কবি হতে চেয়েছিলাম... মাসুক হেলাল ও এক বুক নিঃসঙ্গতা
-জুলফিকার শাহাদাৎ
মাসুক হেলালকে কী বলে শান্ত্বনা দেব সে ভাষা আমার জানা নেই। এক বুক হাহাকার ও চরম নিঃসঙ্গতা এ মুহূর্তে তাকে ঘিরে রেখেছে। মাত্র কিছুদিন আগে তিনি মাতৃহারা হন। মায়ের কবর দিতে গিয়ে খবর পান প্রিয় বন্ধু মিনার মাহমুদের আত্মহত্যার খবর। এ শোক কাটিয়ে উঠার আগেই ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ জুন চিরতরে চলে যান প্রিয়তমা স্ত্রী আছিয়া বেগম ।
৭ বছরের একমাত্র কন্যা চর্যাকে রেখে এ স্ত্রী বিয়োগের যন্ত্রণা মাসুক ভাই কিভাবে সইবেন? জানি না।
মাসুক ভাইয়ের স্ত্রী আছিয়া বেগম আমার অফিস কলিগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। বছর পাঁচেক আগে গ্রামীণ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে বদলী হয়ে আসেন তিনি। কাজ করতেন সংস্থাপন বিভাগে।
তাই আছিয়া আপুর সাথে আমার দেখা হতো প্রায়ই।
একদিন কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি, আছিয়া আপুর স্বামীর নাম মাসুক হেলাল। কথাটি শুনে ত আমি যারপর নাই বিস্মিত! আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ মাসুক হেলাল। তার সহধর্মিনী তিনি?
এরপর থেকে ধিরে ধিরে তার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে । শ্রদ্ধা বাড়ে।
দেখা হলেই মাসুক ভাইয়ের খবর নিই। একদিন আছিয়া আপা একটি বই উপহার দেন আমাকে।
বইয়ের নাম “চর্যা তাম খাবে “ লেখক মাসুক হেলাল। একমাত্র মেয়ের ছবির ইলাষ্ট্রেশন সমৃদ্ধ এই বইটির পুরো গল্পই মেয়েকে নিয়ে লেখা।
মাসুক ভাইয়ের সাথে তখনও আমার দেখা হয়নি ।
তাকে ভয় পেতাম খুব। এখনও পাই। এতো স্পষ্টবাদী,নির্মোহ এ মানুষটিকে ভয় না পেয়ে উপায় আছে ?
মাসুক ভাই অনেক বিখ্যাতজন। শিল্প নির্দেশনার জন্য এ পর্যন্ত কয়েকবার জাতিয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ‘আগুনের পরশমণি’ ‘ওরা এগারজন’ ‘মেহেরজান’সহ অজস্ত্র চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশক এই মাসুক হেলাল।
মিনার মাহমুদ সম্পাদিত সাড়াজাগানো ‘বিচিন্তা'র প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদশিল্পীও মাসুক ভাই। আরো একটা তথ্য দিই,আজকের জনপ্রিয় উপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন যখন তার প্রথম উপন্যাস ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ প্রকাশ করতে না পেরে বিদেশ পাড়ি দেন তখন প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এই বইটি প্রকাশে সফল হন এই মাসুক হেলাল।
সেই মাসুক ভাইয়ের কাছে দাঁড়ানোর যোগ্যতা ত আমার নেই। একদিন আমার অফিস কলিগ আছিয়া আপাকে বললাম,
‘আপা, মাসুক ভাইকে দিয়ে আমার একটা বইয়ের অলংকরণ ও প্রচ্ছদ করাতে পারবেন?’
আছিয়া আপা মাসুক ভাইকে বলতে বললেন। আমি তাকে আমার অক্ষমতার কথা জানালাম।
একদিন আপা আমার হাতে লেখা এ পাণ্ডুলিপি মাসুক ভাইয়ের হাতে দিলেন। মাসুক ভাই সানন্দে সে কাজ করে দিয়েছিলেন। একটি টাকাও নেন নি। আমিও দেয়ার সাহস করিনি। তার ব্যক্তিত্বের সামনে আমি যেন দাঁড়াতেই পারছিলাম না।
‘দৈনিক প্রথম আলো’ থেকে মাঝে-মাঝে আমাকে ফোন দিতেন মাসুক ভাই। আমার ছড়ার অলংকরণ ও ছাপা নিয়ে কথা বলতেন। আমি খুব কম ফোন দিতাম। এখনও কম দিই। কারণ তার কাছে ফোন করার সাহস পাই না।
তাই বলে যে মাসুক ভাই খুব রাশভারী টাইপের লোক তাও না। অতি সরল প্রকৃতির মানুষ তিনি।
এবারের(২০১২) বইমেলায় ‘সূচিপত্র’ থেকে প্রকাশিত আমার গল্পের বই ‘ধ্রুব এষ যে ভূতের ছবি এঁকেছিলেন’ এ বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ নিয়ে আমি মহা ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ গল্পের চরিত্রগুলো বিভিন্ন জীবিত ও মৃত বিখ্যাতজনদের । এসকল বিখ্যাতজনদের স্কেচ আঁকার জন্য মাসুক ভাইয়ের চেয়ে উপযুক্ত কাউকে আমি ধারে কাছে দেখছিলাম না।
একদিন আছিয়া আপাকে আমার সমস্যার কথা বললাম। তিনি বললেন,মাসুক প্রথম আলোর কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত, এ মুহূর্তে মনে হয় তিনি সময় দিতে পারবেন না। তিনি আরো বললেন, ‘একদিন বাসায় আসেন,মাসুককে বলে দেখেন’
মাসুক ভাইয়ের অফিস রোববার ডে অফ। সেদিন তার বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আছিয়া আপার সাথে বাসায় গেলাম।
আপা আমাকে কী খাওয়াবেন তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একটার পর একটা খাবার আসতেই থাকল। আর পরিবারের মধ্যমণি চর্যা কখনও বাবার সাথে কখনও মায়ের সাথে দুষ্টুমি করছিল তখন। আমি কাছে টেনে একটু আদর দিলাম তাকে। মাসুক ভাইকে তখনও আমার কথাটি বলার সাহস পাচ্ছিলাম না।
আপাকে বললাম একটু আমাদের আড্ডায় অংশ নিতে। এরপর আপা এলে আমি আমার কথাটি বলার সাহস পেলাম।
মাসুক ভাই তখন শুধু প্রথম আলোর কাজ নয়, তাদের প্রকাশনা ‘প্রথমা’র কাজ নিয়েও মহাব্যস্ত। আমি প্রস্তাব করতেই তিনি বললেন, সম্ভব না।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।
আপা বললেন, প্রচ্ছদটা অন্ততঃ করে দাও।
মাসুক ভাই এতে রাজি হলেন। আমি আরো কিছুক্ষণ গল্প করে বাসায় ফিরে এলাম।
এরপর বহুদিন চলে যায়। আমি আর আমার পাণ্ডুলিপির খবর নিই না।
আছিয়া আপাকে মাঝে মাঝে বলি, মাসুক ভাইকে বলার সাহস পাই না।
একদিন মাসুক ভাই আমাকে অবাক করে ফোন দিলেন,
‘জুলফিকার, আপনার প্রচ্ছদ ও ইলাষ্ট্রেশন হয়ে গেছে ,এসে নিয়ে যান’
আমার এ আনন্দ তখন বোঝাবার মত নয়। এত ভালো লাগছিল যে!
আছিয়া আপা আমাদের অফিসের সকলের মন জয় করেছিলেন এই কিছুদিনের মধ্যে। বন্ধুবৎসল,সৎও পরোপকারী হিসেবে তার পরিচিতি গড়ে উঠেছিল এখানে। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে তিনি যখন হাসপাতালে, সাহস করে একদিন(মে,২২,২০১২) তাকে ফোন দিই।
অফিসের আমরা ক’বন্ধু তার পাশে আর্থিক সহায়তা নিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আমাদের বিভাগ প্রধান জনাব এ,এস,এম মহীউদ্দিনের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাবের কথা ফোনে আছিয়া আপাকে জানালে তিনি তা বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেন। তার এ কণ্ঠস্বর আমি আমার মোবাইলে রেকর্ড করে রাখি। যা আজ কেবলই স্মৃতি।
আছিয়া আপা আজ আর নেই।
তার সেই ছোট্ট সোনামণিটি এখন একা। হাসপাতালের বিছানায় সারাক্ষণ যে মেয়ের ছবি দেখতেন আপা সে ছবি এখন আর প্রাণ ভরে এমনভাবে কে দেখবে ?আপা ছেড়ে গেছেন মাসুক ভাইকে। মা’ও ছেড়ে গেছেন মাসুক ভাইকে। তিনি এখন একা। বড় একা।
এভাবে ক্রমাগত আপনজনহারা মাসুক ভাই এ শোক কিভাবে সইবেন জানি না। মাসুক ভাই, আপনাকে শান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। বিধাতার কাছে প্রার্থনা, তিনি আপনাকে এ শোক বইবার শক্তি দিন।
জুলফিকার শাহাদাৎ: শিশুসাহিত্যিক,প্রাবন্ধিক।
June 20 at 12:46am ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।