কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কিন্তু, পানিতে পড়ার আগে এক এক জন রুই মাছ রূপান্তরিত হল।
ক্বি! কি বলছিস তুই!
হ্যাঁ। যা দেখেছি তাই বলছি। ভৌতিক দৃশ্যটা দেখে আমার শরীর জমে গেল। মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে যাব।
নদী শান্ত। মৃদু রূপালি ঢেউ। একটু পর ঝাঁক ঝাঁক রুইমাছ ডলফিনের মতন লাফালাফি করতে লাগল। ছবি তুলে নিলাম। অনেক মাছ।
এই ধর কয়েক হাজার । আবার সেই বড় রুই মাছটা ছোট তিমির মতন ভেসে উঠল। ছবি তুলে নিলাম। আমার হাত কাঁপছিল। হঠাৎ দেখলাম রুইয়ের ঝাঁক দ্রুত তীরের দিকে আসতে লাগল।
তীরে উঠেই সব কটা মাছ ভয়ঙ্কর রূপ ধরল। ভীষণ বিভৎস-কী বলব। হলুদ লম্বা কান, মাথায় ছোট্ট লাল রঙের শিং। সারা শরীরে সোনালি রোম। তারা উলু ধ্বণির মতন শব্দ করে আমার দিকে তেড়ে আসতে ।
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তারপর?
আমি উঠে দৌড় দিলাম। উচুঁ পাড়ে উঠে একবারও পিছনে না তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকি। এড়বোখেবড়ো রাস্তা। ওপাশে একটা খাল।
খালটা আড়াআড়ি পেরোতেই ক্যামেরা ছিটকে পানিতে পড়ে যায়। পিছনের ওরাও খালের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মুখ দিয়ে সেই অদ্ভূত স্বর করছে ...তারপর আমি কীভাবে খাল পেরিয়ে করলা আর কলমি শাকের ক্ষেত আর শিরীষের জঙ্গল পেরিয়ে পিচ রাস্তায় উঠে এলাম বলতে পারব না। দৌড়াতে দৌড়াতে টের পেলাম শেষ রাত। তখনও দৌড়াচ্ছি।
আন্দাজে। আধা কিলোর মতন দৌড়ানোর পর আজান শুনতে পেলাম। তখন পিছনে ওদের আওয়াজ কমে এল। একটা মসজিদ চোখে পড়ল। মসজিদের সামনে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
তারপর মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি মাথার কাছে মুয়াজ্জ্বিন সাহেব বসে। দোওয়া দরুদ পড়ছে। সব শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, নিশিকাটি গ্রামের নাম বাপ-দাদার আমলে শুনছি।
অনেক বছর আগে ছিল। এখন আর নাই। বন্যায় নাকি ভেইসে গেছে। তিনিই টাকা-পয়সা দিয়ে আমাকে খুলনার বাসে তুলে দিলেন।
ওহ্।
আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।
ঠিক তখনই ফোন বাজল। শবনম।
হ্যাঁ। বল।
শবনম থমথমে গলায় বলল, ভাইজান আদিত্যকে এখুনি বাড়ি আসতে বল, ও যদি এখন না আসে, তাহলে যেন সারাজীবনে না আসে।
ঠিক আছে। পাঠাচ্ছি। বলে ফোন অফ করে দিলাম। বললাম, শোন, আদিত্য।
তুই এবার বাড়ি যা। তোর মা ক্ষেপেছে । আবার আসিস। তখন ঘটনাটার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাব।
আদিত্য উঠে দাঁড়াল।
ওকে ভাঙতি কিছু টাকা দিয়ে দরজা অবধি পৌঁছে দিলাম। তারপর দরজা বন্ধ করে গেস্টরূমে উঁকি দিলাম। সাদেক মিঞা ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাচ্ছে। তবে গেস্টরুমে আতরের তীব্র গন্ধ পেয়ে অবাক হলাম।
আমার ঘরে যেতেই বাজে একটা আশটে গন্ধ।
মনে পড়ল আদিত্য নিশিকাটি গ্রামে হাজেরাকে দেখেছে বলল। আসলে আদিত্যর কোনও কারণে হেলুসিনেশন হয়েছে। ভারি সেনসেটিভ ছেলে।
হাজেরার রান্নার কদ্দূর কি হল। হলে সাদেক মিঞাকে ডেকে খেতে বলব।
রান্নাঘরে গেলাম। রান্নাঘরে হাজেরা নেই। ডালের চুলা বন্ধ। ভাতের হাঁড়ি বারান্দায়। বারান্দায় হাজেরা নেই।
বাকি রূমগুলো দেখলাম। নেই। বাথরুমে নেই। ও বাইরে যায়নি তো । না।
আমার ঘরে আামি যে চেয়ারে বসে ছিলাম সেখান থেকে মেইন গেইটা দেখা যায়। নাহ্ । কেউ বেড়িয়ে যায়নি।
জেসমিনকে ফোন করলাম। হাজেরা কি তোমার ওখানে?
না মামা।
আশ্চর্য!
কেন আপনার ওখানে নেই?
না। আচ্ছা। তোমায় সব পরে জানাচ্ছি।
আচ্ছা।
ইন্টারকমে নীচে ফোন করলাম ।
জামাল ধরল, বললাম, সেভেন বি- থ্রির কাজের মেয়েটি কি নীচে নেমেছে?
না স্যার।
তুমি সিওর?
জ্বী, স্যার।
বেশ খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে রিসিভার রেখে দিলাম। আদিত্যর তাহলে হেলুসিনেশন হয়নি। আমার কি হচ্ছে? আমি হাজেরাকে দেখছি না কেন? ওয়াল ক্লকের দিকে তাকালাম।
একটা বাজতে পাঁচ মিনিট। গেস্ট রুমে ঢুকলাম। বিছানার ওপর বসে আছে সাদেক মিঞা। কানে সিটিসেলের একটা শস্তা সেট ঠেকিয়ে কার সঙ্গে ফোন কথা বলছে। সেটটায় আবার লাল সুতলি বাঁধা।
সাদেক মিঞা বলল, আইচ্ছা আমি আইতেছি। তুমি আধামন চুন সংগ্রহ কর সালামত। তারপর ফোন অফ করে আমার দিকে তাকিয়ে সাদেক মিঞা বলল, স্যার। আমারে এখনি একবার মানিকগঞ্জের ঘিওর যাইতে হইব। মৌলভী সুলেমান মুন্সির পুকুরে জিনিসটা দেখা গেছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আচ্ছা যাও। তার আগে একটু ভাত মুখে দিয়ে যাও।
সময় নাই ছার। সন্ধা নাগাদ জিনিসটা ভাইসা উঠব। তখনই চূনপড়া ছিটাইতে হইব।
বলতে বলতে সাদেক মিঞা বিছানা থেকে নেমে গেস্টরুমের বাইরে বেরিয়ে এল। বলল, আমার ব্যাগখান কই ছার?
ও তোমার ব্যাগ । তোমার ব্যাগ তো রান্নাঘরে। এসো। দিচ্ছি।
রান্নাঘরের মেঝের ওপর একটা রুইমাছ পড়ে আছে। বেশ বড় মাছ। আমার শরীর কেঁপে উঠল।
সাদেক মিঞা বলল, জিনিসটা তাইলে এইখানে। বলে মাছটা ধরে ব্যাগে ভরল।
তারপর বলল, আমি মাছটা নিয়া গেলাম স্যার। এইটা এইখানে থাকলে মুসিবত আছে।
আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না।
দরজার কাছে এসে সাদেক মিঞা বলল, আমি আবার আসমু সার। দেখলেন তো কেমন ব্যস্থ থাকি।
তয় আপনার ছুট বইনের পোলায় হারা বছর আদার-বাদারে ঘুইরা বেড়ায়। কিয়ের মইধ্যে গিয়া পড়ে, কি দেখে না দেখে, নিজেও ঠাওর পায় না। তারে এই তাবিজখান দিয়েন স্যার । এই তাবিজ ধারণ না করলে হে বড় বিপদে পড়ব কইলাম।
বলে শূন্য থেকেই একটা কাইতন লাগানো ছোট্ট রুপোর তাবিজ আমাকে দিল।
আমি কখনও কোনওদিনই এইসব তাবিজ-কবজের মন্ত্রশক্তি কিংবা অতিপ্রাকৃত ঘটনায় বিশ্বাস করিনি।
আজ আর তাবিজ না নিয়ে পারলাম না ..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।